অকপট: বাদ্যি, দিব্যপুরুষ ও গ্রাস
পাঠক হিসেবে যত ভালো হন না কেন, নতুন বই পেলেই তার ওপর গ্রোগ্রাসে ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে, তেমনটায় আমি বিশ্বাসী নই। বরং ফেব্রুয়ারির মেলা এলে কিছুটা বিব্রতই লাগে। প্রতিটি স্টলেই কিছু না কিছু বই দেখে আগ্রহ তৈরি হয়। কিন্তু নিম্ন মধ্যবিত্ত জীবনে পকেটের স্বাস্থ্য প্রতিনিয়ত এতটা অপুষ্টিতে ভোগে যে, গোটা মেলা ঘুরে সাগর সেচে মুক্তা আনার মতো পাঁচ-ছয়টি বই খুঁজে বের করতে হয়। আবার খুঁজে আনা সব বই যে কেনার দিন থেকেই পড়া শুরু করতে হবে এমনও নয়। শত্রুকে যেমন নৃশংসভাবে পাষণ্ড খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে রক্তাক্ত করে, তেমনি আমিও নতুন কেনা বইগুলোকে অপেক্ষার আগুনে পোড়াই। ওদের নীরব অপেক্ষা, অনুনয় দেখে আমি কোথায় যেন সুখ পাই। ধরা যাক আজ যে বইটা পড়তে ইচ্ছে করছে, কেন যেন আমি সেটা হাতে নেই না। বরং নিজস্ব সংগ্রহের একেবারে ভেতর থেকে আরেকটি বই এনে পড়া শুরু করি।
গত বই মেলায় কেনা আট-দশটি বইয়ের মধ্যে কয়েকটিই মাত্র পড়েছি। বাকিগুলোও মর্জি মতো পড়ে শেষ করবো। নিজেকে নিজে কথা দিয়েছিলাম, এবার যত লেখা পড়বো, তার প্রতিটিরই পাঠানুভূতি লেখককে জানাবো। তেমনই তিনটি উপন্যাস নিয়ে ‘মেলায় কেনা বই’ প্রথম পর্বের আলোচনা। একে রিভিউ ধরার কোনো কারণ নেই, বরং খুব সাধারণ এক নিতান্ত পাঠকের অনুভূতি মনে করাই শ্রেয়।
বাদ্যি: শওকত আলীর প্রদোষে প্রাকৃতজন যারা পড়েছেন, তারা মঈন আহমেদের লেখা বাদ্যি পড়লে একটুও চমকে উঠবেন। না, সস্তা কোনো কপি নয়, বরং শওকত আলী আটশ বছর আগের বাংলাদেশের যে প্রদোষ চিত্র প্রাকৃতজনদের মুখ দিয়ে বলিয়েছেন, বাদ্যি উপন্যাসেও তাই বলার চেষ্টা হয়েছে। তবে সেটা মঈন আহমেদ বলেছেন এতটাই স্বাতন্ত্র আর নিপুণতা বজায় রেখে যে বাদ্যি পরিপূর্ণভাবে প্রদোষে প্রাকৃতজনের চেয়ে আলাদা হয়ে দাঁড়ায়। আমি শওকত আলীর শক্তির সঙ্গে মঈন আহমেদের লেখার তুলনা করছি না, বরং তার চেষ্টা ও পরিশ্রমটুকুকে স্বীকৃতি দিচ্ছি।
অত্যন্ত কঠিন, প্রচুর সাধু এবং সাধারণের কাছে প্রায় দুর্বোধ্য শব্দে মঈন আহমেদ প্রদোষে প্রাকৃতজন স্টাইলে গল্প বলে গেছেন। ভাষা নিয়ে এই অভিযোগ আসবে জেনেও তিনি সচেতনভাবেই যে গল্পের সময়কালের সঙ্গে সঙ্গতি বিধানের লক্ষ্যে ১২ শতকের অন্তিম কালের ভাষারূপ (আমি জানি না সে কালে সত্যি মানুষ এভাবে কথা বলতো কি না) ব্যবহার করেছেন, তা ইউনিক। এর অনুপ্রেরণা যে প্রদোষে প্রাকৃতজন তা নিয়ে কনন সন্দেহ নেই। বলতে দ্বিধা নেই যে, কঠিন হলেও বাদ্যি উপন্যাসে কথ্যভাষার ব্যবহার চরিত্রানুগ এবং সমাজবাস্তবতা প্রকাশের অনুকূল হয়েছে। ঔপন্যাসিকের সামাজিক দায়বদ্ধতার প্রকাশ ঘটেছে ইতিহাসের আশ্রয়ে সমাজবাস্তবতার রূপায়ণে।
