প্রেম জীবনের অবিচ্ছেদ্য বিষয়। এ প্রেমহীন কোনো মানুষের অস্তিত্ব পৃথিবীতে অকল্পনীয়। তাই প্রেম সবার জীবনকেই আলোড়িত করে। অন্যভাবে বলা যায়—প্রেম সবার জীবনকে আলোড়িত করতেই সৃষ্টি। আর এ কারণেই শিল্প-সাহিত্য ও সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ প্রেম। কবিতা ও গানের প্রায় বৃহদাংশজুড়েই প্রেমের উপস্থিতি। এ বাস্তবতাকে মরে রেখে আমরা দেখি—প্রেমের কবিতার সংকলন। এবার এ প্রেমের কবিতা সংকলনের মধ্যে একটু নতুনত্বের সংযোজন হয়েছে। আর এ ধরনেরই একটি উদ্যোগ নিয়েছে পশ্চিমবঙ্গের ‘অচিনপাখি প্রকাশন’। এই প্রকাশনীর প্রকাশক ধমেন্দ্র বিশ্বাস তার সম্পাদনায় প্রকাশ করেছেন— ‘একশো কবিতায় প্রেম: দুই বাংলার প্রেমের কবিতা’। কবিতা নির্বাচনে প্রকাশক দুই বাংলার কবিদেরই সহয়তা নিয়েছেন। তিনি চেয়েছেন একটি প্রতিনিধিত্বশীল প্রেমের কবিতা সংকলন প্রকাশ করতে। আবার উপদেষ্টা হিসেবে রেখেছেন বিজ্ঞ চিন্তক পবিত্র সরকারকে। কবিতার বইয়ে প্রায় ১০৩ জন কবির কবিতা রয়েছে। এই একশ তিনজনের কাছে প্রেম ভিন্ন ভিন্নভাবে ধরা দিয়েছে। তাদের কেউ প্রেম দেখেছেন মানব সংসারে। কেউ বা আবার প্রেম দেখেছেন হতাশার মাঝে বিভাজিত অবস্থায়। আবার কেউ প্রেম দেখেছেন চুম্বনে। এভাবে প্রেমের অভিব্যক্তি একেকজন কবির কাছে একেক রকম। তাই বইয়ের কিছু প্রেমের কবিতা ও প্রাসঙ্গিক আলোচনায় পাঠক পেতে পারেন একটু অন্য স্বাদ। তবে এর মধ্যে যে সব কবির কবিতা ভালো লেগেছে, তা না বললেই নয়। এই বইয়ের প্রথম কবিতা নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর। তার কবিতার শিরোনাম ‘মানব-সংসারে’। কবিতাটির শেষোক্ত পঙ্ক্তি হৃদয় ছোঁয়া বলতে হয়। যখন তিনি বলেন—
মানুষ তোমার প্রেম ছিল।
তবুও, মানুষ, তুমি কিছুই দিলে না
নিখিল সংসারে।
তখন আমরা প্রেমের প্রয়োজন কতটা গভীর তা উপলব্ধি করতে পারি।
অথবা শরৎকুমার মুখোপাধ্যায়ের কবিতা—যখন তিনি বর্তমানের বিভাজিত প্রেম নিয়ে বলেন—
দেখেছ আজকাল থাকে ভালোবাসা দু’দিকে ছড়ানো
সিঁথির দুপাশের চুল, যেমন
হৃদয়ে চৈতন্যে বিভাজিত?
অথবা আল মাহমুদের সেই অমর প্রেমের কবিতা যখন আমরা পড়ি, তখন যেন প্রেমের দোলায় আমরা দুলতে থাকি। যেমন—
তোমার চুম্বন টানে সবখানে। বলো কোথা কূল ও কিনার?
