‘শিশিরের আয়না ও অন্যান্যা গল্প’গ্রন্থটির রচয়িতা প্রবাসী কথাসাহিত্যিক রেজা নুর। এ গ্রন্থে নয়টি গল্প মুদ্রিত হয়েছে। গল্পগুলোর নাম ‘পথচারী’, ‘কৃষ্ণচূড়া মন’, ‘প্রথম মেঘের জল’, ‘নীল পাহাড় ‘, ‘ছায়ামেঘ’, ‘নরসুন্দর’, ‘শিশিরের আয়ন ‘, ‘কালোনদী’ ও ‘সুলেখা’।
‘ছায়ামেঘ’ গল্পটি অসাধারণ। এর বিষয় প্রান্তিক জনপদের মানুষ। শুরুটাও চমৎকার। আধুনিকগল্পে যে চমক থাকে তা রেজা নুরের গল্পে রয়েছে। তিনি প্রতিটি গল্পের শুরুতেই পাঠকের কথা বিস্তৃত ভূমিতে দাঁড় করিয়ে দেন। গল্পটির শুরুর লাইন ‘শীত আসার আগে আগে আইজদ্দী কামারের ব্যস্ততা বাড়ে।’ পাঠক গল্পের শুরুতেই একজন খেটে খাওয়া মানুষের সঙ্গে পরিচিত হয়। তার পরপরই গল্পের বিষয় ভিন্ন দিকে বাঁক নেয়। তবে এ বাঁক, ‘উড়ে এসে জুড়ে বসা নয়।’এটি গল্পের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখেই ভিন্ন পথ তৈরি করে নেয়। পাঠকের পরিচয় ঘটে আইজদ্দীর মেয়েটির সঙ্গে । ‘মাটির রঙের মতোই রঙ মেয়েটার। আর্দ্র, মোহন কালো। বাবার মতো রঙ। মায়ের গা দুধে আলতা হলেও মেয়েটা তার ধারেকাছেও যায়নি। ছায়া দিয়ে হেঁটেছে বরং।’নায়িকার বর্ণনা লেখক সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন। মমতাজের ভেতরে পাঠক খুঁজে পায় জসীমউদ্দীনের রূপাইয়ের গায়ের বর্ণনা। গল্পটি সহজভাবেই এগিয়ে গেছে শব্দেবাক্যে; সরল রেখায়। মমতাজ, রিজিয়া, মকবুল, মজনু; চারটি চরিত্র ঘিরেই গল্পের বুনন। রিজিয়া স্বামীর ভালোবাসাবঞ্চিত। মমতাজ জড়িয়ে পড়ে মকবুলের সঙ্গে দৈহিক সম্পর্কে। মজনু জোয়ান পুরুষ। সে রিজিয়ার দুর্বলতার সুযোগ নেয়। গল্পটিতে যৌনতার যে জগৎ দেখতে পাই, তা অতিকথনে ভারাক্রান্ত নয়। তা গল্পের প্রয়োজনেই ঘটে। গল্পে মুজিবরের মেয়ের সাপে কাটার ঘটনাটা অতিরঞ্জিত। লেখক এ গল্পে এটি না আনলেও পারতেন। তবে গল্পের শেষটা চমৎকার। রিজিয়া মমতাজের ভাবি হলেও মায়ের মতো তাকে ভালোবাসে। গল্পের শেষে আমরা দেখি রিজিয়ার চোখে ঘৃণা। কারণ, মমতাজ রিজিয়ার স্বামী মকবুলের সঙ্গে অনৈতিক সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ে।
‘সুলেখা’এই গল্পটি সম্পূর্ণ ভিন্ন স্বাদের। রূপকথার ধাঁচে। ছোট-ছোট বাক্যে সুন্দর উপমায় গল্পটি লিখিত। পড়লে মনে হয়, একটি অসাধারণ কবিতা। সুলেখা পরীরাজ্যের রাজকুমারী। রাজারাণীর আদরের দুলালী। পূর্ণিমার রাতে গানবাজনার আসর ঘিরে গল্পটি ভিন্ন দিকে মোড় নেয়। রাজকুমারীর দেহের সৌন্দর্যে ঈর্ষাকাতর হয়ে ওঠে নীলপরী। নীলপরীরা সাতবোন। সাতবোনে যুক্তি করে সুলেখার চোখে ঘুম এনে দেয়। ‘খোলাজানালা জোছনার ঝালর দুলছে। পালঙ্কের চারপাশে মিহি আবরণ তুলে ধরলো অন্যপরীরা। লালপরী আলগোছে শুইয়ে দিল। রাজকুমারী ঘুমিয়ে পাশাদের প্রান্তের ঘরে। সাদাপর্দা উড়ছে। জোছসনার ঢেউ আচড়ে পড়ছে শুভ্রবিছানায়। পিনপিনে রাত পোশাকে স্বল্প আবৃত রাজকন্যা ঘুমেকাদা।’ লেখক প্রতিটি গল্পে ছড়িয়ে রাখেন প্রকৃতির অসাধারণ দৃশ্যাবলি। এই বর্ণনা তারই প্রমাণ। ‘সুলেখা’গল্পে পরীরা নায়িকাকে ঘুম পাড়িয়ে দিলে পরীদের হাত ধরেই ঘুমন্ত রাজকুমার মোহন কুমারের প্রবেশ। তারপর গল্প নানান নাটকীয়তায় মোড় নেয়। সংলাপগুলো লক্ষণীয়।
‘আমার নাম মোহনকুমার। আর তোমার নাম নদীকুমারী বুঝি?’
