তখন ৩ জুনে [বক্ষ্যমান কবিভ্রাতা বুলবুলের মৃত্যুদিন]-এর ধেয়ে আসা মৃত্যু, কবিকে স্তব্ধ করলে—আফ্রেদিতির প্রিয় অ্যাডোনিস্—মুখ থুবড়ে পড়ে যায়। আর তার পরে নিঃশেষে প্রাণবিয়োগ ঘটে। তারপর সব দেবী শূন্যতার ডানায় ভর করে হাহাকার করতে করতে ছুটে আসে—সৌন্দর্য দেবতা আফ্রেদিতির কাছে। কী যে অসহ্য এক বেদনা—সে বিচ্ছদে! তখন সবকিছু অমান্য আর হাহাকারে ভরা। শূন্যতা অবারিত ক্রোধে ঢাকা। আর বিমর্ষতার খেদ তো আছেই। এই শোক কাটবে কিভাবে? মর্ত্যের দেবতাদের তখন সভা শুরু হলো। সিদ্ধান্ত—বছরে ছয় মাস তারা সবাই সময় দেবেন আফ্রেদিতিকে। তখন একপ্রকার মুক্তির মুক্ত স্বস্তি। কিন্তু স্বস্তি তো সহজ নয়! এই অব্যক্ত শোক ছিল পি. বি. শেলীর কল্পনার কিটসকে ঘিরে।
খুব অল্পসময়ে বন্ধুর মৃত্যুতে শেলি অ্যডোনিস শোককাব্য লেখেন। এই এক তুমুল শোককাব্য। জোয়ারও ছিল ওই সময়ের! সে তো তখন রোম্যান্টিক যুগ—কবিতার ফ্রেম একেবারে দুমড়ে-মুচড়ে গেছে। রোম্যান্টিক হাওয়ায় সবাই তখন কেশর ফুলিয়ে চলছে সম্মুখে—উদ্দাম অনুভূতির এক আকাশে। সবটাই যেন আকাশঘেরা সূর্য-তারা। তখনই এলো ঝড়ো হাওয়া। ওড রচনার কাল। নির্জন, একাকিত্ব, ব্যক্তিগত, অতীন্দ্রিয় আয়ুধ সব ব্যাপারজুড়ে বসলো কবিতায়। কথাগুলো দুর্দাম করে চৌকাঠে ফিরে এলো—ঠিক এরকম করেই—যখন ‘বুলবুলবেদনাকাব্য’ হাতে পেলাম। ওড তো শোক, শোকের গান, শোকে তৈরি হওয়ার পুরো স্তূতি। সেটাকে মাপজোক নিয়ে তো কথা বলা চলে না। হুড়হাড় আবেগের সিম্ফনি ওতে গড়ে ওঠে। কোনো ব্যাকরণ ছাড়াই। সে তুমুল বাতাস! তাতে লেখা হয়: স্কাইলার্ক।
এখানে যাহার সমাধি শয়ন
নাম তার শুধু জলের লিখন।
আর আমাদের রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন সত্যেন দত্তকে নিয়ে। কী ঘনীভূত সে শোক! মেনে নিতে পারেননি, ছোট্ট সত্যেনের কম বয়সে চলে যাওয়াটা:
কোকিলের কুহুরবে, শিখীর কেকায়
দিয়েছ সঙ্গীত তব।
রকিবুল হাসান ভ্রাতৃবিয়োগে ঠিক ওডের ফর্মে নয়, রঙ-তুলির ছত্রে কিছু প্রগাঢ় অনুভূতি বারংবার অভিভূতরূপে ফিরে ফিরে প্রকাশ পেয়েছে। ৩৭টি স্তবকগুচ্ছ অর্থাৎ ৩৭ কবিতা। এর রহস্য তেমন নয়, আছে স্মৃতি-ফেরানো আহ্বান আর অধীত শঙ্খমালার প্রত্নস্বর। কোনো রঙই অচেনা নয় যেন! এর আগেও রকিবুল লিখেছেন—একরকম এই অনুভূতিই, সেটি ছিল প্রেম ও প্রকৃতির রাগের বিহ্বলতার প্রেমকাব্য। এখানে সেটি মৃত্যুর অমর শোকরূপে অন্য রূপ নিয়েছে। স্মৃতিগুলো ফিরে এসেছে তাজা গোলাপের সিক্তাভায়, থরে-বিথরে তাতে গাঢ়তর হয়েছে শোক, শোক অতঃপর শোক। ভ্রাতৃ-বুলবুল (স্মর্তব্য: গীতিকবি নজরুলের বুলবুল—শূন্য