এ সময়ের তরুণ কবিদের মধ্যে গিরীশ গৈরিক স্বমহিমায় প্রোজ্জ্বল। তার কবিতার দ্যুতি ইতোমধ্যেই ছড়িয়ে পড়েছে কবিতাপ্রেমীদের মাঝে। কবির ‘ক্ষুধার্ত ধানের নামতা’, ‘মা আদি পর্ব ও ‘ডোম’ পাঠকপ্রিয়তা পেয়েছে প্রকাশের পরপরই। তার বর্তমান কাব্যগ্রন্থ ‘মেডিটেশনগুচ্ছ’ বরাবরের মতোই পাঠকপ্রিয়তা পাবে বলে আমার বিশ্বাস। তার যৌক্তিক কিছু কারণও রয়েছে। মেডিটেশনগুচ্ছ পড়ে আমার এমনটাই ধারণা তৈরি হয়েছে। কারণ গিরীশ কবিতায় জীবনবোধের কথা বলেন। কখনো তা বাউল গানের মতো সহজিয়া। কখনো জীবনের গভীর বোধের মতো কঠোর।
গিরীশ বরাবরই কবিতা লেখার আগে নিরীক্ষা করেন। প্রতিবেশ-পরিবেশ তৈরি করেন। ডোম সিরিজ লেখার সময় তিনি বিভিন্ন শবাগারে গিয়েছেন। ডোমদের সঙ্গে মিশেছেন। নিজের হাতে মরদেহ ব্যবচ্ছেদ করেছেন। কোনো কিছু প্রকাশের আগে কবি নিজের ভেতরে তা লালন করেন। ‘মেডিটেশনগুচ্ছ’ লেখার সময় তিনি ধ্যান করেছেন। বই প্রসঙ্গে তিনি একাধিক মাধ্যমে বলেছেন, ‘আমি মেডিটেশনগুচ্ছ লিখেছি গভীর রাতে। প্রথমে স্নান করে নগ্ন হয়ে হয়ে টেবিলে বসতাম, তারপর এক-এক করে অসংখ্য মোমবাতি, আগরবাতি, ঘিতপ্রদীপ জ্বেলে দিতাম। টেবিলে রাখা এক ধরনের রঙিন পানি পান করতাম আর একঘণ্টা ধরে ধ্যানের মিউজিক শুনতাম। এভাবে আমি রাতের পর রাত কবিতা লিখেছি।’
তাই বলতে দ্বিধা নেই, মেডিটেশনগুচ্ছে লুকিয়ে আছে জন্মান্ধের মতো শ্রবণশক্তি, কুকুরের মতো ঘ্রাণশক্তি, ইগলের মতো দৃষ্টিশক্তি এবং ধ্যানী বুদ্ধের মতো বোধশক্তি। তাই তো কবি বলেন—
মানুষ জন্মগত অজ্ঞাতবাসী, ভুলত কবি
মূলত কখনো জানে না নদীর স্বরলিপি।
(জন্মপদ্ম)
প্রথমেই তার কবিতার প্রতীকী ব্যঞ্জনা পাঠককে ভাবিয়ে তুলবে। উপমা প্রয়োগে যথেষ্ঠ যৌক্তিকতার পরিচয় দিয়েছেন। তিনি নগ্ন হওয়ার সাথে মৃত্যুর একটি ঘনিষ্ঠ যোগসূত্র স্থাপন করেছেন। গিরীশের ‘অদৃশ্য’ কবিতায় যে দার্শনিক তত্ত্ব উত্থাপিত হয়েছে, তা স্বাভাবিক জ্ঞানে বোধগম্য না-ও হতে পারে। কেননা তার কবিতায়—
• বধির শুনতে পায়
• গন্ধ দেখা যায়
• বাতাস দেখা যায়
