দেশভাগ পরবর্তী অর্থাৎ ১৯৪৭ সাল পরবর্তী বাংলা কথাসাহিত্যের আঙিনায় যে পরিবর্তন পরিলক্ষিত হয়েছিল, সেটি মূলত সামাজিক প্রেক্ষাপট নিয়ে তৈরি উপন্যাসগুলোতে স্পষ্টভাবে প্রকাশিত হয়েছে। এরও পরবর্তী পর্যায়ে অর্থাৎ বাংলাদেশের স্বাধীনতা-উত্তর কথাসাহিত্যেও এই বিষয়টি খুব সহজেই খুঁজে পাওয়া যায়। উপন্যাস তো রচিত হয়েছে বিভিন্নভাবে বিভিন্ন প্রেক্ষাপটে এই বাংলাদেশে, এই বাংলা ভাষায়। সে সব উপন্যাসে উঠে এসেছে সমকালীন মানবসমাজ, অর্থনৈতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটসহ মানুষের ব্যক্তিজীবন ও পারিবারিক জীবন। কোনো কোনো উপন্যাসে ব্যক্তির একান্ত জৈবিক অনুভূতিও নান্দনিক ভাষায় বিবৃত হয়েছে। যে কারণেই একপাশ দিয়ে সার্থকতা লাভ করেছে এই দেশের কথাসাহিত্য।
স্বাধীনতা-উত্তর বাংলা কথাসাহিত্যের প্রেক্ষাপটে মানবজীবনের সামাজিক দায়বোধ, সমাজ জীবনের অবক্ষয়, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ, ভাষা আন্দোলন, ৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান, স্বাধীনতা-পরবর্তী স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনসহ নানামুখী চিন্তা-চেতনায় যখন বৈচিত্র্য পেয়েছে আমাদের কথাসাহিত্য, যে সময়টাতে আধুনিকতার ছোঁয়া লেগেছে আমাদের নগরে সমাজে, রাষ্ট্রে, ব্যক্তিক জীবনে ঠিক সেই সময়েই জ্ঞাত কিংবা অজ্ঞাতসারে এদেশের কথা শিল্পীগণ পাশ কাটিয়ে গেছেন, এমন কিছু বিষয়, যেগুলো আমাদের যাপিত জীবনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। যে বিষয়গুলো আমাদের চারপাশেই রয়েছে অথচ এই চারপাশে ছড়িয়ে থাকা চারপাশে নিবিড় ভাবে লেগে থাকাই হয়তো কথাশিল্পীদের অনাগ্রহের বিষয়ে পরিণত হয়েছিল। এরকম একটি বিষয় আমাদের দেশের তাঁতশিল্প। কেবল তাঁতশিল্প নিয়েই এ যাবৎ সিরিয়াস ঘরানার উল্লেখযোগ্য কোনো কথাসাহিত্য তৈরি হয়নি। বাংলা কথাসাহিত্যে তাঁতশিল্প ও তাঁতশিল্পীদের উত্থান-পতনের ইতিহাস নিয়ে লেখা একেবারেই হয়নি বলা চলে।
বাংলাদেশের কথাসাহিত্যে জরুরি ছিল তাঁতশিল্পীদের জীবন নিয়ে কোনো কিছু বলা,জরুরি ছিল সামগ্রিক না হোক অন্তত আঞ্চলিক চিন্তাভাবনা থেকেও তাঁতশিল্পীদের নিয়ে কোনো উপন্যাস কিংবা এমন কোনো রচনা সৃষ্টি, যা বাংলাদেশের কথাসাহিত্যকে সমৃদ্ধ করতে পারে। অত্যন্ত পরিতাপের বিষয়, বাংলা কথাসাহিত্য এত এত গভীর বিষয় নিয়ে সমৃদ্ধ যে, তাতে বাঙালিয়ানার প্রায় সমস্ত বিষয়ই উঠে এসেছে। কিন্তু এই ভাষায় তাঁতিদের নিয়ে খুব বেশি লেখা হয়নি। কথাসাহিত্য তো কখনোই নয়। এই জাতীয় উপন্যাস সৃষ্টি করে জাতিগত দায়মোচন করেছেন শফিক আশরাফ তার নিরীক্ষাধর্মী উপন্যাস ‘পাউঠি’র মাধ্যমে।
