কোথায় যেন পড়েছিলাম, ‘প্রত্যেকটা পথ প্রতিনিয়ত আরেকটা পথের জন্ম দেয়।’ আর নতুন পথ মানেই সেখানে নতুন পথিকের আনাগোনা। যদিও খুব বেশি পথবাদী মানুষ না হলে সেই গলি-উপগলি চেনা মুশকিল। অভিশাপে হোক বা আশীর্বাদে, আমি মাঝে মাঝেই এমন সব পথে ঢুকি। এর চারপাশটা, নির্জনতা, নোংরা, ধুলোবালি, ক্লেদ, দেয়ালের লেখা, পোস্টার খুব আগ্রহ নিয়ে দেখি।
এসব দেখতে আমার ভালো লাগে, মনে হয় অচেনা কিছু দেখলাম। সবচেয়ে আকর্ষণীয় এই পথের মানুষগুলো। বিচিত্র মুখ, অথচ চেনা তাদের চরিত্রায়ণ। আরও বিচিত্র কিন্তু চেনা তাদের কথা, গল্পগুলোও। রাত যখন গভীর হয়ে আসে, তখন এসব নানা কথার ঝুলি ও গল্পের ডালা নিয়ে আসর বসায় রাস্তারা। স্ট্রিট লাইটের ঘোলাটে আলোয় রাস্তারা নিজেদের মধ্যে এসব নিয়ে আলাপ সেরে নেয়।
আগারগাঁও রেডিও অফিসের সামনে যে বটগাছটা আছে, সেখানে একদিন খুব রাতে আমি রাস্তাদের এই আড্ডাবাজিতে ঘটনাচক্রে সামিল হয়েছিলাম। সে এক বিচিত্র অভিজ্ঞতা, তবে সেটা না হয় তোলা থাক আরেক দিনের জন্য। আপাতত বৈচিত্র্য ও বিচিত্র সন্ধানী পাঠকদের আমি একটি অদ্ভুত পথের সন্ধান দিতে পারি। যেখানে একাকি হাঁটলে আমি নিশ্চিত, আপনি এমন কিছু অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হবেন, যা হয়তো আপনার পরিচিত, কিন্তু তবু এর কাঁপন একেবারে নতুন।
আমাকে বিচিত্র এই পথটির সন্ধান দিয়েছেন বন্ধু জাহীদ ইকবাল। শেষ করলাম তার নতুন উপন্যাস (নাকি একে বড় আলেখ্য গল্প বলবো)। সোজা সাপটা কথা হলো, সম্প্রতি যে ক’টি ভালো বই পড়েছি, জাহীদ ইকবালের ‘বাইশ খান্দান’ অন্যতম। তার বইটিকে যদি আমি নতুন এক পথ ধরি, সেখানে আমার সঙ্গে দেখা হয়েছে চেনা কিন্তু নানা অচেনা মানুষের। এমনকী বইতে লেখক হয়তো উল্লেখও করেননি, কিন্তু এমন কিছু চরিত্রও আমার ভাবনায় খেলা করে গেছে।
যে শূন্যস্থানে এসে হয়তো জড়ো হয় শব্দ, চেতনা আর অনুপ্রেরণারা। আপনি ওই শব্দগুলোকে নিয়ে আরও চমৎকার কথামালা গাঁথবেন, অপেক্ষায় রইলাম।
চোর ও দেহজীবী নামক আদিম দুই পেশাধারীদের নিয়ে এগিয়ে চলা এই গল্প যেন ক্ষণে ক্ষণে রূপ পরিবর্তন করে। কখনো সে আমাদের পরিচয় করায় অন্ধ কৃষ্ণপরীর সঙ্গে, পরক্ষণেই আবার দেখা হয় চোর রমজানের। বিচিত্র এই দুই চরিত্রের মধ্যে সম্পর্কের সুতো বেঁধে দেয় তা হলো, ক্ষুধা। এই ক্ষুধা শুধু ভুখা পেটের নয়, এই ক্ষুধা শরীরের, এই ক্ষুধা মনের, এই ক্ষুধা একাকিত্বের। গল্পে রমজানের চরিত্রটি এগিয়েছে যত দ্বন্দ্ব নিয়ে তার চেয়ে বরং কৃষ্ণপরী এসেছে আরও বিচিত্র রূপ ধরে। জাহীদ ইকবাল কবি বলেই হয়তো তার লেখার ভাষার মধ্যে এমন সব উপমা, ইঙ্গিত, ঘোর কাজ করে যে তা লেখাটা পড়ার সময় টেনে ধরে। যেমন আমাকে টেনে ধরেছিল কৃষ্ণপরী।