‘না । আমার বাবার রাজ্য নদীয়া বলে এই কথা বলছ? তাহলে তো তোমার নাম হওয়া উচিত যশোহর কুমার। তুমি নিজের জন্য নামযশ হরণ করেছ তাই। তাইনা?’
রেজা নূর প্রতিটি গল্পেই হতাশা, বেদনাকে পাশ কাটিয়ে সবুজশ্যামল এক ভাবনা সৃষ্টি করেন। এ গল্পেও সুলেখা মোহন কুমারকে পেয়ে যায়। পরীররাজ্যে সুখের নহর বয়।
‘কৃষ্ণচূড়া মন’গল্পে তানিয়া নিঃসন্তান। এজন্য স্বামীই দায়ী। স্বামীর অক্ষমতা শাশুড়ি আর পড়শীরা বোঝে না। গল্পটি স্বামী-স্ত্রীর সুন্দর সম্পর্কের ভেতর দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছিল, কিন্তু লেখক গল্পটিকে অন্যদিকে টেনে নেন। যা সত্য এবং বাস্তব। আমরা দেখি শাহজাহান এক মাসের ট্যুরে চলে যায়। গল্পে প্রবেশ করে ভাইপো পলাশ। পলাশ খুবই লাজুক। তানিয়া চটপটে ও রহস্যে মোড়নো। তারপর দুজনেই জড়িয়ে পড়ে দৈহিক সম্পর্কে। রেজা নূরের গল্পে লিবিডো চেতনা প্রকট। গল্পটি শেষ হয় দার্শনিক ভাবনার মধ্য দিয়ে। তানিয়া পলাশের মুখের দিকে তাকিয়ে ভাবে, স্ত্রীকে একান্তে পেয়ে কেমন করে পুরুষ…। পাঠক টের পায় তানিয়ার অনেক দিনের লালিত শূন্যতার। যা সে স্বামীর কাছ থেকে কখনো পায়নি, তা সে পলাশের কাছে পায়। গল্পটিতে সামাজিক অবক্ষয়, বিশ্বাসের ভাঙন উপস্থাপিত হয়েছে।
‘নরসুন্দ ‘গল্পটি বালক মন আর নরসুন্দর বলাইয়ের আখ্যান। গল্পটি উত্তম পুরুষে লেখা। এতে আবহমান বাংলার অসম্প্রদায়িক চিত্র ফুটে উঠেছে। নরসুন্দর বলাই ভালো মনের মানুষ। যেসব বালকের চুল কাটে তাদের সন্তানের চোখে দেখে। বালকরা তাকে শ্রদ্ধা করে। বলাই ভালো অভিনয় জানে। ফলে সে ‘প্রতিমা অপেরা’গানের দলে যোগ দেয়। সে না থাকাতে বালকরা টের পায় তার অভাব। নায়ক মনা অথবা লেখক নিজেই কল্পনায় দেখতে পান গাছের সঙ্গে হেলান দেওয়া বলাই কাকার সাইকেল। গল্পটি শৈশবের স্মৃতি রেখা ধরে হেঁটে কথন। শেষ হয়েছে সুন্দুর একটা উপমায়‘আর বেলের শব্দে আমরা মৌমাছির মতো ছুটে যাই নারকেল তলায়’। মানুষ চলে গেলেও স্মৃতি থেকে যায়। নরসুন্দর বলাই বালকদের মনে সুন্দর একটি স্মৃতি রেখা অঙ্কন করেছে।
