শামসুর রাহমান—একাধারে কবি, ঔপন্যাসিক, গল্পকার, অনুবাদক, ছড়াকার ও আত্মজীবনী লেখক। একজন মানুষের এত গুণ দেখে মনে হতেই পারে তিনি বহুগুণের অধিকারী। মনে হওয়াটাই স্বাভাবিক। আর সে ভাবনাটিও অমূলক নয়। প্রাবন্ধিক কাজী মহম্মদ আশরাফ এই বহুগুণে গুণান্বিত মানুষকেই মলাটবন্ধ করেছেন ‘শামসুর রাহমান: প্রকৃত শিল্পীর প্রতিকৃতি’ শিরোনামে। প্রথমত ধাক্কাটা আসে এখানেই, ‘প্রকৃত শিল্পী’ বলতে তিনি কী বোঝাতে চেয়েছেন? শিল্পী তো সবাই। এরমধ্যে প্রকৃত ও অপ্রকৃত শব্দের গুরুত্ব কতখানি? সে জবাবও তিনি দিয়েছেন। কাজী আশরাফ বলেছেন, ‘তার প্রকৃত পরিচয় জানতে হলে তার সাহিত্যের ব্যাপক পাঠ প্রয়োজন।’
কাজী মহম্মদ আশরাফ হয়তো সেই ব্যাপক পাঠের পরেই ‘প্রকৃত শিল্পীর প্রতিকৃতি’ নিয়ে আমাদের সামনে হাজির হয়েছেন। বইতে শামসুর রাহমানের কবিতা, কবিতায় ঐতিহ্য, গল্পের ভাষা, সাহিত্যচিন্তা, উপন্যাসে আত্মদর্শন, বিদেশি ভাষায় কবির কবিতা অনুবাদ, ছড়ায় ছন্দের মেলা, কবির অনুবাদকর্মে শব্দভ্রমণ এবং আত্মকথা বিশদভাবে তুলে ধরেছেন। খুব অল্প পরিসরে শামসুর রাহমানের প্রতিভার নানা দিক নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে বইটিতে।
‘কবিশ্রেষ্ঠ’ বা ‘নাগরিক কবি’ হিসেবে পরিচিত শামসুর রাহমান শুধু কবিই নন; তিনি বহু গুণের অধিকারী। এমনকি বাংলা সাহিত্যের পাশাপাশি বিশ্বসাহিত্যের আসরেও কম বিবেচ্য নন। জন্মগতভাবে স্বল্পভাষী এই মানুষটি তার সব কথা বলে গেছেন সাহিত্যচর্চা বা সাহিত্য সৃষ্টির মধ্য দিয়ে। ঢাকা শহরেই জন্ম থেকে মৃত্যু অবধি বসবাসরত এই মহান শিল্পী গ্রামবাংলাকেও আপন ভেবেছেন পূর্বপুরুষের মতো। রাজনীতির সঙ্গে জড়িত না থেকেও রাজনীতি সচেতন ছিলেন তিনি। তার সাহিত্যে সমসাময়িক বিষয় উঠে এসেছে একেকটা স্লোগানের মতো।
কাজী মহম্মদ আশরাফের এই গ্রন্থ পাঠককে অনেক জিজ্ঞাসার জবাব দিতে সক্ষম। এই শ্রমসাধ্য কাজটি কাজী আশরাফকেও স্মরণীয় করে রাখবে বলে আমার বিশ্বাস। শামসুর রাহমান কবিতা ছাড়াও গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ-নিবন্ধ, অনুবাদ, ছড়া, আত্মজীবনী ও স্মৃতিকথা লিখে গেছেন। সাহিত্যের প্রায় প্রতিটি শাখায় তার এ সফল বিচরণকে পর্যবেক্ষণ করেছেন লেখক। তার আলোচনায় উঠে এসেছে কবির জীবন যাপন, পুরনো ঢাকার ইতিহাস-ঐতিহ্য, চিন্তা-চেতনাসহ নানাবিধ অনুষঙ্গ।
