উপমহাদেশে কলিঙ্গের যুদ্ধের পরে সবচেয়ে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ কোনটি? কোন যুদ্ধের রণক্ষেত্রটি উপমহাদেশে সবচেয়ে বড় ছিল?
এই সব প্রশ্নের উত্তর বাংলাদেশের যেকোনো নাগরিকের জানা। আমাদের জাতির মুক্তির যুদ্ধ উনিশ শ একাত্তর। এ যুদ্ধেই সবচেয়ে বেশি মানুষ মারা যান, আহত হন, উদ্বাস্তু হন। এই যুদ্ধের রণক্ষেত্র ছিল ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইলের। যেকোনো যুদ্ধের অনেকগুলো দিক থাকে। একেক দিক একেক জনের কাছে, একে পেশার মানুষের কাছে গুরুত্ব লাভ করে। বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায়ের কাছে বুদ্ধিবৃত্তিক দিকগুলো প্রাধান্য পায়।
উনিশ শ একাত্তরের যুদ্ধের শেষের দিকে শহীদ বুদ্ধিজীবী আনোয়ার পাশার কাছে যুদ্ধের ভয়াবহতা ও নির্মমতা ছাড়াও স্বাধীনতার স্পৃহা ছিল সবচেয়ে বেশি। তিনি যুদ্ধের ভয়াবহতার মাঝখানে লেখেন জীবনের শেষ উপন্যাস ‘রাইফেল রোটি আওরাত’। যদিও নামটি উর্দু। বাংলাতে রুটি বলি আমরা, নারীকে আওরাত বলি না। এর আগে আনোয়ার পাশার দুটি উপন্যাস প্রকাশিত হয়েছে, ‘নিষুতি রাতের গাথা’ (১৯৬৮) এবং ‘নীড় সন্ধানী’ (১৯৬৮)। বেরিয়েছে একটি গল্পগ্রন্থ ‘নিরুপায় হরিণী’ (১৩৭০) এবং দুটি কবিতার বই, ‘নদী নিঃশেষিত হলে’ ও ‘সমুদ্র শঙ্খলতা উজ্জয়নী ও অন্যান্য কবিতা’। মধ্যযুগের অনেকগুলো কাব্য সম্পাদনাও করেছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের জন্য পাঠ্যগ্রন্থ সম্পাদনাও করেছেন। গবেষণা করেছেন আবুল ফজলের সাহিত্য ও রবীন্দ্রনাথের ছোটগল্প নিয়ে।
‘রাইফেল রোটি আওরাত’ মুক্তিযুদ্ধের প্রথম উপন্যাস। এটিকে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের ‘আনা ফ্রাঙ্কের ডায়রি’ও বলে থাকেন কেউ কেউ। এটিতে আছে যুদ্ধের ভয়াবহতা। আছে যুদ্ধে জেতার সম্ভাবনার ইশারা। আরো আছে বুদ্ধিবৃত্তিক পেশার লোকদের মানসিক দাসত্বের কথা। আনোয়ার পাশা লিখেছেন, “‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি’ শুধু এই গানটি গাইতে গাইতেই সারাটা জীবন কাটিয়ে দেওয়া যায়।” এ কথার ভেতর দিয়ে মুক্তিযুদ্ধে রবীন্দ্রনাথের উপস্থিতি ও অবস্থান বোঝা যায়।
আনোয়ার পাশাকে চিনতে পারলে তার উপন্যাসটি বুঝতে সুবিধা হবে। পশ্চিম বাংলা থেকে যেসব মুসলমান লেখক হিন্দুদের তাড়া খেয়ে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে এসেছিলেন তাদের মধ্যে কিছুটা সাম্প্রদায়িকতা থাকাটা ছিল স্বাভাবিক। সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ তাঁর বিখ্যাত ‘একটি তুলসীগাছের কাহিনী’ গল্পে এমনটিই দেখিয়েছেন। তবে এদের মধ্যে কয়েকজন ছিলেন ব্যতিক্রম। তাদের অন্যতম আনোয়ার পাশা।
