ময়ুখ চৌধুরী কবি—আপাদমস্তক কবি, বিশুদ্ধ কবি। কবিতা-নির্মাণকে নিছক সখ, নেশা বা প্রচারের কোনো মাধ্যম মনে করেন না এই কবি। সাধারণ মানুষের মতো জীবনযাপন করেন না কবি, কবিতাযাপন করেন। কবিতা তাঁর কাছে জীবনের সমস্ত উপলব্ধি, আনন্দ ও যন্ত্রণার সিরিয়াস এক শিল্পমাধ্যম। তাই কবিতা লেখার বয়স যখন দুই যুগ, তখন প্রথম ‘বইকালো বরফের প্রতিবেশী’ (১৯৮৯) প্রকাশিত হয়, আবার এক দশক প্রকাশে নীরব থেকে বের হয় ‘অর্ধেক রয়েছি জলে অর্ধেক জালে’ (১৯৯৯)। এরপর অবশ্য দেরি করেননি, পরের তিন বছরে তিনটি কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়: ‘তোমার জানালায় আমি জেগে আছি চন্দ্রমল্লিকা’ (২০০০), ‘প্যারিসের নীলরুটি’ (২০০১) ও ‘আমার আসতে একটু দেরি হতে পারে’ (২০০২)। কবির ‘একটু দেরি’মানে একযুগ এক বছর হয়ে যাবে কেউ ভাবেনি। দেরি হলেও অবশেষে প্রকাশিত হলো ‘পলাতক পেণ্ডুলাম’ (২০১৫)।
ময়ুখ চৌধুরী মূলত ত্রিশের কাব্যধারার উত্তরাধিকারী। সমাজবাদী নন, ব্যক্তিবাদী। স্বভাব ও শৈলীগত দিক থেকে কবি আত্মমুখী, ব্যক্তিত্বনিষ্ঠ, মন্ময় ও অস্পষ্ট; তবে প্রতীকী ব্যঞ্জনাধর্মী। অনেক ক্ষেত্রে জটিল ও দুর্বোধ্য।বাংলার আবহমান জীবন ও প্রকৃতি থেকে উপকরণের সংগ্রহ করেন। আঙ্গিক ও কাব্যাদর্শগত দিক রোমান্টিক ও সৌন্দর্যবাদী। উপযোগিতাবাদের ঘোর বিরোধী। ব্যক্তিগত প্রেরণায় বিশ্বাসী। আধুনিক হয়েও ঐতিহ্যবাদী। তাই এলিয়টের ট্রেডিশন অ্যান্ড ইনডিভিজুয়াল ট্যালেন্টে আস্থাশীল। ত্রিশি স্বভাব মর্মগত; তাই সুধীন্দ্রনাথ দত্তের এই মতামতে তিনি বিশ্বাসী নন,‘আমিও মনে করি যে ব্যক্তিগত মনীষায় জাতীয় মানস ফুটিয়ে তোলাই কবি জীবনের পরম সার্থকতা।’ কবি আরাধ্য কবিতা কুমারীকে পাওয়ার মধ্যেই কবি জীবনের সার্থকতা খুঁজে পেয়েছেন:
কবিতা, দরজা খোলো; আমি এক অনিন্দ্র জোনাকী
নিজের আগুনে পুড়ে রয়ে গেছি অবুজ সবুজ।
তোমাকে রচনা করি এ রকম সাধ্য বলো কই!
দ্বিদল দরজা খোলো, আমাকে রচনা করো, কবিতা কুমারী।
(কবিতা, তোমার দরজায়: অর্ধেক রয়েছি জলে অর্ধেক জালে)
কবির আপন আগুনে পুড়ে উড়ে উড়ে ঘুরে-ঘুরে শেষ পর্যন্ত কবিতার দুয়ারে এসে পৌঁছাতে চান। নিজেকে বারবার জ্বলন্ত ‘জোনাকী’র প্রতীকে উপস্থাপন করেন। আবার ‘সরীসৃপে’র মতো চলার ভঙ্গি বলে কবিতাকে অপেক্ষা করতে বলেন আকুলভাবে:
আমি বুক ঘষে-ঘষে তোমার দরজায় পৌঁছুতে চাই,
হে কবিতা, হে আমার প্রিয়তমা।
আনাড়ী সরীসৃপের মতো বুক ঘষে-ঘষে আসতে গিয়ে
আমার অনেক দেরি হয়ে যাচ্ছে,
অনেক দেরি করে ফেলেছি আমি।
(হে কবিতা, অপেক্ষা করো: আমার আসতে একটু দেরি হতে পারে)
এ ধরনের উচ্চারণ বিশুদ্ধ,সদা নিমগ্ন ও নিবেদিত কবির পক্ষেই সম্ভব। কবি মানুষের মতো পা ফেলে কবিতার কাছে আসতে চাননি। দুই পায়ের ফাঁকের জায়গা যদি ফাঁকি পড়ে যায়।
দুই.
