সাহিত্যের ইতিহাসে পত্রকাব্যের ঐতিহ্য প্রাচীন। কবি ওভিদের পত্রকাব্য অনুপ্রাণিত করেছিল মধুসূদনকে ‘বীরাঙ্গনা’ কাব্যরচনায়। প্রণয়ী বা প্রণয়িনী প্রেমাস্পদ কিংবা প্রেমাস্পদাকে পাঠায় তার প্রেমলিখন, কবিতার সুষমায় বিজড়িত হয়ে সে লিখন সাধারণত পত্রকাব্য হয়ে ওঠে। অথবা যেখানে পত্রের সুযোগ নেই, সেখানে মেঘ করে প্রণয়-সংবাদ বহন, কালিদাসের ‘মেঘদূত’ সেই ভাবনাকে কাব্যচ্ছন্দে মেঘমন্দ্র করে রেখেছে। আকাশপথে সঞ্চরণশীল হংসবলাকা প্রণয়কথা বয়ে নিয়ে গেছে নল-দময়ন্তী সংবাদে। আজ এই ভাবনাগুলো অচল হয়ে এসেছে, যখন বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ আর অনামিকার সংযোগে তুড়ি দেওয়ার অনুপল সময়ের মধ্যে মেসেজে, ইনবক্সে আমরা একে অন্যকে চিন্তাবীজ প্রেরণ করতে পারি। যোগাযোগের এই সৌলভ্য দূরকে নিকট করেনি, বরং দূরকে সুদূরতর করে তুলেছে হৃদয়ের দিক থেকে। মুছে গেছে প্রতীক্ষার সৌন্দর্য, বিরহের বেদনাকারুণ্য, সাময়িক বিচ্ছেদের কাব্যমধুরিমা। এমন একটা সময় বুঝি ওই এলো, যখন আমাদের পাশের মানুষটিই হয়ে উঠবে আমাদের সব থেকে অপরিচিত। প্রণয়ের এই ঘনীভূত সংকটের কালে কবি অপাংশু দেবনাথ তাঁর সাম্প্রতিক কাব্যগ্রন্থ ‘মৃত্তিকাঋণ মেঘমিতাকে’ লিখেছেন পত্রকাব্যের প্রাচীন রীতির কাছে ফিরে গিয়ে। এটি একটি অখণ্ড কাব্য, একটি মাত্র চিঠির রূপ নিয়েছে এ মলাট থেকে ও মলাট পর্যন্ত। আঙ্গিক বা ফর্মের দিক থেকে তাঁকে এই হেতু অসম্ভব সাহসী হতে হয়েছে।
মেঘকে এখানে চিঠি লিখছে মৃত্তিকা। ‘প্রিয় মেঘমিতা’ সম্বোধনে পত্রকবিতা শুরু হয়ে শেষ হয়েছে ‘চির বাউল ভুবন’ নামাঙ্কনের মধ্য দিয়ে। নিসর্গচেতনাকে অতিক্রম করে তবু মানবিক প্রণয়ের ছায়ানট জমাট হয়ে ওঠে কবিতার অক্ষরে। ‘ট্রেনিং ফেরৎ সীমারক্ষী বুঝি! এত ছোটো / কেশ-বিন্যাসে প্রার্থিত মানব নও আমার’ –প্রেমিকার এই ‘শৈশবোক্তি’ চিনিয়ে দেয় এ কবিতার পাত্রপাত্রীকে, মেঘ আর মাটি নয় তারা আর, তারা মানুষ, অথবা মেঘ বা আকাশের মানবায়ন বা পারসনিফিকেশান অচিরেই পাঠকের চেতনায় প্রেমের ভুবনকে অপাবৃত করে অনায়াসে। একটি ঈশ্বরবিশ্বাসী মেয়ের প্রতি এক চিরনাস্তিক বাউলধর্মী যুবকের আত্মগত উচ্চারণ এ কবিতার মর্মবস্তু। মেদুর হয়ে ওঠে ভাষারীতি, কখনো আচম্বিতে মেদুরতা ভেঙে ফিরে আসতে চায় আরক্ত সমাজচেতনায়, সব কিছু জড়িয়ে থাকে এক বিষণ্ন মন কেমনের অনুভব, সেই অনুভব জনান্তিকে মর্মরিত হয়, গুঞ্জরিত হয়।