• কিছু কথা পাখির মতো উড়ে যায়।
কবি তাই বলেন—
কিছু গন্ধ দেখা যায় হৃদয় দিয়ে—
অনুভূতির দুয়ারে দাঁড়িয়ে তারা নাচে।’
(অদৃশ্য)
কবি অন্ধকারের কবিতা লিখতে চান। তার জন্য জন্মের পূর্বে ও মৃত্যুর পর থেকে বসে আছেন। অসম্ভব এক মায়াময় আবেগ ফুটিয়ে তোলেন কবি। তার কথায় এতোই মুগ্ধ হয়ে যাই, যেন এমন কথা আগে কখনো শুনিনি। তিনিই কেবল বলতে পারেন—
‘জননীও রঙিন হয়ে ওঠে জন্মদাতার কামের নিমগ্নতায়।’
কিংবা
‘পিতার প্রেমের বেদনায় মায়ের চোখের জল স্পর্শ করতে চাই না।’
(জন্মপুরাণ)
এভাবেই কবি কখনো কখনো স্মৃতিকাতর হয়ে পড়েন। প্রশ্ন ও উত্তরের বাইরেও অনেক কথা চলে আসে। ঝরে পড়ে বেদনা। কবি বলে ওঠেন—
‘বাবা, তোমার ছবি আজ নীরব বৃক্ষ
আমরা তার ঝরে যাওয়া হলুদ পাতা।’
(প্রশ্ন ও উত্তরের বাহিরে)
কবি বটবৃক্ষকে বনসাই হয়ে ওঠার আক্ষেপ ফুটিয়ে তুলেছেন। মানুষও কখনো কখনো বনসাই হয়ে যায়। পরিবেশ-প্রতিবেশ প্রতিকূলে চলে যায়। শুধু সুযোগের অপেক্ষায় থাকতে হয়। বৃহৎ ও প্রকাণ্ড হওয়ার অপেক্ষায় থাকতে হয়।
তার কবিতায় স্থির দাঁড়িয়ে থাকা মানুষের ছায়া থরথর করে কেঁপে ওঠে। অসম্ভব কিছু ক্রিয়াকলাপ ভাবনার বুদ্বুদ সৃষ্টি করে। ভাবনার অতলে তলিয়ে যেতে সাহায্য করে। কেননা মাতৃগর্ভের স্মৃতি কি কেউ বলতে পারে? এই যে আমাদের কেন এত মায়াজাল, জীবনের ভেতর-বাহিরজুড়ে স্তব্ধতা? মানুষ কেন বিলীন হয়। কোথায় হারায়? কবি বলে ওঠেন—
‘জন্মের সত্যতা নিয়ে মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে মনে হয়—
কেন এই মায়াজাল, কেন জীবনের ভেতর-বাহির জুড়ে স্তব্ধতা!’
(আত্মদীপো ভব)
এমনকি কবি অপর কবিতায় ভালোবাসার সংজ্ঞা তুলে ধরেছেন চমৎকারিত্বের সঙ্গে। সেখানে কারণ-অকারণ মিলে ভালোবাসা গড়ে ওঠে।
শুনতে অবাক লাগলেও গিরীশের কবিতায় সূর্যও ভায়াগ্রা খায়। আবার একজনকেই তার জননী, প্রিয়তমা, আত্মজা মনে হয়। পরক্ষণেই আবার মনে হয়—
‘আসলে তুমি আমার কেউ না
এমনকি তুমি তোমারও কেউ না
তাহলে তুমি কে?
কে তুমি?’
(?)
