মহাকালের মহাশূন্যতায় পঁচিশ বছর খুবই কিঞ্চিত একটা কালখণ্ড। কিন্তু আমাদের শারীরিক জীবনের পরিপ্রেক্ষিতে এই সময়টা বেশ বড় একটা সময়ই বৈ কি। সেটা যদি আবার শিল্প-সাহিত্যচর্চা-বিষয়ক হয়, তাহলে তো কথাই নেই। এত বছর সময় দিয়ে লেগে থাকা কিংবা একটি প্রকাশনার রেশ এবং আগ্রহ এতদিন ধরে রাখতে পারা অনেক বড় ব্যাপার। কবি মজিদ মাহমুদের মাহফুজামঙ্গল প্রকাশিত হয় ১৯৮৯ সালে। এটিই তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ। তারপর আরও অনেক গ্রন্থের জনক হয়েছেন তিনি। সেগুলোর মধ্যে কাব্যগ্রন্থ যেমন রয়েছে, তেমনি রয়েছে গবেষণা ও প্রবন্ধগ্রন্থ, গল্প-উপন্যাস, শিশু কিশোর রচনা ইত্যাদি। কিন্তু সবকিছু ছাপিয়ে তিনি হয়ে গেছেন মাহফুজামঙ্গলের কবি।
এরই মধ্যে মজিদ মাহমুদকে নিয়ে ছোটকাগজের বিশেষ সংখ্যা হয়েছে। সেখানে লিখেছেন বাংলাসাহিত্যের স্বনামধন্য লেখকরা। সেখানে আমার লেখার সৌভাগ্য হয়নি। সম্পাদকের আমন্ত্রণ পাইনি বলে জানাই হয়নি এ রকম একটি সংবাদ। যা হোক, আমার সৌভাগ্য বা দুর্ভাগ্য যে ওই সংখ্যাটিও আমার সংগ্রহে নেই। দুর্ভাগ্য এজন্য যে এটা আমার সংগ্রহে থাকা উচিত ছিল। আর সৌভাগ্য এজন্য যে, ওটা পড়লে মাহফুজামঙ্গলবিষয়ক আমার উপলব্ধি ও প্রতিক্রিয়া মৌলিক থাকত না।
সাহিত্যর চরিত্র নিয়ে কথা হলে দেখা যায় ওই চরিত্রের একটা কল্পিত অবয়ব মনের অজান্তেই নির্মিত হয়ে যায়। কথাসাহিত্যে বিষয়টি বিস্তারিত করার সুযোগ বেশি থাকে বলে ওই কল্পিত অবয়বটি খুব বেশি কল্পনার সুযোগ পায় না। লেখকের বর্ণনায়, কথকের ভঙ্গিমায়, চরিত্রের অভিব্যক্তিতে তার একটি মূর্তরূপ পাঠকের মনোশ্চক্ষে গেঁথে যায়। কিন্তু কবিতায় সে সুযোগ কম থাকে বলে পাঠকের কল্পনার বিস্তারটা বেশিই হয়। স্বল্পপাল্লার কবিতার ক্ষেত্রে বেশিরভাগ সময় পাঠকের ওই কল্পনা করার অভিলাষ জন্মায় না। কিন্তু দূরপাল্লার কবিতা হলে, কবিতায় কোনো একক নারীর উপস্থিতি বেশি হলে, কবির নির্মিত কাব্য-নায়িকা নৈর্ব্যক্তিক না হলে পাঠক মনে মনে তার একটা অবয়ব দাঁড় করিয়ে ফেলে। কারণ কবির পৌনপুনিক উপস্থাপনে পাঠক কিছুটা বাধ্যই হয় এরকম একটি অবয়ব দাঁড় করাতে।
তার আগে অন্য কিছু কথা বলা যেতে পারে
কাব্য নায়িকাকে যখন নৈর্ব্যক্তিকতা থেকে মুক্ত করে সুনির্দিষ্ট করে দেওয়া হয় নাম দ্বারা তখন পাঠকের তৃতীয় নয়ন আরও তাড়াতাড়ি এবং সহজেই একটা অবয়ব দাঁড় করায়। পুরো মাহফুজামঙ্গল কাব্যগ্রন্থটি পাঠ করার পরও আমি অবাক হয়ে লক্ষ করলাম এ রকম কোনো অবয়ব মনের ভেতরে সৃষ্টি হলো না। কেন? সেটা নিয়ে ভাবা যেতে পারে গভীরভাবে। তার আগে অন্য কিছু কথা বলা যেতে পারে।
মাহফুজামঙ্গলের কেন্দ্রে আছে মাহফুজা। মাহফুজাকে নিয়েই কবির সকল আত্মপ্রকাশ, আকুতি এবং বক্তব্য। কিন্তু এই আত্মপ্রকাশ যখনই ধীরে ধীরে অতিব্যক্তিগততা থেকে শিথিল হতে থাকে, আকুতি যখনই এক মাহফুজা থেকে অন্য মাহফুজার প্রতিনিধি হয়ে ওঠে, তখনই কবির বক্তব্যের ধারটা আঁচ করা যায়। তখন ওই কেন্দ্র একটু একটু করে ভাঙতে থাকে। তখন ওই কেন্দ্র একটু একটু করে তার মূল-কেন্দ্র থেকে সরে যায়।
