‘শ্যাডোস অব টাইম’—একটি চলচ্চিত্রের নাম। তবে নাম শুনে বোঝার উপায় নেই সিনেমাটি কোন ভাষার। চলচ্চিত্রটি ২০০৪ সালে নির্মিত। এটি জার্মান পরিচালক ফ্লোরিয়ান গ্যালেনবার্গারের প্রথম পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র। এর আগে অবশ্য ‘আই ওয়ান্ট টু বি’ শর্টফিল্মের জন্য অস্কার পুরস্কার পেয়েছেন তিনি। ‘আই ওয়ান্ট টু বি’ ছিল মেক্সিকান সমাজের একটি খণ্ডচিত্র। অন্যদিকে ২০০৪ সালের ‘শ্যাডোস অব টাইম’ একটি গভীর প্রেমের উপাখ্যান। চলচ্চিত্রটির নির্মাণের পেছনের গল্পও চমকপ্রদ। গ্যালেনবার্গার ২০০১ সালে ভারতে আসেন একটি চলচ্চিত্র নির্মাণের উদ্দেশ্য নিয়ে। তিনি দেড় বছর ভারতে অবস্থান করেন ভারতের মানুষের জীবনধারা সম্পর্কে জানার জন্য। সবশেষে তিনি তার সিনেমাটি নির্মাণের জন্য কলকাতাকে বেছে নিলেন। তিনি চাইলে অন্যদের মতো ইংরেজি ভাষায় সিনেমাটি নির্মাণ করতে পারতেন, কিন্তু সিদ্ধান্ত নিলেন বাংলা ও জার্মান ভাষায় সিনেমাটি করবেন।
শুরুটা হয় এভাবে, পশ্চিমবঙ্গের একটি পরিত্যক্ত কার্পেট ফ্যাক্টরির উদ্দেশ্যে জিপে চড়ে যাত্রা করেছে বয়স্ক রবি গুপ্ত। পৌঁছানোর পরে কার্পেট ফ্যাক্টরির নানা স্মৃতি তাকে গ্রাস করতে থাকে। ফ্যাক্টরির আনাচেকানাচে একদা তার আর মাশার বিচরণ ছিল। ফ্ল্যাশব্যাকের দক্ষ প্রয়োগে ধীরে ধীরে বয়োবৃদ্ধ রবির শৈশবকাল, যৌবনকালের নানা কথা একে একে সামনে আসতে থাকে। মাশা আর তার প্রেমের গাঁথুনি প্রগাঢ় হয়, এরপর সেই প্রেম নানা রঙ ধারণ করে। সেই কার্পেট ফ্যাক্টরিতে বসে একদিন আলোর আকাঙ্ক্ষা করেছিল রবি গুপ্ত। সময়ের পরিবর্তনে একদিন আলোর দেখা পায় সে, তবে হারিয়ে ফেলে মাশাকে। তবু তার মন থেকে মাশা মুছে যায় না।
ভাগ্যের পরিহাসে, ইয়ানি মিশ্রার সঙ্গে পরিচয় সূত্রে আবারও মাশার সম্মুখীন হয় রবি। এরপর যা হয়, তা তো কল্পনাতীত। মনের আকাঙ্ক্ষার কাছে তারা হার মানে। একসময় যৌবনের আকাঙ্ক্ষার কাছেও তাদের পরাজয় হয়। প্রেমের আকুতিতে তারা ভুলে বসে তারা দু’জন অন্যের স্বামী কিংবা স্ত্রী। কিন্তু এ সুখমুহূর্ত দীর্ঘায়িত হয়নি। মাশাকে আঁকড়ে ধরে রাখতে পারে না রবি। মাশা আবার ছুট দেয় কেরালায়। এভাবেই ধীরে ধীরে এক বিখ্যাত ট্র্যাজেডি সৃষ্টি করে শ্যাডোস অব টাইমের সমাপ্তি হয়।
একজন বিদেশি নির্মাতা এসে বাংলায় রবি-মাশা জুটির যে নিরবচ্ছিন্ন প্রেমের উপাখ্যান সৃষ্টি করে গেলেন, তা বুঝি বাংলার মানুষেরা বহুদিন মনে রাখবে, এটা নিশ্চিত। সিনেমাটির শিল্পগুণ নিয়ে বলতে গেলে, একদিকে একটি শক্তিশালী চিত্রনাট্যের উপস্থিতি রয়েছে, অন্যদিকে নিখুঁত শটের সম্ভার একে অন্য মাত্রা নিয়েছে।
চল্লিশের দশকের পরবর্তী সময়ের কলকাতার আর্থসমাজিক চিত্র তুলে ধরতে বেশ ভালোমতো রিসার্চ করেছেন গ্যালেনবার্গার, তা না হলে এমন উন্নত একটি চলচ্চিত্র নির্মাণ সম্ভব ছিল না। সে সময়ের আর্থসামাজিক অবস্থা বোঝাতে একটি দৃশ্যই যথেষ্ট। একটি দৃশ্যে মাশার বাবা মাশাকে কার্পেট ফ্যাক্টরির ম্যানেজারের কাছে বিক্রি করে দেয় মাত্র পঁচিশ টাকায়। এতে বোঝা যায়, ওই সময়ে বাংলার অর্থনৈতিক অবস্থা কেমন ছিল, সামান্য টাকার জন্য একজন বাবা তার সন্তানকে বিক্রি করতেও দ্বিধা করেননি।
