যাকে আমরা শুরু বলতে পারি
কবিতা নিয়ে লিখতে গেলে চিরটাকালই একটা অস্বস্তি, একটা খচ খচ বুক ঢিপ ঢিপ ভাব চেপে বসে। দুর্বল চিত্তের লক্ষণ, বোঝা যায়। আমার পক্ষের দুর্বল যুক্তিটা হচ্ছে, কবিতা ভাব প্রকাশের এমন এক মাধ্যম, যার অনুভব ভিন্ন তো বটেই একেবারে উলটো স্রোতেও প্রবাহিত হয় এবং তার বিস্তর নজির দেখার জন্যে আমাদের খুব বেশি কসরৎ করতে হয় না। একই কবিতা ভিন্ন পাঠে পায় ভিন্ন অনুভব, ভিন্ন জন্ম। তবে ভরসা এই যে, মহাপ্রাণ আলোচক, সমালোচক বা বোদ্ধাদের প্রবল প্রভাবের কালেও কোনো এককোণে কেবল পাঠানুভূতি প্রকাশের সুযোগ আমরা কেউ কেউ পাই, যারা কবিতা-কাঠামো বা তত্ত্ব না-জানা অভাজন। অল্পে খুশি থাকাই আমাদের বৈশিষ্ট্য। তারপরও কাজটা বড্ড কঠিন হয়ে দাঁড়ায় যখন লিখতে বসি প্রিয় কোনো কবির কবিতা নিয়ে। পক্ষপাতদুষ্ট উপলব্ধির ঝুঁকি রয়ে যায়। যাক। সেটুকু ঝুঁকি না হয় থাক। আমার লাভের জায়গাটা তো পাওয়া যায়। আরও কিছু কবিতার সান্নিধ্যের আশা থেকে যায় এই মৃত্যুপ্রবণ পৃথিবীতে। যাযাবর কবিতা, প্রেম-দ্রোহের যুগলবন্দি আর বাও-বাতাসের কবিতাঘূর্ণিতে আমার জন্মান্তর ঘটে না হয় কিছুক্ষণের।
ফেরদৌস নাহার। কবিতার একনিষ্ঠ শ্রমণ। তার কবিতা ভাণ্ডার নিয়ে পাঠকের সামনে সরবে উপস্থিত থাকছেন আশির দশক থেকেই। ‘ছিঁড়ে যাই বিংশতি বন্ধন’ (১৯৮৬) দিয়ে শুরু। ২০১৯-র আজকের দিন পর্যন্ত তার প্রকাশিত একক গ্রন্থ মোট ১৮টি। এর ভেতর ১৫টি কবিতার এবং ৩টি প্রবন্ধের বই। আমি আজ লিখছি ফেরদৌস নাহারের ‘পাখিদের ধর্মগ্রন্থ’ নিয়ে। এটি কবির বারোতম কবিতাগ্রন্থ। প্রথম প্রকাশ কলকাতা বইমেলায় ২০১৫ সালের জানুয়ারিতে। প্রকাশক কৌরব প্রকাশনী।
কবির লেখার সঙ্গে পাঠক হিসেবে একটা বোঝাপড়া শুরু থেকেই আমার আছে। ফেরদৌস নাহারের সব কবিতা ও প্রবন্ধ-গ্রন্থের সঙ্গে আমার পরিচয় ঘটেছে স্বাভাবিকভাবেই। কারণ তার কবিতার ধরন, বিষয় ও মায়াময় সাবলীল গদ্য আমাকে টানে। এর আগে তার ‘বর্ষার দুয়েন্দে’ ও ‘পান করি জগৎ তরল’ কবিতাগ্রন্থ দুটি নিয়ে আমার পাঠানুভূতি লিখেছিলাম। এই বইটি নিয়ে লিখতে গিয়ে আগের কবিতাগ্রন্থগুলো থেকে কিছু অন্য বিষয় বা ভাবের সঙ্গে পরিচিত হয়েছি। যেটি স্পষ্টতই একজন কবির বহুমাত্রিকতা ও কবিতার উত্তরণকে ইঙ্গিত করে। ‘পাখিদের ধর্মগ্রন্থ’ কাব্যে আপাত দৃষ্টিতে দুটি বিপরীতধর্মী