১৯৭১ সালে দীর্ঘ নয় মাস প্রাণঘাতী যুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন হয়েছে প্রিয় বাংলাদেশ। তখন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নির্দেশে বাংলার আপামর মানুষ ঝাঁপিয়ে পড়েছিল রণাঙ্গনে। পঁচিশ মার্চ কাল রাতে হানাদার বাহিনী হত্যাযজ্ঞ চালায় বাঙালির ওপর। ঢাকা থেকে শুরু করে দেশের আনাচে-কানাচে চালায় গণহত্যা। পাকিস্তানি বাহিনীকে এ কাজে সাহায্য করে এদেশের দোসর রাজাকার, আল-বদর, শান্তি কমিটির সদস্যরা। তাই দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলেও ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে অসংখ্য বধ্যভূমি ও গণকবর। নির্যাতনের শিকার বহু নারী-পুরুষ এখনো সেই স্মৃতি রোমন্থন করেন।
একটি স্বাধীন দেশের বিনিময়ে আমরা হারিয়েছি ত্রিশ লাখের অধিক মানুষ। এত কম সময়ে একটি দেশে ত্রিশ লাখেরও বেশি মানুষ কোথাও হত্যা করা হয়নি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এ ধরনের ঘটনা এই প্রথম। একাত্তরে পাক হানাদার বাহিনীর নির্বিচারে গণহত্যা ও নির্যাতনে হারিয়েছি আমাদের বাবা-মা, ভাই-বোন, স্বামী-স্ত্রী, সন্তান, আত্মীয়-স্বজন। ফলে জানা-অজানা, চেনা-অচেনা অনেক বধ্যভূমি রয়েছে আমাদের দেশের সোনার মাটির তলায়। সবুজ-শ্যামল দেশটি রক্তে রঞ্জিত হয়েছে হায়েনার নখরাঘাতে। গণহত্যার সাক্ষী হয়ে এখানো মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে যেসব অঞ্চল, তার মধ্যে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার সরাইল উপজেলার পানিশ্বর উত্তর ইউনিয়নের বিটঘর অন্যতম। সেদিনের নারকীয় গণহত্যার স্মৃতি বহন করে এখনো টিকে আছে অঞ্চলটি।
বিটঘরের সেই নারকীয় হত্যাকাণ্ড নিয়ে ‘১৯৭১: গণহত্যা-নির্যাতন আর্কাইভ ও জাদুঘর ট্রাস্ট’র উদ্যোগে ‘গণহত্যা-নির্যাতন ও মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গবেষণা কেন্দ্র’র তত্ত্বাবধানে প্রকাশিত হয়েছে ‘বিটঘর গণহত্যা’ নামে একটি গবেষণাগ্রন্থ। গণহত্যার এ অনন্য দলিল গ্রন্থভুক্ত করেছেন কবি ও সংগঠক জয়দুল হোসেন। মুক্তিযুদ্ধের এক অজানা অধ্যায় তিনি আমাদের সামনে তুলে ধরেছেন। বর্তমান ও আগামী প্রজন্মের জন্য যা মাইলফলক হয়ে থাকবে।
গ্রন্থমালার সম্পাদনা করেছেন ইতিহাসবিদ ড. মুনতাসীর মামুন। সহযোগী সম্পাদক ছিলেন মামুন সিদ্দিকী। এই গ্রন্থে বিটঘরের ভৌগোলিক অবস্থান, স্থানটির তৎকালীন অবস্থা, পারিপার্শ্বিক পরিবেশ, গণহত্যা-নির্যাতনের পটভূমি, গণহত্যা-নির্যাতনের বিবরণ, তারিখ বিভ্রাট নিরসন, গণহত্যা-নির্যাতনকারীর পরিচয়, শহীদদের শনাক্তকরণ ও পরিচয়, ভুক্তভোগী ও নির্যাতিতদের তালিকা, নির্যাতিতদের মৌখিক ভাষ্য, প্রত্যক্ষদর্শীর ভাষ্য, বিটঘরের বর্তমান অবস্থা ও সংরক্ষণের প্রয়াস, মূল্যায়ন এবং তথ্যপুঞ্জি অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