মাশাকে নিয়ে পতিতাপল্লীর একজন পতিতার রাজনীতি, রবিকে নিয়ে কার্পেট ফ্যাক্টরির ম্যানেজারের রাজনীতি কিংবা বাস কাউন্টারম্যানের রাজনীতি—সবই স্বার্থের কাছে নত। মানবতার চেয়ে স্বার্থ তাদের কাছে বৃহৎ। দয়ামায়াহীন এক স্বার্থপর সমাজের কথা যেন ঠিকরে বের হয়েছে শ্যাডোস অব টাইম চলচ্চিত্রে। আবার রবির স্ত্রী দীপার তার স্বামীকে আগলে রাখার চেষ্টা, প্রার্থনা—০সবই একজন বাঙালি নারীর সফল চিত্রায়ণ।
চলচ্চিত্রটিতে রবি চরিত্রে অভিনয় করেছেন তিনজন। শৈশবের রবি বেশে সিকান্দার আগারওয়ালকে দেখা গেছে, যৌবনের রবির বেশ নিয়েছে প্রশান্ত নারায়ণ, আর বৃদ্ধ রবির পার্টটি করেছেন সৌমিত্র চ্যাটার্জী। মাশা চরিত্রটিকে রূপায়িত করতেও তিনজন অভিনেত্রীর প্রয়োজন পড়েছে। শৈশবের মাশা চরিত্রে টুম্পা দাস, যুবতী মাশা চরিত্রে তানিষ্ঠা চ্যাটার্জী আর বৃদ্ধা মাশা চরিত্রে শোভা সেন অভিনয় করেছেন। জীবনের ত্রিকালে এই ত্রিজুটির রসায়ন খুব শক্তিশালীভাবে ফুটে উঠেছে চলচ্চিত্রটিতে। শৈশবের মাশা ও রবি চরিত্রকে বাছাই করতে ৭০০০ স্কুল শিক্ষার্থীকে ডাকা হয়, তারপর নির্বাচন করা হয় সিকান্দার আগারওয়াল ও টুম্পা দাসকে। সিকান্দার ও টুম্পার অভিনয় প্রশংসার যোগ্য। প্রশান্ত নারায়ণ বাঙালি অভিনেতা না হওয়ায় তাকেও বাংলা ভাষা শিখতে হয়েছিল। বলতে গেলে, একটি চলচ্চিত্র সফলভাবে সম্পাদন করার জন্য সকল আয়োজনই করা হয়েছিল। রবি চরিত্রটি সমাজের নীচু শ্রেণীর এক চরিত্র থেকে উঁচু শ্রেণীতে লাফ দিয়েছে। কার্পেট ফ্যাক্টরি থেকে ছাড়া পেয়ে একসময় নিজেই একটি কার্পেট কোম্পানি খুলে বসে। বিদেশি ক্রেতাদের অর্ডার পড়তে থাকে তার কোম্পানিতে। অন্যদিকে কার্পেট কোম্পানি থেকে বের হয়ে মাশার অনিশ্চিত জীবনে নেমে আসে আরও অন্ধকার। পতিতাপল্লীর একজন নারী হয়েও একসময় রূপের গুণে সে স্ত্রী বনে যায় ঘুষখোর সরকারি কর্মকর্তা ইয়ানি মিশ্রার। ইয়ানি মিশ্রা চরিত্রে ইরফান খান তার স্বকীয় প্রতিভার পরিচয় দিতে ভুল করেননি। দীপা চরিত্রে তীলোত্তমা সোমও ভালো অভিনয় করেছেন।
সিনেমাটির মূল কারিগর ফ্লোরিয়ান গ্যালেনবার্গার। পরিচালনা ও চিত্রনাট্যের কাজটা তিনিই সেরেছেন। এদিক দিয়ে তিনি সফল। চিত্রনাট্য উন্নত সংলাপ ও সম্পর্কের উত্থান-পতনে ভরপুর। একটি কার্পেটকে কেন্দ্র করে ইয়ানি মিশ্রা, রবি ও মাশার ভিতর সূক্ষ্ণভাবে ত্রিমাত্রিক রসায়ন স্থাপন করতেও ভোলেননি তিনি। আবার মাশার স্মৃতিবিজড়িত মালাটির গলা বদল যেন সময়ের সাক্ষী হয়ে থাকে। গার্ট ওয়াল্ডেন জুনিয়র ছিলেন মিউজিকের দায়িত্বে। তিনি বাঙালির মন ও টোন বুঝে পুরো সিনেমায় অসাধারণ মিউজিকের সমন্বয় ঘটিয়েছেন। সিনেমাটোগ্রাফিতে জার্গেন জার্জেস নৈপুণ্য দেখিয়েছেন। সিনেমাটিতে লং শট ও ফুল শটের সফল ব্যবহার দেখা গেছে, ক্লোজ আপ শটের ক্ষেত্রেও ক্যামেরার সূক্ষ্ণ কাজ দেখা গেছে। মূল চরিত্রগুলোর পাশাপাশি তার পারিপার্শ্বিক অবস্থা খুব ভালোভাবে ফুটে উঠেছে সিনেমাটিতে।
শিব মন্দিরে প্রেমের খোঁজে মাশা এসেছিল, রবি এসেছিল, এসেছিল দীপাও; তবে সময়ের কাছে, নিয়তির কাছে বার বার হেরে যাওয়া রবি-মাশার প্রেম যে শেষ হবার নয় তা শেষমুহূর্তে দৃষ্টিগোচর হয়েছে। প্রেমনির্ভর বাংলা সিনেমার এমন শৈল্পিক সমাপ্তি সচরাচর দেখা যায় না।