অর্থবহনকারী শব্দের যুগলবন্দি কতটা দ্যোতনা সৃষ্টি করে, সেটা নিয়ে ভাবার আগে সরল পথটায় যাই। পাখি চিরকালই প্রায় সব সৃজনকর্মে মুক্তির প্রতীক হয়ে এসেছে। আর ধর্মগ্রন্থ উচ্চারণ-মাত্রই ভার বোধ করবেন না, এমন শিল্পপ্রেমী পাওয়া দুষ্কর। মোচড়টা এখানেই। ‘পাখিদের ধর্মগ্রন্থ’র ধর্ম, যত দূর টের পাই, মূলত স্বভাব। স্বভাবের ইচ্ছে, গতিপ্রকৃতিসমূহ। যেখানে ভাষার ঔদার্য্য, অবমুক্তির গান গীত হয়। নামটায় একটা উড়াল, একটা ভ্রমণের গন্ধ। জন্মেই নিয়মের রজ্জুতে বাঁধা পড়ে মানুষ, তার সামনে পাখি মূলত মুক্তির পথিক। আর তাই অবমুক্তির আকাঙ্ক্ষা তার ভেতর তীব্রভাবে জিইয়ে থাকে। জগতের ক্ষমতাসীন নিয়ম-কানুনের চাপে সেগুলো প্রতিনিয়ত পিষ্ট হয়, অবরুদ্ধ হয়। তবে এটাও ঠিক মাটির শেকল কেটে কম মানুষই পারে মনের উড়পলপনার সঙ্গে হতে। নামের সূত্র ধরে পাঠক নিজেকে অবমুক্ত করার একটা আভাস পান কি শুরুতেই? কবিতার পাঠকেরা এই বইটির কবিতাগুলোর সঙ্গে উড়ালভ্রমণের একটা প্রস্তুতি নিতে থাকবেন, সেটা নিশ্চিত। ফেরদৌস নাহারের কবিতা মানে ভ্রমণকাহিনীর ব্যঞ্জনা সেখানে আছে। কবিতায় কবির কল্পনা আর অভিজ্ঞতার ভ্রমণসঙ্গী হয়ে যাই আমরা পাঠকেরা। শুরুতেই ‘পাখিদের ধর্মগ্রন্থ’ নামের সুষমায় কবি খানিকটা মাত করে দিলেন বোধহয়। আমাদের অভ্যস্ত কান ও মনের প্রস্তুতি শেষ। ব্যাকপ্যাক চাপিয়ে এবার যাত্রা শুরুর পালা।
এক বিজন যাত্রার গান
পাখিদের ধর্মগ্রন্থে আছি। মানুষ আমাকে মনে রেখো না
এই জন্মে মানুষ পরিচয়ে আসমানি কিতাবের আশ্রয়ে
পুরোপুরি যেতে পারি নি, তাই
পাখিদেরই আপন মনে হয়েছে বার বার। উড়ে গেছি
আরও যাব। যেতে যেতে পাখিরা নিশ্চয়ই টেনে নেবে
চুমু খাবে গভীর আগ্রহে, মানুষ যা কোনোদিনও পারে নি…
উৎসর্গপত্রে স্পষ্ট ঘোষণা দিলেন, মানবজন্ম নয়, আস্থা তার পাখিজন্মে। জীবন অনিশ্চিত সবকিছুতেই। কিন্তু প্রেমের মাঝে বেঁচে থাকা, ডানার উষ্ণতায় বেঁচে থাকা কখনো কখনো অর্থবহ, পরম কাঙ্ক্ষিত হয়ে ওঠে। শঠতা নেই যেখানে, পরাজিত মুখ, অনুদার অস্বীকৃতি যেখানে নেই, আছে ভালোবাসা। সহজ চুম্বনের গ্রহণ। এ শুধু খেয়ালি অভিমান নয়, জীবন-পর্বের বাঁকে কবির স্পষ্ট প্রত্যয়। উৎসর্গপথের ঢাল বেয়ে নেমে যাই প্রকৃতি-গহীনে। পয়লা কবিতাটিতেই কবি পাঠককে গেঁথে ফেলেন উড্ডীনসঙ্গীতে। আসুন পাঠ করি। ‘পাখিদের ধর্মগ্রন্থ’ কবিতাটি—
