গত ৯ মার্চ ২০১৬ তারিখে চিন্তাসূত্রে নামে প্রকাশিত ‘সিদ্ধ ধানের ওম’ নিয়ে কবি খালেদ রাহীর বস্তুনিষ্ঠ আলোচনাটি পাঠকের নজরকাড়ে। পলিয়ারের কবিতা সম্পর্কে ভালো একটা মূল্যায়ন, সেটা স্বীকার করি। তবু আলোচকের প্রতি সম্মান রেখেই বলছি, তার সববিষয়ে একমত হতে পারিনি। পলিয়ারের কবিতার সঙ্গে আমার পরিচয় অনেক আগে। সে কারণে দুই-একটি কথা বলেই মূল আলোচনায় ফিরব।
কবি খালেদ রাহী বলছেন, ‘’তুর পাহাড় একটি ইসলামি মিথ। কবিতায় পুরাণের ব্যবহার সতর্কতার সঙ্গে করতে হয়। এতে কবি ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছেন। ‘তুমি আল্লাহওয়ালী আমি মাংসের লাঠিতে বীর্যময় মুছা’লাইনটি জোর করেই বানানো। শরীরী সম্পর্কের বিষয়ে এই উক্তি যথার্থ হয়নি। লিঙ্গ কখনো বীর্যময় মুছা হতে পারে না। তবে কবি যদি লেখার স্বাধীনতার প্রশ্ন তোলেন, তাতেও উক্তিটি নির্দিষ্ট স্থানে নির্দিষ্টভাবে উপস্থাপনে ব্যর্থ হয়েছেন।’’
আমরা জানি—রঙধনুর সাত রঙ। এটা নিয়ে কখনো কথা তুলেছি? কেন হলুদ রঙটা আরও গাঢ় হলো না? এ যেন প্রকৃতির সঙ্গেও মাস্তানি! ইসলামি মিথ ব্যবহারে পলিয়ার ব্যর্থ! কিভাবে? বরং তিনি যে সাহসিকতার নজির সৃষ্টি করেছে, সেটাই আলোচ্য হতে পারে। অনেকে ভাববেন, কবিতার সমালোচনায় আমার বিস্তর আগ্রহ নেই। বিষয়টা তা নয়। নজরুল অনেক আগেই তো বলেছেন—‘আমি বিদ্রোহী ভৃগু, ভগবান-বুক এঁকে দিই পদ-চিহ্ন!’ পলিয়ার যখন বলে—‘তুমি আল্লাহওয়ালী আমি মাংসের লাঠিতে বীর্যময় মুছা’, তখন প্রত্যেক পাঠকের গায়ের লোম দাঁড়িয়ে যায়! ‘লাইনটি জোর করেই বানানো’—এই বক্তব্যের বিরোধিতা করছি। এটা কোনোভাবেই বানানো হতে পারে না। যে কেউ একটু ভাবলেই আশা করি বুঝবেন। এমন একটা লাইন বানিয়ে লেখা সম্ভব নয়। আপনার কাছে যা বানানো মনে হচ্ছে, অন্যের কাছে তা স্বতঃস্ফূর্ত হতে পারে। তাহলে আপনার ‘বানানো’ শব্দটা এখানে আপত্তিকর! আমার কাছে এটা কবির স্বতঃস্ফূর্ত দ্যোতনা! কবিতা ইচ্ছা করে বানানো বিষয় নয়! এটা কবির চিন্তার ফসল। কারণ সাহস ও শিল্প একইপথের দুই পথিক। সেটা ভুলে গেলে চলে না।
‘শরীরী সম্পর্কের বিষয়ে এই উক্তি যর্থাথ হয়নি। লিঙ্গ কখনো বীর্যময় মুছা হতে পারে না।’ এটাকে কেন শুধু শরীরী ভাবছেন? কারণ জীবন-যাপনে কবি তো এটাকে উপমা হিসেবে আঁকতে পারেন। মাংসের লাঠিকে আপনি আগ বাড়িয়ে লিঙ্গ হিসেবে ধরতে গেলেন কেন? মাংসের লাঠিতো একটা মানবদেহও হতে পারে, নাকি? এই বীর্যময়তা কি পুরুষের সৌর্য-বীর্যের কথা বোঝায় না? অন্যদিকে নারীকে ‘আল্লাহওয়ালী’ উপাধি দিয়ে নারীর মর্যাদাকে আরও বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। নিঃসন্দেহে এটা একটা দুঃসাহসিক অলঙ্কার! আর মুছা নবী স্বয়ং আল্লার সঙ্গে তর্ক করতেন। নবী তর্ক তুলতে পারলে, কবি কেন নয়? কবিতায় এই যে যুক্তিপূর্ণ তর্ক পলিয়ার তুলে দিতে পারলেন, সেটাই বা কম কিসে?