শেষহীন নীলিমায় মিশে আছো, কেন খুঁজি উষ্ণ পদতল
লোভের চুমকি হয়ে জলে ডুবে যাওয়া আমি এক শুভ্র শতদল।
অথবা মহাদেব সাহার কবিতার পঙ্ক্তি—‘তুমি যদি আমাকে না ভালোবাসে আর/ এই মুখে কবিতা ফুটবে না।’
কিংবা নির্মলেন্দু গুণের পঙ্ক্তি—
অইখানে থাকে প্রেম, থাকে স্মৃতি, থাকে সুখ, প্রেমের সিম্ফনি;
অই বুকে প্রেম ছিল, স্মৃতি ছিল, সব ছিল, তুমিই থাকোনি।
অথবা বিরহী হেলাল হাফিজের সেই কবিতা ‘অচল প্রেমের পদ্য’ যখন আমরা পড়ি, তখন আলোড়িত না হয়ে পারি না।
যেমন:
বেদনা আমাকে নিয়ে আশৈশব খেলেছে তুমুল
আর তিলে তিলে শিখিয়েছে সহসশীলতা
নিলাজ নখের মতো দুঃখ কেটে কেটে আমি
আজকাল অর্জন করেছি মৌন উদ্ভিদের অদ্ভুত স্তব্ধতা।
ধীরে ধীরে এ প্রেমের রূপ ও আকার পরিবর্তন হয়েছে। বয়োজ্যেষ্ঠদের কাছে যে প্রেম খুবই আবেগী, সেই একই প্রেম তরুণদের কাছে ধরা দিয়েছে ভিন্নভাবে। সেই পঞ্চাশ পরবর্তী ভীরু থরোথরো প্রেম থেকে তরুণদের প্রেম যেন অন্যরকম। তাই অতি উত্তেজনায় ভরপুর তরুণী বীথি চট্টোপাধ্যায় যখন উচ্চারণ করেন—
ঝটকা মেরে দরজা ভেঙে দেব
তোমার হাত ধরব একটানে
পারলে দুটো চুমুও খেতে পারি
বাদবাকিটা পরিস্থিতি জানে।
তখন সত্যি এ সময়ের তরুণদের প্রেমে আন্দোলিত না হয়ে আর উপায় থাকে না।
আবার এ প্রেম যখন কোনো ফ্যান ভক্ত থেকে আসে, তখন তা যে কোন রূপে আসতে পারে—তাও কবিদের দৃষ্টি এড়ায়নি। তারা বলতে চেয়েছেন, যে অবস্থাতে যেভাবেই আসুক না কেন প্রেম, সেই প্রেমের পূজা দিতে তারা পিছপা হবেন না। এই কারণে মন্দাক্রান্তা সেন কবিতায় বলেন—
তবু যদি দেখা লেখা হয়ে থাকে ভাগ্যে
তখন তো আমি তোমাকে..ওহ, না,…থাকগে।
বোঝাই যাচ্ছে—পুরনো আমালের প্রেমের চেয়ে এখনকার প্রেমের প্রস্তাব পাল্টেছে।
তবু এই হালআমলের অনেক প্রেম প্রকাশে একটু রাখঢাকতে পছন্দ করেন। তাই পিঙ্কি চক্রবর্তী বলেন—
রাতপালকের ছায়া পড়ে অনুভূতির আলোয়
লজ্জাবতী রাত্রি মুখ ঢাকে বুকের গভীরে।
তারপরও এ অল্প বয়সে যখন কোনো বেশি বয়সী নারীর প্রেমে কোনো কিশোর পড়ে, তখন আমরা তা স্বাভাবিকভাবে মেনে নেই। ঠিক তেমনি অংশুমান চক্রবর্তী প্রেমে পড়েন। আর বলেন—
বয়েসে প্রায় দুই বছরের বড়ো, সম্পর্ক আঁকতে যাওয়া ঠিক?
হলুদ শাড়ি, কপালজুড়ে চাঁদ, নরম ঠোঁটে আলতে লিপস্টিক।…
… শহর জুড়ে আলোর কোলাহল, আগুন নয়, জন্ম নেয় গান
ফিনকি দিয়ে উঠছে পাপবোধ, শুরুতে কেন করোনি সাবধান?
অথবা প্রেমের জন্য অপক্ষোয় থেকে শাহাজাদি রুশবাই যখন রচনা করেন শামীম রেজা। তখন আমরাও যেন কবির মতো প্রেমিকার অপেক্ষায় থেকে বলি—
বলো দেখা হবে কবে?
