জাহিদুর রহিমের সঙ্গে সম্পর্ক ভার্চুয়ালি—শুধু কবিতার সূত্রে। ফলে তার কবিতা পড়ার সুযোগ হয়েছে দ্রুত। আর এ বছরই হঠাৎ বলা নেই, কওয়া নেই প্রকাশিত হলো তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘সুন্দর দাঁড়িয়ে আছে নিঃসঙ্গ’। রাতে পড়া শুরু করলাম। পড়তে-পড়তে মনে হলো লেখার কথা। ভালো লাগার কথা। তার কবিতার শব্দগুলো গরম ভাতের মতো নরম। অথবা জোসনার মতো ঘন। তিনি কবিতায় রক্তিম লাবণ্য খুঁজে ফেরেন। সুগন্ধি বাতাসে আয়ুর বিলাসিতা মেশান। শোনান রাবণের লঙ্কা হারানোর বিষাদ। যৌন আবেশে ভাসিয়ে দেন ঊষর স্রোত। সলাজ আঁচল সরিয়ে দেখান ঘূর্ণিত জলকণা। রচনা করেন অসংখ্য ছন্মবেশে ভবঘুরে মানবেতিহাস। সরোদের মৃদু তেজে রাতের হৃদয়ে আত্মার বিচ্ছিন্নতা। এ কারণে তার কবিতার প্রতি ভালো লাগা ছড়িয়ে গেল অজান্তে।
বইমেলায় যে নামটি আমি বহুবার বার উচ্চারণ করেছি, সেটা বোধ হয় ‘সুন্দর দাঁড়িয়ে আছে নিঃসঙ্গ।’ কথাটা যে কাউকে উদ্দেশ বলা যেতে পারে। সুন্দরী হলে তো কথায় নেই। সম্ভবত সে কারণে বেশি প্রাসঙ্গিক ছিল। জাহিদুর রহিমের কবিতা পড়তে-পড়তে কোথায় যেন যেতে হয়। না গিয়ে থাকা যায় না। কবিতার স্রোতে গা না ভাসিয়ে উপায় থাকে না। তিনি একটা জলের স্তর তৈরি করেন। তারপর একটা সোনারি নৌকা ছেড়ে দেন তার ওপর। উজ্জ্বল প্রলেপের ওপর সেই নৌকায় পাঠক ভাসতে থাকেন। তিরতির করে সেটা যখন চলতে শুরু করে, তখন উদোম বাতাসে পাল তুলে দিতে হয়। আর মুখ থেকে বের হয় আহ! এমন মধুর ব্যথা কে না পেতে চায়!
তার একটি কবিতার শিরোনাম ‘আশ্চর্য রেশমের সিংহদুয়ার’। তিনি সেখানে বয়ান করেন এভাবে—
‘ধরো একদিন মোহিনী রূপের জলে ডুবে গেল ঈর্ষার নীল বিষ রাঙা আংটি, শিল্পীর বর্ণস্নাত ঢেউয়ের দোলায়। উঁচু মার্বেল সিঁড়ি দিয়ে অস্পষ্ট সম্রাটের ছায়া। তোমার হাতে সিক্ত মেঘের বাকলের ঘ্রাণ, হাওয়ার পালকে অনন্ত ভালোবাসার নাট্যমঞ্চ স্বর্গ বিজয়ের চাবিকাঠি-আলতো ছুঁয়ে দিলে তুমি আশ্চর্য রেশমের সিংহদুয়ার শান্ত হ্রদের মতো জলে।’
কবিতাটি পাঠ করতে করতে কোথায় যেন ঘুরে এলাম। রূপের জল থেকে শুরু করে ঈর্ষার নীল বিষ। তারপর রাঙা আংটি তা আবার স্বর্গ বিজয়ের চাবিকাঠি পর্যন্ত। এভাবে পাঠক পৌঁছে যান আশ্চর্য রেশমের সিংহদুয়ারে।
