একজন লেখক কেন রম্যের আশ্রয় নেন? সমাজ ও রাষ্ট্রের দানব যখন নাগরিকের টুঁটি চেপে ধরে, ফায্ সিবাদ যখন লেখকের কলমের কণ্ঠরোধ করে, তখনই একজন সমাজসচেতন লেখককে বাধ্য্ হয়েই রম্যের আশ্রয় নিতে হয়। এই যেন রবি ঠাকুরের সহজ কথা যায় না লেখা সহজে। কথাগুলো মনে এলো, তাপস রায়ের ‘বঙ্গ ভাণ্ডারে তব বিবিধ আষাঢ়’ রম্যগ্রন্থটি পাঠের পর। তিনি যে উদ্দেশ্য নিয়ে এই রম্যগ্রন্থটি রচনা করেছেন, সেটি সম্পূর্ণ সফল ও সার্থক হয়েছে। ভেতরের আলোচনা আপাতত তোলা থাক। সংক্ষেপে বইটির ধারণা দেওয়া যাক।
ইদানিং পাঠকদের মোটা বই দেখলে গতরে জ্বর চলে আসে। কিন্তু হলফ করে বলতে পারি বনফুলের পাঠকের মৃত্যু হলেও এই বইটি পাঠক এক নিঃশ্বাসে পড়ে আবার জেগে উঠবে। রচনায় লেখক ভাষার অলঙ্কার ও অনুপ্রাস যেভাবে ব্যবহার করেছেন, তাতে পাঠকের মন বইতে আটকে থাকবে। এছাড়া, রয়েছে উপযুক্ত বাগ্ধারা, প্রবাদ-প্রবোচন, হিন্দু পুরাণের যুতসই ব্যবহার, যা বইটিকে দিয়েছে অসামান্য, মাত্রা ও বিবিধ ব্যজঞ্জন।
‘বঙ্গ ভাণ্ডারে বিবিধ আষাঢ়’ শিরোনাম পড়ে এর অর্থ যারা উদ্ধার করতে চাইবেন, তাদের জন্যভ সোজা সাপ্টা বলে দেই, আমরা প্রায়ই ইতিউতি আষাঢ়ে গল্প শুনে থাকি। এটা বন্ধুদের আড্ডায় হরহামেশাই যেমন আষাঢ়ে গপ্পো চলে, রাজনৈতিক নেতারা তেমন অহরহ আষাঢ়ে গল্প বিভিন্ন সভা সেমিনারে শুনিয়ে খাকেন। লেখক তার নামগল্পে সম্প্রতি ঘটে যাওয়া কিছু ঘটনার পাশাপাশি নেতাদের পক্ষ থেকে দেওয়া আষাঢ়ে গল্পগুলো তুলে ধরেছেন। ১৩ নম্বর পৃষ্ঠায় লেখক বলেছেন ‘আমি জানি, এই কথাটি আপনার কাছে আষাঢ়ে গল্পের মতো মনে হতে পারে। কেননা আপনারা শুনেছেন, এই বঙ্গে স্যারেরা আজকাল নম্বরের ঝুড়ি নিয়ে বসে থাকেন। চিকিৎসক যেমন রোগের পুরো নাম না শুনেই ঘ্যাচ ঘ্যাচ কলম চালান, শিক্ষকও তাই। উত্তরপত্র পুরোটা পড়ার আগেই খসখস কলম চালিয়ে দেন। দশে শূন্য দশ, হয়ে থাক বশ। শিক্ষা মন্ত্রণালয় খুশি, ছাত্র খুশি, শিক্ষক খুশি, অভিভাবক ব্যাটা খুশি না হয়ে যাবে কোথায়?’ এই গল্পের রেশ টেনেই তিনি বলেছেন, ‘এই তো গত বছর আমাদের মহল্লার ছেলে ছাইদুল জিপিএ-৫ পেলো। এই খুশির খবর সে যখন দুলতে দুলতে এসে আমাদের জানালো, আমরা দোটানায় পড়ে গেলাম। দুষ্টু ছেলেরাই তবে রটিয়েছিল, ছাইদুল নাকি প্রি-টেস্টে করগুনে পাঁচ বিষয়ে ফেল করেছিল! যাই হোক, এ কথা শুনে প্রেসার ফল করলো মহল্লার অনেকের।’
