অনু হোসেন (১৯৬৫-২০১৯) আমার সমসময়ের একজন অগ্রজ লেখক। নানাবিধ গুণ থাকলেও একজন নিবেদিত প্রাবন্ধিক-গবেষক হিসেবে তিনি আমার ভক্তির জায়গাজুড়ে আছে। তার সঙ্গে সরাসরি কখনো দেখা হয়নি। ফেসবুকের সুবাদে, ম্যাসেঞ্জারে লেখালেখি প্রসঙ্গে বেশ ক’বার কথা হয়েছে। স্বভাবে মৃদুভাষী কিন্তু প্রাণপ্রাচুর্যে ভরপুর মনে হয়েছে তাকে। কিন্তু তার আকস্মিক মৃত্যু আমাকে ভীষণ মর্মাহত করেছে। তার সমকালে সাহিত্যের বিবিধ মাধ্যমে কাজ হলেও শিল্পসাহিত্য-বিষয়ক প্রবন্ধে উল্লেখযোগ্য সমবয়সী প্রাবন্ধিকের সংখ্যা ছিল হাতেগোনা। প্রবন্ধ রচনায় অনু হোসেন আমাদের মনোযোগ আকর্ষণ করেছেন। কারণ তার লেখা প্রবন্ধমালায় একজন গবেষকের অভিনিবেশের ছাপ লক্ষণীয়। যে বিষয়ে তিনি লিখতে চেয়েছেন, সেই বিষয়ের ওপর তাঁর নিবিড় পর্যবেক্ষণ ছিলো।
অনু হোসেনের শিল্পসাহিত্য-বিষয়ক প্রবন্ধগুলো নন্দনতত্ত্বের আলোকে উন্মোচিত। তার উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ—‘শিল্পের চতুষ্কোণ’, ‘বাংলাদেশের কবিতা: লোকসংস্কৃতির নন্দনতত্ত্ব’, ‘বোধ ও বাতি’, ‘শিল্পের তরঙ্গ অন্তরঙ্গ’। এছাড়া সম্পাদিত গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে—‘আবদুল মান্নান সৈয়দ রচনাবলি’, ‘উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীর টুনটুনির গল্প’, ‘গল্পমালা’, ‘জ্যোতির্ময়: সৈয়দ আকরম হোসেন সংবর্ধনাগ্রন্থ’, ‘অভিবাদন শহীদ কাদরী’, ‘সংস্কৃতিসাধক সনজীদা খাতুন (যৌথ)’, ‘সমকালে রবীন্দ্রনাথ: সমকাল পত্রিকায় রবীন্দ্রচর্চা’ ও Bangla Academy English-Bangla Dictionry : Revised & Enlarged Edition (যৌথ)’।
বর্তমান লেখাটি প্রয়াত লেখক অনু হোসেনের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন। মূলত ‘শিল্পের চতুষ্কোণ’ গ্রন্থের পাঠোদ্ধার এই লেখার অন্বিষ্ট বিষয়।
‘শিল্পের চতুষ্কোণ’ (২০০৫) অনু হোসেন প্রণীত শিল্পসাহিত্য বিষয়ক প্রবন্ধগ্রন্থ। গ্রন্থটি উৎসর্গ করা হয়েছে লেখকপত্নী আফসানা ফেরদৌসকে। এখানে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে লেখা সর্বমোট ১৩টি প্রবন্ধ মলাটবন্দি হয়েছে। এরমধ্যে সমকালীন নানা সাহিত্যতত্ত্বের আলোচনা গ্রন্থের আলোকিত একটি দিক। লেখক সরস গদ্যের বাতাবরণে তত্ত্বকথার স্বরূপ উন্মোচনে প্রয়াস রেখেছেন। কার্ল গুস্তাভ ইয়্যুং-এর শিল্পীর মনোজগৎ, মিশেল ফুকোর নন্দনভুবন ও জ্যাক দেরিদার পোস্ট-স্ট্রাকচারালিজমের আলোচনা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