লেখক আমাদের জানিয়েছেন, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সরাইল উপজেলার পানিশ্বর উত্তর ইউনিয়নের একটি গ্রাম বিটঘর। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বিশ্বেরোড থেকে বেড়তলা হয়ে আনুমানিক ৭ কিলোমিটার উত্তরে, আশুগঞ্জ বেড়তলা হয়ে ১২ কিলোমিটার পূর্বে, মেঘনা নদী থেকে সোজাসুজি ২ কিলোমিটার পূর্বে এ অজপাড়া গাঁয়ের অবস্থান। বিটঘর গ্রামের পশ্চিম পাশ ঘেঁষে উত্তর-দক্ষিণে ‘ছোট খাল’ নামে পরিচিত একটি খাল রয়েছে। এই ছোট খালের পূর্বপাশে একসঙ্গে ৬১ জন, মালিহাতার ৪ জন, বুধলের ১ জন, শান্তিনগরের ২ জন, সিতাহরণের ১ জন, নাইলার ১১ জন শহীদসহ মোট ৮০ জন শহীদের তালিকাও সংযুক্ত হয়েছে বইটিতে।
বইটিতে গণহত্যার তারিখ সম্পর্কে প্রচলিত বিভ্রাট দূর করা হয়েছে। লেখক বলেছেন, যুদ্ধের সময় কথাসাহিত্যিক মিন্নাত আলী নিয়মিত ডায়েরি লিখতেন। ডায়েরিতে লিখিত বিভিন্ন ঘটনাকে একত্র করে ‘না বলা কথা’ নামে একটি বইও তিনি প্রকাশ করেছেন। সেই বইয়ের তথ্যানুযায়ী ৩১ অক্টোবর ঘটেছিল গণহত্যার ঘটনাটি। যেহেতু তিনি ডায়েরি লিখতেন; সেহেতু তাঁর দেওয়া তথ্য নির্ভরযোগ্য। ফলে ৩১ অক্টোবরই হবে গণহত্যার প্রকৃত দিন।
বিটঘর গ্রামে আক্রমণকারী বেশিরভাগ ছিল পাকিস্তানি সৈনিক। এছাড়া তাদের সহযোগিতা করেছে ওই অঞ্চলের কয়েকজন রাজাকার নামধারী বেঈমান দেশবিরোধী অমানুষ। যাদের মধ্যে পনেরো রাজাকারের নাম প্রকাশ করা হয়েছে স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা আবদুর রাশেদ এবং সরাইল উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের ইউনিট কমান্ডার ইসমত আলীর সহযোগিতায়।
লেখক তার গ্রন্থে জানিয়েছেন, গণহত্যার সময় নির্যাতিতের কেউ কেউ এখনো বেঁচে আছেন। বইটিতে জীবিত ৩৪ জনের একটি তালিকা প্রকাশ করেছেন তিনি। কথা বলেছেন নির্যাতিত দশজন নারী-পুরুষের সঙ্গে। তাদের মুখে শুনিয়েছেন নির্যাতনের নৃশংস কাহিনী। নির্যাতিত মালেকা খাতুন (৬৭) সেদিনের ভয়াবহতা তুলে ধরেছেন তার বক্তব্যে। কান্নাভেজা কণ্ঠে তিনি লেখককে বলেন, ‘তখন আমার বয়স মাত্র ২০ বছর। যৌবন বয়সে স্বামীকে হারিয়ে অসহায় অবস্থায় দুটি নাবালক সন্তানকে নিয়ে অনেক কষ্টে দিন কাটিয়েছি। খালের পাড়ে অনেক মানুষকে হত্যা করে লাশ খালের পাড়ে ও পানিতে ফেলে রেখে যায়। এই ঘটনার পর ৩-৪ দিন পর্যন্ত লাশ দাফন করা হয়েছে।’