এ বুকে ফিরে পাখি মোর ফিরে আয়…) বকুল বিছানো পথে ফিরছে যেন, শূন্যতার দহনে। যা হোক, শেলির অ্যাডোনিসে দীর্ঘতর ভাবমহিমার স্বর প্রকটিত ছিল, অতীন্দ্রয়তা সেখানে দানা বেঁধেছে অভূতপূর্বরূপে। ‘তিনি জীবিত, তিনি জাগ্রত; মৃত্যুই মৃত, তিনি নন। অ্যাডোনেইস-র জন্য শোক করো না, ওগো তরুণী ঊষা। দীপ্ত করে তোল শিশির বিন্দুগুলোকে, যে প্রাণের জন্য তোমার শোক, যায়নি সে। প্রকৃতির সঙ্গে সে গেছে এক হয়ে। বজ্রনির্ঘোষ থেকে রাত্রিবেলাকার পাখির গান পর্যন্ত তার সব সংগীতে শোনা যায় তাঁরই কণ্ঠস্বর। যে শক্তি তাকে সংহত করে নিয়েছেন নিজের মধ্যে, যিনি জগৎ পোষণ করছেন মূলদেশে আর আলোকিত করছেন ঊর্ধ্বভোগে,—সেখানে তাঁর সঞ্চার, সেখানেই সে-কবিও আছেন ব্যাপ্ত—আলোয়, অন্ধকারে, লতাগুল্মে, পাষাণে।
হ্যাঁ, এই রোম্যান্টিকতা হয়তো আগেও ছিল—কিন্তু এখানে এই কর্কট সময় বাস্তবতায় তা নিজের মতো অক্ষয়রূপে পুনর্বাসিত হয়ে চলেছে। যা হোক, আমরা আবার বলে নেই, সেই পুনর্বাসনের ধর্ম কী? ‘তোমার মাথায় হাত রাখি’ বা ‘দুঃখ শিরোনামে নিজেই এক জীবনকাব্য’—কী সঙ্গত হয়ে ওঠে না! এই সারার্থ পৌঁছয় বিলাপের বারতা পেরিয়ে নবরক্তরাগের ব্যপ্ত চেতনায়।
যে সৌন্দর্যকে তিনি একদিন তুলেছিলেন আরও সুন্দর করে, আজ তিনি তারই অঙ্গীভূত। ‘এক’ই চিরস্থায়ী, ‘বহু’ রূপান্তরের পথে করে অন্তর্ধান। স্বর্গের আলো চিরউজ্জ্বল, মর্ত্যের ছায়া দ্রুত অপসৃত নানারঙে রঙিন কাচের চূড়ার (গম্বুজের) মতো জীবন অনন্তের শুভ্র রশ্মিকে করে বিচিত্রবর্ণ, তার পর মৃত্যু এসে একদিন চূর্ণবিচূর্ণ করে দিয়ে যায়।’—এমন দারুণরূপে সৌন্দর্য মিশতে থাকে, মিশে থাকে। রূপরীতিতে—আর সব প্রকৃতিতে, নিসর্গে। এরকমই বলেন জন মিল্টন লিসিডাসে, আর টেনিসন ইন মেমোরিয়ামে। এমনই ধারাক্রমে একালে আমরা পেয়ে চলি রকিবুল হাসানকে—‘বুলবুলবেদনাকাব্য’ (২০২১)-সমীপে। তবে এ রচনা নিয়ে যেমনটা বলেছি, তার বিষয়াবেগ আছে, ভরপুরত্বের দায়ে লেখক দণ্ডায়মান—পুরো আবহে ‘শোক’—সেটির বিস্তৃতি অতীতের সমগ্রসময়—যা ধীরে ধীরে দাঁড়টানার মতো বিরহের উজান বাইতে বাইতে একসময় স্থির হয়ে কাল-গুণে আর শর্তগুলো ধরে বলে ওঠে—বুলবুলই অ্যডোনিস, সে নিভৃতের নিবৃত্তি পায় না, শুধুই উল্কি মেলে রোদ-জল-মেঘ-জ্যেৎস্না ধরে সাকুল্যে সর্বত্র। আবার এবং ততোধিক পুনর্বার। তাই তো লিখিত হয়:
নদীর মতো তুই চলে যাচ্ছিস—কী এক ভীষণ অভিমানে
আর কখনো ফিরবি না—ফেরা হবে না কখনো আর।
… … …
বিক্ষুব্ধ ঢেউয়ের মতো বুকের ’পর আছড়ে পড়ে গহীন রাত্রি
আমি ঘুমোতে পারি না—দু’হাঁটুর ভেতর মুখ গুঁজে বসে থাকি।
কিংবা,