পাখিদের ধর্মগ্রন্থে আমার নাম লেখা আছে
তুমি বলেছ, উড়ে যাবার হয়েছে সময়
পাখিরা দাঁড়িয়ে আছে, ওঠো
প্যাঁটরা তুলে নাও কাঁধে
আমাদের যেতে হবে পাখিদের সাথে
পাহাড় ডিঙিয়ে উঁচু উঁচু ব্লাফার্সের ধার ঘেঁষে
কত দিন ও রাত্রির অভিযান শেষে
আমরা থেমেছি মেহিকান প্রাচীন আকাশে
আমার যে মাটিতেই ভালো লাগে, কেন যে
পাখিদের ধর্মগ্রন্থে নাম লেখা থাকে
আমার সাদা চোখে এটি বস্তু ও চৈতন্যের ভেতর চৈতন্য অভিমুখে জয়যাত্রায় আহ্বানের কবিতা। জাগতিক যা কিছু প্যাঁটরা তা থেকে সামান্য নিয়ে প্রস্তুতি সম্পন্ন। এবার যাওয়ার পালা। কবি কোনো মতবাদে আটকে থাকেন না। তবে তার প্রচ্ছন্ন সমর্থনছায়া পঙ্ক্তির আবরণ হয়ে থাকে কখনো কখনো। বৌদ্ধ মতবাদে আত্মার উন্নতি সাধনের মাঝে মুক্তি অর্জনের কথা বলা আছে। তেমনি ক্লেদাক্ত দিনের শেষে মাটির ঘর ছেড়ে উড্ডীন সঙ্গীতের ডাকে সাড়া দিতে প্রস্তুত মন-মননের কথা কবি ব্যক্ত করছেন কবিতায়। যেন এই তার নিয়তি। যেন সেখানেই প্রকৃত মুক্তি। অনেক তো হলো জীবন সংলগ্ন আকাঙ্ক্ষারাশির উদযাপন। চলুন, এবার যাওয়া যাক আত্মার সাধনে। যদিও ত্যাগের প্রশ্নে এ বড় কঠিন মায়া। তবু, কবি জানেন এ মায়া প্রপঞ্চময়!
‘পাখিদের ধর্মগ্রন্থ’ বইটির কবিতাগুলো আকারে খুব দীর্ঘ নয়। দশ থেকে কুড়ি লাইনের ভেতরে তার অনুভূতি, উপলব্ধি উপস্থাপন করেছেন। মূলত অক্ষরবৃত্ত ও গদ্যছন্দের মিশেলে সৃষ্ট তার কবিতা। আকারে মাঝারি কবিতাকে ভেবে এবার আমি এই সিদ্ধান্তে উপনীত হলাম যে, আমার পাঠানুভূতি প্রকাশের এই লেখায় কয়েকটি গোটা কবিতার উপস্থাপন করব। কবিতাংশ উদ্ধৃতের বিষয়টি গ্রন্থের আলোচনায় খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি বৈশিষ্ট্য, সন্দেহ নেই; তবে কোনো কোনো ক্ষেত্রে কয়েকটি পূর্ণ কবিতার উপস্থাপনের মধ্য দিয়ে সেই বিশেষ ভাব, অনুভূতি এবং সবশেষে কবির সঙ্গে পরিচয়ের মুহূর্তগুলো পাঠকের কাছে কাঙ্ক্ষিত হয়ে ওঠার দাবি করে বলে আমার মনে হয়। এরই ধারাবাহিকতায় আসুন পাঠ করি এবার ‘অন্যচোখে’ শীর্ষক কবিতাটি।
একদিন সে আমার চোখের মণি ছিঁড়ে নিয়ে বলেছিল
এইবার লাগাব নিজের চোখে
দেখি তোকে দেখতে পারি কিনা তোর মতো করেছন্নছাড়া বাতাসের বিমনা সাঁতার রক্তের বাঁক ভুলে
চলে গেল অন্যপথে
রাতদিন গান গায় ধুলোর পাখি
চোখ গেল! চোখ গেল! চিৎকারে