‘তবে কবি যদি লেখার স্বাধীনতার প্রশ্ন তোলেন, তাতেও উক্তিটি নির্দিষ্ট স্থানে নির্দিষ্টভাবে উপস্থাপনে ব্যর্থ হয়েছেন কবি’—শেষে আপনি লেখার স্বাধীনতা বলে ব্যাপারটাকে শিথিল করেছেন। আবার ‘নির্দিষ্টস্থানে নির্দিষ্টভাবে’ বলে কী বুঝাতে চেয়েছেন? সেটা কিন্তু বলেননি? উপস্থাপনে কোথায় ব্যর্থ, পলিয়ার সেটা ধামাচাপা থেকেই গেল!
রাহী আরও লিখেছেন—‘‘অযোদ্ধা’ কবিতাটি শুরু হয়েছে এভাবে— ‘তুমুল মেতেছে ওঠে পরিখা খনন দিন’। শেষ হয়েছে ‘ধর্ম ছাড়তে ছাড়তে আমরা দেখব অরক্ষিত তেতুলের বাগান’। কবিতাটির নায়িকা তাসনুভা অরিণের ভেতর দিয়ে নারী জাতিকে ছোট করেছেন তিনি। অবহেলা, তুচ্ছের বিষয় হিসেবে তুলে ধরেছেন নারীকে। কবি কৌশলে শফি হুজুরের তেতুল তত্ত্বে ফিরে গেছেন। ‘ধর্ম’ বিশ্বাসেরই আরেক নাম। কবিতায় ধর্মের ব্যবহার না করাই বাঞ্ছনীয়। কবি এ কবিতায় কখনো আস্তিক, কখনো নাস্তিক, কখনো সংশয়বাদী, কখনো স্বেচ্চাচারী।’’ রাহীর বক্তব্যের সঙ্গে আমি মোটেও একমত নই। ‘অযোদ্ধা’ কবিতাটি পড়লে যে কেউ বলে উঠবেন, কবিতাটি দর্শনের গুলবাগে পরিণত হয়েছে। আর নারীকে ছোট করার প্রশ্ন তো ওঠেই না, বরং প্রেম-মায়া-ভালোবাসা ছাড়া একজন কবি কিভাবে কবিতা লিখতে পারেন, তা বোধগম্য হয় না। আরাধনা না থাকলে কিভাবে লেখেন কবিতা? ‘ধর্ম ছাড়তে ছাড়তে আমরা দেখব অরক্ষিত তেতুলের বাগান’ লাইনটির মাধ্যমে শফি হুজুরের তেতুল তত্ত্বে ফেরেননি কবি, নারীকে তেতুল শফি হুজুর নয়, এটা আরও আগে ব্যবহৃত হয়েছে বিভিন্ন কিতাবে উদাহরণ স্বরূপ। এখানে কবি ধর্ম বলতে বৃহৎ অর্থে কালচার বা সংস্কৃতির কথা বলেছেন। কারণ ধর্মও আমাদের কালচারের অংশ। ‘কবিতায় ধর্মের ব্যবহার না করাই বাঞ্ছনীয়।’ কেন ধর্মের ব্যবহার না করা বাঞ্ছনীয়? কবিতায় সবকিছুর ব্যবহার হতে পারে। কবিতা যদি সেটা দাবি করে, তাহলে ব্যবহারে সমস্যা কী? ধর্ম কি আমাদের যাপিত জীবনের বাইরে? ‘কবি এ কবিতায় কখনো আস্তিক, কখনো নাস্তিক, কখনো সংশয়বাদী, কখনো স্বেচ্চাচারী।’ এটা খুব স্বাভাবিক ঘটনা। কারণ বর্তমান সময়ে একজন মানুষ প্রতিক্ষণে বিশ্বাসভঙ্গের দোলাচলে দৌড়ে চলেছেন। কোনোখানেই মানুষ যখন প্রেম বা বিশ্বাস খুঁজে পাচ্ছেন না, তখন এটা থেকে সমাজের, রাষ্ট্রের এমনকি প্রত্যেকটা মানুষের অস্থিরতা ধরা পড়ে।
বিষয়টা ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখবেন রাহী। আপনার মত আপনি ব্যক্ত করেছেন। আমার দ্বিমত আমি প্রকাশ করলাম। এছাড়া আপনার আলোচনাটি সংক্ষিপ্ত এবং স্মার্ট। খামাখা বকবকানি নেই। প্রশংসার ভনভনানি নেই। আছে মেদহীন ঝরঝরে সমালোচনা। সেজন্য আপনাকে অনেক ধন্যবাদ। এবার ‘সিদ্ধ ধানের ওম’ নিয়ে মূল আলোচনায় ফিরছি।