তলিয়ে যেতে যেত কবিতায় তিনি ভালোবাসা সম্বন্ধে বলেন—‘ভালোবাসা কি অদ্ভুত তাই না? মানুষকে তীব্রভাবে আক্রান্ত করা এক অসুখ।’ আর কোনো উত্তর কি কবির কাছে পাঠকের থাকে? থাকতে পারে? কারণ ভালোবাসা সীমাহীন, অসীম। তাই প্রশ্ন কিংবা উত্তরের সীমা পরিসীমাও থাকা অবাঞ্ছনীয়। ভালোবাসা সত্যি তীব্রভাবে আক্রান্ত করা এক অসুখই হতে পারে কেবল। তারপর এই কবিতার শেষে এসে তিনি বলেন—‘ইচ্ছে হয় তোমাকে এক দ্বীপে রেখে আসি—যেন আর কেউ তোমাকে না দেখে, আর কাউকে তুমি না দেখো। শুধু তোমার কবিতার পরে আমি থাকবো। তোমার স্বপ্নে আমি, কল্পনায় আমি।’ নিজেকে হিংসুটে দাবি করে কবি স্বীকার করেন ভালোবাসা আর প্রেমিকা শিকারের ইতিহাস।
‘আমার সময়’ শিরোনামে কবিতার তিনি হাজির করেন অসংখ্য ইমেজ। সময়টা ছিলো বাতাবিলেবুর গন্ধ মাখা; রোদের গন্ধ না থাকলেও কবি তা তৈরি করেন। সৃষ্টি করেন শব্দের রঙ আর মেঘের উচ্ছ্বাস। কবির সময়ে নাকি নারীরা ছিলো সৌন্দার্যের অহঙ্কারে পলাতক। চাওয়া ছিলো হরিণ শাবকের মতো অবাধ্য। জলকন্যার মতো রহস্যময়। তখন ভালোবাসা ছিলো কবিতার মতো নিষিদ্ধ। রংধনুগুলো ছিল আকাশের সম্পদ। উৎসব হতো নিজেদের ঘিরে। বেদনা ছিলো অনিবার্য। বিষণ্নতা ছিল বিলাসিতা। সে সময়ে হারতে চাইত সবাই, কারণ হারানোর কোনো ভয় ছিল না। কিন্তু কবির সময়ও পাল্টে গেল। সংগ্রাম, অবিশ্বাসে ভরে গেল সময়। তবু নিজেকে আকড়ে ধরার সন্দেহ ছিলো না। ধীরে-ধীরে সবাই নাকি বড় মানুষ হয়ে গেল। এমন যে খুব ভয়ের কোনো স্বপ্ন দেখে ঘুম ভাঙে। এই যে নিজের সময়কে নানা রঙে আঁকানো। তা সত্যি অসাধারণ ভঙ্গিমায় আমাদের আকর্ষণ করতে বাধ্য করে জাহিদের কবিতা।
জাহিদের কবিতায় দেখা যায় নতুন-নতুন শব্দের ক্যানভাস। নতুন ইমেজ তৈরিতে জাহিদ দক্ষ। শব্দের সমরে তিনি বাক্যকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করেছেন। এটাই যেন একজন তরুণ কবির যথার্থ আয়োজন। যেমন তার কবিতায় পাই হাওয়ার হত্যায় মোড়ানো দুপুর, ঢেউয়ের সুখের মতো, অস্ফুট চেনা নবনী নারীর মতো সহজাত মায়া। ভেসে আসে ধুপ চন্দনও। পূর্ণিমার আকাশের মতো আনন্দ। অখণ্ড স্থির বিন্দুর মধ্যে সংহত। সঙ্গে-সঙ্গে দেখা হয় তার প্রিয় ভুলগুলো কবিতার সঙ্গে। কিন্তু সেখানে তিনি তার ভুলের ফুলে পাঠকীয় মৌমাছি বেশিক্ষণ ধরে রাখতে সক্ষম হননি। তবে ‘ভালো থেকো’ কবিতার শেষের চারটি চরণ মুগ্ধ করবে পাঠককে।
আমার সাজানো বিষাদ, আমার নিঝুম রাতি
আর নীল থোকা থোকা ফুল,