উন্মাদ চাঁদমারি ডুব দিলো পুরাতন ক্রোধে
ভাষা নেই, ওরে পথ ভুলে চলে গেলি অনার্য স্টেশনে
তোরও কি যাবার কথা ছিল মণিখোর চোখের অতলে
একবার বাঁক ফিরে দেখ
কী করে চোখ গেল অন্যচোখে
কোনো এক চরিত্রের গল্প বলার ধরনে কথাটা তুললেন কবি! অন্যের চোখে নিজের দেখাটাকে আড়াল করে কাকে দেখি, দিন শেষে প্রশ্ন থেকে যায় নিজের কাছেই। ব্যক্তিসত্তার ‘নিজ’ আড়াল হয়ে যায় সমষ্টির ভিড়ে। সমাজের রীতি-রেওয়াজ, ফাঁপা নিয়ম-কানুন ছড়ি হাতে জেগে থাকে। যা আমাদের অন্তর্গত, দূরে সরে থাকে তা-ই। প্রেমের অসম সমীকরণে নিজকে উজাড় করে দেওয়ার প্রবণতায় চাপা দেয় স্বকীয়তাকে। ‘নিজ’কে পরবাসী করে হয়ে ওঠে কেবল ‘অপর’-এর জন্যে কোনো কাঙ্ক্ষিত বস্তু। অপরের দেখা, অন্যের হো হো বাঁচাটা আমাদের কুসুমিত প্রাণে সূক্ষ্ণ বিষকাঁটা হয়ে বিঁধে থাকে। তবু কেউ কি পেরেছে নিজেকে ঠিকঠাক দেখতে? কেউকে পেরেছে অন্যের চোখে তাকেই তার মনমতো দেখতে? সত্যি হলো, এ পৃথিবী কারোই মনমতো নয়। তবু ‘মনমতো’ বা ‘তার মতো’ দেখার বাসনা লেপ্টে থাকে আমাদের রুগ্ণ মনে। এ চিরকালীন ব্যাধি থেকে মুক্তির উপায়—না কবি জানে, না শিল্পী। সমাধানের প্রশ্ন পরে। আগে খুঁজে নিতে হয় কারণ। এ বিশ্বাস থেকে কবিতায় তার আভাস দিয়েছেন মাত্র ফেরদৌস—‘একবার বাঁক ফিরে দেখ / কী করে চোখ গেল অন্য চোখে।’ এই আভাসই কখনো ফেরদৌসের কবিতার অন্য এক বৈশিষ্ট্য।
কবিতা কখনো শোষণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ। কখনো কবিতার স্বর উচ্চকিত, কখনো তা পেলব। ফেরদৌস কখনোই খুব উচ্চকিত কবিতার কবি নন। তার বলার ধরন অনেকটাই প্রতীকী। এর পরের কবিতাটিতে ফেরদৌস নির্মোহ স্বরে লৈঙ্গিক হেনস্তার ছবিটা তুলে ধরেছেন যথার্থ ফ্রেমে। শ্রেণীর ভেতর শ্রেণীর শোষণ বুঝতে গেলে নারীর বঞ্চনা আর নিপীড়নের সুদীর্ঘ ইতিহাস না বুঝে উপায় নেই। সবচে সহজে যার ওপর প্রশ্নের ঝাঁপি উপুড় করা যায়, সে নারী। প্রেমের অঙ্গারে নারীই পুড়বে. পুড়বে পুরুষের চিন্তাকাঠামোয় গড়ে তোলা একচোখা নিয়ম-কানুনের চিতাভূমে। এজলাসে পরতে পরতে কী করে নারী, নারীর আকাঙ্ক্ষা, প্রেম তথা অস্তিত্ব প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে আসছে এবং হয়, সেটি এই কবিতাটিতে চমৎকারভাবে উঠে এসেছে একটি দৃশ্যের বয়ানে। চলুন, এ দৃশ্যের সাক্ষী হই।
আপনার বয়ফ্রেন্ড আপনাকে রেপ করেছিল?
