স্বাধীনতা-উত্তরকালের সুস্পষ্ট তিনটি ধারা নিয়ে আমাদের কাব্য-সাহিত্য স্বাধীনতার যুগে উপনীত হয়েছে। ‘মুসলিম এতিহ্য-চেতনা, সমাজ ও সমাজবাদী চেতনা এবং যুগ ও ব্যক্তি-চেতনা আমাদের কাব্য-সাহিত্যের এই তিনটি ভিন্ন খাতকে নিয়ন্ত্রিত করেছে।’ (স্বাধীনতা-উত্তরকালের কাব্য পরিস্থিতি: হাসান হাফিজুর রহমান)। তবে স্বাধীনতা-উত্তরকালে কবিদের মনোযোগ যে পরিমাণে আঙ্গিকের দিকে, শব্দের দিকে, কাব্যসৌন্দর্যের দিকে আকৃষ্ট হয়েছে, সে পরিমাণে নিজস্ব স্বভাব ও যুগ-স্বভাব অনুযায়ী আত্মবিকাশের দিকে আকৃষ্ট হয়নি। হাসান হাফিজুর রহমান এমনটাই আশঙ্কা করেছিলেন।
একুশ শতকে এসেও কবিতার আঙ্গিক, শব্দচয়ন, বাক্যগঠন, উপমা প্রয়োগ—তথা কাব্যসৌন্দর্যের দিকে যতটা না আকৃষ্ট হয়েছেন, ততটা বিষয় নির্বাচনে সমকালীন ভাব পরিস্ফুটনে মনোযোগী হতে দেখা যায়নি। অনেকেই কবিতায় আধুনিকতার কথা বলেন। সম্প্রতি যা ঘটছে; তা-ই তো আধুনিক । সুতরাং মধ্যযুগের কাব্যনির্মাণ কৌশল ওই সময়ের সর্বাধুনিক ধরন হিসেবে বিবেচিত। কেননা কালে কালে কবিতা তার রূপ বদলায়। কবিতায় ছন্দ-ভাব-ভাষা ঠিকভাবে রক্ষিত হচ্ছে কিনা, এ নিয়ে কবিদের ভাবার অবকাশ নেই বলেই মনে হয়।
কবি আহমেদ ফিরোজের ‘রাতের ঘোড়া’ কাব্যগ্রন্থে পাঠ শেষে উপরিউক্ত কথাগুলো মনে এলো। এ গ্রন্থের একটি কবিতার সঙ্গে অন্য কবিতার যোগসূত্র রয়েছে। যে বিষয়টি একটি কবিতা পাঠের পর অন্য কবিতা পাঠে আগ্রহ জাগাবে। ভালো লাগা তৈরি করবে।
কবি বলতে চান—কথার ওপর ভরসা না থাকলেও সবকিছু উজাড় করে দেওয়া যায়। ‘রাতের ঘোড়া’ কবিতায় ‘যা কিছু দেবার সব’ দিয়েছিল কেউ একজন। কারা যেন আসে, এসে ফাঁদ পাতে। আশাতীত মানুষের আগমন। কবি বলেন—
আমার কল্পিত দেহখানি অনেকক্ষণ আলতোভাবেই বুকে ধরে
একটি কথাও না বলে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল
তার আলতো ছোঁয়া, নম্র অথচ দীর্ঘ চুম্বন
অব্যক্ত ভাষায় অনেক কথা বলে গেল;
কবিতায় একটি গল্প বলা হয়েছে। ভালোবাসার গল্প। হয়তো কোনো বিপ্লবী এবং তার প্রেমিকার গল্প। কবিতার ভাষায়—
আমার প্রশ্নে বিস্ময়ের লেশমাত্র ছিল না
মুখ ফুটে বলি
আমি ভেবেছিলাম হয়তো ধরাই পড়ে গেছ
নয়তো আত্মগোপন করে আছ কোথাও
গল্পটি তিনটি দৃশ্যে বিভাজিত হয়েছে। নিজেদের পুরোপুরি সঁপে দিয়ে ক্লান্ত হয় দু’জন। অথবা একজন নারীর ওপর ঘটে যাওয়া একটি ঘটনার প্রকাশ। শেষের দিকে এসে বুঝতে পারি জেলখানায় বন্দি কোনো নারীর ব্যক্তিগত উপলব্ধিও হতে পারে। কল্পনায় তার ওপর আরোহণ করতে পারে তার সোওয়ারীর।