শামসুর রাহমানের সঙ্গে লেখকের সম্পর্ক ছিল গুরু-শিষ্যের। কাজী মহম্মদ আশরাফ কবি শামসুর রাহমানকে নিজের ছন্দশিক্ষক হিসেবে পরিচয় দিয়েছেন। কবিতায় ছন্দ না মানার বিষয়ে কবি বলতেন, ‘মানো না মানো তা পরের বিষয়, কিন্তু আগে তো জানো।’ লেখক কাজী আশরাফ কবিতার পাশাপাশি শামসুর রাহমানের সব ধরনের বই পড়ার আগ্রহ ও অভিজ্ঞতা থেকে বইটি লিখেছেন।
শামসুর রাহমানকে নিয়ে লেখা প্রকৃত শিল্পীর প্রতিকৃতি বইটিতে আমরা পূর্ণাঙ্গ এক শামসুর রাহমানকে দেখতে পাই। সে হিসেবে বলবো- কাজী আশরাফের শ্রম সার্থক হয়েছে। পাঠকের কল্যাণার্থে তিনি যে পরিশ্রম করেছেন তা বিফলে যাবে না। বইটিতে শুধু কবি শামসুর রাহমান নন; একজন মানুষ শামসুর রাহমানকেও দেখতে পাই। যার জীবনজুড়ে কত অভিজ্ঞতা, কত সংঘাত, কত টানাপড়েন, কত সংগ্রাম; তারপরও অবিচল আস্থা।
বইটিতে কবি শামসুর রাহমান সম্পর্কে কিছু ধারণা পাওয়া যায়-
ক. শামসুর রাহমান ঢাকা শহরে জন্ম নেওয়া বড় কবি।
খ. তার কবিতার পরিমাণ সম্ভবত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের চেয়েও বেশি।
গ. তাকে ঢাকাকেন্দ্রিক কবি বলা হয়।
ঘ. তার কবিতা দেহে ও মনে পাশ্চাত্য প্রভাবিত আধুনিক।
ঙ. তার মধ্যে রাজনৈতিক সীমাবদ্ধতা ছিলো না।
চ. তিনি মুক্তচিন্তা ও স্বাধীন কর্মপন্থায় বিশ্বাসী ছিলেন।
ছ. তিনি স্বভাবে নম্র ও স্বল্পভাষী ছিলেন।
জ. ধর্ম ও আচারে কোনো বাড়াবাড়ি ছিল না।
ঝ. তিনি সংসারী হিসেবে সফল ছিলেন।
এছাড়া তার কবিতায় নাগরিক ও লোকজ ঐতিহ্য খুঁজে পাওয়া যায়। যেমন:
সমাহার এ জীবন। কখনো বিবির পান-রাঙা
ঠোঁট রক্তে জাগায় বলক, ছোট্ট মেয়েটার হাসি
আমার ক্লান্তির কালি করে সাফ, দোস্তের দরাজ
দিল বুকে কেমন ভরসা দেয়, ফিল্মি গান গাই।
(স্কুটার ড্রাইভার)
লোকজীবনের নানা প্রবাদ-প্রবচনও তিনি তার কবিতায় তুলে ধরেছেন। যেমন- ‘হাড়ির খবর’, ‘ভিটায় ঘুঘু চড়ানো’ এবং ‘বেজায় দড়’ প্রভৃতি।
শামসুর রাহমান কবিতার তুলনায় গল্প লিখেছেন কম। কারণ তিনি গদ্য লেখায় স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করতেন না। তবে লেখক জীবনের একেবারে শুরুতে গল্প লিখেছেন। তার গল্প সংখ্যা সম্ভবত ছয়টি। যা একটি গ্রন্থে মলাটবন্দি হয়েছিল। গল্পের সংখ্যা কম হলেও প্রবন্ধ ছিলো প্রায় দেড়শ’র মতো। তিনি বিভিন্ন বিষয়ে প্রবন্ধ-নিবন্ধ লিখেছেন। বিষয় ছাড়াও তিনি অনেক কবি-লেখককে নিয়ে লিখেছেন। তাদের জীবনের বিভিন্ন ঘটনা, পরিচয় এবং স্মৃতিকথা লিখেছেন।