প্রশ্ন শুনে মেয়েটি হাসবে না কেঁদে ফেলবে
তা দেখতে বেশ উৎকণ্ঠায় অপেক্ষায় ছিল
অনেক চোখ
শুনবে পুরানো কথা নতুন ঠোঁটে
আনকোরা অভিযোগ নবান্ন আদিরস
নড়েচড়ে বসে, কী বলে শুনবে ব’লে
এসব কথায় মেয়েটির হাসি পাবে কিনা
এটাই দেখার ছিল বাকি, আর সব ফাঁকি
বয়সের বেকায়দা চাঁদ সঙ্গমের ফার্স্টএইড নিয়ে
মাঠের এককোণে চুপচাপ দাঁড়িয়ে ছিল
বছরের পর বছর হাবিজাবি গল্পগাছায়
ভাসিয়ে নিয়ে গেলো পুবের পাতাল
আর একটু পরে মনে পড়ে ঘাসের রং
অনাবিল সমর্থন, কাঁপা কাঁপা শয়ন সঙ্গম
কেউ জানে না, কী কথা বলবে সে এখন
মানুষের সম্পর্কগুলো বিচিত্র। দ্বন্দ্বমুখর। স্বার্থ সম্পর্কিত। ভালোবাসা কিংবা ভালোবাসাহীন। হিসাবের বাইরে কোনো কিছু ঘটলে কাঁধ থেকে সবচে কাছের বন্ধুটির হাতও সরে যায়। মুখোমুখি যে দাঁড়ায় সে হয়ে যায় অন্য কেউ। তখন প্রকৃতির কাছে ফিরে যেতে চায় মানুষ। যা হতে জন্ম, তার শরণ নিতে প্রাণ হয় আভূমি নত। পাঠ করি মাতাল মগ্নতা মেখে কবিতাটি।
যারা যারা পেরেক ঠুকেছিল, আমি তাদের দলে ছিলাম না
আমি ছিলাম নদীর পাশে পাশে, ফুল তোলা পাখা হাতে
ভ্রমরের পিছে গান গেয়ে
ও মাটি সোঁদাঘ্রাণ, তোমার ঠোঁট কোথায়
কোন দূর নক্ষত্রের দেশে মাতাল মমতা মেখে
নিয়ে যাও আরও দূর পাহাড়ি সন্ধ্যার স্বরগ্রাম ধরে
যে আমি চিনেছি জল ছলছল, তার বুকে সন্ধ্যার আলিঙ্গন
ভোরের শব্দ হয়ে জেগে ওঠে। কেন ওঠে
মৃত্যুর আগেই আমি তোমাদের সব জল্পনা কল্পনার অবসান
করে দিয়ে যাবমাটি, আমাকে নির্মাণ করো নিষ্ঠুর অভিঘাতে
হাড়ের বাজনা বাজাও ধীরে ধীরে, ভেতরে বাহিরে
কবিতাটির শেষের দুই পঙ্ক্তিতে ফেরদৌস বোঝাতে চাইছেন, যেন বিশেষ কিছু। কফিন প্রস্তুত রেখেছে মানুষ। শেষ পেরেক ঠোকার খাতায় নামও উঠে গেছে। এমন স্বজনদের ছাড়িয়ে তবু কোনো কোনো মানুষ থেকে যায় এসবের বাইরে—প্রকৃতির সান্নিধ্যে। মানুষের নির্মম আঘাতকে প্রতিহত করার মন্ত্র প্রার্থনা করে কবি। এ কবিতা এক নিমগ্ন প্রার্থনা।
ঠিক এমন একটি কবিতা একটু ভিন্ন সুরে পাই আমরা যেখানে কবি সব আলিঙ্গন বিচ্ছেদ শেষে অভিমান রেখে স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন যাওয়ার কথা। যে মন্ত্রে তিনি দীক্ষিত, যে পথের ডাক তাকে নতুন করে বাঁচতে শেখায় তার আভাস রেখে যাচ্ছেন তিনি। জল ও ফুলের আলিঙ্গন কবিতাটি পাঠ করি।
সবার থেকে সরে গিয়ে একটা মেঘলা নদীর দেশে