কেবল এই ‘পাউঠি’র দিকে তাকালেই তাঁতি সম্প্রদায়ের দীর্ঘ ইতিকথা কল্পনা করা সহজ হয়ে উঠবে যেকোনো শেকড়সন্ধানী পাঠকের কাছে।
বাংলাদেশের তাঁতি সম্প্রদায় নিয়ে রচিত এই উপন্যাসের পর্ব সংখ্যা দুই। লেখক তার নিজের জন্মবৃত্তান্ত বর্ণনার ভেতর দিয়ে উপন্যাসের প্রেক্ষাপটের সূচনা করেছেন প্রথম পর্বে। তিনি পাঠককে টেনে নিয়ে গেছেন বর্তমান সময় থেকে অনেকটাই পেছনে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়টিতে। বাংলাদেশের একটি জেলার প্রত্যন্ত গ্রামের একটি তাঁতি পরিবারকে কেন্দ্র করে উপন্যাসটি শুরু হলেও ধীরে ধীরে পরিসর বিস্তৃত হয়েছে।
টাঙ্গাইল জেলার কালিহাতী উপজেলার বল্লা একটি তাঁতি সম্প্রদায় অধ্যুষিত অঞ্চল। বহ যুগ আগের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে এই সম্প্রদায়ের মানুষের পদচারণায় এক সময় মুখরিত ছিল এই অঞ্চল। শফিক আশরাফ তার ‘পাউঠি’তে এই সম্প্রদায়ের উত্থান-পতনকে চিহ্নিত করতে সচেষ্ট হয়েছেন। তিনি সময়কাল নির্ণয় করেছেন ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময় থেকে নিয়ে বর্তমান কালকে। উপন্যাসের স্বার্থে বলতে গেলে একটি কাহিনি দাঁড় করিয়েই ক্ষান্ত হননি। তুলে এনেছেন তাঁতি সম্প্রদায়ের ওপর সামগ্রিকভাবে একটি নিরীক্ষাধর্মী পর্যালোচনা। যে বিষয়টি উপন্যাসের দ্বিতীয় পর্বে সাংঘাতিকভাবে ধরা পড়বে পাঠকের চোখে। উপন্যাসের চরিত্রগুলো ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়তে থাকে জীবন-জীবিকার প্রয়োজনে বল্লা অঞ্চলের আশেপাশে এবং আরও দূরে পার্শ্ববর্তী জেলার তাঁতি অধ্যুষিত এলাকাগুলোতে। শফিক আশরাফ এই উপন্যাসের পাতায় পাতায় যেন সত্যকেই তুলে ধরেছেন বারবার। অথচ আড়াল করেছেন উপন্যাস লেখার ঢঙ তৈরির স্বার্থে। একটি পরিবারের চরিত্রগুলোকে তিনি ধীরে ধীরে সময় সময়ে সরিয়ে নিয়ে গিয়েছেন উপন্যাসের বিভিন্ন আঙ্গিকে। এই উপন্যাসের মতিউদ্দিন একটি গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র। যদিও উপন্যাসিক এইখানে নিজেকে মতিউদ্দিনের পুত্র অর্থাৎ রফিক হিসেবে পরিচিত করেছেন। তারপরও স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় রফিকের জন্ম, পরবর্তী পর্যায়ে বেড়ে ওঠা এবং তার ছোট ভাই আলেফ, চাচা সোয়ালেরসহ অন্য সব চরিত্র বারবার চক্রভূত হয়েছে মতিউদ্দিন চরিত্রটিকে ঘিরে।