বলি ঝিলাম নদীতে ঝড় উঠলে তবে
ততদিন চারারা গোলাপ দেবে
পৃথিবীতে কত সন্ধ্যা সকাল হবে
কত কত কিশোরীরা পদ্মিনী হবে যৌবনে…
অর্থাৎ প্রেমের অপেক্ষায় থাকতে থাকতে কবি বুড়িয়ে যাবেন। তারপরেও তার কাছে প্রেম আসবে কি না, এখন সেটাই প্রশ্ন। তবু কবি ও আমরা এই প্রেমের জন্য অপেক্ষায় থাকতে প্রস্তুত।
প্রেমেও বিশ্বস্ত থাকার একটি ব্যাপার আছে। প্রেয়সীর প্রতি প্রেম প্রকাশ করে নিজের দায়িত্ব পালন করার চেষ্টা করেন। যেমন কবি মোহাম্মদ নুরুল হক তার ‘শ্রাবণসন্ধ্যা: মাতাল পাহাড়’ কবিতায় প্রেয়সীর প্রতি নিজেকে সমর্পণ করেন। বলেন—
এই যে প্রেমের আকাশ পড়ি পদাবলির সুরে
নদী নদী জলের স্রোতে রোদের জোছনা নাচে
মুঠোবন্দি বাতাসেরা দ্রোহের ছবি আঁকে
গেলাস গেলাস চাঁদ গিলেছি তোমার মুখের ছাঁচে।কবির বুকের দুঃখের নদী: রাতও তন্দ্রাহারা
এবার বুকের মাতাল পাহাড় নামাও জাহানারা।
এভাবে কবিতায় প্রেয়সীর নাম নিয়ে যারা সত্যিকার সততার পরিচয় দেন, তারা হয়তো একজন সাংসারিক প্রেমিক হতে চান। কিন্তু কী পরিমাণ প্রেমিক হতে পারেন, সেটাই প্রশ্ন। তবু এ ব্যর্থ প্রচেষ্টা হয়তো পরিবার সমাজ ও জগৎ সংসার টিকিয়ে রাখার জন্য অনুঘটকের কাজ করে। তারপরও সামাজিকতার সীমাবদ্ধতায় থেকে কবিরা তাদের প্রেমিকাকে ভুলতে পারেন না।
শরাফত হোসেনের মতো কবিরা শব্দ খোঁজেন প্রেমিকার আশেপাশে। আর উচ্চারণ করেন—
আমি ভরদুপুরে, বৃষ্টিতে রোদ্দুরে
এমনকি অন্ধকারে খুঁজে বেড়াই শব্দমালা
তোমার নূপুরে, গলার লকেটে, কানের দুলে
. অথবা দীর্ঘশ্বাসে।
আর সবশেষে কবি এ প্রেম খুঁজতে খুঁজতে অমরত্বের স্পর্শ পান তার প্রেমিকা ছুঁয়ে। এভাবে কবি মেহেদী হাসান রনী যখন বলেন, ‘এ সবের কিছুই আমার দরকার নেই, শুধু একবার/ শুধু একটি বার, তোর হাত আমার রুক্ষ আঙুল ছোঁয়াবো/ আমি অমর হবো’, তখন সত্যি প্রেমকে আমরা অমর না ভেবে পারি না।
সবশেষে ধন্যবাদ জনাতে হয় ধর্মেন্দ্র বিশ্বাসকে। কারণ কবিতা নির্বাচনে তিনি রুচিশীল হতে চেষ্টা করেছেন। অনেকক্ষেত্রে তিনি সফল । তবে বাংলাদেশের কবিদের আরও উপস্থিতি থাকলে বইটিকে যথাযথ প্রতিনিধিত্বশীল সংকল বলা যেত। তারপরও যা হয়েছে, তা অন্যান্য সংকলেনের তুলনায় অনেক ভালো বলতে হবে। আমরা এ ধরনের দুই বাংলার সমন্বিত প্রচেষ্টা আরও দেখতে চাই।