ফুল তুমি ভালো থেকো, ভালো থেকো
এ জীবনের যতটুকু ভুল।
এখানেই যেন প্রিয় ভুলগুলোর একটা সংগীত বেজে ওঠে কোথাও। ঠিক তখনই পাঠক ফিরে-ফিরে তাকায় তার ভুলের পানে ফুলের পানে।
জাহিদুর রহিমের কবিতার আরেকটি বড় বৈশিষ্ট্য হলো, তার কবিতা পড়তে-পড়তে সুন্দরের সাগরে সাঁতার কাটা যায়। ভুলে থাকা যায় যাবতীয় বেদনার রঙ। কোনো প্রতিবাদ করা যায় না তার কবিতা পড়তে পড়তে। আরামে আহারে-কোমলে-কুসুমে যেন ঘুমিয়ে পড়া যায়। কোথাও তার কবিতায় দুঃস্বপ্ন দেখা যেতে পারে স্বপ্নের ঘোরে কিন্তু বাস্তবতা থেকে খানিক দূরে। আমার মনে হয়, সেখানেই তিনি সার্থক। তার কবিতা পড়তে পড়তে আলাদা একটা জগতে পা রাখা যায়। ভুলে থাকা যায় অসীম আয়নার কান্না। ক্রমে মুছে যায় কোনো বয়সী ক্ষত। ভালো লাগে তখন।
যেখানে লাল সিগন্যালগুলো নিভু নিভু নিয়নে
রক্ত চক্ষু দৈত্যের মতো একরোখা
অথবা অ্যাভেনুর প্রশস্ত ফুটপাতে
প্রেমিকার হাত ধরা এলানো বাতাস
সম্ভব সেখানেও।
(এই সব সম্ভব)
এরপর আমরা পড়তে শুরু করি কবির নিজের গ্রাম নিয়ে লেখা বিখ্যাত ‘নলকডাঙ্গা’ কবিতাটি। যেখানে শেষ রাতে ঝরে পড়ে শেফালী-হিজল। গাঙে ভেসে যায় হিম স্রোতে মায়াবি কাজল। দেখা যায় ছেঁড়া কাঁথা দিয়ে মোড়ানো রহিম শেখের বাড়ি। বুড়ো বট গাছ থেকে যে গ্রামে এখনো প্রেতের গান ভেসে আসে। কুয়াশায় মিলিয়ে যাওয়া মানুষেরা সে গ্রামে আলপথ ধরে জীবনের পথে এগুই। আর পথে পথে খুঁজে ফেরে মৃত মানুষের ঘ্রাণ। যেখানে ইতিহাস বিষপাতা। শতাব্দী ধরে কবরের মতো আঁধার। এখন আর সেখানে পড়শীর জমিগুলো নেই। কবির তাই অনেক খেদ। সেখানে এখন বসে থাকে দুটো কাকতাড়ুয়া। এই রকম বর্ণনাভঙ্গি একটা হালকা চালে সর্তক থাকেন কবিতার মধ্যেই।
খুব ভালো লাগে তার ‘বেদনায় একা থাকতে নেই’ কবিতাটি। ‘সেই তো আমার’ কবিতায় তিনি বলেন— সারাদিন চড়ে বেড়ানো কিছু বুনো সাদা লাগামহীন ঘোড়ার মতোন তার কবিতা। রূপালী সৈকতে অনাদরে পড়ে থাকা কিছু নিষ্প্রাণ ঝিনুক তার কবিতা। বহুদূরের কোনো রূপকথার দেশ থেকে উড়ে আসা এক ঝাঁক পাখিতে তার কবিতা। এমন সুন্দর সুন্দর বিষয়ে যার কবিতা লুকানো থাকে, তাকে তো সুন্দরের কবিই বলতে হয়। বুঁদ হয়ে যাই তার ‘আমার কেবল দেরি হয়ে যায়’ কবিতাটি পড়তে-পড়তে। একবার কবিতাটিতে চোখ বোলানো যাক।
আমার পৌঁছুতে শুধু দেরি হয়ে যায়
দরজা খুললেই আলোকের বারান্দা,
