বর্তমান সময়ে বাংলা ছোটগল্পে অনেক তরুণ গল্পকারই চমকপ্রদ বিষয় আর বলার কৌশলে নতুনত্ব নিয়ে আসার চেষ্টা করছেন। সালাহ উদ্দিন মাহমুদ তাদেরই একজন। এই লেখক বর্তমান সময়ে ছোটগল্পে ভিন্নতার মেজাজ নিয়ে পাঠকের সামনে উপস্থিত হয়েছেন। তার ‘সার্কাসসুন্দরী’পড়লে অনায়াসেই তা বোঝা যায়। ভাব, রস আর সময়কে উপস্থাপনে সালাহ উদ্দিন তার গল্পে বেশ কৌশলী। তবে, পুরোপুরি এ কথা বলা যায় না যে, তিনি সব গল্পেই এই ভিন্নতাকে বা চিন্তার ধারাকে নতুনভাবে প্রবাহিত করতে পেরেছেন। তবে তার চেষ্টা আছে।
সালাহ উদ্দিন তার কিছু গল্পে বর্ণনার বাহুল্য বা দর্শনাক্রান্ত খুব বেশি শব্দ প্রয়োগ করেননি, তা আশার কথা। তার গল্পে জীবনের বিশেষ সময়ের একটি বিশেষ আবেগের রূপায়নের ভেতর দিয়ে সারা জীবনের আনন্দ বা বেদনার একটি মৃদু আভাস তিনি দেওয়ার চেষ্টা করেছেন।যা হয়তো অনেক গল্পে দেখা দিয়েছে বেশ সুনিপুণ দক্ষতায়, কিছু গল্পে তা হয়ে উঠেও কিছুটা মুখ থুবড়ে পড়েছে।
‘ক্ষত’গল্পটির প্লট বর্তমান সময়ের প্রেম নিয়ে একটি বাস্তবতার চিত্রপট আঁকতে সক্ষম হয়েছে। মানুষের জীবনের প্রেম ও শরীরের চাহিদাকে তিনি তুলে এনেছেন ভিন্ন চোখে। গল্পের শুরুর কথাটি, ‘তোমার মন চাইলে যে কারও সঙ্গে সেক্স করতে পারো। আমি তাতে রাগ করব না’-বিয়ের প্রথম রাতেই স্বামীর মুখে এমন কথা শুনে নববধূ সোহানা ভড়কে যায়। এটি যেকোনো ধরনের পাঠকের জন্যও এটি একটি বিশাল ধাক্কা। যে আরশিতে পাঠককে দাঁড় করিয়ে দেন লেখক, তাতে সোহানা অথবা সোহানের জীবন ও আমাদের চারপাশের অদেখা জীবনের চিহ্নের অনুলিপি পাঠককে ভাবনায় ফেলে দেবে। আয়নায় তার ‘ক্ষত’গুলোর দিকে চোখ বুলিয়ে নিতে সচেষ্ট করবে নিঃসন্দেহে। অনেকটা ঘরের ভেতর থেকে ছোট জানালা দিয়ে বিশাল আকাশ দেখার মতো ব্যাপার!
