‘জীবনকে স্বচ্ছন্দ আর গতিশীল করার জন্য যদি বিজ্ঞান-প্রযুক্তি কাজ করে, তবে শিল্প ও দর্শন সক্রিয় থাকে জীবনকে ব্যাখ্যা ও আনন্দমুখী করার ব্যাপারে। যন্ত্রের গতি ও জীবনের আত্মব্যাখ্যার রক্তাক্ত অবস্থানে ছোটগল্প।’ ছোটগল্প নিয়ে বলতে গিয়ে সিরাজুল ইসলাম ভূমিকায়ই উল্লেখ করেছেন একথা। সত্যিই তো তাই! কিন্তু ছোটগল্প; সেটা কতটা ছোটগল্প, কেমনতর ছোটগল্প; এ হলো সবচেয়ে জরুরি প্রশ্ন। রবীন্দ্রপূর্ব যুগ থেকে আরম্ভ করে আজ পর্যন্ত বাংলা ভাষায় অসংখ্য ছোটগল্প চর্চিত হয়েছে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ছোটগল্প বদলেছে, বদলেছে গল্পের ধরন-ধারণা। বদলেছে গল্পের কথা। এমনকি বদলেছে সম্ভবত গল্পের সংজ্ঞাও! আজকে একুশ শতকের এই দ্বিতীয় দশকের তরুণরা কেমন ভাবছেন গল্প নিয়ে? তারা কিভাবে লিখছেন গল্প?
এই সময়ের একজন তরুণ লেখক মারুফ কামরুল। তার গল্পগ্রন্থ ‘মাংসরা পোশাক পরা মানুষ’। এই বইয়ের গল্পটির নাম, ‘গন্ধপরাগ। গন্ধপরাগ’। এই গল্পে দেখছি মারুফের ভাবনার দ্বিচারণ। ‘একজন নারী সন্তানের দিক ফিরলে কী করে মা হয়ে যায় আর স্বামীর দিকে ফিরলে কামিনী। কী করে পাল্টে যায় শরীরের গন্ধ!’ এই রহস্যময় প্রশ্নটি নিয়েই ‘গন্ধপরাগ’! লেখকের ভাবনাটি জানা যাবে গল্পটি পড়লেই। এটিকে সরলভাবে ব্যাখ্যা করার সুযোগ নেই।
বিশ শতকের বাস্তবতার সঙ্গে একুশ শতকের দ্বন্দ্বটা যেন এখানে এসে প্রকাশ্য হয়ে পড়ে! একুশ শতকের মানবিক পৃথিবীতে এসে দুর্বল হয়ে পড়ে এই বক্তব্য, ‘জগতে কে কাহার!’
দ্বিতীয় গলের নাম ‘জীবন জীবনে গড়ায়’। গল্পের প্রধান দু’টি চরিত্র, ডাক্তার শোভন সারোয়ার এবং রেহনুমা জামান। শোভন গ্রামের একটি ক্লিনিকের সদ্যনিযুক্ত ডাক্তার। পুতুল নাচের ইতিকথার শশী ডাক্তারকে মনে থাকলে পাঠক শোভন চরিত্রটিকে সহজে অনুধাবন করতে পারবেন। শশী ডাক্তার যেমন গ্রামের হাসপাতালে নিজের জন্য একটি কক্ষ বরাদ্দ রেখেছিল, হাসপাতালের ভেতরকার তেমনি একটি কক্ষে থাকে শোভন। সদ্যবিধবা গর্ভবতী মেয়ে রেহনুমা। রেহনুমার গর্ভে সন্তান আসার পরেই স্বামী সৌরভ জামান মারা যায়। পরিবারের অমতে বিয়ে করেছে বলে স্বামীহারা রেহনুমা পৈতৃক পরিবারকেও পাশে পাচ্ছে না। নিতান্ত অসহায় রেহনুমা একটি অনাথ কিশোরকে সঙ্গে নিয়ে বাস করতে থাকে গ্রামে। গর্ভাবস্থায় সঙ্গত কারণেই তাকে ডাক্তারের কাছে যেতে হয়েছে। তরুণ ডাক্তারের সাথে যোগাযোগের ঘনিষ্ঠতা বাড়তে থাকলে এক পর্যায়ে পরস্পরের মধ্যে জন্ম নেয় নির্ভরতা এবং আস্থার সম্পর্ক। এক সময়ে রেহনুমা শোভনের জামার পুরুষসুলভ গন্ধকেও উপভোগ করতে আরম্ভ করে। গল্প মোড় নেয় ভিন্ন দিকে।
রবীন্দ্রনাথের বিখ্যাত ‘পোস্টমাস্টার’গল্পের কথা উল্লেখ্য। পোস্ট মাস্টার বাবুর চলে যাওয়ার কথা শুনে আহত হয়েছিল রতন। বারবার বায়না করেছিল পোস্ট মাস্টার বাবুর সঙ্গে যেতে। পোস্ট মাস্টার বাবু বাস্তবতা জানতেন। রতনের প্রতি প্রচণ্ড স্নেহ থাকার পরও সে তাকে ছাড়াই ফিরেছিল মাতৃভূমিতে। কারণ, রবীন্দ্রনাথের ভাষায়, ‘জগতে কে কাহার!’
