ব্যক্তি জীবনের সবচেয়ে দৃঢ় মেলবন্ধন কী? এই একটি প্রশ্নকে ঘিরে প্রত্যহিক জীবন চেতনায় ঘুরছে আমাদের অনুভূতির উইপোকা। ২২, ২৩, ২৪, ২৫ সংখ্যার ধারাবাহিকতা জীবনের একটি বড় রহস্য। এই ধারাবাহিকতাকে বিবেচা করা যায় জীবনের নানা ক্ষেত্রের অর্জন কিংবা হারানোর অব্যাহত সংখ্যার রকমফেরে। আর সেই ক্রমিক সংখ্যাকে ব্যবহার করে চলচ্চিত্র নির্মাতা ফ্লোরিয়ান গ্যালেন বার্গার গালিচা কারখানা দিয়ে শুরু করেছেন জীবনের ধারাবাহিক গল্প। একের পর এক চলছে খাবারের টোকেন সংগ্রহের কাজ।
আসলে জীবনকে প্রতিদিনকার বেঁচে থাকার টোকেন সংগ্রহ বললেও ভুল হবে না। কখনো কখোন জীবন সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ে গালিচা কারাখানার কাজ আর অভুক্ত শরীরের জন্য খাবারের সন্ধানে, বেঁচে থাকার সংগ্রাম। আর এই জীবনের মাঝেই হারিয়ে পায়, বাস্তবজীবনের অন্যান্য চাহিদার রং। কিন্তু, তাই বলে তো এই জীবন আর জীবিকার ঘোরের মধ্যে আটকে থাকে না জীবন। আর সেই কৈশরের স্বচ্ছ নিঃস্বার্থ অনুভূতিকে পুঁজি করে জার্মান নির্মাতা ফ্লোরিয়ান গ্যালেন সৃষ্টি করেছেন ‘শ্যাডোস অব টাইম’।
স্বাধীনতা পূর্ব কলকাতায় একটি গালিচা কারখানায় কাজ করে রবি ও মাসা-দু’জন শিশুশ্রমিক। আর এখানেই জন্ম হয় তাদের বয়ঃসন্ধিকালের এক নিঃস্বার্থ অনুভূতি, যা তাদের কাছেও অচেনা। দুজন দুজনের অনুসঙ্গী হয়ে উঠলেও, ভাগ্যের অন্বেষণে নিজেদের ছাড়িয়ে নেয় নিজেদের সেই অব্যক্ত অভিব্যক্তি । জীবন বোধের একটি অংশকে জুড়ে শুধু থেকে যায় পরস্পরের সাহচর্য পাওয়ার একটি অব্যক্ত কামনা। সেই বাসনা নিয়েই শুরু হয় তাদের দূরুত্ব সৃষ্টি আর লুকোচুরির খেলা। অভাবের তাড়নায় ছোট্ট মাসাকে কারখানার এক কর্মকর্তার কাছে বিক্রি করে দিয়েছিলেন তার বাবা। আবার সেই মাসাকে কারাখানার মালিকের যৌন লোলুপ দৃষ্টি থেকে বাঁচাতে নিজের সব সঞ্চয় দিয়ে মুক্ত করে রবি।
নির্মাতা সিনেমায় একই মানুষের জীবনে এক দুটি ঘটনার মধ্যদিয়ে তুলে ধরতে সমর্থ হয়েছেন ভালোভাসার বৈচিত্র্য। দর্শকদের বুঝিয়েছেন, শুধু পাওয়া নয়, ভালোবাসায় নিজেকে হারানোর মধ্যেও আছে এক ধরনের অনন্দ। আর সেই বিশালতার দাবিদার রবি। তবে জীবনের কিছু রহস্য ঘেরা থাকে, যেখানে কেবল বাহ্যিক উপস্থিতি নয়, আত্মিক ক্ষুধাও নিজেকে করে রাখে অসম্পূর্ণ। সেই ধারাবাহিকতায় রবি আর মাসার অপ্রাপ্তির হিসাব না মিলিয়ে হারিয়ে যাওয়ার গল্পেই তাদের পুনরায় এক করে বহু বছরের ব্যবধানে।
প্রকৃতির নিয়মে নিজেদের কাছে অপ্রাপ্তির গল্প তো আর শেষ হতে দেওয়া যায় না। আর সে কারণে দশকের ব্যবধানে নিজেদের স্ব-স্ব অবস্থান থেকে ফের নিজেদের অবিষ্কার করে মাসা-রবি। পথ চলার হিসাবে নিজেদের স্ব-স্ব অবস্থান তৈরি করে মাসা-রবি পৌঁছেন পরিণত বয়সে। মাঝ খানের পথচলায় নানা চড়াই-উৎরাই পার হয়ে মাসা শহরের পতিতা পল্লীর জনপ্রিয় নর্তকী থেকে শহরের শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তার স্ত্রী আর রবি তার কর্মউদীপ্ত ব্যবসায়ী। কিন্তু, শুধু প্রাত্যহিক জীবন-যাপনের মাঝে যে রহস্য নিহিত, যে সময়ের ফেরে একটি নিয়ামক হিসেবে কাজ করে, সেটি আবার বুঝিয়েছেন পরিচালক। তা না হলে, বছরের পর বছর ধরে গঙ্গার ধীরে প্রতিবছর কালিমন্দিরে গিয়ে রবির দেখা পাওয়ার পাওয়ার পূর্ণিমার রাতে মন্দির যাওয়ার দৃশ্য দর্শককে ভাবিয়ে তোলে।