মৃত্যু সরণী বেয়ে মানুষের ক্রমাগত প্রস্থান
কবিতায় স্থানিক চিহ্ন এসেছে সচেতনভাবেই। মৃত্তিকা তো একেবারে স্থান-কাল অনবচ্ছিন্ন হতে পারে না। কবির শহর আগরতলা ‘বাইপাস থেকে প্রান্তসীমা ছাড়িয়ে, রহস্যাবৃত বুদ্ধ-বলয়ের দিকে আমাদের স্বপ্ন গৃহ, রঙ নীল’ পঙক্তিতে আশ্রয় পেয়েছে। বাইপাস, বুদ্ধমন্দির, চৌমূহনী প্রভৃতি স্থানাঙ্ক আগরতলা শহরকে চিনিয়ে দেয়। হয়ত বুদ্ধমন্দিরে অপরাহ্নবেলায় দেখা হত মেঘের সঙ্গে মৃত্তিকার –অন্তত এমন ভাবতে ভালোই লাগে। এবং সেই শহর যার বুকের নিচেই কিছুটা পুরোনো হয়ে গেলেও জমে আছে আশি সালের দাঙ্গার স্মৃতি_ ‘মনে আছে তোমার? ওই যে নির্মোহ অন্ধকারে বলেছিলাম –আশির ভয়ার্ত সে ভগ্ন বিকেল ও ত্রস্ত মানুষের ক্ষত কথা’ – এমন মনে করিয়ে দেওয়া সামাজিক দাগ, রইস্যাবাড়ি, ফুটামাটিয়া, মান্দাই, অর্জুন ঠাকুরপাড়া দাঙ্গাবিক্ষত দগ্ধীভূত গ্রাম, দগ্ধ হয়ত কবিরও শৈশব কৈশোর, গণ-শ্মশানের মৃত্যু সরণি বেয়ে মানুষের ক্রমাগত প্রস্থান বারবার ফিরে আসে। তবু তার পরও ‘আমারও তো চাই আত্মভোলা জীবন’। অনেক হারানোর পর, পরিচিত কোনও আন্দোলনে সমাধান নেই জেনে কবি হয়ত হাত পাতেন নিসর্গচেতনার মত অপার্থিব-পার্থিব কোনও মেঘমিতার কাছে, যার প্রতি মৃত্তিকার একমাত্র ঋণ।
‘তোমার বিনয়ের কাছে আবার নতজানু হই। ভাষাহীন জীবনে মুক্ত ছন্দ তুমিই।‘—এই সিদ্ধান্তিত প্রত্যয় এ কবিতার অন্তঃশীল প্রেরণা। প্রায় মিস্টিক উচ্চারণ আমাদের ভাবনাবিশ্বকে দোলা দেয় এসব পঙক্তি—‘আকাশ ও মাটির মাঝ বরাবর একাকী যে অপার বাউল হাওয়া বয়ে যায় দূরে, আমাদের হৃদয়ে –অনুভূত হয় তোমার?’ আকাশ ও মাটি তো চির বিচ্ছিন্ন, তাদের মিলন অসম্ভব, সেই নিত্যবিচ্ছেদের শূন্যতার হাওয়াই যেন তাদের মিলনের সুপ্রতীক। অথবা এমন আশ্চর্য মুগ্ধকারী চরণ— ‘চোখ রাখো শান্ত আকাশে –দেখো, কতোটুকুন ক্রমাগত ঘূর্ণায়মান নীল মাথার ‘পরে। মিহি রোদ ও হাওয়ার যে ঘ্রাণ ভেসে আসে –তা তোমারই শরীর ছুঁয়ে আসা অফুরাণ সুখ’—এইখানে পৌঁছে কোনও হেমন্তের বিকেলে ত্রিপুরার মেঘনীল আকাশের নীচে এসে দাঁড়াবার আমন্ত্রণ জানাতে পারেন কবি তাঁর অব্যর্থ অধিকারে।