‘শিশিরের আয়না’এটি এই গ্রন্থের নামগল্প। গল্পটি শুরু হয়েছে, ‘অন্ধকার আর মাটির রঙ মিশে আরও ঘন হয়ে রয়েছে রাত। ’গল্পটিতে নায়ক কালো ব্যবসা করত। সে এখন ওসব ছেড়ে ভালো হয়ে যেতে চায়। হতে চায় সাইকেল মেকানিক। কারণ তার চোখে খেলা করে মায়ের স্বপ্ন, শাকিলার স্বপ্ন। শাকিলাকে সে ভালোবাসে। লেখক করেশের রূপের বর্ণনা তুলে ধরেছেন এভাবে: ‘জ্বলজ্বলে একজোড়া চোখ, কাঁধ-অবধি ঢেউদোলা চুল, দু‘সারি মুক্তোর ঝিলিক নিয়ে কে যেন দাঁড়ানো।’ লাইনগুলো পড়েই পাঠকের মনে প্রত্যক্ষভাবে নায়কের ছবি অঙ্কিত হয়ে যায়।
তুমি আবার আইছো? আমি তো যাইনে কখনো। আসার কী হইল? ঠাট্টা করবা না, কী জন্যি আইছো কও। মা বাড়ি আচে, বেশি দাঁড়াইনে যাবে না।
আমি কাজ নিচি। গিরামে না। মণিরামপুর বাজারে। বেতন-কড়ি পাকা হইয়ে গেলি তুমারে নিয়ে যাব। ঘর বানব।’
করেশের ঘর বাঁধা হয় না। মণিরামপুরেও যাওয়া হয় না। করেশ একরাতে শাকিলার সঙ্গে দেখা করতে বের হয়। কারণ সে মণিরামপুরে চলে যাওয়ার আগে শাকিলাকে নতুন শাড়ি দিতে চায়। ভর সন্ধ্যাবেলায় যেন দুপুর রাত ঘনিয়ে আসে বাগের আমতলায়। মানুষজন করেশকে বিলাকমার্কেটের দালাল ভাবে। চোর ভাবে। করেশ যতই বোঝাতে চায় আমি চুরি করিনি, মানুষ বিশ্বাস করে না। তারা পুটলিতে পেয়ে যায় নতুন তিনটে শাড়ি। তারপর গল্পে আমরা দেখি করেশ হাসপাতালে আধমরা শুয়ে আছে। করেশের মনে পড়ছে মায়ের কথা, করেশ মৃত্যুর দিকে যেতে যেতে কল্পনায় দেখে নতুন শাড়ি পরিহিত শাকিলাকে। গল্পটি শুরু অন্ধকারের মধ্যদিয়ে সমাপ্তিও অন্ধকারে। প্রথমটা প্রকৃতিগত অন্ধকার, শেষটা মানবসৃষ্ট অন্ধকার। এই যে সমাজে অনাচার-ব্যভিচার, কোনো কারণ না খতিয়ে মানুষ হত্যা, এই যে কেউ ভালো হতে চাইলে তাকে পেছনে টেনে ধরা, এসবই এই গল্পের রেজা নুর উপস্থাপন করেছেন। লেখকের কাজ তো সময়কে ধারণ করা। সমাজ, রাষ্ট্র যে সময়ের মধ্য দিয়ে অতিবাহিত হচ্ছে তার রূপরেখা অঙ্কন করাই প্রকৃত লেখকের কাজ। রেজা নুর তা সফলভাবে করতে পেরেছেন।
অন্যান্য গল্পগুলোও সুখপাঠ্য । পাঠক আধুনিক গল্পের স্বাদ খুঁজে পাবে। রেজা নূরের গল্প বিষয়প্রকরণে সহজসরল। শব্দে-বাক্যে প্রতিটি গল্প পাঠকের হৃদয় হরণ করে। এমন একটি চমৎকার বই উপহার দেওয়ার জন্য লেখককে ধন্যবাদ দিতেই হয়।
মন্তব্য