কিন্তু ডাক্তার শোভন পোস্টবাবুর মতো বাস্তবতা স্বীকার করেছে কিনা; সে তার নৌকায় ঠিকই তুলে নিয়েছে রেহনুমাকে। বিশ শতকের বাস্তবতায় রবীন্দ্রনাথ রতনকে পোস্ট মাস্টার বাবুর গরুর গাড়িতে জায়গা করে দিতে না পারলেও একুশ শতকে মারুফ ঠিকই রেহনুমাকে তুলে দিয়েছে শোভনের নৌকায়! বিশ শতকের বাস্তবতার সঙ্গে একুশ শতকের দ্বন্দ্বটা যেন এখানে এসে প্রকাশ্য হয়ে পড়ে! একুশ শতকের মানবিক পৃথিবীতে এসে দুর্বল হয়ে পড়ে এই বক্তব্য, ‘জগতে কে কাহার!’
‘আঁধার ফেড়ে আলো ওঠা দিন’ গল্পের প্রধান চরিত্র বালা। বালা সরল একটি মেয়ে। গল্পের শুরুতে বালাকে আমরা পাবো প্রায় বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী একটি মেয়ের ভূমিকায়। কিন্তু ঘটনাচক্রে এই সরল মেয়েটিই হয়ে ওঠে শহিদুল্লা কায়সারের সারেং বৌ’র বিখ্যাত নবিতুন চরিত্রের প্রতিনিধি। বালার বিয়ে হয়েছে নেসারুদ্দির সেঙ্গে। নেসারুদ্দিও সারেং বৌয়ের কদম সারেং হয়ে ওঠে অনেকাংশে। কদম সারেং জাহাজে কাজে গিয়ে বেশ কিছুদিন যোগাযোগবিচ্ছিন্ন থেকেছিল, একই ঘটনা ঘটেছে নেসারুদ্দির সঙ্গেও। কিন্তু ঘটনার পটভূমি ভিন্ন ও নতুন।
সে সিদ্ধান্ত নেয়, এবারে ইবনে তুহুর ধর্ষণ করতে আসলে তার মুখে প্রস্রাব করে দেবে। এবং শেষ পর্যন্ত, ‘আমেনা শরীর ঝাঁকি দিয়ে চিৎকার করে মুতে দিলা ইবনে তুহুরের মুখে’। মূলত চেরাগধারী বর্বরতার মুখে।
কদম সারেং টাকা পাঠালে তা লুন্দর শেখের হাতে পড়ে বেহাত হতো, লুন্দর শেখ সে টাকা নিজের টাকা বলে নবিতুনকে দিতে গেলে নবিতুন তা প্রত্যাখ্যান করতো। নেসারুদ্দিও টাকা পাঠিয়েছিল আছলামের হাতে করে। কিন্তু আছলাম পথে দুর্ঘটনায় মারা যায়। আছলাম এখানে সারেং বৌ উপন্যাসের লুন্দর শেখের প্রতিনিধি না হলেও লুন্দর শেখ হিসেবে এই গল্পে আমরা পাই কাজল নামক গ্রামের দোকানদারকে। সে বালার স্বামীর অনিশ্চিত প্রত্যাবর্তনের সুযোগে বালাকে আত্মসাৎ করতে নানা প্রলোভন দেখায়, কিন্তু বালা তা প্রতিহত করে নবিতুনের মতোই। নবিতুন চরিত্রের এক্সটেনশন বলা যায় বালাকে। মারুফ সম্ভবত আজকালের নবিতুনকে আঁকতে চেয়েছেন বালার মধ্যে। নবিতুনের নতুন সংস্করণের মন-মগজ জানতে হলে পাঠককে অবশ্যই ‘আঁধারোত্তর সূর্য’ পড়তে হবে।