কবিতা তো কবিতাই। তবে দীর্ঘ কবিতা সে যেন অন্যরকম ব্যঞ্জনার বহুরূপী রেলগাড়ি। কবিকে জানার সহজিয়া পথ। বাংলা সাহিত্যে দীর্ঘ কবিতার চর্চা ত্রিকালে ত্রিতাপে বহুলাংশে লক্ষণীয়। তরুণ সাহিত্য চর্চাকারীদের মধ্যে কমসংখ্যক কলমযোদ্ধাই দীর্ঘ কবিতার চর্চায় ব্রতী। সেই কম সংখ্যকের মধ্য থেকে উত্থান-পতনময় জীবনের অধিকারী পলিয়ার। ‘পৃথিবী পাপের পালকি’তে আমরা যে কবিতার কৃষককে দেখতে পায়, ‘সিদ্ধ ধানের ওমে’ এসে সেই কৃষক হয়ে ওঠেন কারিগর! শিল্পীর মতো নিপুণ তার বুনন। অভিজ্ঞ ডাক্তারের মতো সার্জারি। আর্কিটেক্টের মতো সৌন্দর্য নির্মাণ করেন পলিয়ার। রাহীর দেওয়া শিরোনাম ‘পরিণত বোধের বয়ান’ই তো এর বড় প্রমাণ।
পলিয়ার সর্বদা নিজস্ব কাব্যভাষার সন্ধানে ঘুর্ণনরত। সংসারে থেকেও সংসারবিবাগী। ‘সিদ্ধ ধানের ওম’ কাব্যগ্রন্থটি পাঁচটি প্রধান ভাগে বিভক্ত। প্রথম ভাগের শিরোনাম ‘কাছের মানুষে ল্যাপ্টানো সিঁদুরে মখমলে’। দুটো কবিতা। ‘মা ও অন্যান্য শীতলপাটি’ কবিতাটি আত্মজৈবনিক। স্মৃতিতে উজ্জ্বল। শুরুতে জননী বন্দনা—
ছাবিয়া বেগম—যার গায়ের রঙ
সিন্ধু নদ থেকে উঠে আসা
মাগুরমাছের মতো ফ্যাকাশে কিংবা কালো।
তাঁর ছিলো একান্ত মহৎ ও মোমবাতি জীবন।
হাজার বছর আগের গুহাময় অন্ধকারে
নিভৃতে জ্বলতেই দেখি—
অথচ মায়ের আলোয় প্রাগৈতিহাসিক
খাওয়া-দাওয়া—দ্রাবিড় সন্ধ্যার ইতিহাস
পাঠ—উপনিবেশিক ঘুমপড়া চলে…
(মা ও অন্যান্য শীতলপাটি)
এই লাইনগুলো কিছু বলার দাবি রাখে। ঐতিহাসিক সিন্ধুনদের মাগুর মাছের সঙ্গে তাঁর মায়ের রঙের তুলনামূলক কল্পনাপ্রসূত উপমার মতো অনেক ভিন্নধর্মী ও দুর্দান্ত উপমা তাঁর কবিতাকে রূপান্তরিত করে। যা পাঠককে ইতিহাসের পাতায় চোখ বোলাতে প্রাণিত করে। তারপর কবি আমাদের নিয়ে যান প্রাগৈতিহাসিক খাওয়া-দাওয়ায়। দ্রাবিড় সন্ধ্যায় পাঠ করান ইতিহাস। আর ঔপনিবেশিক ঘুমপাড়া থেকে জাগিয়ে দেন সহসা! এই যে মাকে উপস্থাপন করতে গিয়ে আমাদের ইতিহাস, ঐতিহ্য, মিথ, পুরানে কবি চোখ ফেলতে বাধ্য হন, তখন বিস্মিত না হয়ে উপায় কি! পাঠক আধুনিকতার সানসওকতে বসেও, সেই মধ্যযুগে বা আদিম যুগে ফিরে যেতে বাধ্য হন। এই যে পাওয়ার! এটা একটা সার্থক কবির কাজ। একটা জায়গা থেকে পাঠককে আরেক জায়গায় উপস্থিত করে ভাবনার বুদ্বুদ উসকে দেওয়াকে উপভোগ করি। বিশেষ করে কবিতায়।