এখানে কবিকে সংশয়বাদী মনে হয়। অস্তিত্বের সংকটে ভোগা মানুষ মাত্র। পাশাপাশি তার অসাম্প্রদায়িকতা উঠে আসে ‘মাইলস্টোন’ কবিতায়। কবি তরবারির চেয়ে ফুলকে বেশি ভালোবাসেন।
কবি শব্দ নিয়ে খেলেছেন। মজার সে খেলা। যা শব্দভান্ডার পূর্ণ হলেই কেবল সম্ভব। তাই সমকালীন কবিদের মধ্যে গিরীশকে পরিশ্রমী বলতেই হয়। তাছাড়া তার অনুসন্ধিৎসু মন একের পর এক যথার্থ শব্দ খুঁজে আনতে সাহায্য করেছে। কবি ‘নয়’ ও ‘ছয়’ সংখ্যা দুটি নিয়ে চমৎকার খেলেছেন। কবির সুরেই বলতে হয়—
‘তুমি আমায় ভাগ করতে ভালোবাসো
তাই নয় ও ছয়ের ভাগশেষই আমাদের প্রেম।’
(নিতম্ব)
গিরীশের কবিতা কখনো কখনো আকাশ হয়ে যায়। তার তিমিরা আকাশে ওড়ে। আবার ইগল সাগরে ডুবে যায়। অদ্ভুত এমন উপমা তার কাব্যগ্রন্থজুড়েই বিদ্যমান। কবি বলেন—
‘একদিন তোমার কবিতা আকাশ হলো
সেই আকাশে আমি— তিমি হয়ে উড়লাম।
একদিন আমার দুঃখ সাগর হলো
সেই সাগরে তুমি— ইগল হয়ে ডুবলে।’
(স্বপ্ন)
গিরীশের স্বপ্নও যেন বর্ণিল। অসম্ভব সব স্বপ্নে ভরপুর কবিতার চরণ। কেননা স্বপ্ন দেখতে কারো অনুমতি নিতে হয় না। এ স্বপ্ন সংক্রামক। ছড়িয়ে পড়ে বাবা থেকে সন্তানের ভেতরে।
তার কবিতায় একটি গল্প থাকে। তবে কবিতাগুলো দীর্ঘ নয়। কিন্তু গল্পগুলো অনন্ত। সে গল্প সবার। সব ঘটনার প্রতিনিধিত্ব করে। বর্ণনায় সাবলীল, উপমায় সহজবোধ্য। তিনি কঠিনকে কত সহজভাবে তুলে ধরেন— ‘আমিও একা— সূর্যের মতো ডুবে গিয়ে জেগে উঠি।’(ডুব)
সূর্যের মতোই কবিও একা। সূর্যের মতোই জেগে ওঠেন। একাকিত্ব বোধের উৎকৃষ্ট উদাহরণ তিনি এভাবেই তুলে ধরেছেন। পাখির চেয়ে মানুষ বেশি পরাধীন- এমনতর অসংখ্য দার্শনিক তত্ত্ব খুঁজে পাওয়া যাবে গিরীশের কবিতায়। তার কোন কোন চরণ বিপরীতমুখী হলেও ভাবার্থে মুখোমুখি মনে হয়। যেমন—
১. পায়ে পায়ে উড়ে যায়
২. ডানায় ডানায় হাঁটে
৩. ভৈরবী বাঁশির ঘ্রাণ
৪. অন্ধ আলো ও বোবা সময়
৫. তিমি হয়ে ওড়ে
৬. ইগল হয়ে ডোবে।
কবিতার উপমায় বৈচিত্র্য এনেছেন গিরীশ।
১. মায়ের আঁচলের মতো পবিত্র প্রেম
২. নদীর স্রোতে মায়ের মমতার স্বরলিপি
৩. সবুজ চুলের কবি
৪. সাদা রক্তের কবি
৫. হাসির শব্দ কান্নার মতো
৬. ঋতুস্রাবহীন মেঘ
৭. ক্ষয়ে যাওয়া নদী
৮. বেদনার পুকুর।
কবিতায় গিরীশের নতুন কিছু অভিজ্ঞান আমাদের ভাবায়। যেমন—