কাঙ্ক্ষিত ব্যর্থতার ভেতর দিয়ে এ কাব্য সার্থকতা পেয়েছে
তবু এই মুক্তছন্দ কবি ধরে রাখতে পারেন না, সময় তাঁকে নিয়ে যায় বন্দীদশায়, তাঁকেও বলতে হয়, ‘মুক্তছন্দ হৃদয় মুহূর্তে রুদ্ধদল হয়’ কারণ, তিনিও যে ‘অগ্নিরথে গমন’ চাননি, চেয়েছেন ‘যৌথ উঠোন তোমার সাথে’। এখানেই এ কাব্যের সমস্যা, হয়ত এ সমস্যা মানবজীবন জুড়েই। আর এই কারণেই কবি সন্ন্যাসী নন, অনেক কিছু ভুলে গিয়ে আকাশের নিচে তিনি হাত পাতেন ঠিকই, কিন্তু যখন অগ্নিপক্ষ ইকারুসের ডানায় ভর দিয়ে সূর্যপ্রয়াণের সময় আসে, তখনই পায়ে পায়ে জড়িয়ে যায় পৃথিবীর নীলমণিলতা। ফলত মৃত্তিকা মেঘকে নিয়ে কবিতা লিখতে পারে বটে, কিন্তু মেঘের দেশে যাদুকর লামার মতো উড্ডীন হতে পারে না। এই কাঙ্ক্ষিত ব্যর্থতার ভেতর দিয়ে এ কাব্য সার্থকতা পেয়েছে।
সমস্ত কবিতাটি অক্ষরবৃত্তের ‘মেজাজি আমেজে’ লেখা, যদিও মূলপর্বে প্রায়শই শৃঙ্খলাবিহীন করেছেন কবি। হয়ত বা ইচ্ছে করেই। হয়ত বা তাঁর ভেতরের কথা বাইরে বেরিয়ে আসতে চেয়েছে ব্যাকরণ না মেনেই। কিন্তু কবিতার বইয়ের ৫৭ পৃষ্ঠায় ‘দৈন্য’ কী করে লিখে বসলেন অপাংশু, কে জানে? এমন অনবধানজনিত ভ্রান্তি তিনি যেন আর না করেন –বিনীত প্রার্থনা করি। অপাংশু এ মুহূর্তে ত্রিপুরার প্রতিশ্রুতিমান কবি, তাঁর কাছে আমাদের আশা অনেক, তাই এত কথা বলছি।
এ রাজ্যের তরুণতম প্রতিভাবান শিল্পী পুষ্পল দেব প্রচ্ছদ এঁকেছেন অনায়াস দক্ষতায়। বইটি প্রকাশ করেছেন ‘স্রোত প্রকাশনা’। বইয়ের প্রচ্ছদ, কাগজ ঝকঝক করছে। এ জন্য প্রকাশক ধন্যবাদার্হ। কিন্তু এত মুদ্রণ প্রমাদ কেন? প্রায় প্রতি পাতায় বানান ভুল আছে, সেগুলো কবিতাপাঠে বিঘ্ন ঘটায়। অপাংশু এ বইয়ের প্রুফ দেখে দিলে ভালো হতো। আমি ভুল বানানগুলো এখানে উল্লেখ করলাম না। আশা করব, পরবর্তী সংস্করণে আমরা নির্ভুল বানানে এ কাব্যের পরিবেশনা চাক্ষুষ করতে পারব।
সবশেষে বলি, ‘মৃত্তিকাঋণ মেঘমিতাকে’ একটি সুখপাঠ্য বই। যে বেদনার্ত শৈশব কৈশোর থেকে কবি উত্তীর্ণ হয়েছেন যৌবনে, মানুষের কাছ থেকে সরে এসে জনান্তিকে ঋণস্বীকার করেছেন তাঁর মেঘমিতার কাছে, তাঁর সেই যাপনের চিহ্নপত্র এই কাব্যের সর্বাঙ্গে জড়িয়ে আছে। কবি অপাংশু দেবনাথের কাব্যচেতনা আরও অন্য রকম মোড় নিক, আমরা আরও নবতর অনুভবের কাছে ঋণী হয়ে উঠি।