ইশারায় ডাকে রূপালী হাহাকার,
সারি সারি ঘর উজালা উঠান,
বেদীতে বাঁধানো হর্ষ চারুলতা।
সবকিছু জুড়ে কোথায় যেন এক মানবিক ঘ্রাণ।
উৎপল নেশায় রাঙা কামনা,
রূপের কাছে মিনতি শুধু,
অগ্নি শুভ্রতায় দুপায়ে জড়ানো শৃঙ্খল,
লক্ষ বছরের চুম্বনের হতাশায়
দাঁড়ানো ভালোবাসা,
পায়রা ওড়ানো হারানো বিকেল,
কিশোরীর নাভিমূলে দূরত্বে ঝড়।
আমার পৌছুতে শুধু দেরি হয়ে যায়।
কিন্তু কেন জানি এই কবিতার প্রতিটি লাইনে তিনি বিনা কারণে যতি চিহ্ন ব্যবহার করেছেন। প্রতিটি লাইনের শেষে গণহারে কমা বসানো আমার ভালো লাগেনি। তাছাড়া প্রয়োজনও নেই বলে মনে হয়। তবু কবির ইচ্ছার ওপর আমাদের কোনো হাত নেই। আবার ‘একঘর আমন্ত্রণ’ কবিতায় বর্তমান সময়ের কথাবর্তা বলেন ছোট আকারে। ‘বহুদিন পর ফিরে এলো, কবিতার পুরনো সন্ত্রাস।’ লাইন দুটো যেন হৃদয়ে দাগ বসিয়ে যায়। যা কখনো ভুলে থাকার বা ভুলে যাওয়ার নয়। এছাড়া জাহিদের কবিতার আরেকটা বড় লক্ষণ হলো স্মৃতি কাতরতা। বেশিরভাগ কবিতার ইতিহাস তার জীবনের পুরনো কোনো স্মৃতিরোমান্থনকেই হাজির করে। আর যেকোনো স্মৃতি আমাদের নস্টালজিতে ভিজিয়ে রাখে। যেমন ‘যখন সময় হবে’ কবিতটি পুরোপুরো স্মৃতি হাতড়ানো।
জাহিদের কবিতা ভালো লাগার আরেকটি দরজা খুলে গেল। তার কবিতায় পাওয়া যায় ঐতিহ্য, পুরনো আসবাবের গন্ধ। জোনাকি আর শুয়োপোকার মশাল। পাওয়া যায় মশা আর শুয়োরের যন্ত্রণা। এরপর আমরা নাম কবিতায় ফিরে আসি। ‘সুন্দর দাঁড়িয়ে আছে নিঃসঙ্গে’ প্রবেশ করি। আসলে যেকোনো নিঃসঙ্গতায় কি সুন্দর? নাকি সুন্দর সর্বদা নিঃসঙ্গতার ভেতরে জমে থাকে? সে প্রশ্ন রাখতে গিয়ে দেখি তিনি গেয়ে ওঠেন সুন্দর কিভাবে নিঃসঙ্গ হয়ে থাকে। তার কবিতায় দেখা মেলে ময়ূরের পেখম, নির্জন ভাঙা পালক, অলস তারাদের আবদার, কলসের গোপন রসায়ন এ রকম আরো নতুন নতুন ভাষা ভঙ্গিমা। জীবনানন্দ যেভাবে বিষণ্নতার ধূসরে ডুবে যেতে ভালোবাসেন, আবুল হাসান যেভাবে নিঃসঙ্গতায় ডানা মেলে দেন, ঠিক সেভাবে জাহিদুর রহিমও নির্জন মৌনতার হাহাকারে চিৎকার করতে থাকেন আপন আলোর ভেতর। নিজস্ব আলো-আঁধারে জ্বলতে দেখি তার কবিতার রেখা।
‘অতীত আর ভবিষ্যৎ’ কবিতায় বলেন— বর্তমানটা ঘিরে পিঁপড়ের সারি। কিন্তু ভবিষ্যৎ সম্পর্কে তিনি আর কোনো বয়ান রাখেন না। শেষে গিয়ে বর্ণনা করে নিরেট গদ্য ভঙ্গিতে যখন কবিতা লেখা হয় না কিছুতেই।