আহমেদ ফিরোজের কবিতায় ক্ষোভ আছে। আছে অন্তর্দহন। প্রতিবাদের ফুলকি ওঠে। শ্লেষ ঝরে পড়ে প্রতিটি পঙ্ক্তিতে। কবিতায় উঠে আসে ভাগাড়ে পড়ে থাকা মানবশিশু। নর্দমায় পড়ে থাকা মানবশিশুকে আশ্রয় দেয় এক ব্যক্তি। তার কবিতায় বিপ্লবী চেতনাও মূর্ত হয়ে ওঠে। জটিল এক দর্শন আছে কবিতায়। রূপকার্থে ‘কান’ ও ‘পিঁপড়া’র আধিপত্য প্রকট হয়ে ওঠে। শয়তানকে দেখতে পাওয়া যায় তার কাব্যে। কবি বলেন—
শয়তানকে আবার দেখা গেল
সঙ্গে সঙ্গেই জুটে গেল একগাদা লোক
ইয়াহু চিৎকারে রাস্তাঘাট বলতে গেলে জমে উঠল
(পাখা নাড়ছে শয়তান)
অথবা
প্রাসাদ থেকে রাজপথে ছিটকে পড়ল শয়তানটি।
(সময়ের ঘণ্টাধ্বনি)
এছাড়া ‘কাল সাত আট, একাশি নব্বই কিংবা সাতাত্তর একাশি’ বাক্যটি কবিতায় বর্ণিত সময়কাল হবে হয়তো। জনতার হ্যাঁ ভোটে নির্বাচিত এক রাষ্ট্রের কথা বলা হয়েছে এখানে। ‘পাখা নাড়ছে শয়তান’ কবিতায় যে দৃশ্যপটের যাত্রা শুরু হয়েছে ‘সময়ের ঘণ্টাধ্বনি’ কবিতায় এসে তা সমাপ্তির রেখা টেনেছে। মনে হয় আলাদা শিরোনামের প্রয়োজন ছিল না। ‘পাখা নাড়ছে শয়তান’ কবিতার যেখানে শেষ; ‘সময়ের ঘণ্টাধ্বনি’ কবিতার সেখানে শুরু। পর্ব ভাগ করা যেত।
কবিতায় ‘পদযুগ’ শব্দ ব্যবহার করেছেন। শব্দটি ‘পদযুগল’ হতে পারে। পাঠকের মনে সংশয় জাগে। ‘স্মৃতিক্রুশ’ কবিতার বিবরণে ঘটনার শুরু থেকে ‘দুই বছর পর…’ এবং ‘দুই যুগ পর…’ বিবৃত হয়েছে।
তাঁর প্রতিটি কবিতায় গভীর এক জীবনবোধ খেলা করে। অন্তর্দহনের বিন্যাস। মুক্তিযুদ্ধকালীন স্মৃতি তাড়িয়ে বেড়ায় কোনো কোনো রমণীকে। স্মৃতির কাছে আত্মসমর্পণ করে নিজেকে। এক গোপন ধাঁধা কবিতার শরীরজুড়ে। আলো-আঁধারির খেলা। কখনো কখনো মনে হয় কথাগুলো খুব স্পষ্ট। আবার কখনো কখনো মনে হয় এর চেয়ে অস্পষ্ট কথা আর নেই জগতে। উপমার ম্যাজিক্যাল মোমেন্ট তৈরি করেছেন। ভাবনার বিস্তার আছে; তবে সমাধানের অন্ত নেই। তিনি ফকনারের নোবেল ভাষণ কবিতায় নিজের মতো করে উপস্থাপন করেছেন। অন্যদিকে ‘স্মৃতিভ্রষ্ট বারান্দায় আয়না অদরকারি’ শিরোনামই যেন একটি কবিতা। বিশদে বলার প্রয়াস থাকে না। বলে দেওয়া যায়, বলা হয়ে যায়। এছাড়া কবিতায় মুক্তিযুদ্ধ মূর্ত হয়ে ওঠে। তাঁর কবিতা রমনা বটমূলে বোমা হামলার কথা স্মরণ করিয়ে দেয়।