এভাবে আরেকটি কেন্দ্র নির্মিত হয়। মজার ব্যাপার হলো, এই যে একের পর এক কেন্দ্র নির্মাণের খেলা চলে, তাতে আগের কেন্দ্রের গুরুত্ব ও মাহাত্ম্য কমে যায় না। কেন্দ্রের কেন্দ্রাতীত আকর্ষণও কমে না। আপাত বিকেন্দ্রীকরণের এই খেলায় সব কেন্দ্রই সমান গুরুত্ব বহন করে করে পুরো কাব্যগ্রন্থকে প্রদান করে এক সম-ঘনত্বের শিল্পে। কিন্তু সম-ঘনত্বের এই শিল্পের নির্মাণে কবিকে জটিল মনস্তত্বের প্রতিনিধি হতে হয় না। চাতুর্যতার আশ্রয়ও নিতে হয় না। তাঁর বাক সক্ষমতা চাতুর্যহীন। আছে সরলতা। তার এই সরলতা শুধু ভাষায় নয়, প্রকরণে এবং চিন্তায়ও। কিন্তু মজার বিষয় হলো এতসব সরলতা ও কেন্দ্র বিনির্মাণের ফলেও তাঁর কবিতা তরল হয়ে যায়নি। ফলে তাঁর কবিতাগুলোকে অনেক আপন মনে হয়। এত আপন যে কঠিন রকম বিশ্লেষণী মনে হয় না। কিন্তু খুব অনুভবী অনুভবী লাগে। যেন মনের সবচেয়ে কোমল জায়গার সাথে দোস্তি তাঁর। অনুভবে অনুভবে তার অস্তিত্বের সুখ পাওয়া যায়। আজকাল তো কবিতার ভেতরে প্রবেশের জন্য পাঠককে সুচতুর কৌশলী হতে হয়। কবিরা যেন দিনকে দিন হয়ে উঠছেন জটিলতাপ্রেমী প্রকৌশলী। তাঁদের প্রকৌশলে একটুখানে প্রবেশের জন্য তো পাঠককে কমপক্ষে কৌশলী হতেই হয়।
মাহফুজা যেন এমন এক ভোগ্যবস্তু
মজিদ মাহমুদকে এক্ষেত্রে ব্যর্থই বলতে হবে। কারণ তিনি সুচতুর প্রকৌশলী নন। তিনি সাধারণ আকুতি নিয়ে হাজির হন মাহফুজাকে নিয়ে। এই আকুতিই তার আত্মপ্রকাশী-স্মারক। তাঁর উপলব্ধি ও প্রতিক্রিয়া সরলার্থিক। এসবের সমন্বয়ে যা গঠিত হয় সেটাই মাহফুজামঙ্গলের মূল বক্তব্য।
এই বক্তব্যের মধ্য গিয়ে দেখা যায় মাহফুজা কখনো ঈশ্বরের প্রতিস্থাপক। কখনো দেবীর আসনে আসীন। কখনো ইবাদতের নামে যৌনাবেদনময়ী। কিন্তু এতসব কখনোর মধ্য থেকে ধীরে ধীরে বের হয়ে আসে আসল মাহফুজা। এই মাহফুজা যেন এমন এক ভোগ্যবস্তু, যার প্রাণ আছে কিন্তু প্রাণাধিকার নেই। নির্যাতনে নির্যাতনে তার যে রূপ দাঁড়ায় শারীরিকভাবে কিংবা সত্তায় তারই অনুপুঙ্খ সর্ব-বিদারক দৃশ্য উপস্থাপন করেন কবি। এখানেই তার আকুলতার মাধ্যমে বক্তব্যটিও প্রকাশিত হয়।
তাতে যা দৃশ্যমান হয়, যা আমাদের মতো পাঠককে আক্রান্ত করে তাতে সব অত্যাচারিত হতভাগ্যের কথাই মনে করিয়ে দেয়। এ জন্য রক্তমাংসের অবয়ব নিয়ে মাহফুজার কোনো অবয়ব পাঠকের মনে কল্পিত হয় না। মনের ভেতরে যা প্রতিফলিত হয় তা সব নির্যাতিত মাহফুজার করুণ পরিণতি আর মজিদ মাহমুদদের শিল্প-পরিণয়।
এভাবেই মাহফুজার সঙ্গে মজিদ মাহমুদের শিল্প-সমর্পন একাত্ম হয়ে ওঠে। আর সেজন্যই বোধ করি প্রকাশনার ২৫ বছর পরও মাহফুজামঙ্গল পাঠকের কাছে সমান আদরণীয় ও আগ্রহের বিষয় হয়ে থাকে।