‘মুদ্রিত কাগজের বয়ান’ একটি বইকেন্দ্রিক গল্প। একটি বইয়ের আত্মকথা। বই গল্প বলে। পরের গল্প; অন্যের গল্প। কিন্তু মুদ্রিত কাগজগুলো যদি মানুষের মতো অনুভূতিসম্পন্ন হতো, তাদেরও যদি দেখার চোখ থাকতো; কেমন হতো তাদের ভাষ্য? এই প্রশ্নটিকেই মূল্যায়ন করেছেন লেখক। জড়-কাগজের প্রতি বিভিন্ন মানুষের অনুভূতি এবং প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করতে দেখা যায় একটি বইকে। এই বইটিই গল্পের কথক।
আবার বইটির দৃষ্টিতে দেখি তরুণ-তরুণীর প্রেম। বইয়ের মধ্যে করে চিঠি আদান-প্রদানের ঘটনা থেকে শারীরিক সম্পর্ক। মেয়েটির কাতর অনুরোধ, ‘তবুও কথা রেখো, সবটাই দিলাম।’ শেষ পর্যন্ত কথা না রাখা যুবকের প্রতারিত সেই প্রেমিকার ‘এক নদী বিষাদ’-এর সাক্ষী হয়ে থাকে বিষণ্ন জড় বইটি। এই গল্পটি বলতে বলতেই ‘মুদ্রিত কাগজের বয়ান’ শেষ হয়।
‘চেরাগের নিজস্ব বর্বরতা’ গল্পটি সমকালীন সমাজবাস্তবতার এক রোমান্টিক রূপায়ন। সৌদি প্রবাসী এক বাঙালি মেয়ে আমেনা। গৃহপরিচারিকার কাজ করে মরু-আরবে। ধর্মের চেরাগধারী সৌদির মানুষেরাও যে কতটা বর্বর হতে পারে, তা দেখাচ্ছেন মারুফ কামরুল। মারুফের রূপায়নে স্পষ্ট হয়ে ওঠে বাংলাদেশ থেকে কাজের সন্ধানে সৌদি যাওয়া নির্যাতিত মেয়েদের করুণ অবস্থা। আমেনা সৌদির গৃহকর্তার হাতে ধর্ষিত হতে গিয়ে এক ভিন্নতর প্রতিবাদের পথ বেছে নেয় এই গল্পে। সে সিদ্ধান্ত নেয়, এবারে ইবনে তুহুর ধর্ষণ করতে আসলে তার মুখে প্রস্রাব করে দেবে। এবং শেষ পর্যন্ত, ‘আমেনা শরীর ঝাঁকি দিয়ে চিৎকার করে মুতে দিলা ইবনে তুহুরের মুখে’। মূলত চেরাগধারী বর্বরতার মুখে।
এই বইয়ে মোট ১৩টি গল্প আছে। আলোচ্য গল্পগুলো ছাড়াও, ‘পদ্ম ফুলের তৃষ্ণা’, ‘শিউলি ফুলের বোঁটাহীন জীবন’, ‘রাত্রির ব্যবধান’, ‘সাহসী তিলের শেষ দর্শন’, ‘ফুল ঝরে পড়ে’, ‘অতুল ওকাছারি ঘর’, ‘যে গল্প কেউ জানত না’ ও ‘কামফুলের প্রেম’ গল্পগুরো সংকলিত হয়েছে এই বইয়ে।