বইটি পড়ে আমরা জানতে পারি, শামসুর রাহমান চারটি উপন্যাস লিখেছেন। তার উপন্যাসের বৈশিষ্ট্য ছিল-
১. ইনট্রোভার্ট
২. পুরুষপ্রধান
৩. প্রধান চরিত্র সৃষ্টিশীল পেশার
৪. ঘটনা ঢাকাকেন্দ্রিক
৫. প্রেমমনা
৬. নায়ক বিবাহিত।
শামসুর রাহমানের কবিতা অনেকেই অনুবাদ করেছেন। তবে কায়সার হকের অনুবাদকে বিশ্বস্ত বলেছেন কাজী আশরাফ। কায়সার হকের বইটি প্রায় তিন দশক আগে প্রকাশিত হলেও বর্তমান প্রজন্মের পাঠকের কাছে পরিচিত নয়। কায়সার হকের অনুবাদ সম্পর্কে এই লেখক এও বলেছেন, ‘তার অনুবাদ অন্যদের চেয়ে উন্নত বলেই গণ্য। তবে অনেকটাই লাইন টু লাইন আক্ষরিক অনুবাদ। শুধুই ভাষার অনুবাদ বলে মনে হয়। ভাবের নয়। অথচ কবিতা শুধুই ভাষার অনুবাদে চলে না।’
শামসুর রাহমান কবিতা, গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ ছাড়াও প্রচুর ছড়া লিখেছেন। তার ছড়াগ্রন্থ অনেক। সেসব ছড়ায় শিশুমনস্কতা, সমাজ-দৃশ্য, রাজনীতি, অর্থনীতি, নাগরিক জীবনের সমস্যা উঠে এসেছে। এছাড়া ছড়ায় নির্দিষ্ট মাত্রার পর্ববিন্যাস, চমৎকার অন্ত্যমিল, বিষয়বৈচিত্র্য ও শব্দনির্বাচনে বিশেষত্ব দেখিয়েছেন তিনি।
এখানেই শেষ নয়; তিনি নিজেও অনুবাদ করেছেন। এরমধ্যে দুটি নাটক এবং দুটি কাব্যগ্রন্থ। বইগুলো হচ্ছে:
১. মার্কোমিলিয়ানস: ইউজন ও’ নীল
২. সামার অ্যান্ড স্মোক: টেনেসি ইউলিয়ামস
৩. নির্বাচিত কবিতা: রবার্ট ফ্রস্ট
৪. খাজা ফরিদের কবিতা
সবশেষে বলতে হয়, তার স্মৃতিকথা বা আত্মজীবনী নিয়ে। আত্মকথাধর্মী দুটি বই প্রকাশিত হয়েছে তার। বই দুটি হচ্ছে- ‘স্মৃতির শহর’ ও ‘কালের ধুলোয় লেখা’। প্রথমটি স্মৃতিকথা, পরেরটি আত্মজীবনী। ফলে বলাই যায়, শামসুর রাহমানের বলয় খুব সংকীর্ণ নয়। কাজী মহম্মদ আশরাফের এই বইটি পাঠ করলে শামসুর রাহমানের নামের আগে শুধু ‘কবি’ শব্দটি ব্যবহার করতে ইচ্ছে হবে না আর। সাহিত্যের সবগুলো অভিধা যুক্ত করে তার নাম উচ্চারণ করলে আত্মা তৃপ্তি পাবে বলে মনে হয়। এমন একটি আকর গ্রন্থ আমাদের হাতে তুলে দেওয়ার জন্য তাই কাজী আশরাফকে ধন্যবাদ জানাতে হয়। আশা করি বইটি বহুল পঠিত হবে।
শামসুর রাহমান: প্রকৃত শিল্পীর প্রতিকৃতি
লেখক: কাজী মহম্মদ আশরাফ
প্রচ্ছদ: শতাব্দী জাহিদ
প্রকাশনী: দৃষ্টি
প্রকাশকাল: ফেব্রুয়ারি ২০১৭
মূল্য- ২০০ টাকা