ডুব দিতে যাই। ডুব দিতে থাকি স্তন ভাঁজে
পাখির ডাকে, আবছা আঁধারেভুজলতা, তোমরা আমাকে চিনবে না, আমি নতুন
এ তল্লাটে প্রথম নয়, তবুও প্রথম
ঝকঝকে নদী হয়ে বয়ে গেছি, এখনো যাই
সারাক্ষণ ডুবো জাহাজের সন্ধানে উভচর
খুলে ফেলি পুরানো চামড়ার ঘর
গোপন সঙ্গম থেকে জল ও ফুলের আলিঙ্গন
জেনে নিও নিরখা করার দিন করাতে চিরেছি এই দেহ
ফের যদি ফেরিঘাট ডাকে তবে চলে যাব নেই সন্দেহ
কবিতাটিতে এনভয় রেখেছেন কবি। শেষের দুটো পঙ্ক্তি পুনশ্চের মতো জুড়ে দেওয়া। নিহিতার্থকে বিশেষ করে তোলা। বলছেন, নিজের নিপুণ নিরীক্ষণ শেষে এই মতে উপনীত হন, তিনি পথের জন্যে নিবেদিত। পথ ও পাখির ডাকের অপেক্ষায় আছেন কবি। ডাক এলো বলে। আর এলো যাত্রা শুরুর কাল। এই যে ভ্রমণের অনুরণন ফেরদৌসের কবিতায়, তা কবিতাকে উন্মুক্ত করে দেয়। পাঠকের দর্শন ও শ্রবণকেও দেয় ভ্রমণের আনন্দ। কোনো আবদ্ধ বোধ এখানে কেবল একাকিত্বের ফেবল শোনায় না।
‘পাখিদের ধর্মগ্রন্থ’ থেকে আমার প্রিয় আরেকটি কবিতা নিচ্ছি পাঠকদের জন্যে। ‘মেসিপোটেমিয়ান জেলখানা’। পৃথিবীর সভ্যতার ইতিহাস একটি কবিতার ভেতর সাংকেতিক রূপে এনেছেন ফেরদৌস। লিখেছেন—
পতনের শব্দে কাঁপে বেনামা পাহাড়
এইমাত্র নেমে আসা একঝাঁক নতুন সারস
টাইগ্রিস ইউফ্রেতিসের পাড়ে এসে ভিড় জমাল
সেখানে দাঁড়িয়ে ছিলাম গভীর কাজল চোখে
সেই হল কাল, সাথে সাথে বন্দি হলাম
মেসিপোটেমিয়ার জেলখানায় আটকে ছিলামআমাকে ওরা দেশান্তরী অবৈধ করেছিল
হয়তো হাজার বছর কেউই পায়নি খোঁজ
একদিন কী যেন কী ভেবে, কোনো এক ভোরে
ওরা আমাকে ছেড়েও দিলো, ইস্তাম্বুলের পথে
বলল, দৌড় লাগাও! দূর হও এখান থেকে!আমি জানি না কী ছিল অপরাধ
ততদিনে জেনে গেছি সম্পূর্ণ পৃথিবী আমার নয়
দৌড়াতে পারি না, বারবার হোঁচট খাই
মা বলে কেঁদে উঠি আতাতুর্কের মূর্তির নিচে
হাঁপাতে হাঁপাতে আবারো ঊর্ধ্বশ্বাস। যা ভাগ!এভাবেই কতকাল দৌড়েই চলছি জানি না
সব শেষে থেমে যাব রুশদেশে গিয়ে। যেখানে
ফিওদর দস্তয়েভস্কি জেলখানার সাত নম্বর কয়েদি
সভ্যতার ইতিহাসে শরণার্থী বন্দি জীবনের চেহারাটা দেশ-কাল-পাত্র ভেদে একই। যেমন এক বন্দিত্ব এবং মুক্ত চিন্তার চিরকালীন সংঘর্ষ। সভ্যতা যেমন দেয়, কেড়েও নেয় দুই হাতে। মেসিপোটেমিয়ান সভ্যতা মানুষকে যা দেয়, তার মাঝে অন্যতম চাকা আর শস্যের আবিষ্কার। চাকার সঙ্গে অনির্ণীত ভ্রমণের সম্পর্ক মানুষের অনুসন্ধিৎসু মনকে এগিয়ে