ময়ুখ চৌধুরীর প্রথম আত্মমুদ্রিত, স্বাক্ষরিত ও প্রতিনিধিত্বশীল কাব্য অর্ধেক রয়েছি জলে অর্ধেক জালে। এখানে কবি প্রচণ্ড এক কাব্যশিখায় জ্বলে উঠেছেন। কর্ণফুলী, বঙ্গোপসাগর—নদী ও সমুদ্রের জল, জলজ প্রকৃতি, জললগ্ন জীবনের জোয়ারভাটায় কবি জীবনের জলে আটকে পড়া এক ‘মৎস্যকুমার’ হিসেবে নিজেকে প্রকাশ করেন, যা বাংলা কবিতায় নয়া স্বাদ ও অভিজ্ঞতা নিয়ে আসে। কবির মৌলিকতা, কাব্যশক্তি ও নিজস্ব কাব্যভাষার পরিচয় পাঠক পেয়ে যায়। সবচেয়ে বড় অজর্ন প্রাচীন ও মধ্যযুগের বাংলা কবিতার ঐতিহ্যের পুনর্নির্মাণ ও দক্ষিণ অঞ্চলের স্থানিক আবহমানতাকে দেশজ আধুনিকতায় রূপায়িত করা। এই কাজটি এস এম সুলতান চিত্রকলায় করেছেন দারুণ দক্ষতায়। নতুন প্রতীক, রূপক, উপমা ও চিত্রকল্পের নির্মাণ এবং ছন্দের বহুমাত্রিক কাজ এই বইকে স্বতন্ত্র মর্যাদা দিয়েছে। এখানেই কবির অমর উচ্চারণ—’এ শহর আমার শহর/ এখানে বৃষ্টি-মেঘে কেটেছে হাজার বছর।’সবদিক বিবেচনায় ব্যক্তিগতভাবে আমি এই গ্রন্থটি কবির শ্রেষ্ঠ কাব্য বলে মনে করি।
পরের বইয়ে কবি সৃজনে ও মননে আলাদা হয়ে যান। তোমার জানালায় আমি জেগে আছি চন্দ্রমল্লিকা অনেকগুলো উজ্জ্বল কবিতায় সমৃদ্ধ। নিজের উত্তরণও ঘটে। প্যারিসের নীলরুটির উল্লেখযোগ্য দিক হলো কলকাতা ও প্যারিসের প্রবাস জীবনাভিজ্ঞতা ছাড়াও আন্তর্জাতিক কিছু বিষয়ের সমন্বয়ে কবিতায় ভিন্ন স্বাদের ব্যঞ্জনা সৃষ্টি। আরেক হেলেন, আরেক নেপোলিয়ন; কেমন আছ রাশিয়া, আরেক আফ্রিকা, একটি কাশ্মিরি সন্ধ্যা, সন্ধ্যার বেহালাবাদক, কালমার্কস জেনিকে যে কথা বলতে পারতো; সময়, আমার সময় আলাদা দ্যোতনার সমৃদ্ধ কবিতা।
তিন.