এরপর লেখক কথা বলেছেন সেই ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শীদের সঙ্গে। এগারো জন প্রত্যক্ষদর্শীর বক্তব্য তিনি তুলে ধরেছেন বইটিতে। তাঁরা প্রত্যেকেই মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে এসেছেন। সেদিনের দুঃসহ স্মৃতির কথা বলতে গিয়ে হয়তো শরীর কেঁপে উঠেছিল তাঁদের। হয়তো গলা শুকিয়ে আসছিল। লেখকও হয়তো ভয়ে কেঁপে কেঁপে উঠেছেন। তার চোখের সামনে ভেসে উঠেছে তাঁদের বর্ণিত গণহত্যার নির্মম দৃশ্যাবলী।
লেখক গণহত্যায় সর্বস্ব হারানো মানুষের বর্তমান অবস্থাও তুলে ধরেছেন বইতে। লেখক বলেছেন, ‘১৯৭২ সালে সরকারের পক্ষ থেকে শহীদ পরিবারের সদস্যদেরকে কিছু আর্থিক সহায়তা দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু এরপরে তাদের কোনো খোঁজ খবরই নেয়নি কেউ।’ বইটি পাঠে আমরা আরো জানতে পারি, বিটঘর গ্রামে শহীদদের স্মরণে স্মৃতিসৌধ ও পাঠাগার নির্মাণের দাবি জানিয়েছেন তাঁরা। এছাড়া ব্যক্তিগত অর্থায়নে নির্মিত শহীদ মিনারের সংস্কার চায় এলাকাবাসী। ১৯৯১ সালে গড়ে তোলা শহীদস্মৃতি সংসদের পাশাপাশি শহীদস্মৃতি কমপ্লেক্স নির্মাণের দাবিও তাঁদের। এছাড়া এখনো সেদিনের গণহত্যায় শহীদদের কবরগুলো চিহ্নিত বা সংরক্ষণ করা হয়নি। এমনকি গণহত্যা দিবসটিও পালিত হচ্ছে না। তবে এ ব্যাপারে সব কিছু সরকারের ওপর ছেড়ে না দিয়ে এলাকাবাসীর উদ্যোগী হওয়া উচিত বলে অভিমত ব্যক্ত করেছেন লেখক।
বইটি পাঠ শেষে সহজেই অনুমান করা যায় যে, এর তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করতে লেখককে অনেক পরিশ্রম করতে হয়েছে। লেখক ছুটে গেছেন মানুষের দুয়ারে দুয়ারে। বিটঘরের বিচ্ছিন্ন ইতিহাস জানতে পড়াশোনা করেছেন প্রচুর। স্থানীয়দের সহযোগিতা নিয়ে খুঁজে বের করেছেন শহীদ পরিবার, নির্যাতিত এবং প্রত্যক্ষদর্শীদের। যা সত্যিকারার্থে সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। তাই আমি বলবো শেষপর্যন্ত লেখকের শ্রম সার্থক হয়েছে। তাঁর শ্রম ইতিহাসের মহিমায় চির ভাস্বর হয়ে থাকবে।
মহামূল্যবান বইটির নকশা ও প্রচ্ছদ করেছেন চিত্রশিল্পী ও কবি তারিক সুজাত। এক শ’পঞ্চাশ টাকা মূল্যমানের বায়ান্ন পৃষ্ঠার বইটি শুধু বিটঘরবাসীর আকরগ্রন্থ হয়েই রইল না। হয়ে রইল বাংলাদেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের সাক্ষী। সেই অসাধ্যকে সাধন করেছেন জয়দুল হোসেন। লেখকের সঙ্গেসঙ্গে আমরাও চাই- নতুন প্রজন্ম জানুক, স্বাধীনতা শুধু চারটি বর্ণের সমাহার নয়। এর পেছনে আছে লাখো মানুষের আত্মত্যাগ, নির্যাতন আর দীর্ঘশ্বাস।
বিটঘর গণহত্যা
লেখক: জয়দুল হোসেন
প্রকাশক: ১৯৭১: গণহত্যা-নির্যাতন ও মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গবেষণা কেন্দ্র
প্রচ্ছদ: তারিক সুজাত
প্রকাশকাল: মে, ২০১৭
মূল্য: ১৫০ টাকা মাত্র