দেয় কয়েক ধাপ। ভ্রমণের পথে সেখানে আটক হন কবি। কারণ তার চোখ বাক্সময়, মন উন্মুক্ত। একসময় ক্ষমতাসীনরা ছেড়েও দেয় তাকে ইস্তানবুলের পথে। ইস্তানবুল। যে শহর পূব আর পশ্চিমের সেতুবন্ধন। উদয় ও অস্তের মিলনশহর। মুক্তির দিকে, সন্ধির দিকে ধাবিত হতে চান কবি কিন্তু শেষতক সভ্যতার যুগপৎ অন্ধকার আর বঞ্চনার প্রবল ইতিহাসের কারাগারে নিক্ষেপিত হন। ব্যক্তিগত পছন্দের তালিকায় থাকা এই কবিতাটি আমাকে আলোড়িত করে ভীষণ।
শেষ কবিতাটি উল্লেখ করছি এবার—‘উড়ে যায় কবিদের পাখি’। কবি নিষিদ্ধ নিগৃহীত চিরকাল। চিরকাল তাই কবির গায়ে কালশিটের দাগ। ইতিহাস খুঁড়ে কেউ তার ভগ্নচিহ্ন পায়, কেউ সসম্ভ্রমে করে তাকে পুনর্বার সমাহিত। কেউ সেই সঙ্গচিহ্ন ধারণ করে অতলের ডাকে পা বাড়ায়। তখন তফাৎ ঘুঁচে যায় বুঝি ঘর ও পথের। অন্তর আর বাইরের। গন্তব্য নয়, সফরই মুখ্য যেন। যে সফর ভুলিয়ে রাখে সব দীনতা, আহ্বান করে ক্ষমা। আর ক্ষমার পথ বেয়ে আসে মুক্তি।
স্বপ্নের পাশে বসে অপেক্ষা করছি
ঘুম ভেঙে গেলে বলো জল খাবে কিনাচুপচাপ চলে যাওয়া যায়
যাবার আগে অনেকগুলো গল্প একসাথে বেঁধে
আকাশে উড়িয়ে দেয়া হবে
সে জন্যে কিছুটা বিশ্রাম নিচ্ছ
আমাদের বেলা বেড়ে যায়
কপালের মাঝখানে না-দেখা জানালা খুলে
উড়ে যায় কবিদের পাখি
গায়ে কালশিটে
তবু বসে থাকে স্বপ্নখোর তামুক সাজিয়েবসে থাকি বেশ
আমাকে বলো জল খাবে কিনা
পাগলামি ছাড়া পাগলের কিছুই থাকল না
জলের অতল ডাকে, আয়
আসব কী, এখন যাবার বেলা—যাই
ইশারা স্রোতস্বী, অভিমান স্মৃতি-লাবণ্যে
সব বই সব পাঠকের জন্যে নয়। উদার পাঠকহৃদয় পাওয়া সত্যিই দুর্লভ। তবু তাদের উদ্দেশে নিবেদিত যেন এই কবিতাগ্রন্থটি। সেই খোলা মন যা গ্রহণ-বর্জনের মোটা দাগে সীমাবদ্ধ নয়। নয় চাঁদ-ফুল-সমীরের চিত্রকল্পে আবদ্ধ। নতুন সময়ের কবিতা। যা মারদাঙ্গা স্লোগানের নয়, একেবারে নিভৃতে গুনগুন করার কবিতাও নয়। এ কবিতা কণ্ঠ ছেড়ে পাঠ করার। খাতা দেখে নয়, আত্মস্থ করে পড়ার। ফেরদৌসের কবিতায় ইশারা অনেক। ইশারা বুঝে নেওয়ার, অনুভবের। সবটা বলে দেওয়ার দায় নেই কবির। ভিনভাষার সঙ্গীত যেমন সুরের মূর্ছনায় মোহিত করে শ্রোতার শ্রবণ, তেমনি স্রোতস্বী অথচ গভীর কবিতাকে, প্রেমকে বুঝে নিতে হয় পাঠককে সন্ধ্যা-আলোয়। সেইখানে মিলবে চেনার সঙ্গে অচেনাও।