পলাতক পেণ্ডুলাম ময়ুখ চৌধুরীর অর্জিত জীবনাভিজ্ঞতা ও লালিত দৃষ্টিভঙ্গির শিল্পসৃজন ও দক্ষতার নতুন জগৎ। আগের সব কাব্যগ্রন্থ থেকে এই বই ভাব, ভাষা, ভাবনা, চেতনা, অনুভবের দিক থেকে অন্য আলোয় উজ্জ্বল। তবে প্রকরণের কোনো নতুনত্ব নেই। নিজস্ব নির্মাণশৈলীতে এ-কাব্যে প্রধানত প্রকাশ পেয়েছে প্রকৃতি, বিজ্ঞান, দর্শন, আধুনিক মানবসভ্যতার সংকট, নষ্টকালের মানবিক যন্ত্রণা, পার্থিব জীবনের নশ্বরতা ও মৃত্যুচেতনা।
দর্শন ও বিজ্ঞান মানষের জ্ঞানকাণ্ডের শিখরস্পর্শী দুটি ক্ষেত্র। কবি যখন উচ্চতর মননশীলতা ও অন্তর্দৃষ্টি লাভ করেন, তখন আপন ভাববস্তু প্রকাশে দর্শন ও বিজ্ঞানের উপাদান কাজে লাগান। দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদে বস্তুজগৎ পরস্পর সংযুক্ত ও সুসংহত; বস্তুসমষ্টি ও ঘটনাপুঞ্জ পরস্পরের সঙ্গে প্রাকৃতিকভাবে আবদ্ধ এবং পারস্পরিক নির্ভরশীলতা ও নিয়ন্ত্রণ ক্রিয়াশীল। মার্কসের মতে মানব ইতিহাসের বিকাশ দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদী প্রক্রিয়ায় ঘটে। এই বিকাশ বস্তুর অভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিকভাবে ঘটে থাকে। বস্তুর ধর্ম অনুসারে জল গড়িয়ে যায় এবং তাপমাত্রা কমে গেলে বরফ হয়ে যায়। প্রকৃতির ‘বরফ’ কবি ময়ুখ চৌধুরীর অন্যতম প্রিয় প্রতীক। প্রথম কাব্যগ্রন্থের নাম কালো বরফের প্রতিবেশী। পরের প্রত্যেক কাব্যেই এই ‘বরফ’ বার বার ব্যবহৃত। অর্ধেক রয়েছি জলে অর্ধেক জালে কাব্যের বরফেরা জানে কবিতায় আবার ভাববাদী পঙ্ক্তি— ‘জলেদের ঘুম পেলে নাকি / জলেরা বরফ হয়ে যায়।’ আলোচ্য কাব্যের প্রথম কবিতা প্রকৃত বিজ্ঞান এই ‘বরফে’র দ্বন্দ্বময় উপস্থাপনা একদম অভিনব:
এক টুকরো বরফ আরেকটা টুকরোর সঙ্গে সেঁটে যাচ্ছে…
কয়েকটা ব্যতিব্যস্ত হাত
খুঁজছে করাত
করাত দেখলো এসে বরফযুগল
তার আগেই রওনা দিয়েছে
পরিতৃপ্ত সরীসৃপ তারা।
একদিকে বস্তুর স্বভাবে বরফের যূথবদ্ধতা, অন্যদিকে অন্য বস্তুর সঙ্গে দ্বন্দ্ব। পরিশেষে গতিশীলতার মাধ্যমে বস্তুধর্মের জয়। এভাবে কবি প্রাকৃতিক দর্শন ও বিজ্ঞানের সূত্রকে কবিতায় জারিত করেন নতুন ভঙ্গিমায়। বহুল ব্যবহৃত প্রতীক ‘সরীসৃপ’ অনেক সময় কবি নিজেই, এখানেও যদি ধরে নেই তাহলে বিপত্তি ঘটে না। এভাবে দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদ/প্রকৃতিবাদ ও কবিরদৃষ্টিভঙ্গি হাত ধরাধরি করে বেশ কিছু কবিতায় ছায়াপাত করেছে। ‘একটি প্রাকৃতিক দৃশ্য’, ‘দরজার কাঠ’ ও ‘বিবাহপ্রথা’য় প্রকৃতির সহজ, স্বাভাবিক সূত্র ও নিয়মকে আমাদের যাপিত জীবনের সঙ্গে সংযোগ ঘটান কবি। ‘বরফের কাছ থেকে পাঠ নিয়েছিল/ চুম্বক-সমাজে তাই বিবাহের প্রচলন নেই।’ অথবা ‘কেননা, সে দেখেছিল আরণ্যক সভতার ডালে/ বিবাহবিহীন ডিমে পাখিদের দাম্পত্যজীবন।’ কবি মানুষের সম্পর্কের ভঙ্গুরতা-কৃত্রিমতার পাশে প্রকৃতির অকৃত্রিম স্বভাবের দিকে আঙুল তুলে তাকে কবিতা করে তোলেন।