স্বপ্ন নাকি বাস্তবতা। যৌবনের আহ্বান অস্বীকার করার ক্ষমতা কার আছে? কবি বলেন—
মধ্যরাতের নির্জনতায় আমরা পরস্পরের
অপ্রত্যাশিত মিলনক্ষণের অভূতপূর্ব অনুভূতির কাছাকাছি।
পাশাপাশি সমসাময়িক অব্যবস্থাপনার বিরুদ্ধে উচ্চারিত হয় তাঁর কণ্ঠস্বর। পোশাকশিল্পে ঘটে যাওয়া দুর্ঘটনা উঠে আসে পঙ্ক্তিতে। কবি বলেন—
হ্যাঙ্গারে টানানো জামা
পাশে পড়ে আছে নগ্ন একখানা জ্বলন্ত শরীর।
(গার্মেন্টস)
কবিতায় তাঁর হিসেব-নিকাশ দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গির জন্ম দেয়। তথাকথিত নামতা বা গণনা নয়। অন্য এক ধারাপাত। কবিতার ভাষায়—
একে একে দুয়ে নয়, দুয়ে দুয়ে চার
ভেতরের আমি আছি বাইরে আচার
(দুয়ে দুয়ে চার)
‘রাতের ঘোড়া’য় যাপিত জীবনের হতাশা, ব্যর্থতা, প্রবঞ্চনা, হাহাকার কবিতার উপজীব্য হয়ে উঠেছে। মানুষের কথা, রাজনীতির কথা, দেশের কথা—সামগ্রিক অর্থে সমকালীন লুকিয়ে থাকা বেদনাগুলো ঠাঁই পেয়েছে কবিতায়। কবি বলছেন, ‘ঘাস, ফুল, নদী নিয়ে কবিতা লেখার দিন শেষ’—অথচ তাঁর কবিতায়ই উঠে আসে এসব। কেননা প্রকৃতি থেকে শিক্ষা নিয়ে প্রকৃতির দেওয়া শব্দ থেকেই কবিতা লিখতে হয়। লিখেছেনও তিনি। তবে ঘাস, ফুল, নদীর বন্দনার দিন শেষ।
তিনি দরিদ্র কবির পক্ষে কথা বলেছেন। চেয়েছেন নিরাপদ সড়ক। কবিজীবন উঠে এসেছে তার কবিতায়। কবির বুকে প্রেম কাঁটা বিঁধে, তিনি স্মৃতি ফেরি করে বেড়ান। তাঁর প্রেমিকারা আজ পরজীবী। প্রেমিকার জন্য যুদ্ধের অপেক্ষা করেন। আসন্ন মৃত্যুর জন্য যোগ্য হওয়ার বাসনা রাখেন। কবি ‘আবিষ্কার’ করেন—
মানুষ কখনো মানুষ হয় না
পশুও কখনো পশুত্ব পায় না
যদি সে নিজেকে না-করে আবিষ্কার।
কবিতায় তিনি মানুষের কথা বলেন। রাজনীতি, মানবতা, প্রেম— এক সুঁতোয় গেঁথে নেন। তাঁর ‘সতর্ক জীবনে’ উঠে আসে গোপনতম গভীর কথা। কবিতার বিষয় হয়ে ওঠে বৃক্ষপ্রেম।
তাঁর কবিতার অন্তর্নিহিত ভাবাবেগ বিভিন্নভাবে আলোড়িত করবে পাঠককে। চমৎকারিত্ব রয়েছে বলার ধরনে, শব্দ নির্মাণের প্রয়াসে। ‘ঝিঁঝিদের স্তনের ওপর ঈশ্বর থাকেন’র মতো চমৎকার উপস্থাপনা, উপমা, দৃশ্যপট বর্ণনা সাবলীল। ভাবনার অতলে গেলেও প্রকাশের আতিশয্য নেই। পাঠককে টেনে নিয়ে যায় শেষ লাইনের শেষ শব্দমালা অবধি। আশা করি বইটি পাঠকপ্রিয়তা পাবে। অমর একুশে বইমেলায় বইটি প্রকাশ করেছে কথাপ্রকাশ। প্রচ্ছদ করেছেন শিবু কুমার শীল। মূল্য রাখা হয়েছে ১৩৫ টাকা।