পরের কবিতার শিরোনাম ‘নারকেল পাতার চশমা’। এটা আবার একটা ভিন্ন আঙ্গিকের কবিতা। আপাতদৃষ্টিতে গদ্যময় মনে হলেও অন্তর্নিহিত প্রতিটি লাইনের শেষের শব্দের সঙ্গে পরবর্তী লাইনের প্রথম শব্দের অন্ত্যমিল বিদ্যমান। এই ধারার কবিতার সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয় হলো! যা ব্যতিক্রম মনোমুগ্ধকর ঘটনা। তারুণ্যময় কাব্যনিরীক্ষা। চলুন আমরা কয়েকটা লাইন আবৃত্তি করে আসি—
পুরোনো গোছানো গান
ধান—আর জনপ্রিয় নেতা
যেথা অতীত ঐতিহ্যে খুশি
পুষি যুদ্ধে ফেরা সৈনিকের ট্রেনিং এর মতো
কত সাহসেরা দল বেঁধে
কেঁদে কেঁদে সান্ত্বনার জাবর কাটে
(নারকেল পাতার চশমা)
শিরোনাম উচ্চারণ করার সঙ্গে সঙ্গে পাঠক নড়েচড়ে বসবেন। আসলে শব্দের যে কি পাওয়ার তা পলিয়ার দেখিয়ে দেন পদে পদে। নারকেল পাতার চশমা শিশুকালে কে না চোখে পরেছে? কে বা সেই স্মৃতিকে উপেক্ষা করতে পারি? পলিয়ারের দীর্ঘ কবিতার সবচে বড় সফলতা হলো টানটান উত্তেজনায় কবিতার শরীর ধরে রাখা। কোথাও যেন উঁচুনিচু একটা ঢেউ থাকলেও পরক্ষণে তা আবার সমান্তরালে বইতে থাকে। এটা কবির উত্তম মুন্সিয়ানা বটে।
তারপর পলিয়ার লিখেছে, নিজের গ্রামের শিরোনামে ‘মনোহরনগর’ কবিতা! কবিতাটির চিত্রকল্প, উপমা, উৎপ্রেক্ষায় ভরপুর। কবিতাটি উচ্ছে ফুলের মাচানের মতো পাঠককে সাদা করে ফেলে। মোটাদাগে তা সবারই গ্রামের রূপ নিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে। কল্পনার গাঁয়ে। তখন পাঠক থমকে দাঁড়ায়। মনে হয় এ যেন আমারই নিজের গাঁও। এটা একজন তরুণ কবির শক্তিশালী দিক। যা মেধা ও মননের হাতিয়ারকে হাজির করে নির্দ্বিধায়।
বাড়ির গেটে কাগুজে ফুলে গেছে ছেয়ে
কবরের ওপর ঝুঁকে আছে ছবেদার ডাল
হারানো শোকগুলো সিঁদুরে মেঘের মতো লাল
কৃষকেরা ঘরে ফেরে গান গেয়ে গেয়ে।
(মনোহরনগর)
এই যে গাঢ় আবেগ, সবুজ অনুভূতি, হলুদ স্মৃতির গড়াগড়ি। এছাড়া, কবিতাটিতে আছে ব্যতিক্রম শব্দের আখড়া। কুমারীফুল, মাটির খই, শালুকের হাসি, গোবরে লোপ্টানো দোর, ধোঁয়া ওঠা সকাল, ভাটিপুঁজোর রাধা, নাভী গন্ধী মাছ, ভিটে হারা ব্যথাসহ অর্থময় শব্দ, বাক্য ও বাগধারার ব্যজ্ঞনাময় ব্যবহার।
‘টইটই করা অবাধ্য মোরগের ঝুঁটি’ পর্বে ‘পিতার শোকে’ শিরোনামের কবিতাটি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জীবনের বাঁক-উপবাঁক ও বাঙালির করুণ স্মৃতির করুণ রসে সিক্ত। কখনো দ্রোহ, কখনো স্যাটায়ার প্রস্ফুটিত হয়ে প্রবাহিত হয়েছে। কবিতাটিতে রয়েছে কিছু চিত্তকর্ষণ পঙ্ক্তি—
১। আঙুলের নরম মাথায় বাদাম ভাঙার আওয়াজ
২। বেড়ে যাচ্ছে গুমোট আবহাওয়া
৩। দমদম করে দৌড়াচ্ছে সময়—বুকের অলিগলি
৪। নিজেদের ভাগ্য নিয়ে সত্যিই শোকাহত ভবিষৎ!