মাসা একদিন মন্দিরে ঠিকই রবির দেখা পায়। কিন্তু অন্য নারীর উপস্থিতি পুরোপুরি অলাদা করে ফেলে তাদের। আবারও দেখা হয় তাদের। বছরের পর বছর ধরে না পাওয়ার তীব্র যাতনা প্রাথমিকভাবে যেন তাদের ভুলিয়ে দেয় সামাজিকতার বিধিনিষেধ। তীব্র ভালোবাসা যেখানে তাড়িত করেছে রবি আর মাসাকে, সেখানে কেবল সামাজিক নিয়ম তাদের আটকে রাখতে পারে না। তার প্রমাণ মেলে রবি-মাসার মিলনে। ভালো-মন্দের রকমফেরে এ সর্ম্পককে সামাজিক দৃষ্টি ভঙ্গিতে আটকানো গেলেও, প্রকাশ পেয়েছে বছরের পড় বছর ধরে জমে থাকা দুটি মনের অব্যক্ত কামনা। কিন্তু ভালোবাসা যদি হয়ে থাকে জীবনের বেঁচে থাকার একটি আত্মিক অবলম্বন, তাহলে সমাজ আর পরিবারের প্রতি দায়িত্ব হয়তো জীবনকে তাড়িত করে সমাজের তথাকথিত স্বাভাবিক নিয়মের বেঁচে থাকার গল্প তৈরিতে। যে কারণে রবির সন্তান নিয়ে আবার অজানার উদ্দেশে পাড়ি জমায় মাসা। কিন্তু জীবনের সবচেয়ে মৌলিক অনুভূতির জায়গায় মানুষ যেমন স্বচ্ছ থাকতে চায়, একইভাবে মাসাও রবির প্রতি নিজের ভালোবাসাকে পুঁজি করে নতুন করে সংগ্রামের মাঝে নিজ সন্তানের মাঝে ফিরে দেখার চেষ্টা করে।
জীবনের ধারাবাহিকতায় হয়তো ছেদ পড়তে পারে, কিন্তু তাই বলে তো আর জীবন থেকে থামে না। চাহিদা, শরীর থেকে শুরু করে পারিশার্শ্বিকতা বা প্রয়োজন যেকোনো কারণেই হোক, জীবনে পরিবর্তন চিরধার্য। সেই ধারাবাহিকতায় কেবল যে বিষয়টি কখনো পুরনো হয় না, সেটি হচ্ছে মানুষের মন। আর তারই প্রতিফলন দেখিয়েছেন সিনেমার পরিচালক। ছোট্ট বেলা থেকে মনের মধ্যে একটু একটু করে গড়ে তোলা ভালোবাসার ঘোরে ভিন্ন ধারায় নিজেদের জীবন পার করে দিলেও, দুজনের মনের চাহিদার কোনো পরিবর্তন হয় না। ফলে জীবনের শেষ অধ্যায়ে এসেও নিজেদের মেলে ধরেছেন, যা কেবল সংজ্ঞায়িত করা যায় একক অনুভুতির মাঝে। বলা যায়, অনুভূতির ব্যবচ্ছেদ করলে দেখা যায়, নিজের ভালোবাসার প্রতি শ্রদ্ধা আর বহিঃপ্রকাশের পরিমিতি বোধের মধ্যেই বেঁচে থাকে মানুষ আর মানুসের মন।
জার্মানির নির্মাতা ফ্লোরিয়ান গ্যালেন বার্গার সিনেমার দৃশ্য ধারণের জন্য বেছে নেন কলকাতাকে। এটি এই নির্মাতার প্রথম চলচ্চিত্র হলেও, ভাষা হিসেবে বেছে নিয়ে ছিলেন বাংলাকে। প্রাপ্ত বয়স্ক রবির চরিত্রে অভিনয় করেছেন প্রশান্ত নারায়ণ। আর মাসার ভূমিকায় তনিষ্ঠা চ্যাটার্জি। ইয়ানি মিশ্রের চরিত্রে ইরফান খান আর দ্বিপার ভূমিকায় তিলোত্তমা সৌম। আর বৃদ্ধ রবির চিত্রায়ণ করেছেন সৌমিত্র চট্টপাধ্যায়। ২০০৪ সালে টরেন্টো আর্ন্তজাতিক চলচ্ছিত্র উৎসবে প্রথমমুক্তি পেলেও, ২০০৫ সালে চেন্নাই আর্ন্তজাতিক চলচ্ছিত্র উৎসবে জিতে নেয় সেরা চলচ্চিত্রের গোর্ডেন স্টার অ্যাওয়ার্ড। এখানেই শেষ নয়। বাভারিয়ান ফিল্ম অ্যাওয়ার্ড, জার্মানি ফিল্প অ্যাওয়ার্ড জিতে নেয় কয়েকটি ক্যাটাগরিতে। কলকাতা শহরের বিভিন্ন লোকেসনে ‘শ্যাডোস অব টাইম’ ফুটে উঠেছে অন্যরূপে, যা সেলুলয়েডের ফ্রেমে যোগ করেছে নতুন মাত্রা।