প্রাচীন গৌড়ের রাজা লক্ষণ সেনের সভাকবি বাংলা ভাষায় বৈষ্ণব পদাবলীর সূচনাকর গীতগোবিন্দ কাব্যের রচয়িতা জয়দেব এই উপন্যাসের অন্যতম চরিত্র। তার প্রেমিকা পদ্মাবতী এ উপন্যাসের প্রাণ। লেখক নিজেই বিজ্ঞাপনে জয়দেব আর পদ্মাবতীকে বাংলার লাইলী-মজনু উল্লেখ করলেও, শেষ পর্যন্ত বাদ্যি কেবল তাদের প্রেমের কথন নয়। বরং ইতিহাসের আশ্রয়ে দারুণ গবেষণায় লেখক একে পরিণত করেছেন নীরিক্ষা গ্রন্থে। সে নীরিক্ষা ঠিক, না কি ভুল পথে এগিয়েছে, সে বিষয়ে তর্ক হতে পারে। কিন্তু মঈন আহমেদের চেষ্টায় যে খাদ ছিল না তা বোঝা যায়।
বাদ্যি উপন্যাসটিতে জয়দেব-পদ্মাবতীর প্রেম, পরিণয়, বিরহের অপরূপ বয়ানের পাশাপাশি রয়েছে সে সময়কার সমাজ জীবন, সংস্কৃতি, মানুষের ভাষা, পোশাক, খাদ্য এবং আদি বঙ্গ-সমতট অঞ্চলের শ্যামল গ্রাম্য পরিবেশের মনোহরি বর্ণনা। গল্পের প্রয়োজনে লেখক এখানে নিয়ে এসেছেন হিন্দু দেবতা শিব ও তার স্ত্রী দেবী পার্বতীর প্রাচীন সম্মিলিত রূপ অর্ধনারীশ্বরকে। আমরা দেখি পদ্মাবতী কালো পাথরের সেই প্রতিমায় মগ্ন হয়ে নিজেকে অর্ধনারীশ্বরের রূপেও কল্পনা করে। গল্পের প্রয়োজনেই এখানে এসেছে সেন রাজাদের পূর্বপুরুষ আদিসুরের কথা। স্বশরীরে উপস্থিত দেখতে পাই বিখ্যাত পঞ্চ ব্রাহ্মণের অন্যতমদের। এসেছে রাজা হর্ষবর্ধন, বল্লাল সেন, অতীশ দীপঙ্করের নামও।
উপন্যাসটি লিখতে মঈন আহমেদকে ইতিহাসের বইয়ের এদিক ওদিক প্রচুর ছান মারতে হয়েছে তা বোঝা যায়। তবে উপন্যাসটি খামতির জায়গাও আছে। কখনো কখনো লেখক এমন কিছু ঐতিহাসিক চরিত্র ও জিনিসের বর্ণনা সেখানে দিয়েছেন, যা উপন্যাসকালীন সময় চিন্তার পতন ঘটায়। উপন্যাস পড়তে গিয়ে বেশ কয়েকটি প্রশ্ন আমার মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিল। পঞ্চদশ বা ষষ্ঠদশ শতাব্দীর দিকে কী বাঙলায় মসলিনের প্রচলন ঘটেছিল? এ অঞ্চলের আদি ব্রাহ্মণরা কি মাছ খেতেন? উপন্যাসে দেখা যায় মাঝি ভাটিয়ালি গান গাইছে, কিন্তু সঙ্গীতের ভাটিয়ালি ধরনের কি তখন প্রচলন হয়েছিল? এক জায়গায় সুন্দরবনের হরিণের মাংস খাওয়ার কথা আছে। সে সময় কি বাঙলার ভাটিতে সুন্দরবন গড়ে উঠেছিল? একটি চরিত্র বলছে, যিশু আর বুদ্ধ সহোদর! এ অঞ্চলের মানুষ কি তখন যিশু বা খ্রিস্টান ধর্ম সম্পর্কে ওয়াকিবহাল ছিল? এমন আরও অসংখ্য প্রশ্ন তৈরি হয়। লেখক এর উত্তরগুলো জেনে বুঝে লিখেছেন কিনা জানি না। হঠাৎ হঠাৎ চরিত্র এবং পারিপার্শ্বিকতা বর্ণনায় কিছু অসঙ্গতীও চোখে পড়ে। উপন্যাসের নাম বাদ্যি কেন সেটাও প্রশ্ন। হতে পারে কালের আগমন ধ্বনি।