উপন্যাসের প্রথম পর্ব পড়ে মনে হতে পারে, মতিউদ্দিন প্রধান চরিত্রের দাবিদার। একদিক থেকে সত্যিই। কেননা মতিউদ্দিন এই উপন্যাসের প্রথম থেকে নিয়ে প্রায় শেষব্দি বিস্তৃত। রফিক তার জন্ম থেকে শুরু করে নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় জীবন চাকরি জীবন বিবাহ পরবর্তী জীবন; কেউ যতটুকু না উপভোগ করেছেন এই উপন্যাসে, তার চেয়ে অনেক বেশি উপলব্ধি করেছেন তার বাবা এবং পূর্বপুরুষের তাঁতি সম্প্রদায়ের ধীরে ধ্বংস হয়ে যাওয়ার দিকটি। যদিও উপন্যাস লেখার স্বার্থেই শফিক আশরাফ এই তাঁতি সম্প্রদায়কে অত্যন্ত নির্মম বাস্তবতার সম্মুখীন করেছেন, তবু এই উপন্যাসের চরিত্রগুলো একেবারেই বাস্তবতার নিরিখে জীবন্ত হয়ে দাঁড়িয়েছে। উদাহরণ টেনে বলা যায়, রফিক যখন তার বাবা মতিউদ্দীনের সঙ্গে কথা বলছিল তাদের এবং তাদের আশেপাশের লোকজনদের তাঁত ব্যবসা নিয়ে; তখন কথোপকথন থেকেই দ্বিতীয় পর্ব অর্থাৎ এই উপন্যাসের মধ্যম অংশের প্রেক্ষাপটটি স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
উপন্যাসটির প্রথম পর্ব পড়তে পড়তে পাঠকের মনেই হতে পারে শফিক আশরাফ এমনি একজন কথাশিল্পী, যিনি শুধু চরিত্রের ভাঁজে ভাঁজে চরিত্র সৃষ্টি করে তৈরি করতে পারেন সময় এবং সভ্যতার এক সুন্দর কথাশিল্প; যা কেবল উপন্যাসের স্বার্থেই নয় বরং একটি সম্প্রদায়কে তিনি তার লেখায় তুলে ধরতে চেয়েছেন সুন্দরভাবে,সততার সঙ্গে। আবার পরবর্তী সময়ে এই উপন্যাসের দ্বিতীয় পর্ব পড়তে শুরু করলে পাঠকের মনে হবে শফিক আশরাফ তাঁতি সম্প্রদায় নিয়ে একটি দীর্ঘ নিরীক্ষায় ব্রত রয়েছেন, দীর্ঘ সময় ধরে গবেষণা করেছেন। এই নিরীক্ষণে তিনি তৈরি করেছেন দীর্ঘ ৫০ বছরের পরিসংখ্যান, যে পরিসংখ্যান স্বাধীনতা-পরবর্তী গত ৫০ বছরের তাঁতি সম্প্রদায়ের জীবনযাত্রা অর্থনৈতিক মানদণ্ড জাতীয় বিচারে তাঁতিদের অবস্থানকে পরিচিত করে তুলতে ভূমিকা রাখবে।
দ্বিতীয় পর্বে এসে পাঠকের মনে হতে পারে, তিনি উপন্যাস নয় বরং একটি গবেষণা কর্ম দাঁড় করিয়েছেন। সত্যিকার অর্থে পাঠকের প্রথম এবং দ্বিতীয় পর্বের দুটো ভাবনাকেই শ্রদ্ধার সঙ্গে গ্রহণ করতে হবে উপন্যাসিকের চিন্তাকে সঠিকভাবে উপলব্ধি করতে হলে। এই পর্বে শফিক আশরাফ ‘পাউঠি’র অনন্য দরোজা খুলে দিয়েছেন। দেখিয়েছেন ‘পাউঠি’ কেবল তাঁতিদের পায়ের তলায় পড়ে থাকা সুতোটানা দুই টুকরো কাঠ-ই কেবল নয়, বরং একটি সম্প্রদায়ের ইতিহাস, একশ্রেণীর মানুষের ঘাম,শ্রমের উপযুক্ত উপমাও । কেবল এই ‘পাউঠি’র দিকে তাকালেই তাঁতি সম্প্রদায়ের দীর্ঘ ইতিকথা কল্পনা করা সহজ হয়ে উঠবে যেকোনো শেকড়সন্ধানী পাঠকের কাছে।
কাহিনি বর্ণনা, নিরীক্ষাধর্মী আলোচনা ও আবহ এই উপন্যাসে অনন্য মাত্রা যোগ করেছে। এই সৃষ্টির জন্যই নমস্য ‘পাউঠি’র স্রষ্টা শফিক আশরাফ।