এরপর গল্পে রাজধানীবাসীর যাপিতজীবনের বিড়ম্বনার একটি অংশ তুলে ধরেছেন তিনি। ‘খোদ রাজধানীতে এক মশা সকালে কামড়াচ্ছে চিকনগুনিয়া হচ্ছে। আরেক মশা বিকেলে কামড়াচ্ছে ডেঙ্গু হচ্ছে। শোনা যাচ্ছে, সাধারণ মশারা ক্লান্ত হয়ে বিশ্রামে গেছে। যে কারণে মা মা করে ম্যালেরিয়া থেকে আপাতত মুক্তি। কিন্তু দুর্ভোগ থেকে মুক্তি মিলছে কই? বৃষ্টি নামলেই রাস্তায় হাঁটুপানি। পান থেকে চুন কিনলেই ভ্যাট। বছর ঘুরলেই আয়কর, পৌরসভার হোল্ডিং ট্যাক্স। মাস ফুরোলেই পানি, বিদ্যুৎ, গ্যাস—কত বিল মাথার মধ্যে কিলবিল করে খোঁচাচ্ছে। উল্টো গ্যাসও এখন শিখে গেছে বিদ্যুতের ছলাকলা। স্কুলে বাচ্চা রেখে এক ভাবি আরেক ভাবিকে বলছে, আপনাদের বাসায় সব সময় গ্যাস থাকে? উত্তরে, হ্যাঁ থাকে তো। ও মা! আপনাদের থাকে না? শুনে হিংসায় অন্যজনের পেটভর্তি অম্বল। প্রশ্নের উত্তর দেন না। শুকনো হেসে শুধু বলেন, অ। মনে মনে ভাবেন—মিথ্যুক, চাপা মারার আর জায়গা পাও না!’
এদিকে ‘তাড়া খাওয়া ভূতের জীবন’ গল্পে দুর্নীতিবাজ সরকারি সম্পদ লোপাটের চিত্র তুলে ধরেছেন। লেখক বলেছেন, ‘এই শহরের অলিতেগলিতে তাদের নিত্য চলাচল। চট করে চেনা যায় না তাই বাঁচোয়া। এ জন্য চাই দিব্যদৃষ্টি। দশ ঘাটের পানি খেয়ে জীবনের ঘানি ঘোরাতে ঘোরাতে ঘোড়েল না হলে কলিতে দিব্যদৃষ্টি হয় না। সেই দৃষ্টিতেই শুধু ধরা পড়ে এই সমাজ, সংসারে কত অযুত, নিযুত রাম নাম জপতে জপতে দুর্নীতির কাদাজলে গঙ্গাস্নান সেরে নেয়ার অভিনয় করছেন। কত শত সরকারি টাকা চলে যাচ্ছে ভূতের বাপের শ্রাদ্ধে। যাদের জন্য এই আয়োজন এক জীবনে জানতেই পারেন না তারা কতটা ভূতগ্রস্ত! এরপরেই তিনি লিখেছেন, ঘাড়ে ভূত চেপেছে এমন লোকের সংখ্যাও নেহায়েত কম নয়। পঞ্চায়েত সে খবর রাখে। বিলক্ষণ দেখেছি, বঙ্গরমনীরা কোমরে আঁচল পেঁচিয়ে ঝাটা দিয়ে সেই ভূত নামাতে পারেন, ফার্স্টলেডিরা পারেন না। পারলে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের আশঙ্কা অন্তত থাকে না।’
১৪টি গল্পের প্রতিটি গল্পেই লেখক ঘটনাগুলোকে হাস্যরস ও ব্যঙ্গ-বিদ্রূপাত্মকভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন। যা পাঠকদের একইসঙ্গে প্রাণ খুলে হাসাবে, আবার যাপিতজীবনের ঘটনাগুলোকে মর্মান্তিকভাবে মনে করিয়ে দেবে। অসঙ্গতিগুলো সম্পর্কেও পাঠকরা আরও সচেতন হবেন আশা করি। যাদের কটাক্ষ করে লেখা হয়েছে তারা কতখানি সংশোধন হবেন, সেই ভার সময়ের ওপর দেওয়া থাকলো।
পরের প্যারায় তিনি গল্পকে টেনে নিয়ে গেছেন তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের আশঙ্কা থেকে একেবারে হিন্দু পুরাণে। যেখানে তিনি বলেছেন, ‘শুনেছি দেবী দুর্গা যখন মহিষাসুরের সঙ্গে যুদ্ধ করছিলেন; তার সৈনাবাহিনীতে অনেক ভূত ছিল। তারা অট্ট অট্ট ঘট্ট ঘট্ট ঘোর হাসিতে হুম হাম থুম থাম ভীম শব্দে শত্রু নাশ করেছে। সেই ভীম শব্দ অনেক রাষ্ট্র প্রধানের কণ্ঠেও আজকাল শোনা যায়। তাদের ঝুপ ঝাপ দুপ দাপ লম্ফ ঝম্ফে ভূতল কাঁপে। তাদের শান্তির বাণী ভূতের মুখে রাম নামের মতোই শোনায়!’