প্রকৃতিবাদের সূত্রেই পৃথিবীতে জীবজীবনের ক্ষণস্থায়ীত্ব, নশ্বরতা, বিনাশ ও বিকাশ বিরাজমান। অমরতার কোন স্থান নেই। এই নিয়ম মানুষ হিসেবে কবিকেও মাঝে মাঝে হতাশ ও বিপন্ন করে। সেজন্য ‘উইপোকা’ প্রতীক কবির সমগ্র কাব্যে বারবার এসেছে। প্রকৃতিতে বিনাশী তৎপরতা ও ক্ষয়ের দৃষ্টান্ত থেকেই কবি ‘উইপোকা’ নির্বাচন করেন।
একটা পাণ্ডুলিপি আমি রেখে যাবো মনের মতন,
হাত দিও না,—যতক্ষণ এ জীবনযাপন।
আপাতত হাঁটছি আমি, খাচ্ছি ঠোকর নুনপানি আর খিস্তি খেউড়।
পাণ্ডুলিপি রেখে যাবো। —উইপোকারা সম্পাদনা করে দিলে
পড়তে পাবে,—পড়ে নিও;
(স্বম্পাদিত গর্তগুলো)
কবি বার বার কালের ক্ষয়ের প্রতীকের কাছে ফিরে যান জীবনের নশ্বরতা অনুভব করে। সাধারণ মানুষের জীবন, সৃষ্টিশীল বাল্মীকী সম্প্রদায় ও মহৎ প্রাচীন পুঁথি সবই কালের গ্রাসে নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। প্রাকৃতিক নিয়ম কবিকে জীবনের চরম সত্যোপলব্ধি ঘটায়। চেয়ারে নয়, হয়তো-বা, ভ্রমণকাহিনিতে এই সরল সত্য আপন কাব্যভাষায় উচ্চারিত।
কবি সমাজের কাছে দায়বদ্ধতায় এবং উপযোগবাদে আস্থাশীল নন; কিন্তু বহমান ও যাপিত জীবনের প্রতি এক ধরনের মঙ্গলবোধে উজ্জীবিত। এই মঙ্গলবোধের কারণেই কবি বার বার আধুনিক সভ্যতার সংকটকে একান্ত পর্যবেক্ষণ করেন। এই সংকট প্রকৃতপক্ষে মানবসংকট। এই কাব্যের অন্যতম প্রধান সুর এই সংকটের বেহালা থেকে উত্থিত।নৈতিক মূল্যবোধ, কয়েক ভরি সম্পর্ক, ট্রেনের ছাদে বাড়ি যাওয়া দেখে, মৃত মানুষের কাছে লজ্জা ঢাকা কবিতাগুলোয় বর্তমান সভ্যতার আড়ালে ক্রমক্ষয়িষ্ণু ও অন্তঃসারশূন্য মানবসম্পর্ক এবং সম্পর্কের সংকটকে মৌলিক চিত্রকল্প, প্রতীক, উপমা ও রূপকের সাহায্যে বিনির্মাণ করেন। সঙ্গে সমালোচনা ও ব্যঙ্গ উপস্থিত।
বাইরে পড়ে থাকতে থাকতে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।
চলো, ওগুলো ঢুকিয়ে রাখি ফ্রিজে
যখন দরকার হবে, তখন না হয়…
…ওদের খবর নেয় ছত্রাকেরা—গা ঘেঁষে দাঁড়ায়।
ফ্রিজটা খারাপ হলে বিশ্বব্যাংক ঠিক করে দেবে।
(নৈতিক মূল্যবোধ)
কবি চলমান জীবনের সমগ্র অবক্ষয়কে ব্যঙ্গ-বিদ্রূপের ভঙ্গিতে চিহ্নিত করেন। ‘বিশ্বব্যাংকে’র প্রসঙ্গটা উত্থাপন করে কবি অবক্ষয়ের সঙ্গে বিশ্বরাজনীতি ও বিশ্বপুঁজির কর্তৃপক্ষের যোগসূত্র স্থাপন করেন। বিরাজমান সমাজজীবনের বাস্তবতা ও বৈশ্বিক পুঁজিবাদী শক্তির সম্পর্ককে একসঙ্গে দেখার অন্তর্দৃষ্টিকে কবি কবিতার রূপ দিয়েছেন একান্ত আপন ঢঙে ও মেজাজে।