সালাহ উদ্দিন মাহমুদের ‘সার্কাসসুন্দরী’গল্পটি রচনা করেছে জীবনের আরেক অধ্যায়কে। যে জীবন হাতছানি দিয়ে ডাকে, কাছে গেলে হারিয়ে যায়,কুহুকের মতো, যে জীবনের দৃশ্যপটকে লেখকবন্দি করতে চেয়েছিলেন তার শব্দের জালে, তা দেখে, মানিকের ‘পুতুল নাচের ইতিকথা’র কথা মনে পড়লো। অদৃশ্য কেউ একজন পর্দার আড়াল থেকে খেলে চলেছে নিষ্ঠুর খেলা। তাতে তৃষ্ণার্ত জীবন মরীচীকার পেছনে ঘুরে মরে যাচ্ছে। শেষ হয়েও হয় না কো শেষ-গল্পটি অতৃপ্তির একটি সুক্ষ্ণ ব্যথা মনকে এক পশলা বৃষ্টির মতো কাকভেজা করে দেয়। যা হয়তো কোনো অবদমিত স্বপ্নের খাতা খুলে দেয়, স্মৃতির আঁচলে ঢেকে দেয় জাগতিক চিন্তা।
শ্রীশচন্দ্র দাশ তাঁর ‘সাহিত্য সন্দর্শন’ নামক বইয়ে লিখেছেন,‘ছোট গল্প মানব জীবনের গভীরতর রহস্য ভেদ করিতে চায় না, জীবনের অবিরাম স্রোতে ক্ষণপ্রাণ ও ক্ষণ বিলীয়মান যে তরঙ্গ উঠিতেছে, পড়িতেছে, ভাঙ্গিতেছে, তাহাকেই লেখক স্থিরদৃষ্টিতে নিরীক্ষণ করেন। ইহাতে নাটক-উপন্যাসের বা মহাকাব্যের বিস্তৃতি নাই- জীবনের খণ্ডরূপ এইখানে একটি বিশেষ রূপে ধরা দেয়। এই রূপ সৃষ্টিকে সার্থক করিবার জন্য লেখক গল্পের উপাদান ও ভাববিন্যাস একটি মাত্র রস পরিণামমুখী করিয়া তুলিতে চেষ্টা করেন। শ্রেষ্ঠ ছোটগল্পের ইহাই আদর্শ।’
শ্রীশচন্দ্র দাশের উপর্যুক্ত বক্তব্যের আলোকে সালাহ উদ্দিনের গল্প বিবেচনা করতে গেলে দেখি, এর কাঠামো অথবা বর্ননায় তিনি যা বলতে চেয়েছেন, অনেক সময় তা ঠিকভাবে প্রকাশিত হয়নি। অনেক গল্পে পুনরাবৃত্তি ঘটেছে। একই কথা বার বার বলে লেখক হয়তো তার পাঠককে কোনো বার্তা দিতে চেয়েছেন। এটি লেখকের নিজস্ব ভাবনা। তাতে অন্তত এভাবেই বলা যায়, একটি গল্প আরেকটি গল্পের তুলনায় ভালো কিংবা দুর্বল।
‘রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে ফোনালাপ’, ‘মাহিনের ইচ্ছেগুলো’, ‘যুবতী এবং চাঅলা’, ‘মাউছ্যা ভূত’, ‘মিথিলা এখনো কানামাছি খেলে’, ‘মাঝরাতে কবির সঙ্গে’- ইত্যাদি গল্পগুলোয় ভিন্নতার স্বাদ আছে। যদিও তা অনেকটা পুরনো জিনিস, নতুন মোড়কে উপস্থাপনের মতো। তবু এসব গল্পে সালাহ উদ্দিন মানুষের চিরন্তন ভাবনার সঙ্গে বর্তমানকে মিশিয়ে নতুন রূপে ও রঙে উপস্থাপনের চেষ্টা করেছেন। এটি অবশ্যই একজন লেখকের স্বকীয়তার পথে সহায়ক।
বাস্তবতার পরিপ্রেক্ষিতে সালাহ উদ্দিন কখনোই কেবল একমুখী নন, বহুমুখী। গল্পগুলো একাধিক রসমণ্ডিত। ফলে পাঠকের নতুন কিছু না কিছু প্রাপ্তির নিশ্চয়তা রয়েছে।
আমাদের চারপাশের সবকিছুই আমাদের অভিজ্ঞতার অংশ। নানাবিধ অভিজ্ঞতায় আমরা দেখি আমাদের জীবনকে। সাহিত্য এর বাইরে নয়। জীবন ও সাহিত্য লেখকের কাছে অভিন্ন। সালাহ উদ্দিন মাহমুদও এই অভিজ্ঞতার কথাই বলতে চেয়েছেন, তার ‘সার্কাসসুন্দরী’র গল্পগুলোয়। তবে এটাও ঠিক একই অভিজ্ঞতালব্ধ ধারণাও নানা জনের কাছে নানাভাবে প্রতিভাত হয়।