১. মিছিলের কোনো শব্দ নেই
২. মোমবাতির কান্নার শব্দ
৩. নিঃশ্বাস নেবার নাক নেই
৪. খাদ্য গ্রহণের মুখ নেই
৫. খেজুর রসের আবিষ্কার
৬. বোবা বলছে বধিরকে
৭. বাতাস অন্ধ
৮. বাতাস পঙ্গু
৯. মানুষ মৃত্যুর সময় সত্য বলে কেন
১০. বিড়ির ব্রান্ডের নাম পৃথিবী
১১. রাবীন্দ্রিক মাথায় নেতাজির টুপি
১২. জলের মাঝে পানি মিশে অশ্রু হয়ে যায় প্রভৃতি।
কবি তার ‘ফসল’ কবিতায় লাঙল ও লিঙের বিভেদ সম্পর্কে চমৎকার বর্ণনা দিয়েছেন। কবির এখানে লাঙল নেই লিঙ্গ নেই। তার আছে কলম আর খাতা। তাই তিনি কলমকে লাঙল আর লিঙ্গ, খাতাকে জমি আর যোনি বানিয়ে দিতে প্রার্থনা করেছেন। কবি অন্তরতম নির্জন কবিকে প্রশ্ন করছেন—
‘তুমি আমায় বলো—
কাব্যধ্যান কেন এত নির্মম?’
(ধ্যান)
তার রঙের মেলা কবিতায় রঙের খেলা দেখি। লাল, নীল ও হলুদ রং মিশে কালো রং হয়ে যায়। অর্থাৎ কাউকে নিন্দা করলে সেই নিন্দা একসময় নিজের ওপরই বর্তায়। মানুষ নিন্দুককেই অপছন্দ করে। নিন্দিতকে বাহবা দেয়। গ্রহণ করে। তার কবিতায় ‘ভুমিষ্ট শিশুর কান্না বাঁশির সুর হয়ে ধ্বনিত হয়’। কবি চোখ বুজলেই শ্মশান দেখেন। অথচ কোথাও বিড়ি ধরানোর আগুন পাচ্ছেন না। তিনি আগুন দিয়ে জীবনের ধারাপাত জ্বালাতে চান। কবি বলেন—
‘রবিবাবু— একফোঁটা আগুন ধার দেবেন?
আমাদের জীবনের ধারাপাত জ্বালাবো…’
(ঋষিঋণ)
তাই মাঝে মাঝে মনে হয়, গিরীশের কবিতা যেন আস্ত একটি গল্প। কবিতার আদলে নিটোল, নিখাদ গল্প বলে যান। কবিতার শরীরে এত সহজে এত সুন্দর গল্প ঠেসে দেওয়া যায়, তা মেডিটেশনগুচ্ছ না পড়লে অজানাই থেকে যেত। আমি বইটির বহুল প্রচার ও পাঠ কামনা করছি।
বলে রাখা ভালো, গ্রন্থটির এক পৃষ্ঠায় অলঙ্করণ, অন্য পৃষ্ঠায় কবিতা রয়েছে। ১১২ পৃষ্ঠার বইতে কবিতা রয়েছে অর্ধশত। ফলে সঙ্গত কারণেই শিল্পীদের মাধ্যমে অলঙ্করণ করতে হয়েছে। এ কাব্যগ্রন্থের অলঙ্করণ করেছেন নাসিফ আহমেদ (বাংলাদেশ), শ্রী গোপাল চন্দ্র নস্কর (ভারত), ভিতোর সান্তোস (পর্তুগাল), লুইডমিলা কোগান (আমেরিকা), ফার্নান্দো কোবেলা (ভেনেজুয়েলা), আইরিনা অরলভ (আমেরিকা)।
মেডিটেশনগুচ্ছ
গীরিশ গৈরিক
প্রকাশক: কথাপ্রকাশ
প্রচ্ছদ: আইয়ুব আল আমিন।
মূল্য: ৪০০ টাকা। বইটি পাওয়া যাচ্ছে বইমেলার ০৯ নম্বর প্যাভিলিয়নে