বুদ্ধির দীপ্তি ও হৃদয়ের সংবেদের মিশেলে কবি সেবক বিশ্বাসের এক নান্দনিক কাব্য। মানবিক চেতনায় উজ্জীবিত এই কবির কাব্যটিতে মুখ্যত যুগযন্ত্রণার নানা প্রকাশ লক্ষ্য করা যায়। মানবতার মুমূর্ষু দশা তাঁর চোখে ধরা পড়ে, তিনি দেখেন সভ্যতার নামে নষ্টামো, পাশবিকতা ও পৈশাচিকতা। বর্তমান সভ্যতাকে তিনি বলেছেন নীল সভ্যতা, যা কোনোভাবে প্রাণটি নিয়ে বেঁচে আছে, কিন্তু দারুণ অসুস্থ। তার ভাষায়-
সভ্যতার ইটে ইটে নগ্নতার বিদ্যুৎ-ঘর্ষণে
জন্ম হয় মৃত্যু-মশালের।
গ্যাংগ্রিন পায়ে হেঁটে চলে নীল সভ্যতা।
তিনি সমাজ ও পরিপার্শ্বে দেখতে পান ‘গোলাপের ফসিল’। তার ভাষায়, সুন্দর ও সৌকুমার্যে ভরপুর ছিল যে মনুষ্যত্ব, তা মরে গিয়ে হয়ে গেছে মিশরের পিরামিড এবং স্বপ্নের জোনাকিগুলোও পুড়ে শেষ। সময়ের নানা অপঘাত, সন্ত্রাস, হত্যা ও হানাহানিতে শান্তি, সুন্দর ও ভালোবাসা উজার হতে দেখেই তার মাঝে এই শূন্যচেতনার জাগরণ।
আমরা এর আগে সুধীন দত্ত, জীবনানন্দ ও শামসুর রাহমানের মাঝেও শূন্যবোধ প্রত্যক্ষ করেছি। সময়ের বিনষ্টিতে সুধীনের মাঝে এই শূন্যবোধ এক অনালোকিত মরুভূমি রচনা করেছিল। শূন্যতা ও শূষ্কতা একাকার হয়ে সুধীনের রিক্ত, আত্মবৈরী কাব্যমানসে উন্মোচিত হলো, যেমন দেখেছি তাঁর ‘উঠপাখি’ কবিতায়-
কোথায় লুকাবে? ধু ধু করে মরুভূমি
ক্ষয়ে ক্ষয়ে ছায়া মরে গেছে পদতলে।
আজ দিগন্তে মরীচিকাও যে নেই;
নির্বাক, নীল, নির্মম আকাশ।
জীবনানন্দেও শূন্যবোধ ছিল, তবে তা তার আত্মনিবিষ্ট মনোভূমিতে লালিত বিষাদ ও নৈঃসঙ্গ্য থেকেই উদ্ভূত। তবু তার আত্মগুণ্ঠিত, নির্জনতম অবস্থানটিও যে সময়ের বেদনাগুলো চিত্তপটে শুঁষে নেওয়ার ফলে সৃষ্ট, তা বলা যায়। তা না হলে তিনি কেন বলবেন, “সবকিছু তুচ্ছ হয়, পণ্ড মনে হয়/ সব চিন্তা প্রার্থনার সকল সময়/ শূন্য মনে হয়”। এই শূন্যবোধেরই আরো ব্যাপ্তি, আরও প্রকোপ লক্ষ করা গেল শামসুর রাহমানে এসে। ক্লিষ্ট ও দুর্দশাগ্রস্ত সমকালে তার উচ্চারণ,- “মুছে গেল দৃশ্যাবলী চারদিকে, অনন্তর একা/ আমি আর অকূল শূন্যতা” (‘সুন্দরের গাথা’)। তিনি ‘একটি বিনষ্ট নগরের দিকে’ শীর্ষক কবিতায় লিখেছেন-
বারুদমণ্ডিত কাঠিগুলো একে একে পুড়ে গেল,
দেশলাই খুব শূন্য থেকে যায়,
অনুরূপ শূন্যতায় ভোগে এ মূঢ় শহর সারাবেলা;
ট্রাম্বোন দূরের কথা,
এমন কি দিকপ্রিয় পুলিশের বাঁশি
যায় না শোনা কোথাও এখন।
পূর্বসূরিদের মতো জীবন ও সমাজের সংকট কবি সেবক বিশ্বাসকেও নিয়ে গেছে এক প্রখর শূন্যবোধের ভুবনে। কখনো হৃদয়টাকে তাঁর মনে হয় হিরোসিমা বা নাগাসাকির মতো আণবিক আঘাতে মৃত। আবার কখনো শুষ্ক নদী-“মনটা বুঝিবা শুকিয়ে মরে গেছে/ মধুকবির কপোতাক্ষের মতো”। তার শূন্যতা ফের যেন মৃত্যুর অন্য নাম-
হলুদ ধুলোয় গড়াগড়ি দেয় অন্ধ পৃথিবী,