কার্ল গুস্তাভ ইয়ুং শিল্পীর মনোজগতের দুর্জ্ঞেয় অঞ্চল অনুসন্ধানের ভিন্ন ভিন্ন রকমফের কিংবা মনোবিশ্বের অজানা স্তর নির্ণয়ের যে তত্ত্ব হাজির করেছেন, সেই তত্ত্ব নিয়ে তুলনামূলক বিশ্লেষণ শেষে পরিসমাপ্তিতে উপনীত হওয়ার মনোভঙ্গি লেখকের মধ্যে দেখা যায়। বাংলা ভাষায় তত্ত্বকথার আলোচনা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ধূসর এবং অস্পষ্ট ভাবে উপস্থাপিত হয়। অনু হোসেন তার আলোচনায় সেই ধূসর ও ঝাপসা তত্ত্বকথার আড়াল থেকে বেরিয়ে সারকথা উপস্থাপনে নিবিষ্ট ছিলেন। শিল্পীর অবচেতন ও যৌথ অবচেতন স্তরে যে অপার রহস্যময়তা, ইয়্যুং মনোবিশ্লেষণী পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে তাকে ‘অদ্ভুতময়তার কথা’ হিসেবে অভিহিত করেন। লেখকের ভাষায়—‘শিল্পীর মনের গভীরে অন্তরিত আছে অপার রহস্যময় জগৎ। ইয়্যুংয়ের বহু মনোবিশ্লেষণী পরীক্ষা-নিরীক্ষার মধ্যে অন্তবীজের মতো অঙ্কুরিত হয়ে আছে এই রহস্যময়তার কথা। অবচেতনে এবং যৌথ অবচেতনে এই রহস্যময় জগৎ শিল্পীর মনে অস্তিত্বশীল। এর বিস্তৃতি নানা ব্যঞ্জনায় স্তরীভূত। কল্পনাশক্তির তীব্রতা আর স্বপ্নের বহুস্তরী রূপক-প্রতীকাশ্রয়ী চিত্রকল্পের দ্বৈততায় গড়ে উঠতে থাকে এই অপার রহস্যের জাল। শিল্পীর চেতনায় এর প্রভাব অত্যন্ত নিবিড় ও বহুবিস্তৃত। শিল্পীমনের রহস্য উদঘাটনে ইয়্যুং স্বপ্ন, প্রত্নরূপ, ধরনবাদ, প্রতীকবাদ, আদিমানব, অনুমান প্রভৃতি অনুষঙ্গের পাশাপাশি য়্যানিমা ও য়্যানিমাস সত্তার গুরুত্ব নির্দেশ করে।’
একজন সাধারণ মানুষ সুস্থ কি অসুস্থ সেটা নির্ণয় করার জন্য তার দৈহিক ও ব্যক্তিক বৈশিষ্ট্য পরখ করতে হয়। কিন্তু একজন শিল্পীর মনোজগৎ সন্ধানের ক্ষেত্রে আরও বিশেষ কিছু ব্যাপার জড়িত। ইয়্যুং মনে করেন শিল্পীর বংশগত পরম্পরা ও জন্মগত বৈশিষ্ট্য ছাড়াও অতিরিক্ত উচ্চজ্ঞানের অধিকারী। ফলে সাধারণের মনোজগৎ থেকে শিল্পীর মনোজগৎ আরও বিস্ময়কর, রহস্যময়। গভীর অর্থের বিবেচনায় ইয়্যুং যাকে ‘সমষ্টিমানব’ হিসেবে অভিহিত করেছেন। অর্জিত অভিজ্ঞতা ও জ্ঞানের সুউচ্চ অনুধাবন একজন শিল্পীর নির্জ্ঞান বা অবচেতনার স্তরে গিয়ে জমা হয়। যখন কবি কিংবা শিল্পীর ভেতর সৃজন উন্মাদনা তৈরি হয় তখন চেতন ও অবচেতন স্তরের অভিজ্ঞতামথিত চিন্তার প্রকাশ ঘটে। এছাড়া স্বপ্নতত্ত্বের আওতায় এনে শিল্পীমানস বিশ্লেষণেও ইয়্যুং অগ্রসর হয়েছেন। প্রাবন্ধিক ইয়্যুংয়ের ভাবনাকে বোঝাতে গিয়ে সিগমুন্ড ফ্রয়েড, এন্থনি স্টেভেন্স, ই বি টেইলর ও জেমস ফ্রেজারের উদ্ধৃতি ভাবনাবিন্দুকে হাজির করেছেন।