৫। পিতা তুমি কী শুনতে পাও— এসব বিকল মাইকের গান?
তবে সুন্দর সুন্দর পঙ্ক্তির ভীড়েও কিছু ক্রোধমাখা পঙক্তির সন্ধান মেলে।
১। জাতি ভোঁতা হলে ক্ষতি কী এমন?
২। এক মুক্তি থেকে আরেক মুক্তির দূরত্বের নাম—বন্দি!
৩। এসব ফরমালিন কথা মানায় না চুলোর হাঁড়িতে
জীবন-যৌবন নিয়ে মানুষের জানার অন্ত নেই। সবাই সুন্দর মনোরম পরিবেশে বাঁচতে চায়। বেদনার দেয়ালে পিঠ ঠেকাতে ঠেকাতে ক্লান্ত হয়ে বলে—মরে গেলি বাঁচি। ‘সিদ্ধ ধানের ওম’-এর তৃতীয় পর্বে ‘জীবন এক অলিখিত সুরের সংগীত।’ সংগীতেই সুর বিদ্যমান। তাহলে অলিখিত সুর বা সংগীতটাই বা কী? অনেককেই ভাবনায় ডুবিয়ে দেওয়ার মতো শিরোনাম! তবে কবির ভাবনাও আরেকটু প্রখর হওয়া দরকার। এই পর্বে দুটি কবিতা। ‘সিন্দুক হারানো চাবি’ ও ‘পরাবাস্তব প্রেমের নকশা’। কবিতাদুটিতে মিথোলজি প্রয়োগের পাশাপাশি নাটকীয়তা পরিলক্ষিত হয়। সর্বধর্মের মানবীয় দিক এবং নজরুলীয় ভাবধারা তাঁর কবিতায় বিরাজমান। প্রকাশিত হয় বিরহভাবের অসাধারণ সব লাইন—
রাতজাগা পাখির ডানায় অতীত ঝাপটায়
মসজিদের কাঠের মিনারে দাঁড়ায়ে
তোমার কপালে চুমু খাওয়ার দৃশ্য
আমাকে করে তোলে—বেহেস্তি আদম!
(সিন্দুক হারানো চাবি)
পুরো কবিতাটি প্রেমে-বিরহে এক কাতর কবির সন্ধান পাওয়া যায়। প্রেমের কবিতায় পলিয়ার যে সিদ্ধহস্ত তা যেকোনো পাঠক বুঝে ফেলবেন ওপরের লাইনগুলো আওড়াতে আওড়াতে। এ রকম ১২২ লাইনের কবিতায় পাওয়া যাবে কবির আর্তি। যেন কোথাও নিশি পাখি ডেকে উঠল হঠাৎ।
ওয়াহিদ, বাঁচবো না তোমাকে ছাড়া
এই লাইনটা নীল রঙপেন্সিলে
দাগী আসামির মতো চিহ্নিত করা
রাতে ডাকা দর্পিত পতঙ্গের মতো নেমে আসে গলা
যেন হঠাৎ এক সাথে বন্ধ হলো ঝিঁঝিঁর ডাক!