লেখক আরেকটি গল্পে হিন্দু মিথ টেনে এনেছেন। এটির পুরোটা জুড়েই পৌরাণিক গল্পের রেশ রয়ে গেছে। গল্পের নাম ‘ত্রাহি সরস্বতী’। গল্পের শুরু করেছেন লেখক এইভাবে ‘সরস্বতীর মন ভালো নেই’। সরস্বতীর মন কেন ভালো নেই, এটা নিয়েই পুরো কাহিনি। কারণ সরস্বতীকে বিদ্যার দেবী বলা হয়। ঈশ্বর পুরো শিক্ষা ব্যবস্থার দায় তার ওপরেই দিয়ে রেখেছেন। পরীক্ষা কেন্দ্রে নকল হলে। প্রশ্নপত্র ফাঁস হলে। পরীক্ষায় শিক্ষার্থীদের ফল আশানুরূপ না হলে। যে কারণে দেবীর বিপদও কম নয়। গল্পের মাধ্যমে লেখক বলেছেন, ‘‘কত স্বপ্ন, কত আশা—ছয় ব্যাটারির টর্চের আলোর মতো সরস্বতী দিকে দিকে শিক্ষা আলো ছড়াবেন। নয় ছয় হবে না। বঙ্গের ঘরে ঘরে শোভা পাবে জিপিএ-৫ সনদ। তিনি থাকতে কেউ ‘আদু ভাই’ হয়ে পস্তাবে- তা হবে না- তা হবে না। একজন শিক্ষাথীও ফেল করে গলায় দড়ি দেওয়ার সুযোগ পাবে না। প্রয়োজনে পরীক্ষার ফল যেদিন বেরুবে মিষ্টি সরবরাহ করতে গিয়ে কুলিয়ে উঠতে না পেরে মনের দুঃখে ময়রা ব্যাটা দেহখানাই ঝুলিয়ে দেবে।’ এই যখন অবস্থা তারপরেও প্রশ্ন ফাঁস ঠেকানো যাচ্ছে না কিছুতেই। দেবী সরস্বতীর এজন্য মন ভালো নেই। প্রশ্ন ফাঁস ঠেকাতে দেবীর নির্দেশে নারদ পরীক্ষার আগের দিন রাতে মর্তে এলেন। রাতের ক্যাম্পাস তিনি ঘুরে দেখবেন। যদি কোন ক্লু পেয়ে যান। ঘুরতে ঘুরতে তিনি এমন ক্লু পেলেন সব ক্লিয়ার হয়ে গেলো। নারায়ণের নাম জপতে জপতে তিনি ভাবতে লাগলেন- মর্ত্যে না এসে সোজা মরতে যাওয়াটাই ভালো ছিল। যা দেখলেন তাতে চোখ কপালে উঠে গেলো। ব্যর্থতার সেই বোঝা এবার মাথায় চাপা বসেছে। প্রশ্ন ফাঁস ঠেকানোই যাচ্ছে না। কর্তৃপক্ষের একেবারে হাসফাঁস উঠে গেছে। পুরো ক্যাম্পাস জুড়ে শিক্ষার্থীদের ‘বাইছা লন, দেইখ্যা লন’ অবস্থা। ফেসবুকের ইনবক্স, মোবাইলের ম্যাসেঞ্জারে একটাই প্রশ্ন- পাইছো? এখনও পাই নাই! আমি পাইছি। এরপর ভিক্টরি সাইন আর হরেক রকম ভেটকি হাসির ইমো। যারা পেয়েছে তাদের একেক জনের একেক অবস্থা। কেউ ‘ইউরেকা, ইউরেকা’ বলে দ্রুত ঘরে ফিরে যাচ্ছে। আর্কিমিডিস পেয়ে গৌরবে চিৎকার করেছিল। এরা ঠিক উল্টো ফিরছে চোরের মতো। কেউ ভাবছে এই হলো জীবনের সেরা পাওয়া। তাদের মনজুড়ে ‘আমি পাইলাম ইহাকে পাইলাম’ ভাব। কারো আবার খুশিতে ‘পথ হারিয়ে কোন বনে যাই’ দশা! নারদ নিজেও একটি সংগ্রহ করে মনে মনে বললেন, গোল্লায় যা! সকালে পরীক্ষা কেন্দ্রে ঢুকে নারদের মনে হলো প্রত্যেকটি কেন্দ্রের চারপাশে যেন গরুর হাট বসেছে!’’