‘রাইফেল রোটি আওরাত’ পড়লে শুরুর দিকে পাঠকের মনে হতে পারে বইটি বুঝি আওয়ামী লীগের পজিশন থেকে লেখা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায়ের রাজনীতিসম্পৃক্ততা, দালালী, আইয়ুব খান, মোনায়েম খানদের বুদ্ধির স্তর, তাদের বাঙালি মোসাহেবদের পরিচয় ইত্যাদি বেশ স্পষ্টভাবে ফুটে উঠেছে। পাকিস্তান আমলের আমাদের চেনা কয়েকজন অধ্যাপক ও বুদ্ধিজীবীর পশ্চিম পাকিস্তানপ্রীতি এবং তাদের ব্যক্তিত্বহীন দুর্বলতা লেখক স্পষ্ট রেখায় এঁকেছেন।
কিন্তু যারা আনোয়ার পাশার রচনার সাথে পরিচিত, তারা বুঝবেন আনোয়ার পাশা আসলে কোনো দলীয় অবস্থানে ছিলেন না। ১৯৬৮ সালে প্রকাশিত ‘নীড় সন্ধানী’ উপন্যাসে আনোয়ার পাশার প্রথম জীবনের পরিচয় পাওয়া যায়। সেই উপন্যাসের নায়কের নামও সুদীপ্ত শাহীন। আসলে সুদীপ্ত শাহীনের দ্বিতীয় উপন্যাস ‘রাইফেল রোটি আওরাত’। সেখানে দেখা যায়, পশ্চিম বাংলার একজন শিক্ষিত মুসলমান যুবকের নীড়ের ঠিকানা নাই। আনোয়ার পাশা কোন অবস্থা ও অবস্থান থেকে পূর্ব পাকিস্তানে হিজরত করেছিলেন তা বোঝা যায়। সুদীপ্ত শাহীন এবং তার ছোট ভাই প্রদীপ্ত হাসান ছিলেন প্রগতিশীল ধারার ছাত্র। তাদের নামই সে সাক্ষ্য বহন করে। উপন্যাসের নায়কের প্রিয় কবি ছিলেন সুধীন্দ্রনাথ দত্ত। সমাজ যখন সাম্প্রদায়িক বিষবাষ্পে আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে তখন তারা পূর্ব পাকিস্তানে আসতে বাধ্য হন।
এই আশাবাদ দিয়ে উপন্যাসটি শেষ হলেও আমাদের মনে সংশয় থেকে যেতে পারে। এই আশাবাদ দেশের স্বাধীনতার জন্য। কিন্তু সুদীপ্ত শাহীনের মতো নীড়হারা মানুষের কি ঠিকানা হবে এই দেশে? আজও কি এই দেশে সবার ঠিকানা হয়েছে?
আনোয়ার পাশা পঞ্চাশের দশকের শুরুর দিকেই পাকিস্তানে আসেন। এখানে এসেই তিনি পড়াশোনা করেন। পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতার সুযোগ লাভ করেন। সাহিত্যের সকল শাখায় তিনি কৃতিত্বের স্বাক্ষর রাখেন। মধ্যযুগের সাহিত্য সম্পাদনাও করেন। তো, এই হলো আনোয়ার পাশা সম্পর্কে সাধারণ ধারণা।