(সিন্দুক হারানো চাবি)
অনেকে বলেন, রোমান্টিক কবিতার দিন শেষ! আসলে কি তাই? তাহলে জীবন জগৎ আর চলবে কীভাবে? যতদিন পৃথিবী আছে, থাকবে প্রেম, থাকবে বিরহের কবিতা। এই কবিতা পড়তে পড়তে পাঠক নিজেদের প্রেমের জিকির করতে ভুলবে না মোটেও। কারণ পলিয়ার এই নিজের প্রেমকে অন্যের করে তুলতে পেরেছে সার্থকভাবে। এছাড়া ‘পরাবাস্তব প্রেমের নকশা’ কবিতায় অন্যরকম একটা আবহ তৈরি হয়। একেবারে সাধাসিধে কথা দিয়ে কবিতার শরীর মোড়ানো। কিন্তু সেটা যে আবহাওয়া তৈরি করে তা ভিন্নরকমের আমেজ দেয়। কবিতার কোনো নিয়ম কানুনের ধার না ধেরে পলিয়ার একের পর এক নতুন নতুন কাঠামোয় ঢুকে পড়েন। অনুমতিহীন কিন্তু অবিব্রত। একেবারে মেদহীন টনটনে স্লিম কবিতা যাকে বলে, ‘পরাবাস্তব প্রেমের নকশা’য় সেটা ধরা পড়ে দারুনভাবে।
কবিতা লেখা ছেড়ে দিচ্ছি
এখন লালশাক পালন করি
ওদেরও মুক্তি দরকার
ঘাম নাকি সবার প্রিয়
রক্ত তো, তাই বোধায়।
কথাগুলো গুলি না হলেও গুলতির মতো শোঁ শোঁ করে। কানের কাছ দিয়ে তুমুল বেগে ভেসে যায়। কত সহজে তিনি শুনিয়ে দেন কত গুরুত্বপূর্ণ ওয়াজ। এখানেই পলিয়ার সবার চেয়ে আলাদা। তাঁর বলার ঢঙ, ছলনা না করে সরাসরি বলে দেওয়া, সঙ্গে সঙ্গে সেগুলোর শিল্পমান বজায় রাখা। সবদিকে তার সজাগ দৃষ্টি। কারণ তার পঙ্ক্তিগুলোর থ্রোয়িং কোনো কিছুতে আপস করে না!
চতুর্থ পর্বের শিরোনাম ‘বালিকা লাবণ্যে আঁকা বিনীত ক্ষত’। আলাদা আলাদা শিরোনামগুলোই যেন একেকটি কবিতা। এই পর্বের ‘অযোদ্ধা’ কবিতাটি অন্যরকম শিল্প স্বাদ হৃদয়ে জাগালো। একজন নারী কবিকে উৎসর্গ করে কবি যে কাব্যতীর নিক্ষেপ করলেন, এ তীরে বিষ নয় মধুরতা মাখানো। কী জানি উত্তরে সে কবি কী জবাব দেবেন! চলুন আমরা কয়েকটি পঙ্ক্তি পাঠ করি—
আমার আরও ভাঙ্গনের দরকার
বনানীর বন্যতা ছুঁয়ে
অরিণের সে কি হাসি
জানো তো—ভালোবাসা হলো ঈশ্বর এর মতো
যাকে ভেঙ্গে ফেলার আগেই
শরিকানা ভুলে যেতে হয়!
যাকে সম্পূর্ণ পাওয়ার পরেও
মনে হয় আংশিক হলো!
কবিতাটি আপাত দৃষ্টিতে প্রেমের মনে হলেও আসলে তা নয়। আছে দর্শনাশ্রিত কাব্যধান। মনোগত দ্বন্দ্বের নির্যাস। কোথাও কোথাও দেহের রূপালী নদীর বর্ণনার দেখা মেলে। যা আমরা সবাই আড়াল করে দেখি। বলার মতো সৎ সাহস দেখাই না। সেখানে পলিয়ার পুরোপুরি সততার সাপ হয়ে ফেনা তোলেন। অথচ তাঁর বিষের ভারে নত হয় না পাঠক!