৩৯ পৃষ্ঠায় পাওয়া যাবে ‘নিঃসঙ্কোচে দেওয়া মিথ্যা বচন’। এই রম্যগল্পে ভোটে দাঁড়ানো প্রার্থীরা কিভাবে জনগণকে মিথ্যা আশ্বাস দেন, সেটি তিনি সরাসরি তুলে ধরেছেন। তিনি বলেছেন, ‘নির্বাচন এলেই আমাদের দেশের প্রার্থীরা যোগ্যতার প্রমাণ দিতে মরিয়া হয়ে ওঠেন। কণ্ঠে শোনা যায় সাম্যের গান। ভাবটা এমন মেরেছিস কলসির কনা, তাই বলে কি প্রেম দেবো না? ব্যাক গ্রাউন্ডে বাজতে থাকে সমবেত নির্বাচনি সংগীত—একটা ভোট দিয়া যান, ভাইজান যোগ্য ইনসান। এ সময় প্রার্থীকেও গলা মেলাতে হয় বাধ্য হয়েই। বেচারা নিজেই যে গলা পানিতে দাঁড়িয়ে। পাড়ে উঠতে বে। তার জন্য আগে পেরে ওঠা চাই। ফলে ডিম পাড়া মুরগির মতো কক্ কক্ শব্দে জানান দেন তার গৌরব। তৈরি হয় সত্য মিথ্যার ওমলেট। নির্বাচন মানেই কি তবে নিঃসংকোচে দেওয়া মিথ্যা বচন? ভোটাররাও শিখে গেছেন বচন থেকে বাঁচার কৌশল। একবার এক প্রার্থী গণসংযোগে বেরিয়েছেন। যাকেই দেখছেন, সালাম দিচ্ছেন, জড়িয়ে ধরছেন, কুশল জিজ্ঞেস করে কৌশলে ভোট চাইছেন। তবে তিনি নিশ্চিত হতে পারছেন না। বিদায় নেওয়ার আগে বার বার বলছেন, আপনার ভোট পাচ্ছি তো তাহলে? সবাই মাথা ঝাঁকিয়ে, হাতে ঝাঁকি দিয়ে হ্যা হ্যা করলেও একজন বিব্রত কণ্ঠে বললেন, না মানে আমি আসলে আপনার আগে একজনকে কথা দিয়ে ফেলেছি। শুনে প্রার্থী হেসে উঠলেন- আরে! তাতে কী হয়েছে? আপনি তো দেখছি এখনও ছেলে মানুষ রয়ে গেছেন। রাজনীতিতে কথায় এবং কাজে অনেক ফারাক। কথা দিলেই রাখতে হবে এমন কোনো কথা আছে নাকি? এবার ভোটদাতা স্বভাবসুলভ হাসি দিয়ে বললেন, তাহলে আর চিন্তা কী! আমিও আপনাকে কথা দিলাম!’
এভাবেই লেখক পুরোটা বইয়ে বর্তমান সমাজ এবং রাষ্ট্রের নানা অসঙ্গতি এবং নিজেদের নির্বুদ্ধিতার কথা তীর্যকভাবে তুলে ধরেছেন তার কলমের মাধ্যমে। ১৪টি গল্পের প্রতিটি গল্পেই লেখক ঘটনাগুলোকে হাস্যরস ও ব্যঙ্গ-বিদ্রূপাত্মকভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন। যা পাঠকদের একইসঙ্গে প্রাণ খুলে হাসাবে, আবার যাপিতজীবনের ঘটনাগুলোকে মর্মান্তিকভাবে মনে করিয়ে দেবে। অসঙ্গতিগুলো সম্পর্কেও পাঠকরা আরও সচেতন হবেন আশা করি। যাদের কটাক্ষ করে লেখা হয়েছে তারা কতখানি সংশোধন হবেন, সেই ভার সময়ের ওপর দেওয়া থাকলো। তবে ‘বঙ্গভাণ্ডারে তব বিবিধ আষাঢ়’ বইটিতে সামসাময়িক ইস্যু নিয়ে লেখা হলেও এতে কালোত্তীর্ণ হওয়ার মতো বিষয় রয়েছে। আশা করি, পাঠক মহলে বইটি সমাদৃত হবে।
বঙ্গ ভাণ্ডারে বিবিধ আষাঢ়
তাপস রায়
প্রকাশকাল: অমর একুশে গ্রন্থমেলা ২০২০
প্রকাশক: অনার্য পাবলিকেশন্স
মূল্য: ২৪০ টাকা