পিকাসোর নারীরা, শেক্সপিয়রের রমণীরা, এ রকম বই আগে পড়েছি। এবার হাতে এলো ‘মধু কবির জীবনে নারী’। মুহম্মদ শফি রচিত বইটি পড়া শুরু করার পর থেকেই একটা অন্যরকম দায় কাজ করেছে। মনে হয়েছে এ রকম বই বাংলা সাহিত্যে তেমনটা নেই। আর মাইকেলের ওপর লেখা এ বইটি আমি এত দেরিতে কেন পড়ছি? যাই হোক পড়েছি আর জেনেছি হাড় শীতল করা সব কাহিনি! বারবার মনে হয়েছে মাইকেল মধুসূদন দত্তের জীবন নাটককে হার মানাই! এ কথা বললে মোটেও অতুক্তি হবে না—বাংলা নাটকের মতোই যেন তার জীবন।
যারা গোলাম মুরশিদের ‘আশার ছলনে ভুলি’ বা ‘মধুর খোঁজে’ পড়েছেন বা মাইকেল গবেষক খসরু পারভেজের মাইকেল বিষয়ক গ্রন্থ পড়েছেন, তাদেরও এ বইটি পড়া প্রয়োজন। মাইকেলের জীবনে যে সব নারীরা এসেছেন, তাদের কেউ কেউ যেমন কাব্যলক্ষ্মী, তেমনি কেউ কেউ অসম্ভব পরশ্রীকাতর ও হিংসুটেও।
দেড়শ পৃষ্ঠার বইটিকে একবার পড়া শুরু করলে আর শেষ না করে উপায় নেই। শুরুতে দীর্ঘ দুটি প্রাক-কথা লিখেছেন লেখক। প্রথমটিতে জমিদার মুন্সী রাজনারায়ণ দত্তের বাড়িতে যেদিন মধুসূদন অবতরণ করছেন, সেদিনের একটা ঘটনা এমন আবহে বর্ণনা করেন, যেন কোনো নাটকের মহড়া চলছে! মানে মধু কবি জন্মগ্রহণ করার দিন নায়েব-গোমস্তা, পাইক-প্রজারা আনন্দে আটখানা। চাকর-বাকররা মহা ধুমধামে আনন্দ করছে। ঘটনাটা এমন যে পড়ার পর মাথা ও মন মোচড় দিয়ে ওঠে। দ্বিতীয় প্রাক-কথায় মাইকেলের সেই সময়কে তুলে ধরার চেষ্টা। সাহিত্য সাধনার জন্য ধর্ম পরিবর্তনসহ মধুকবির জীবন ও সৃষ্টির দুই বিস্ময়কর তথ্য সংবলিত কাহিনী।
মাতা-বিমাতাবৃন্দ, বিষাদিনী জাহ্নবী
এই অংশে তিনি কবির মা জাহ্নবী দেবীর অশ্রুর রঙ যেন আবিষ্কার করেন। ছেলের ধর্ম পরিবর্তনের শোকে শেষ পর্যন্ত যিনি পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করেন। তার গর্ভে আরও দুটি পুত্র সন্তানের জন্ম হলেও তারা অল্প কিছু দিন বেঁচে ছিলেন। ফলে মাইকেলই ছিলেন তাদের একমাত্র পুত্র। আর সে কারণে পুত্র সন্তানের লোভে মাইকেলের আইনজীবী পিতা রাজনারায়ণ দত্ত একে একে আরও তিনটি স্ত্রী গ্রহণ করেন। দ্বিতীয় বিমাতার নাম শিবসুন্দরী দেবী। তৃতীয় বিমাতার নাম প্রসন্নময়ী দেবী, আর তৃতীয় বিমাতার নাম হরকামিনী দেবী। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আর বংশ রক্ষা হয়নি। সেই সব বিমাতাদের সঙ্গে পরে মাইকেলের ভালো সম্পর্ক তৈরি হয়। তারা যতদিন বেঁচে ছিলেন কবি তাদের নিজের মায়ের মতোই যত্ন করে রেখেছিলেন। কিন্তু পরে জানা যাবে সেই আদরের বিমাতা প্রসন্নময়ী দেবী মাইকেল খ্রিস্টান হওয়ার অপরাধে ঘরে প্রবেশ করতে দেননি!
আরও জানা যায়, যে বাল্য শিক্ষকের কথা তিনি কখনো ভেলেননি, সেই হরলাল রায়ের কথা। যিনি মাইকেলের প্রতি মুগ্ধ হয়ে লিখেছিলেন, ‘নামে মধু, হৃদে মধু, বাক্যে মধু যার/ এহেন মধুরে ভুলে, সাধ্য আছে কার!’ মধু কবির ফারসি শিক্ষক ছিলেন খন্দকার মখমল আহমেদ। মৃত্যুর আগেও তিনি যার আশীর্বাদ চেয়েছিলেন!