‘রাইফেল রোটি আওরাত’ উপন্যাসের কাহিনি মাত্র দুই দিনের। পঁচিশে মার্চ গণহত্যা শুরু হয়, ছাব্বিশে মার্চ সারাদিন কারফিউ চলে। সাতাশে মার্চ কারফিউ তোলা হলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সুদীপ্ত শাহীন, তার স্ত্রী আমিনা এবং শিশু কন্যাকে নিয়ে নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে বের হন। আবার সকাল থেকে শুরু, সারা দিনের বর্ণনা দিয়ে আরেকটি দিন। দুটি দিনের বৃত্তাকার বর্ণনা—যেন একটি চশমার ভেতর দিয়ে লেখক আমাদের পুরো পাকিস্তানের সম্পূর্ণ চিত্র দেখাচ্ছেন। সেই পাকিস্তানি শাসনের প্রথম দিকের বর্ণনা থেকে শুরু। জিন্নাহর বর্ণনা আছে। আছে আইয়ুব খান, মোনায়েম খান, ইয়াহিয়া খানের নানা কর্মকাণ্ডের কথা। আর তাদের এদেশীয় দোসরদের ব্যঙ্গচিত্র।
পাকিস্তানি আমলের শুরু থেকেই বাংলা ভাষার ওপরে আক্রমণের কথা আছে। লেখক অনেকটা ব্যঙ্গের সুরে সেসব বর্ণনা দিয়েছেন। তাদের মোসাহেব বুদ্ধিজীবীদের নানা কীর্তিকলাপ, জাতি হিসাবে আমাদের পিছিয়ে রাখার বিজাতি ষড়যন্ত্রীদের সাথে আমাদের ভূমিপুত্র বেঈমানদের কথাও লেখক তুলে ধরেছেন।
কিন্তু না, উপন্যাসটি বিশেষ কোনো দলের পজিশন থেকে লেখা না। মুসলিম লীগ ও তার বিচিত্র শাখা, জামাতে ইসলামী, নেজামে ইসলামী, পিডিপিসহ স্বাধীনতাবিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর কর্মকাণ্ড অল্পের ভেতর লেখক সুন্দরভাবে তুলে ধরেছেন। স্বাধীনতাবিরোধী দলগুলোর ভয়াবহতা ও নৃশংসতা যেমন আনোয়ার পাশা লিখেছেন, তেমনি পঁচিশে মার্চের রাতে জনগণকে নিয়ে গণপ্রতিরোধ কিংবা যুদ্ধপ্রস্তুতি না নিয়ে আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্যদের তাসখেলার আসরে বসার বর্ণনাও লিখেছেন ৯৮ পৃষ্ঠায়। আছে বামপন্থী দলগুলোর অন্তর্গত কোন্দলের কথাও। আছে তাদের দুর্বলতার কথাও।
উপন্যাসটি ঢাকার বুদ্ধিজীবী মহলের যুদ্ধকালীন অবস্থার যেন দিনলিপি। তবে এর বাইরেও আছে সারাদেশের বর্ণনা। ঢাকার বাইরের নানা জায়গার হামলা, খুন, অপহরণ, লুট, অগ্নিসংযোগের কথাও। আরও আছে পলি ভাবীর আত্মঘাতী বোমা হামলায় বিশ-পঁচিশজন পাকিস্তানি সৈনিকের মৃত্যুর বর্ণনাও। লেখক কিন্তু এপ্রিল আর মে মাসের মধ্যেই উপন্যাসটি লিখে শেষ করেছেন। তিনি চেষ্টা করেছেন সারাদেশের নানা ঘটনা, অঘটনের বর্ণনা দেওয়ার। আছে বিহারীদের প্রসঙ্গ, আছে কলকাতার সঙ্গে বাঙালির সম্পর্কের কথাও। বিহারীদের সম্পর্কে বঙ্গবন্ধুর সাতই মার্চের ভাষণের উক্তি এবং দলটির অন্য নেতা ও কর্মীদের ধারণার সঙ্গে বাস্তবতার মিল খুব কম। লেখকের প্রতিনিধি অধ্যাপক সুদীপ্ত শাহীনের বক্তব্য ভিন্ন রকম। তিনি জামশেদের হুমকির জবাবে স্পষ্ট বলেন, “কাজটা সেই পাঞ্জাবিদের মতো হবে, এখন আমরা যাদের প্রবলভাবে ঘৃণা করছি।” (পৃষ্ঠা-৮৮)