ছোট ছোট এসব খামতি ছাড়া মঈন আহমেদ সত্যি দারুণ একটি উপন্যাস লিখেছেন। বইটি ভাবনার উগ্রেক করে, কৌতুহলের জন্ম দেয়। সময় প্রকাশন থেকে বের হওয়া বইটির দ্বিতীয় সংস্করণ আরও পরিশীলিত, তথ্য নির্ভুল থাকবে বলে আশা করি।
দিব্যপুরুষ: কাকতালীয়ভাবে মঈন আহমেদের বাদ্যি উপন্যাসের পরেই পলাশ মজুমদারের দিব্যপুরুষ পড়েছি। দুটো কাহিনীরই ঘটনাকাল প্রায় কাছাকাছি। দুটি উপন্যাসেই সেন বংশের শেষ রাজা লক্ষণ সেন গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র। শুধু দিব্যপুরুষে বাঙলায় মুসলিম শাসনের বিজয় পতাকা ওড়ার পর রাজ্য রেখে পালিয়ে যাওয়া এক লক্ষণ সেনকেই পাই। উল্টো দিকে যেমন পাই এ দেশ দখল করে বর্বর তুর্কি আর তাদের সঙ্গে এ দেশীয় কিছু সুযোগসন্ধানী ভাড়াটে সেনার লুটতরাজ, গণহত্যা, ধর্ষণ, নির্যাতনের চিত্র, তেমনি দেখা পাওয়া যায় ইসলামের বাণী ছড়াতে সৌম্য কান্তি আর নমনীয়তা নিয়ে উপস্থিত হওয়া দিব্যপুরুষের। প্রাচীন পুণ্ড্রনগরে থেকে যিনি নানাভাবে শোষণের শিকার এ দেশীয় অন্তজ হিন্দুদের দেখিয়েছিলেন সুফি বাণীর সমতাময় পথ। আছে বাঙলায় একসময় রাজত্ব করা বৌদ্ধ পাল বংশের পতন, হিন্দু রাজাদের হাতে নির্যাতন নিপীড়নের শিকার হতে হতে বৌদ্ধ ভিক্ষুদের ক্রমশ দেশছাড়া হওয়া, শিক্ষার পিঠস্থান বৌদ্ধ বিহারগুলো ধ্বংসের কথাও।
দুটি বই পাশাপাশি পড়ার কারণে বেশ কয়েকদিন পঞ্চদশ ও ষষ্ঠদশ শতাব্দীতেই যেন ডুবে ছিলাম। তবে বাদ্যির গল্পের সঙ্গে দিব্যপুরুষের গল্পের পার্থক্য হলো এর প্রকাশ ভঙ্গি। বাদ্যি অনেক বেশি প্রকৃতিঘনিষ্ঠ, প্রেম, কাম ও কল্পনানির্ভর। কিন্তু পলাশ মজুমদার দিব্যপুরুষ লেখায় এমন এক সময়কে বেছে নিয়েছেন, যেখানে সত্যি বলতে প্রকৃতি বা জীবনের সে নমনীয়তা দেখানোর সুযোগ নেই। মৃত্যু, ধ্বংস, অনিশ্চয়তা, অবমাননার সে অরাজক সময়ের গল্পে আর যাই হোক কমনীয়তা আসে না। তারপরও কিন্তু আমরা দেখি, ধর্মত্যাগী সন্তানের প্রতিও মায়ের মমতা, বাবার আক্ষেপ, দাম্পত্য সিদ্ধান্তহীনতা, সর্বোপরী মানব মানবীর প্রেম। তৎকালীন রাজনৈতিক ও সামাজিক বাস্তবতার সঙ্গে পলাশ মজুমদার এসব মানবিক অনুভূতিকে এত সুন্দরভাবে মিশ্রণ ঘটিয়েছেন, যা সত্যি উপভোগ্য।
তবে দিব্যপুরুষ উপন্যাসে কিছু খামতিও থেকে গেছে। যেমন ঐতিহাসিক বেশ কয়েকটি চরিত্রের নাম তিনি কেন যেন পাল্টে দিয়েছেন। বিশেষ করে তুর্কি হামলাকারী ইখতিয়ার উদ্দিন মুহাম্মাদ বিন বখতিয়ার খলজি বা পুণ্ড্রনগরের সেই দিব্যপুরুষ শাহ সুলতান বলখী মাহিসাওয়ারকে ভিন্ন নামে পরিচয় করানো হয়েছে। আমার মনে হয় এটা দরকার ছিল না। কোন ভয় থেকে লেখক এটা করেছেন তা খানিকটা উপলগ্ধি করতে পারি। তবে আমার বক্তব্য হলো, একটা সময়কে স্বীকার করে নিলে তার মধ্যে ঘুরপাক খেতে থাকা চরিত্রদেরও স্বীকার করতে হয়; সে সত্য যত রুঢ়ই হোক।