দেবকী প্রসঙ্গ; কাল্পনিক উপখ্যান
এই অংশে দেবকী আসলে কবির কল্পনার কোনো নারী। যাকে নিয়ে তিনি রচনা করেছেন অসংখ্য কাব্য ও নাটক। শেক্সপিয়র, মিল্টন, বায়রন, হোমার, দান্তে, ট্যাসোদের মতোই মধু স্বপ্ন দেখতেন। বিশ্বভরা স্বপ্নের আকাশে ছিল তার বিচরণ। স্বপ্ন আর আকাঙ্ক্ষার জালে এমনভাবে বন্দি হয়ে পড়েছিলেন যে হিতাহিত জ্ঞান শূন্য মাইকেল না খেয়ে দিনের পর দিন সাহিত্য সাধনা করে গেছেন। সোনার চামচ মুখে নিয়ে জন্মেও যার জীবনে কখনো কোনো সুখের দেখা আর পাননি।
রেবেকা টমসন, প্রেমসঙ্গী ও কাব্যলক্ষ্মী
প্রেম ও বিচ্ছেদ কত আনন্দময় ও আনুগত্যের তা রেবেকার জীবনে ছিল চরম মাত্রায়। রেবেকাকে পাওয়ার পর থেকেই তার সাহিত্য সাধনা আরও বেড়ে যায়। এই নীলনয়নাকে মাইকেলের কাব্যলক্ষ্মী হিসেবে দেখেছে সবাই। কিন্তু সেটাও আর মধুর জীবনে সহ্য হয়নি। চিরচঞ্চল মধু যেন মধু সংগ্রহের পরেই অস্থির চিত্ত নিয়ে লাপাত্তা হয়ে যান। চারটি সন্তানসহ রেবেকার সঙ্গে কবির বিচ্ছেদ ঘটে। তখন রেবেকার বয়স মাত্র ২৬ বছর। চার সন্তানের জন্ম হলেও রেবেকা ছিলেন পূর্ণযৌবনবতী। তাদের সম্পর্ক ছিন্ন হওয়ার ১৮ বছর পর ৪৯ বছর বয়সে কবির মৃত্যু হয়। অথচ একটি বারের জন্যও রেবেকা সন্তানের অধিকার আদায়ে স্বামীর সম্মুখে এসে দাঁড়াননি। কবির মৃত্যুর পরও প্রায় ১৯ বছর তিনি বেঁচে ছিলেন। কবির সন্তানদের কথা ভেবে নিজেও আর কখনো কাউকে পতি হিসেবে গ্রহণ করেননি। এসব কাহিনী পড়লে কেবল রূপকথার মতোই শোনায়। গায়ের সরু লোমগুলো দাঁড়িয়ে যায়।
এমিলিয়া হেনরিয়েটা, বাঙালি গৃহবধূর অনিন্দ্যসুন্দর উপমা
এমিলিয়া হেনরিয়েটা সোফিয়া হোয়াইট নামের নারীর আগমন মধুর জীবনে অপ্রত্যাশিত কোনো ঘটনা না। কবির খ্যাতি যখন তুঙ্গে, পতিপত্তির স্বর্ণশিখরে অবস্থান করছেন, ঠিক তখনই তার জীবনে এমিলিয়ার আগমন ঘটে। সুখে-দুখে, আনন্দ-বেদনায়, পাওয়া-না পাওয়ায়, বর্থ্যতায়-সাফল্যে এই নারীর সঙ্গেই কবি শেষ পর্যন্ত জড়িয়ে ছিলেন। এমিলিয়া যেন হাতে নিয়ে এসেছিলেন কল্যাণ প্রদীপ। সেই প্রদীপ মধুকবির জীবনে জ্বালানোর জন্য ছিলেন সর্বদা সচেষ্ট। কিন্তু তাকেও যে প্যারিসে রেখে চলে আসেন কবি। চার সন্তানকে নিয়ে এমিলিয়া ফিরে আসেন কলকাতায়। হাতে কোনো টাকা পয়সা নেই, ঘরে কোনো খাবার নেই। এমন অবস্থায় এমিলিয়া ও চার সন্তানকে কবি ফ্রান্সে কিভাবে কোন ভরসায় ফেলে চলে আসেন, তা কোনো গবেষক আবিষ্কার করতে পারেননি। জীবন নিয়ে এমন খাম-খেয়ালিপনায় যেন ছিল তার আসল জীবন! তিনি ঘর চাননি, না কি ঘর তাকে ধরে রাখতে পারিনি, তাও নির্ণয় করাও দুরূহ হয়ে পড়ে।
মধু কবির সাগরদাঁড়ির শৈশব, কলকাতার কৈশর, মাদ্রাজের যৌবন, প্যারিসের ক্ষুধার্ত জীবনের পুরো আখ্যান তুলে ধরা হয়েছে এই বইয়ে। আর কোথায় কোন নারীর সঙ্গে কিভাবে প্রণয় ও বিয়ে, কার সঙ্গে কত দিনের সংসার—এমন সব কাহিনীর কপোতাক্ষ নদে লেখক ভাসিয়ে দেন মাইকেলের ভাগ্যরেখা। জানা যায়, তাই অজানা অনেক রহস্য আর নিদারুণ জীবনের জলন্ত অগ্নি। মাইকেল যেন নেই আগুনে পুড়ে পুড়ে কয়লা হলেন। কয়লা হতে হতে বাংলা সাহিত্যকে দিয়ে গেলেন অমর আকর।
মধু কবির জীবনে নারী
লেখক: মুহম্মদ শফি
প্রচ্ছদ: শিবু কুমার শীল
প্রকাশক: আগামী প্রকাশনী
মূল্য: ৩০০ টাকা
প্রকাশ: বইমেলা, ২০১৮