প্রবন্ধের শেষে অনু হোসেন তার বক্তব্যের ইতি টানেন এইভাবে—‘কবি-শিল্পীর চেতনায় নির্জ্ঞানের বিপুল অভিজ্ঞতা এবং স্বপ্নপ্রেরিত নানা অনুষঙ্গ-ঘটনা বিরামহীনভাবে আবির্ভূত হয়। ইয়্যুং শিল্পীর মনোজগতের গ্রন্থি মোচনে মূলত শিল্পীর নৈর্ব্যক্তিক সর্বমানবীয় উপলব্ধি, বস্তুনিষ্ঠতা, বোধের বহুমাত্রিকতা, চিন্তনের অবাধ স্বাধীনতা, সমকাল অতিক্রমের পথপরিক্রমা অর্জনের দিকগুলো বারবার তাঁর পর্যবেক্ষণের অন্তর্গত করেন।’
শিল্পচর্চার আঙিনায় অনু হোসেন ছিলেন একজন শিল্পসাহিত্য গবেষক। তার লেখালেখির অঞ্চলজুড়ে ছিল মননশীল সাহিত্যসাধনা। ‘শিল্পের চতুষ্কোণ’ গ্রন্থে একজন নিবেদিত শিল্পগবেষক এবং প্রাবন্ধিকের পরিচয় প্রতিভাত হয়েছে। বাংলা সাহিত্যে তার চিন্তামগ্ন লেখাগুলো সাদরে গৃহীত হয়েছে
‘মিশেল ফুকোর (১৯২৬-১৯৪৮) নন্দনভুবন’ শীর্ষক প্রবন্ধে নন্দনতত্ত্বের প্রচলিত ধারণার বাইরে মিশেল ফুকোর অভিমত ব্যক্ত হয়েছে। ফুকোর মতে, শিল্পের আনন্দ লাভ ব্যক্তিবিশেষে আলাদা। ব্যক্তিসত্তার রুচি, অভিজ্ঞতা ও পঠনপাঠনের অভ্যাসের বিবেচনায় আনন্দযোগ ঘটে। কারণ শিল্প অবস্থাভেদে সব মানুষের কাছে পৌঁছে। প্রাবন্ধিক অনু হোসেন তার লেখায় ফুকোর প্রচারিত ‘ব্যক্তির স্বাধীনতা’, ‘আত্মচিন্তা’, ‘ক্ষমতা’, ‘সৃষ্টি’ ও ‘প্রকাশের মাধ্যম’সহ বেশকিছু প্রসঙ্গের অবতারণা করেছেন। ফুকোর নন্দনতত্ত্ব বিষয়ক অভিমতের একটা বিশেষ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে—প্রচলিত ধ্যানধারণাকে অস্বীকার করে যুক্তিতর্কের নিরিখে নিজের মত প্রতিষ্ঠা করা। প্রাবন্ধিকের ভাষায়—‘ফুকোর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিচার হলো—তিনি বলেন, সাহিত্য ও শিল্প কেবল এলিট বা অভিজাত শ্রেণীর চর্চার বিষয় হতে পারে না, এর সঙ্গে যুক্ত হবে সামাজিক বিন্যাস এবং সেই অর্থে সমাজ-অন্তর্ভুক্ত সর্বসাধারণের মধ্যে এই নন্দন চর্চার ধারাবাহিকতা সংরক্ষণ ও বাঞ্ছনীয়। আধুনিক আধুনিক ধারণায় যাকে বলা হয় অভিজাত শ্রেণির কাজ তা কখনোই সৌন্দর্যচেতনার সামগ্রিক ব্যাপার হতে পারে না, সৌন্দর্যের গন্তব্য হবে একত্ব পেরিয়ে বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর সমৃদ্ধির পথে সহায়ক এবং তাদের আত্মানুশীলনের মাধ্যমে সৌন্দর্যবোধে উদ্বুদ্ধকরণ।’