একতারা হাতে হেঁটে যাই নিজের ভেতরে
কয়া ছেঁউরিয়া শিলাইদহ খলিসাদহের ধূলিমাটি গায়ে মেখে
অভিমানে ফিরেও তাকাই না কারো দিকে …
এ যে সময়ের বোধের তাপ, অ্যডোনিসের নয়। সেটির কালখণ্ড আলাদা। গড়ন-ধরন খুব নির্বাধ, স্লেটের মানসাংক যেন। তাতে সবটু খুবলে খুলে ফেলা অসম্ভব হয় না। নিছক স্তবকীর্তির ছায়া দিয়েও নয়, তাতে ওড হয় না! রকিবুল ফেরারি হন অন্যভাবে। লয়—ধরা থাকে ভিন্ন সরগমে। ফলে ব্যক্তিগত পালকগুলো পলকা হয়ে ওঠে। ফিরে আসে। দূর স্কাইলার্ক কিংবা অভিভূত অভিব্যক্ত বলয়ে তা প্রবেশ করতে তেমন সক্ষম হয় না কিন্তু কিছুই আবার অক্ষম থাকে না। সেজন্য সাঁইত্রিশটি কবিতা নয়, এখানে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে গুরুতররূপে বেশ কয়েকটি। যার তীব্র ও তীক্ষ্ম ধারা—বিশেষ রীতিতে শানানো। অন্যগুলো পূর্বে রচিত তাঁর অন্য জলের কাব্য। সেগুলো এখানে অন্তভুক্তি না হলে অসুবিধে হতো না। যেমন: ‘কবিতার শব্দে’, ‘অচিন বাউল’, ‘তোমার চোখের ভারি মেঘ’, ‘কবিতা কি যূথিকা যৌবনা নদী’ এ ধরনের কিছু লেখা। পুনরাবৃত্তির আখ্যা প্রথম তিনটি কবিতা। তবে যা হোক, সবটাতেই ‘ক্লাউড’ আছে। এটা বাতিল করা যাবে না। তাই ‘বুলবুলবেদনাকাব্য’ অসার্থক হয় না। পাঠককে টানতে পারবে নিজস্ব অন্তর্নিহিত শক্তিতেই।
কারণ, এসব বিলাপে বারতা আছে। প্রশ্ন করি কীসের বারতা?—ফেরার, উপকূলে পৌঁছার। নব নবরূপে জেগে ওঠার। এটাই তো মানুষের ধর্ম। সৌন্দর্যের শক্তি সেখানেই। পেছন থেকে, মৃত্যুশোক থেকে ফিরে আসা, নবচেতনার পথ রচনা করা নিজেই—কোনো না কোনোরূপে। সেই বিলাপের বলয়ে বিরচিত হয়—ওই শোক-প্রতিপাদ্য। হ্যাঁ, এই রোম্যান্টিকতা হয়তো আগেও ছিল—কিন্তু এখানে এই কর্কট সময় বাস্তবতায় তা নিজের মতো অক্ষয়রূপে পুনর্বাসিত হয়ে চলেছে। যা হোক, আমরা আবার বলে নেই, সেই পুনর্বাসনের ধর্ম কী? ‘তোমার মাথায় হাত রাখি’ বা ‘দুঃখ শিরোনামে নিজেই এক জীবনকাব্য’—কী সঙ্গত হয়ে ওঠে না! এই সারার্থ পৌঁছয় বিলাপের বারতা পেরিয়ে নবরক্তরাগের ব্যপ্ত চেতনায়। এই মানুষের—এবং অবশ্যই সার্থক কাব্য-ধর্ম এইটি। এটাই স্পিরিট–‘I fall upon the thorns of life, i bleed’ কিংবা ‘Be thou me, impetuous me’-এ এক ‘luminous wings.’
রকিবুল হাসান ‘বুলবুলবেদনাকাব্যে’ সেই সারাৎসারের সত্যে গৃহীত। ওই রূপ-আধারকেই তিনি পরিস্রুত করে—স্বপ্নডানাকে চিরায়ত অভিমুখের পথে অক্লান্তরূপে এগিয়ে নিয়ে চলেন। এই তাঁর সূচিবিদ্ধ কাব্যস্বরূপা। যেটিকে বলা হয়—‘Ôspontenious overflow of powerful feeling’। শোককাব্যটির পাঠকপ্রিয়তা প্রত্যাশা করি।