এই পর্বে শফিক আশরাফ উপন্যাসিক ও একজন শেখড়সন্ধানী গবেষকের চোখ দিয়ে তুলে এনেছেন বাংলাদেশের তাঁতশিল্পীদের করুণ জীবনাচারের সমীক্ষা, দেখিয়েছেন কেবল টাঙ্গাইল জেলা, সিরাজগঞ্জ জেলার তাঁতশিল্পেই ধস নেমেছে এমনটি নয়; সারাদেশের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে থাকা এই সম্প্রদায়ের মানুষেরও একই অবস্থা। তাদের পেশাবদলের কারণ, জীবনযাপনরীতির পদ্ধতি পরিবর্তনের কারণ শফিক আশরাফ ‘পাউঠি’তে সুচারুভাবে উপস্থাপন করেছেন।
প্রথম পর্বে জাসদপন্থী নেতা তমিজের মেম্বার হওয়ার বিষয়টিকে কেন্দ্র করেই সেই পর্বের যবনিকা টেনেছেন উপন্যাসিক। পরবর্তী পর্যায়ে অর্থাৎ দ্বিতীয় পর্বে এসেই দেখা যায় ভিন্ন প্রেক্ষাপট। এই পর্বে তিনি স্বাভাবিক সব চিন্তা থেকে দূরে সরে গিয়ে একেবারে আধুনিক সময়ের রফিকের শিক্ষাজীবন পরবর্তী অবস্থাকে টেনে নিয়ে শুরু করতে চেয়েছেন ভিন্ন এক সময় আর সামাজিক অবস্থাকে। এই পর্বের প্রতিটি অক্ষরে অক্ষরে তিনি দেখাতে চেয়েছেন রফিকের চোখ দিয়ে টাঙ্গাইলের বল্লা গ্রামের এবং তার পাশাপাশি রংপুর নীলফামারী অঞ্চলের কয়েক ঘর তাঁতির পরিস্থিতি। তিনি মর্মে মর্মে তার শৈশব কৈশোর দিয়ে তাঁতিদের এই দুরবস্থা যে উপলব্ধি করেছেন, সেটি এই উপন্যাস থেকে প্রমাণিত হয় খুব সহজেই। শুধু এই তাঁতি সম্প্রদায়ের বিষয়টি তিনি তুলে আনেননি এই উপন্যাসে; পাশাপাশি আরও কিছু বিষয়কেও ফোকাস করার চেষ্টা করেছেন। তার সহকর্মী গালিব মাহমুদ একজন বিচক্ষণ চিন্তক হিসেবে উপস্থিত হয়েছেন এই উপন্যাসে। যিনি উপন্যাসের রফিককে মাঝেমধ্যেই বিভিন্ন ধরনের বিষয় সম্পর্কে অবহিত করেছেন, উৎসাহ দিয়েছেন নানা ধরনের কাজে-কর্মে। ঠিক এই আবহটিকে তিনি গতানুগতিক উপন্যাসের বাইরে ফেলতে পারেননি। এখানে শফিক আশরাফের সীমাবদ্ধতা নয়; বরং তার উদারতার পরিচয় পাওয়া যায়। তার পাশাপাশি তার নববিবাহিতা স্ত্রী আইরা’র উপস্থিতি এই উপন্যাসটিকে একেবারেই রোমান্টিক সিচুয়েশনে নিয়ে যেতে যেতেও যায়নি। বরং রফিকের স্ত্রী এই উপন্যাসের একজন বড় অনুপ্রেরণাদায়ী চরিত্র হিসেবে চিত্রিত হয়েছেন। সাদাসিধে সংসার হলেও রফিকের জীবন একঘেয়ে নয়। উপন্যাসের প্রয়োজনেও শফিক আশরাফ এখানে অতীন্দ্রিয়তার আশ্রয় নেননি ।
বাংলা উপন্যাসের ধরাবাঁধা নিয়মকে ব্যবচ্ছেদ করেছেন শফিক আশরাফ; একথা বলার অবকাশ নেই। যেমনটা ব্যবচ্ছেদ করেছিলেন সম্মাত্রানন্দ তার ‘নাস্তিক পণ্ডিতের ভিটা’ উপন্যাসে।’নাস্তিক পণ্ডিতের ভিটা’ উপন্যাসে সম্মাত্রানন্দ যেমন শ্রীজ্ঞান অতীশ দীপঙ্করের সমাজ থেকে আবার চলে এসেছেন আধুনিক সমাজে, তেমনি ‘পাউঠি’ উপন্যাসে রফিকের জন্ম ইতিহাস থেকে একবার সরে গেছেন শফিক আশরাফ। আবার ফিরে এসেছেন। এই যে বারবার সরে যাওয়া, ফিরে আসা; এই বিষয়টিতে তিনি তাঁতি সম্প্রদায়ের নানাবিধ চিত্রই তুলে ধরেছেন।