ফেরদৌস নাহারের কবিতার মূল বিষয় কখনো কখনো গতি। তিনি কখনোই হতাশাবাদী কবি নন। সমস্ত উপেক্ষা প্রত্যাখ্যান সত্ত্বেও কবিতায় আশার কথা, সম্ভাবনার কথা থাকে। হ্যাঁ, স্বরটা অভিমানের, তবে সেখানে স্থবিরতা নয়, থাকে যাওয়ার কথা। পথের কথা। একটা জার্নি। কোথাও যাওয়া। গিয়ে ফেরা কিংবা ফিরে না-আসা। অপূর্ণ প্রতিশ্রুতি। অভিমানী অপেক্ষারা স্মৃতি লাবণ্যে ডুবে থাকে। কেউ আসবে না জেনেও। এক নিরন্তর নির্মম খেলায় নিয়ত দোসর কবি। শক্তিশালী কবিদের ক্ষেত্রে যেমন হয়ে থাকে তেমনি ফেরদৌস নাহারের কবিতায় কিছু শব্দপ্রবণতা ঘুরে-ফিরে পাই, যা দিয়ে তার কবিতার আত্মাকে অনুভব করা যায়। যেমন—স্টেশন, প্ল্যাটফরম, চেনামুখ অচেনা হয়ে যায়, আগন্তুক, মুখোশ, রক্ত আগুন পবন, বৃষ্টি আকাশ, স্যানাটোরিয়াম, প্রতীক্ষা, ঈশ্বরের সাথে যুদ্ধ বোঝাপড়া প্রভৃতি। এরসঙ্গে আছে ভ্রমণের অনুষঙ্গ। নানান বিচিত্র পরিবেশে কোন দূরের পথিককে যেন কাছে ডেকে নেন ফেরদৌস নাহার। পাঠককে এই নতুন আবহের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন। পাঠক পান ভ্রমণের ভেতর দিয়ে তথ্যচিত্র দর্শনের বর্ণিল আনন্দের আস্বাদ।
বেলা শেষে দুই-একটি প্রবণতা নিয়ে আরও একটু বলা যায় বোধহয়। ফেরদৌসের কবিতায় স্টেশন একটি অপরিহার্য শব্দ। এই একটি শব্দ কখনো খোদ চিত্রকল্প হয়ে পাঠকের মনে এমন ছবি আঁকে যা দীর্ঘকালীন যাত্রার ছাপ রেখে যায়। স্টেশন। একটা সংযোগ স্থল। আবার বিদায়ের প্রতীকও। কখনো ভিড়ের ছবি। কখনো অপেক্ষা, নৈঃসঙ্গ্যের আরেক রূপ। পৃথিবীর ইতিহাস মাথায় করে হেঁটে যেতে যেতে ফেরদৌস দেখা পান, তার জীবনের, তার কবিতার আগন্তুকের। একাকী সাঁকো বা বেড়িবাঁধের রাস্তায় কোনো কোনো মুখ চেনা হয়ে আসে। আবার অচেনা হয়ে যায়। প্রেমহীন দিনে, প্রেম হারানোর দিনে ঈশ্বরের সঙ্গে যুদ্ধ করে বেঁচে থাকার কথা বলেন ফেরদৌস। এখানে কেবল চলা, কেবল গতি। থেমে থাকার গল্প ফেরদৌসের কবিতায় নেই। ভ্রমণের ঐশ্বর্যে পূর্ণ কবির জীবনপাত্র। এই ভ্রমণ যেন-বা ধ্যান। এই ধ্যান যেন-বা মোক্ষ লাভের সূত্র। এই সূত্র যেন-বা দেখা দেওয়ায় একমাত্র আরাধ্য কবিতার। ফেরদৌস নাহার আক্ষরিক অর্থেই কবিতার শ্রমণে নেমেছেন। কবির এই ধ্যানমগ্ন উড়ালযাত্রা নির্বিঘ্ন হোক।
পাখিদের ধর্মগ্রন্থ
ফেরদৌস নাহার
প্রকাশক: কৌরব প্রকাশনী
প্রকাশ কাল: কলকাতা বইমেলা, জানুয়ারি, ২০১৫
প্রচ্ছদ শিল্পী: ক্যাতেরিনা দ্রামিতিনো
মূল্য ১২০ টাকা