বিমূর্ত বলাকা বাসা বাঁধে বিষণ্ন বলয়ে,
বুকের শূন্যতায় শুয়ে থাকে মৃত ফুসফুস।
তার এই শূন্যবোধ কেবলই বিষণ্নতা ও দুঃখবোধ নিয়ে আবর্তিত, যা ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে তাঁর কবিতার পর কবিতায়। শূন্যতা ও অন্ধকার একই বাকপ্রতিমা নিয়ে ধরা দেয়। কিছু উদাহরণ দেওয়া যাক-
১. শূন্য সভ্যতার দুর্মর অন্ধকারে
রাত জ্বলে কৃষ্ণ শিখায়২. বুঝি, শেষ হয়ে গেছে সব।
গোলাপ এখন মনে হয় এক একটা
রক্তবোম।৩. উননে শয্যা পাতে কালো রাত,
আগুন জ্বলে না এককাঠি৪. পিশাচ বুলেটে বিদীর্ণ হয়
বাংলার বুক,
সিঁড়িতে শুয়ে থাকে মহাকাল,
বত্রিশ নম্বরে।৫. বুকের শ্মশানে খা খা করে
বিধ্বস্ত ট্রয়।৬. মনুষ্যত্ব এখন মিশরের পিরামিড;
এসে গেছে তার ডেথ- সার্টিফিকেট।৭. হৃৎপিণ্ডের পেছনে তার চুয়াল্লিশ বছরের চক্রান্ত;
পুড়ে গেছে সময়ের পাণ্ডুলিপি!
কবির শূন্য বো ক্লিষ্টতার এমন আরও অনেক দৃষ্টান্ত তুলে ধরা যায়। আসলে এই শূন্যতা থেকে তার মাঝে জাগে পূর্ণতার স্বপ্ন, অন্ধকার ঘোচানোর জন্য আলোর প্রত্যাশা। এমন একটি বিপ্লবের স্বপ্ন তাকে তাড়া করে, যা স্বদেশ, সমাজ ও পৃথিবীকে করে তুলবে অর্থবহ, বিভেদ-বৈষম্যহীন ও মানুষের বাসযোগ্য। তাই তো তার আহ্বান:
বন্ধু জেগে ওঠো,
সূর্যের চোখে চোখ রেখে সূর্য হও;
আলোতেই লেখা থাকে রাত্রির মৃত্যু।
এ কাব্যে কবির প্রেমের দিকটি একেবারেই গৌণ। প্রেমের কবিতায় দেখি তার এক কল্পদয়িতা, যে রাখিতা নামে সম্বোধিতা, তাকে পেলে তার অন্তর ‘প্লাবিত হয় উষ্ণপ্লাবণে’ এবং না পেলে বেদনাভার নিয়ে অপেক্ষার প্রহর কাটান। তেমনি ভালোবাসা এলে তার ‘বুকের বনতল ভরে ওঠে গুচ্ছ গুচ্ছ গোলাপ ফুলে’ আর তা যখন অধরা তখন ‘বালুর সাহারা চিকচিক করে বুভুক্ষু বুকে।’ এভাবে মিলন ও বিরহের স্বাভাবিক অনুভূতি নিয়ে গড়ে উঠেছে তার প্রেমবোধ। তবে প্রেমের বর্ণনার মাঝেও যুগযন্ত্রণাক্লিষ্ট সময়ের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ বর্ণনা এসে যায়। ‘পেনসিলে আঁকা জীবন’ কাব্যের আর একটি উল্লেখযোগ্য দিক, আমার মতে, পরাবাস্তব চেতনা। আর শূন্যবোধ সেই পরাবাস্তব চেতনারই সহযোগী। শুধু তাঁর ক্ষেত্রেই নয়, অনেক পরাবাস্তব কবির বেলায়ই এটা দেখা যায়। তবে একথা আমি বলছি না যে, সেবক বিশ্বাস হাড়েমাংশে পরাবাস্তব কবি। বাস্তব ও পরাবাস্তবের মিশেলেই তার কবিসত্তা। আর তার শূন্যবোধও শূন্যবাদ (nihilism ) নয়। শূন্যবাদী দর্শনে প্রথা ও প্রচলিত বিশ্বাসগুলোর ব্যাপারে যে সম্পূর্ণ প্রত্যাখ্যান বা নেতিবোধ কাজ করে তা তার কবিতায় দৃষ্ট হয় না। তার শূন্যবোধ জীবন, সমাজ ও পরিপার্শ্বের অন্ধকার বা অবস্থাগত রিক্ততা থেকে জাত। এই শূন্যবোধ কবির পরাবাস্তব চেতনায় কিভাবে ধরা দেয়, তার একটি পরিচয় তুলে ধরা হলো-
