কবিতার মাঠ নানা ‘মতবাদে’ বিভক্ত হয়ে দিনে-দিনে আবাদের অনুপযোগী হয়ে উঠছে। কবিতা আধুনিকতার সড়ক অতিক্রম করে তথাকথিত উত্তরাধুনিকতার দিকে যাচ্ছে! ফলে কবিতা হারাচ্ছে তার নান্দনিকতা। কবিতার এ অসুস্থ সময়েও যারা কবিতাকে সত্যিকারের নন্দনকাননের দিকে নিয়ে যাচ্ছেন, ফারাহ সাঈদ তাদেরই একজন।
‘পুকুর লাফাচ্ছে লাফাক/ আঁশগন্ধা দুপুরটিও খুন হয় হোক’—প্রত্যেক কবি নিজস্ব জগতে কবিতাকে বেড়ে উঠতে দেয়। এ বেড়ে ওঠাই একদিন পাঠকের কাছে আলাদাভাবে পঠিত হয়। ‘আঁশগন্ধা দুপুর’ কবির কল্পনা, বোধের জগত, শব্দের নতুন ব্যাঞ্জনা পাঠককে পাঠে টেনে নেয়।
এ কোন ভ্যাপসা দিনে
ছেঁড়া বিকেল সেলাই করো তুমি?
ফারাহ কবিতায় যা বলতে চান সহজ করে বলেন। তবে, তার কবিতা সরল নয়। তার কবিতায় শব্দেবাক্যে পরিমিত বোধের ভেতর দিয়ে চিন্তার ভিন্ন এক জগত থাকে। যা পাঠককে কিছুক্ষণ পাঠের ম্যাজিকে বুঁদ করে রাখে।
১. বুকপকেটে ভাঁজ করা নদীযুগল দেখি
২. ব্যাগটির ভঙ্গিমা বলে দিচ্ছে আমি আর ফিরব না
৩. লিফটে তুলে দিচ্ছি মেঘ
৪. দরজা ফেরত একটি ঘুম
এ কবির শব্দের সেলাই মেশিন প্রশংসার দাবি রাখে। চেনাজানা শব্দের ঘোরে নতুন দ্যোতনা দিতে জানেন তিনি। বলার ভঙ্গিতে বিমূর্ত ভাবের মধ্যে রহস্যবাদ কবিতাকে কেমন পেলবতা দান করে। পাঠে শব্দের স্বাদ ধরা পড়লেও পাঠশেষে কবিতা আয়ুর প্রত্যাশায় কিছু-কিছু মানিপ্ল্যান্ট হয়ে ওঠে।
ফারাহর কবিতায় যে বৈশিষ্ট্যগুলো ফুটে ওঠে সেগুলো—
ক. শব্দের উত্তরাধুনিক কারুকাজ
খ. ইংরেজি শব্দের সফল প্রয়োগ
গ. কবিতা মেদমুক্ত
ঘ. নাগরিক বোধে প্রকৃতির শৈল্পিক বয়ান
ঙ. কবিতার ম্যাজিক ফাঁকে ভিন্ন ভাবনার উপস্থিতি
কবিতা যাপিত জীবনের বয়ান। ফারাহর কবিতা তার ব্যতিক্রম নয়। তার কবিতায় পুরাণের কৌশলও নতুন ব্যাঞ্জনায় ব্যাঞ্জিত। ‘ফেরাউনের অক্ষত ম্যাজিক’ তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। তার কবিতা ওড়নার অসুখ পেরিয়ে, দুঃখগুলো খুচরো পয়সার মতো উড়িয়ে, অ্যাপনে রক্তের দাগ শুকিয়ে যাত্রা করে প্রেমময় রোদের দিকে—দুধে ও মাখনে নুনে ও পেঁয়াজে। তিনি কবিতায় যে অন্ধকার, হতাশার ছবি আঁকেন, তা শেষমেশ আলোর যাত্রী হয়ে ওঠে। কবিতার শরীর থেকে তিনি সরিয়ে দিতে চান ক্লান্ত সেমিকোলন।
‘পৃথিবীর নিচুছাদ প্রেম’ কাব্যগ্রন্থে শব্দে-নৈঃশব্দ্যে কবিতাকে ধরার কৌশলটা চমৎকার। তবে কবি ছন্দ প্রয়োগে ব্যর্থ। কবিতায় নিরীক্ষাপ্রবণ কাজ করতে গিয়ে কবিতা হারিয়েছে কিছুটা খেই। এ কাব্যের উল্লেখযোগ্য কবিতাগুলো হলো ‘যুদ্ধে যাচ্ছো যাও’, ‘মনোটনাস শীতকাল’, ‘সাইকেল ফিরে এসো’, ‘মাটি অব্দি হেসো না কারমেন লোপেজ’, ‘ব্রেইল এক স্পর্শ ছুরি’, ‘এল শেইপের বাড়ি’, ‘এ বর্ষায় খুন হওয়া নদী’, ‘সিকুয়েল’, ‘মরিয়মের জানালা’, ‘পিশপাশ বানাবে মা’।
সামগ্রিকভাবে ফারাহ সাঈদ এ কাব্যে সময়, ব্যক্তির মনোজগত তুলে এনেছেন ডুবুরির মতো। প্রকাশ করেছেন একজন নিপুণ শিল্পীর তুলিতে। আধুনিক কালের জীবনযাত্রা ও ব্যক্তির অন্তর্জগত শব্দে চিত্রায়ণের ক্ষেত্রে ফারাহ্ সাঈদ অনেকটাই সফল—এ কথা দ্বিধাহীন চিত্তে বলা যায়।
- পৃথিবীর নিচু ছাদ প্রেম: ফারাহ সাঈদ, প্রকাশক: বাংলা বই, প্রকাশকাল: বইমেলা ২০১৬