পাকিস্তানিরা কলকাতাকে হিন্দুদের শহর হিসাবেই চেনে। তারা সেখানে বাঙালিদের প্রাণের টানটা বোঝে না। কলকাতা সম্পর্কে শেরেবাংলা ফজলুল হকের মানসিক অবস্থা ও অবস্থানের কথাও সুদীপ্ত শাহীন ব্যাখ্যা করে বোঝান বন্ধুদের। সেই যে ‘নীড় সন্ধানী’ উপন্যাসের নায়ককে যেমন ঠিকানার সন্ধান করতে দেখা যায়, এখানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক এলাকায় থেকেও সুদীপ্ত শাহীনকে নীড়ের সন্ধান করতে দেখা যায়। সাতাশ এবং আটাশে মার্চ ঢাকা শহরের বিভিন্ন জায়গায় তারা আশ্রয় নেন; কিন্তু কোথাও নিরাপত্তা বোধ করেন না। বন্ধুর বাড়ি, বন্ধুর আত্মীয়ের বাড়ি কোথাও তারা আশ্রয় নিতে আশ্বস্ত বোধ করেন না। না করার পেছনে আছে ঢাকার বুদ্ধিজীবীদের—শিক্ষক, অধ্যাপক, শিল্পী আবদুল্লাহ মনসুর, কবি আবুল কাসেম প্রমুখের অবস্থার কথা। আছে দালাল বুদ্ধিজীবী ড. আবদুল মালেক এবং তার ছোটভাই বিজ্ঞানী আবদুল খালেকের ব্যক্তিত্বহীন চরিত্রের এবং দুশ্চরিত্রের কথাও।
ড. মালেকের আড়ালে আমরা দেখতে পাই অনেকটা সৈয়দ আলী আহসানের মতো একজন মানুষকে। এ উপন্যাসে আনোয়ার পাশা ড. মালেককে পাকিস্তানি মিলিটারির হাতে সপুত্র নিহত হতে দেখান। দালালি করেও তিনি পার পাননি। তবে বাস্তবে সৈয়দ আলী আহসান আইয়ুব খানের আত্মজীবনী অনুবাদ করে দিলেও, পাকিস্তানের স্বার্থে রবীন্দ্রনাথকে বর্জন করার পক্ষে বিবৃতি দিলেও মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি ঢাকায় পালিয়ে আত্মরক্ষা করেননি। তিনি মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে কাজ করেছেন। মুজিবনগর সরকারে যোগদান করে সরকারের কাজে সহযোগিতা করেছেন। মুজিবনগর সরকারের অন্যতম প্রধান ব্যক্তিত্ব এইচটি ইমাম তার ‘বাংলাদেশ সরকার: ১৯৭১’ গ্রন্থে অনেক তথ্য জানিয়েছেন। তিনি কৃতিত্বের উপহার স্বরূপ স্বাধীনতার পরে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য়ের দায়িত্ব লাভ করেন সদ্যস্বাধীন দেশের সরকারপ্রধান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষ থেকে। এদিক থেকে ধারণা করি, আনোয়ার পাশা বেঁচে থাকলে এই বইটি প্রকাশ করার ক্ষেত্রে দ্বিধা দেখা দিতো কারণ সৈয়দ আলী আহসান তার নিজেকে নিয়ে আঁকা ড. আবদুল মালেক চরিত্রটি নিয়ে আপত্তি তুলতেন হয়তো।
সুদীপ্ত শাহীনের একটি বাড়ির খুব শখ। এই বাড়ি করার কথা আছে একান্ন পৃষ্ঠায়। কিন্তু সুদীপ্ত শাহীন কোথাও ঠিকানা খুঁজে পান না। তবে উপন্যাসের শেষে দেখা যায় আঁধার রাত কেটে গেলে মাভৈঃ। আলো আসবেই। এই আশাবাদ দিয়ে উপন্যাসটি শেষ হলেও আমাদের মনে সংশয় থেকে যেতে পারে। এই আশাবাদ দেশের স্বাধীনতার জন্য। কিন্তু সুদীপ্ত শাহীনের মতো নীড়হারা মানুষের কি ঠিকানা হবে এই দেশে? আজও কি এই দেশে সবার ঠিকানা হয়েছে?