সময়ের সামিয়ানা তলে থেমে যায় সেতারের সুর,
হলুদ মগজ ফেড়ে বেরিয়ে আসে দীর্ঘ হাড়।
এই যে ‘সময়ের সামিয়ানা’ ভাবা কিংবা মগজ ফেড়ে হাড় বেরোনোর মাঝে যে প্রত্যাশিত সুন্দরকে হারিয়ে শুষ্ক, শূন্য বা নিঃস্ব হয়ে যাওয়ার পরোক্ষ কথা বলা, তা পরাবাস্তর কবির পক্ষেই সম্ভব। এখানে সত্যটি কবির মগ্নচৈতন্যের রশ্নিতে বাস্তবের চেয়ে পরম বাস্তব হয়ে বিচ্ছুরিত হয়। এভাবে কল্পনা ও বাস্তব, স্বপ্ন ও সত্য তার কবিতায় অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িয়ে থাকে। কবির নির্মিত কিছু পরাবাস্তব চিত্রকল্পের দৃষ্টান্ত তুলে ধরা হলো-
১. স্খলিত সারঙ্গীর পোড়াপথে ঝরে পড়ে
মৃত মোমবাতির শেষ স্বরলিপি২. চন্দ্রবিন্দু থেকে নেমে আসে মৃত সূর্য
৩. গোধূলির তীরে হেঁটে আসে প্রভাত-পথিক,
পরিযায়ী পায়ে তার ঝরে পড়ে
নীড়ে ফেরা পাখির ধুসর পালক৪. স্বাধীনতার কৌণিক শরীরজুড়ে
জাল বোনে অষ্টপদী;
প্রজাপতি ডানায় ছটফট করে শোকের ডালপালা৫. বেঁকে গেছে শাপলার ঘাড়
সাদা করুণ কান্নায়
কবি যে শুধু পরাবাস্তব চিত্রকল্পই গড়েছেন তা নয়, শিল্পীর তুলিতে নৈসর্গিক ছবি আঁকার মতো অনেক সরল ও দৃশ্যমান প্রকৃতির চিত্রকল্পও (visible image ) পাওয়া যাবে তার কবিতায়। আর পাওয়া যাবে অল্পসল্প বিমূর্ত চিত্রকল্পের উঁকি। তার প্রতিটি কবিতাই যেন চিত্রকল্পের মালা, সেখানে বিবৃতিধর্মিতা সামান্য। আমার কাছে সবচেয়ে ভালো লেগেছে তার উপমাভিত্তিক চিত্রকল্পগুলো, যেগুলোর কিছু দৃষ্টান্ত তুলে ধরার আগ্রহ সংবরণ করতে পারছি না-
১. কালো জুতোর মতো কিম্ভূত দাঁত
২. জিওগ্রাফি চ্যানেলে দেখা ক্ষিপ্র হরিণীর মতো
ছুটে যায় পুরানো পা৩. প্রিয়ার টিপের মতো ওঠে অভিসারী চাঁদ
৪. বেলুম্বা চারাটি শুকিয়ে গেছে
বিবেকের মতো৫. কলাপাতার মতো নত হয় ঋজু মুখ
প্রবহমান গদ্যভঙ্গিতে প্রতিটি শব্দের অপরিহার্যতা নিয়ে গড়া কবির ভাষাবন্ধ। তার কবিতার শব্দ-বিশেষণ ব্যঞ্জনাময়। শব্দগুলো কোনো রীতিসিদ্ধ ছন্দের শেকলে বাঁধা না পড়েও যেন বিভিন্ন মাপের মুদ্রার ঝরে পড়ার মতো শব্দে ধ্বনিত হয়। এমনই কবির গদ্যছন্দের সুর। আর এই শব্দাবলি, প্রজেক্টিভিস্ট কবি চার্লস অলসনের ভাষায় বলতে হয়, ‘জেনারেটরের ব্যাটারির মতোই শক্তিধারণ, শক্তি-সঞ্চালন ও শক্তিস্রাবের আধার।’ কবির সঙ্গে আমার পরিচয় নেই, এর আগে তার কবিতা পড়েছি বলে স্মরণ হয় না। একজন কাব্যপিপাসু পাঠক হিসেবে বলছি, প্রথম কাব্যেই কবি সেবক বিশ্বাসের যে পক্ক কাব্যবোধ দৃষ্ট হলো তা নিঃসন্দেহে প্রশংসার উপযোগী। তিনি এই ঋদ্ধ বোধটিকে আগলে রাখতে পারলে সমকালীন বাংলা কবিতায় আরও অনেক কিছু অবদান রাখতে পারবেন বলে আমার বিশ্বাস।
পেনসিলে আঁকা জীবন
লেখক : সেবক বিশ্বাস
প্রচ্ছদ : মোস্তাফিজ কারিগর।