বর্তমানের প্রচলিত ভাষাতেই বর্ণনা এগিয়ে যাওয়ার কারণে বাদ্যির মতো দিব্যপুরুষে বাড়তি মনোযোগ দিতে হয় না ঠিক। আবার ঘটনা সংঘঠনের সময়কাল ভাবলে ওই প্রাচীন বাংলা ভাষার টানকেও মিস করি। এছাড়া উপন্যাসের কোথাও কোথাও ঘুরেফিরে একই বর্ণনার ভার বেশি। কৃষ্ণা ও নিরঞ্জনের দেখা হওয়ার অংশসহ তাদের ঘিরে আরও কিছু ঘটনা প্রবাহ একটু প্রলম্বিত মনে হয়েছে। তারপরও লেখনির মুন্সিয়ানায় সব মিলে দিব্যপুরুষ বাংলাদেশের ইতিহাসের এক গুরুত্বপূর্ণ সময়ের সরোবরে অবগাহনের দারুণ উপলক্ষ্য।
গ্রাস: পরিবর্তিত সমাজব্যবস্থায় মধ্যবিত্ত মানুষদের চিরায়ত জীবনশৈলিতে প্রতিনিয়ত নানারকম আঘাত লাগে। আর্থিক আঘাত, সম্পর্কের টানাপোড়েন, অতৃপ্ত ইচ্ছা, আদর্শিক অভিঘাত, প্রেম, বেকারত্বসহ কত কিছু যে এই মানুষদের নিয়ে ছিনিমিনি খেলে তার ইয়ত্তা নেই। এসব জটিলতার নামই বোধয় মধ্যবিত্তের যুগযন্ত্রণা। এর মধ্যে জীবন যাপিত হতে থাকে নানা ট্রাজেডি নিয়ে। কিন্তু মাঝে মাঝে নিজেদেরও হয়ে যেতে হয় এমন কোন দুঃখজনক ট্রাজেডির অংশ। রেজওয়ান আহমেদ তার প্রথম উপন্যাস গ্রাস-এ গ্রাম হোক বা শহর, মধ্যবিত্তের সহজ সরল জীবনের ছোট ছোট সুখ-দুঃখের চমৎকার কথামালা এত সুন্দর করে তুলে ধরেছেন, যা পড়ে সত্যি মুগ্ধ হতে হয়। একটি লঞ্চযাত্রার ভেতর রঙ-বেরঙ মানুষের নানা কর্মকাণ্ড, স্মৃতি-বিস্মৃতির চারণ উপন্যাসটিকে যেমন উপভোগ্য করে তুলেছে, তেমনি এর শেষের ট্রাজেডি আমাদের বহুবার দেখা-শোনা ঘটনার বিভৎস অনুভূতিকে উসকে দেবে। তবে সে অনুভূতি কোন পাঠককে কেমন তাড়িয়ে বেড়াবে জানি না, কিন্তু দক্ষিণাঞ্চলের নৌরুটে যাতায়াতকারী মানুষরাই কেবল এর যন্ত্রণা অনুভূব করতে পারবেন। আমার নিজের বাড়ি দক্ষিণের দ্বীপাঞ্চলে বলে হয়তো একটু বেশি আবেগপ্রবণ হয়েছি।
উপন্যাসটি এতটাই উপভোগ্য যে পড়া শেষে কবীর, সুজলা, করিম জ্যোতিষি, শুভ, বিশাখার মতো চরিত্রগুলো মাথার মধ্যে সেঁটে থাকবে। স্বামীর সঙ্গে স্ত্রীর সম্পর্ক, আত্মীয় দ্বারা কিশোরী একটি মেয়ের যৌন হেনস্থার শিকার হয়েও শুধু টিকে থাকার জন্য নীরব থাকা, বাবার সঙ্গে ছেলের দূরত্ব, মায়ের সঙ্গে ছেলের সম্পর্ক, শ্বশুড়ের কাছে পুত্রবধূ থেকে নিজের মেয়ে হয়ে ওঠা, হঠাৎ দেখায় নতুন প্রেমের পরশসহ এমন আরও অনুভূতির খোঁজ দিয়ে যাবে গ্রাস। আবার উপলগ্ধি করতে পারবেন সম্পর্কের রাজনীতি আর বন্ধনের মধ্যেও এক গভীরতর বন্ধনের। কেন এ উপন্যাসের নাম গ্রাস হলো, সে প্রশ্নেরও উত্তর পাওয়া যাবে বই শেষ হলে।
উপন্যাসটির বর্ণনাময় অংশগুলোর কিছু কিছু জায়গা একটু প্রলম্বিত। এর বাইরে গোটা উপন্যাসটিই বেশ। বিদ্যাপ্রকাশ থেকে বের হওয়া সুখাদ্য বইটি পেটুক পাঠক অবশ্যই চেখে দেখতে পারেন।
চলবে…