‘শিল্পের চতুষ্কোণ’ গ্রন্থের একটি বিশেষ প্রবন্ধ ‘পোস্ট-স্ট্রাকচারালিজম ডিকন্সট্রাকশনিজম ও জ্যাক দেরিদা’ শীর্ষক প্রবন্ধে দেরিদার ‘উত্তর কাঠামোবাদ’ ও ‘তত্ত্ব বিনির্মাণ’ নিয়ে আলোচনা স্থান পেয়েছে। জাক দেরিদা (১৯৩০ –২০০৪) বিশ শতকের একজন ফরাসি দার্শনিক। এই শতকের দ্বিতীয়ার্ধে পৃথিবীর চিন্তাশীল ব্যক্তিদের মধ্যে তিনি ছিলেন অগ্রগণ্য একজন। তার প্রবর্তিত তত্ত্ব বিনির্মাণ বা ডিকন্সট্রাকশন নামে পরিচিত। উত্তরাধুনিক দর্শনের সঙ্গে সম্পর্কিত থেকে তার চিন্তা ও বিশ্লেষণ ‘উত্তর কাঠামোবাদী’ তত্ত্ব হিসেবে প্রতিষ্ঠা পায়। এছাড়া তার বক্তৃতা় ও লেখায় কাঠামোবাদের বিভিন্ন দিক আলোচিত হয়েছে। তবে দেরিদার সবচে বেশি আলোচিত ব্যাপার ‘ডিকন্সট্রাকশন’। যদিও ‘ডিকন্সট্রাকশনিজম’ মূলত স্ট্রাকচারালিজম থেকে উদ্ভূত। যা পরবর্তী সময়ে ‘পোস্ট-স্ট্রাকচারালিজম’ হিসেবে নতুন অবয়বে দাঁড়িয়েছে। এক্ষেত্রে দেরিদাকে প্রবলভাবে উৎসাহিত করেছে সস্যুরের ভাষাদর্শন। সাহিত্য সমালোচনার প্রশ্নে দেরিদা প্রশ্নমুখর। প্রচলিত টেক্সটের ধারণাকে প্রত্যাখ্যান করে ভাষার আন্তঃ শৃঙ্খলার ওপর গুরুত্ব দিলেন। প্রাবন্ধিক অনু হোসেনের ভাষায়—‘মেটাফিজিক্স-বিরোধী দার্শনিক নিৎসে, হাইডেগার, সার্ত্রে ও এডম হুরসাল প্রমুখের মতো দেরিদার গ্রাম্যাটোলজি, ডিকন্সট্রাকশনিজম, লোগোসেন্ট্রিসিজম, ট্রেস, বিইং প্রভৃতি বিষয় তাঁর অন্তর্ধানের পরেও সারা পৃথিবীতে নিঃসন্দেহে আরও নতুন চিন্তা ও দর্শনের প্রান্তকে উন্মোচন করবে।[…] শিল্পসাহিত্য ও নন্দনবিশ্বে কেবল নয় প্রচলিত রাষ্ট্রব্যবস্থায় সমাজপ্রচলিত যেকোনো অঞ্চলে সাংকেতিক ভাষাতাত্ত্বিক ধারণায় দেরিদার অবদান সুদূরপ্রসারী ও বহুবিস্তারী চিন্তার উৎসারক বিন্দুরূপে বিবেচনার সুযোগ রাখে।’
অনু হোসেন ‘শিল্পের স্বপ্নপ্রতীক ও চিত্রকল্প’ প্রবন্ধে চিত্রকল্প ও ইমেজিসমের পার্থক্য তুলে ধরেন। অনেকেই কবিতার এই দুই অলঙ্কারকে অভিন্ন মনে করেন। কিন্তু আদপে দু’টি ভিন্ন বিষয়। এতদিন ধরে এজরা পাউন্ড উত্থাপিত ইমেজিস্ট আন্দোলনের ফলে সৃষ্ট কবিতাকে চিত্রকল্প হিসেবে বিবেচনা করা হতো। শুধু তাই নয়, পাউন্ড ঘোষিত ইশতেহারের সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন এমি লাওয়েল, ডি এইচ লরেন্স, রিচার্ড এলডিংটন, ফ্লেশারসহ প্রমুখ কবি-কথাসাহিত্যিক। কিন্তু সি ডি লেউস চিত্রকল্প সম্পর্কে প্রচলিত ধারণাকে প্রশ্নবিদ্ধ করলেন। তার কালজয়ী গ্রন্থ ‘দি পোয়েটিক ইমেজ’ চিত্রকল্পের প্রকৃত স্বরূপ উন্মোচনে সহায়ক। প্রাবন্ধিক এই প্রসঙ্গ আলোকপাত করেন এভাবে—‘লেউসের নির্দেশিত চিত্রকল্পের ভিতটি কীভাবে গড়ে ওঠে তার একটি পারম্পর্য আমরা দাঁড় করাতে প্রয়াস নিই। তিনটি বাহু বা ত্রিভুজ শক্তির প্রবলতায় চিত্রকল্পের স্তম্ভটি বেড়ে ওঠে। এক. সজীবতা, দুই. প্রচ-তা, তিন. স্মৃতি জাগানিয়া শক্তি। এই ভুজত্রয় যখন একে অপরের সঙ্গে বিভিন্ন হয়েও অর্থের দ্যোতনায় দারুণ সঙ্গতি সৃষ্টি করে তখন চিত্রকল্পে অন্তরিত কল্পনার পারম্পর্যটি সার্থকভাবে রূপান্তরিত হয়।’