শফিক আশরাফ উপন্যাস লিখেছেন আবার উপন্যাসের ভেতরে তুলে ধরেছেন পরিসংখ্যান, স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে তাঁতি সম্প্রদায়ের সামগ্রিক উত্থান-পতনের চক্র। কোনো একমুখী চরিত্র এই উপন্যাসে নেই। সাধারণ দৃষ্টি নিয়ে পড়লে দেখা যেতে পারে যে, মতিউদ্দিন অথবা তার ছেলে রফিক এই উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র। কিন্তু একটু গভীরভাবে খেয়াল করলেই দেখা যাবে, মতিউদ্দিন ও রফিক আদতে উপন্যাসের প্রেক্ষাপটকে ধরে রাখার কাজটি করেননি। বরং তাদের উপস্থিতির মাধ্যমে পুরো তাঁতি সম্প্রদায়ের জীবনের ওঠানামাকেই তুলে ধরা হয়েছে।
উপন্যাসের প্রথম পর্বের এক জায়গায় বল্লা বাজারের বর্ণনা দিতে গিয়ে লেখক বলেছেন ––
‘একটু দূরে বল্লা বাজারটাও জেগে থাকে একটা দ্বীপের মতো। সন্ধ্যায় আলোকিত হয়ে যায় অসংখ্য কুপি বাতির আলোয়; কখনো কখনো কপির আলো ছাপিয়ে বিশাল আকৃতির একটা চাঁদ বল্লা বাজারের কাছে স্থির হয়ে থাকে। যেন একটু টোকা দিলেই বাজারের মধ্যেখানে চাঁদটা খসে পড়বে তাদের। কারিগরেরা হাতের মুঠো ছেড়ে দিয়ে পালটি থেকে পা উঠিয়ে বহু পুরনো চাঁদকে দেখে একটা ঘোর লাগা আলোয়। তারা তাদের জীবনের দুঃখ ভুলে যায়।’
আবার এই উপন্যাসের প্রায় শেষের দিকে রফিক তার বাবা মতিউদ্দিনের সঙ্গে তাঁত সম্পর্কিত কিছু কথোপকথনে মত্ত হয়। এরপরেই শফিক আশরাফ এঁকেছেন অন্য এক বাস্তবতা–
‘টিনের ভাঙা ফোকর দিয়ে সূর্যের আলো ঠিক সেই পাউঠি’র ওপর পড়ছে। রফিকের মনে হলো তার বোনাতে বোনাতে কোনো তাঁতি গলা ছেড়ে গাইছে, ‘‘ওরে তুরা মন দিয়ে শোন, তাঁতঘরে আমার গ্যলি যে য্যবন।’’ রফিক দাঁতের তক্তায় বসে পাউঠির ওপর পাটাতে চাপ দিয়ে সানা ধরে টানলো ঠিকই, তখনই মানুষের কান্নার মতো শব্দ বের হলো তাঁতের ভেতর থেকে,সেই কান্নার সঙ্গে মিশে গেলো রফিকের চোখ থেকে টপটপ করে পড়া চোখের জল।’
এমন চিত্রকল্প ‘পাউঠি’ উপন্যাসে শফিক আশরাফ বহুবার দেখিয়েছেন। এই দেখানোটা জরুরি ছিল বাংলা কথাসাহিত্যের জন্য।
শফিক আশরাফ তাঁতি সম্প্রদায় নিয়ে নিরীক্ষাধর্মী উপন্যাস ‘পাউঠি’ রচনা করে দায়মুক্তি ঘটিয়েছেন পুরো বাংলাসাহিত্যের। তাঁতি সম্প্রদায় নিয়ে স্বতন্ত্র কোনো কথাসাহিত্য এর আগে সৃষ্টি হয়নি। এটিই সত্য। যেকারণেই এই উপন্যাসটি অনন্য সাধারণ হয়ে উঠেছে। অন্যদিকে কাহিনি বর্ণনা, নিরীক্ষাধর্মী আলোচনা ও আবহ এই উপন্যাসে অনন্য মাত্রা যোগ করেছে। এই সৃষ্টির জন্যই নমস্য ‘পাউঠি’র স্রষ্টা শফিক আশরাফ।
বাঙালি শিল্পের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ তাঁতশিল্প। বাংলাদেশের একটি নির্দিষ্ট অঞ্চলের তাঁতশিল্পীদের জীবনের উত্থান-পতনের কাহিনি। অর্ধশত বছরের তাঁতিদের যাপিত জীবনের নিরীক্ষাধর্মী এই উপন্যাস বাংলা সাহিত্যের নিঃসন্দেহে এক অনন্য সংযোজন।