‘রত্নাদি’ কবিতাটিও নারী বন্দনার রিপুময় আভাস মেলে। ‘চাবি মানে প্রবেশের মৌন অনুমতি’ পঙ্ক্তিটি সুন্দর-সাবলীল। কবিতার দ্বিতীয় স্তবক পাঠ করা যাক—
তোমার মুখ—পাকা তমালের রঙ, রুপালি চন্দ্রচূড় হাসি,
মেঘ থেকে খসে পড়া শিলার মতো শুভ্র একঘটি দাঁত
বটের পাকা ফলে রক্তজবা রঙের ঠোঁট
ঝিনুকের পাপড়ি মেলা চোখ
তোমার মাথার ওপর আমারই প্রতিনিধিত্ব করা হাজার লক্ষ
এলোকেশী সৌন্দর্যের ঝর্ণা যেন নিত্য করে
সহসা হারায়ে যায়—আমি আর থাকি না নিজের!
আসলে পলিয়ারের সব কাব্যবৈশিষ্ট্য ম্লান হয়ে যায়, তাঁর নারীর প্রতি দিলদিওয়ানা মনোভারের কাছে। প্রতিনিয়ত বদলে যাক এই কবির কাব্যের মোড়ক। মূলে যেন ঠিক থাকে তার স্বর আর সুর।
শেষের পর্বের কবিতাগুলো টানাগদ্যে লেখা। আঞ্চলিক ভাষার প্রবল্যে ভেসে ওঠা জাহাজ। কবির দাদী ও নানীর সাদা পাকা চুলের বয়ানে ফুটে ওঠে ভাষা আন্দোলন, দেশভাগ, মুক্তিযুদ্ধের মতো পরম্পরায় গাঁথা কবিতাগুলো যে কারো চোখ জল এনে দেয়। কিন্তু কবিতার চেয়ে সেগুলো গল্পের নামান্তরে ভরপুর। গল্পকবিতার একটা দারুণ মিশেল। মোটাদাগে পলিয়ার এই কাব্যগ্রন্থে কোন কিছুর তোয়াক্কা করেননি। এটা তারুণ্যের ধর্ম। নতুন কোনো কিছু করার ক্ষেত্রে পলিয়ার দৃঢ়। পাঠকই তাঁর প্রভু। এমনই বক্তব্য তাঁর। পলিয়ার কবিতাকে প্রকৃতির মতো মনে করে। সেখানে কোন রঙ, কোন বাণী, কোন লাইন কী রকম হবে, সেটা কবিই জানেন শুধু। এই যে স্পর্ধা একজন কবির জন্য জরুরী। তবে এই অহঙ্কার যেন অলঙ্কারে পূর্ণতা পায়, সে দায়িত্ব কবির! পাঠক তো কবির রুচি তৈরি করেন না। কবিই পাঠকের রুচি তৈরি করেন।
বইয়ের সর্বশেষ কবিতার শিরোনাম ‘উত্তর প্রদেশীয় বেলি’। কলকাতায় বসবাস করা কবির প্রেমিকা হিয়া বিশ্বাসকে উৎসর্গ করা কবিতাটি একনিঃশ্বাসে পড়া শেষ হয়। একেবারে যেন মন মন্দিরে পূজো দিতে দিতেই লেখা কবিতাটি।
এখন থেকে আমার বাগানবাড়িতে শুধু বেলিফুলের চাষ হবে
যার দেবীত পাঁপড়িতে লেগে থাকবে স্বর্গের সুবাতাস
উত্তর প্রদেশ থেকে এই বাংলায়
এই কবি আর কামনার দেশে সে যেন একবার ঘুরে যায়’
হিয়ার প্রতি কবির মরমি আকুতি পাঠককে স্পর্শ করে। কবি পলিয়ার নিজেকে নাকি নিজের দেশকে কামনার দেশ বলে খটকা লাগিয়ে দেন? অনেক কবি অনেক রকম উপাধি দিয়েছে নিজের মাতৃভূমিকে। সর্বশেষ পলিয়ার তাঁর দেশকে কেন ‘কামনার দেশ’ বলে উপস্থাপন করলেন, এ নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়? তবু এটা সত্যি যে, কবি নতুন একটা অভিধা যোগ করলেন। কবির সেই কামনার দেশে যেন হিয়া বিশ্বাস ঘুরে যান।