পরে গল্পে মায়া, আফজাল, রেনু, বেনু, মোমেনা, বশির মিয়াসহ অনেক চরিত্র এসেছে। তাদেরও সম্পর্কের সুতা সেই শরীর। কিন্তু কৃষ্ণপরী যেন আলাদা করে ভাবায়।
বাইশ খান্দান পড়তে পড়তে মনে হয়েছে জাহীদ ইকবাল লেখার শুরুতে কৃষ্ণপরী ও রমজানের প্রেম ও পরিণতি নিয়ে অনেক বেশি ঘোরগ্রস্ত ও ভেবেচিন্তে এগুচ্ছিলেন। তিন বোনকে খুঁজতে রমজান যখন কৃষ্ণপরীকে ফেলে শহরে এলো, তখনই মনে হয় লেখকের ভাবনাটা একটু ডাইভার্ট হয়েছে। তারপর এই গল্পের পথে পথে হাঁটতে গিয়ে আমার সঙ্গে দেখা হয়েছে মায়া ও তার বোনদের, মোমেনাসহ বহু লোকের। মায়ার মাধ্যমে যে বাইশ রকমের মানুষের সন্ধান লেখক দিতে চেয়েছেন, তা যথার্থ কিন্তু খান্দানের সংখ্যাটা মনে হয় আরও অধিক। যে মানুষরা হয়তো ভাষায় আসে না, কিন্তু চোখের অলক্ষে ঘোরাফেরা করে। তবে এত মানুষের ভিড়েও মনে আফসোস থেকে যায় কৃষ্ণপরী ও রমজানের জন্য। জানতে ইচ্ছে করে কী হলো, কৃষ্ণপরীও কি তবে বকুলের পথ ধরলো? রমজান তো তার বোনদের খুঁজে পাবে না, তাহলে কি সে আবার ফিরবে তার কৃষ্ণপরীর কাছে? কে জানে লেখক হয়তো সব প্রশ্নের উত্তর দিতে চাননি। আমার কাছে মায়া, মোমেনা, রেনু, বেনুদের এই পরীণতি অনেক বেশি অনুমেয়। তাই তাদের ঘটনা প্রবাহে ভাষার মুন্সিয়ানা এবং গল্পের গাঁথুনি লেখাটা পড়ে যেতে আগ্রহ জোগায়, কিন্তু মন পড়ে থাকে সেই গ্রামে কৃষ্ণপরীর কাছে। আগ্রহেরা মৌমাছির মতো ভনভন করে রমজানের আশপাশে।
যাই হোক, বাইশ খান্দানে লেখনির খান্দানিপনা ভালো লেগেছে বন্ধুবর জাহীদ। আপনার দেখানো নতুন পথটিতে ভ্রমণ উপভোগ্য ও ভাবনাউদ্দীপক ছিল। আমার মতে, লেখকের জন্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো কলম থামানোর উপায় জানা। আপনি সঠিক সঠিক জায়গাতেই কলম থামাতে পেরেছেন। ফলে বইটা মেদহীন হয়েছে, পড়তে ভালো লাগে। লেখাটির সঙ্গে টের পাওযা যায় আপনার সেই অতৃপ্তির শূন্যস্থানটুকু। যা হয়তো ক্রমাগত তাড়না দেয় নতুন ভাবনার। যে শূন্যস্থানে এসে হয়তো জড়ো হয় শব্দ, চেতনা আর অনুপ্রেরণারা। আপনি ওই শব্দগুলোকে নিয়ে আরও চমৎকার কথামালা গাঁথবেন, অপেক্ষায় রইলাম।