এই গ্রন্থে লেখক কেবল তত্ত্বকথা আলোচনায় ক্ষান্ত হননি। দেশি-বিদেশি কবিতা নিয়ে আলোচনা করেছেন। ‘বিশ্বকাব্যভূমির লোকবীজ’ শীর্ষক প্রবন্ধে বিশ্বকবিতার বিস্তীর্ণ জমিনে লোকজ অনুষঙ্গের ব্যবহার দেখিয়েছেন। লোকায়ত জীবন, গণমানুষের বিশ্বাস, প্রবাদ-প্রবচন, পুরাণ, রূপকথা-উপকথা ইত্যাদি প্রসঙ্গ কবিতার ক্যানভাসে কিভাবে প্রতিফলিত হয়েছে তার সুবিস্তৃত আলোচনা গ্রন্থটিকে সমৃদ্ধ করেছে। আধুনিক কবিতা প্রধানত নাগরিক অনুষঙ্গ আশ্রয় করে বিকশিত হলেও কবিদের চৈতন্যের গভীরে লোকজ অনুভব ঠিকই ছিল। সেহেতু আধুনিক কবিতা থেকে লোকজ অনুষঙ্গ এবং ভাষাভঙ্গি একেবারেই মুছে যায়নি। এরকম ভুরি ভুরি দৃষ্টান্ত দেওয়া যাবে।
প্রাবন্ধিকের ভাষায়—‘সাহিত্যের ইতিহাসে বিভিন্ন আখ্যান কাব্যগুলোও লোকভাবনার বৈশিষ্ট্যজাত। চসারের (১৩৪০-১৪০০) দি নাইট’স টেল, স্পেন্সারের (১৫৫২-১৫৯৯) ফেইরি কুইন্স, স্কটের (১৭৭১-১৮৩২) লে অব দি লাস্ট মিনস্ট্রেল, টেনিসনের (১৯০৯-১৮৯২) আইডলস অব দি কিং, উইলিয়াম মরিসের (১৮৩৪-১৮৯৬) দ্য আর্থলি প্যারাডাইস প্রভৃতি আখ্যানকাব্যের নাম এ প্রসঙ্গে স্মরণীয়।’
বিশ্বনন্দিত কবি ও নাট্যকার বের্টল্ট ব্রেশটের কবিতা নিয়ে একটি চমৎকার প্রবন্ধ স্থান পেয়েছে গ্রন্থে। প্রবন্ধের নাম ‘বের্টল্ট ব্রেশটের কবিতা: শিল্প ভাঙার শিল্প’। বের্টল্ট ব্রেশট নাট্যকার হিসেবে বেশি জনপ্রিয় হলেও তাঁর কবিতাও নাট্যগুণ সমৃদ্ধ। অনু হোসেন তাঁর প্রবন্ধে কবিতা ও নাটকের সম্পূরক আলোচনা করেছেন। প্রবন্ধটি পড়ে পাঠক ব্রেশটের কবি ও কবিতা সম্পর্কে সম্যক ধারণা পাবেন।
এছাড়া মাইকেল মমধুসূদন দত্ত থেকে শুরু করে কবি শহীদ কাদরী পর্যন্ত বাংলা সাহিত্যের গুরুত্বপূর্ণ কবিদের কবিতা নিয়ে বেশকিছু প্রবন্ধ সন্নিবেশিত হয়েছে ‘শিল্পের চতুষ্কোণ’ গ্রন্থে। সেগুলো হলো—‘মধুসূদন দত্তের সৃষ্টিবৈচিত্র্য’, ‘রবীন্দ্রনাথ ও পঁচিশে বৈশাখ’, ‘জীবনানন্দ পাঠের নতুন খসড়া’, ‘শামসুর রাহমানের কবিতা: লোকবাংলার জলহাওয়া’, ‘আবু জাফর ওবায়দুল্লাহর কবিতায় মাতৃকল্প’, ‘আল মাহমুদের কবিতায় নারীপুরাণ’ ও ‘কবি শহীদ কাদরী: পরবাসে বিদ্ধ পরান’।
শিল্পচর্চার আঙিনায় অনু হোসেন ছিলেন একজন শিল্পসাহিত্য গবেষক। তার লেখালেখির অঞ্চলজুড়ে ছিল মননশীল সাহিত্যসাধনা। ‘শিল্পের চতুষ্কোণ’ গ্রন্থে একজন নিবেদিত শিল্পগবেষক এবং প্রাবন্ধিকের পরিচয় প্রতিভাত হয়েছে। বাংলা সাহিত্যে তার চিন্তামগ্ন লেখাগুলো সাদরে গৃহীত হয়েছে।