কবি কখনো এক জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকেন না, ক্রমাগত সামনের দিকে হাঁটেন। এই গতিশীলতা অনেক সময় দোদুল্যমানতার রূপ নেয়। পেণ্ডুলাম একবার জীবনের দিকে, একবার মৃত্যুর দিকে ঝুঁকে পড়ে। পলাতক পেণ্ডুলামের একটা বড় অংশ জুড়ে আছে এই মৃত্যুর হাতছানি, মৃত্যুচেতনা, মৃত্যুর সঙ্গে বোঝাপোড়া। ‘কোন বনে ফলের ভিতর/ দোলাচলে তেরোটি বছর/ পরিচিত দৃশ্যে কেড়ে সাজিয়েছ গোপন কবর?’ এই পেণ্ডুলাম জীবন থেকে মৃত্যুর দিকেই বেশি ঝোঁকপ্রবণ। দূরবর্তী বিপদ-সংকেত, গোল্ডফিশের চশমা, কৃষ্ণসুড়ঙ্গ, যাওয়া, থেকে-যাওয়া, পূর্বপ্রস্তুতি, মৃত্যুর জীবনীগ্রন্থ ও একটি খাটিয়া নামানোর জন্য ক’জনকে কষ্ট দেবো! তাই কবিতাগুলো মৃত্যুর বহুরৈখিক অনুভব, স্পন্দন, উপলব্ধি, চেতনা ও বোধের চিত্ররূপময় উৎসারণ।কখনো আবার জীবনতৃষ্ণায় সন্দীপিত কবি একই সঙ্গে মৃত্যুর দিকে হেলে পড়ে মৃত্যুর বিপক্ষে দাঁড়ান। আধুনিক সভ্যতার মধ্যে বিচ্ছিন্নতা, একাকিত্ব, অবক্ষয়, নশ্বরচেতনা এবং মৃত্যুবোধ একই সঙ্গে জড়াজড়ি করে আছে।
ক.
ছাই মেখে যা লেখা হলো পাণ্ডুলিপি মনপাথারে,
মুছে দেব। যাচ্ছি চলে যাবো, ফিরবো না আর
ফিরে যাচ্ছি
(গোল্ডফিশের চশমা)খ
আমি কাল চলে যাচ্ছি/ দেহটাকে নিয়ে যাচ্ছি
ছায়াটা তোমার কাছে থাক্
(যাওয়া, থেকে-যাওয়া)গ
যেদিন প্রথমবার কর্পূরের শাদা গন্ধ পেলাম
সেদিনই প্রথম মনে হয়েছিল—বেঁচে আছি
যেদিন প্রথমবার মনে হলো, বেঁচে আছি
সেদিন থেকেই বুঝি মরে যাওয়া শুরু।
(মৃত্যুর জীবনীগ্রন্থ)
কবির কাছে বেঁচে থাকা আর মৃত্যু খুব কাছাকাছি। জীবনের ভেতরদেশে মৃত্যুর অনুভূতি এবং মৃত্যুর মধ্যে জীবনের স্পন্দন কবির মাঝে ক্রিয়াশীল। বাংলা কবিতায় মৃত্যুস্রোতের মাঝে কবির মৃত্যুবোধের বিশেষত্ব হলো মৃত্যুকে নিয়ে বহুমাত্রিক ব্যঞ্জনা ও রঙরেখারূপ সৃষ্টি। বহমান ও যাপিত জীবনের সমগ্র স্মৃতি ও অনুভূতি এই চেতনায় চারিয়ে দিয়ে জীবনকেই সবচেয়ে বড় করে তোলেন কবি, মৃত্যুকে নয়; মৃত্যুর কাছে পরাজয় নয়, উপভোপ।মৃত্যুর জীবনীগ্রন্থ দীর্ঘ কবিতাটি সবদিক বিবেচনায় এই বইয়ের সবচেয়ে শক্তিশালী কবিতা, তাই শ্রেষ্ঠ কবিতাও। একইসঙ্গে জীবন ও মৃত্যু এখানে বহু রঙরেখায়, বোধে, চিত্রকল্পে উজ্জ্বলভাবে উন্মিলিত।
এই গ্রন্থে আরও বেশকিছু কবিতা আছে নানান রঙে প্রকাশিত। ব্যক্তিগত বোধ-বিবেচনা-অভিজ্ঞতায় সেগুলো জারিত। ডান হাতের পাঁচটি আঙুলসার্ত্রের অস্তিত্ববাদী ভাবনায় উদ্দীপ্ত; শামুক আত্মস্বভাব ও বাস্তবের বৈরিতার দ্বন্দ্বে মুখর; ইনসমনিয়াতে মাকড়সার প্রতীকে কবির শান্তি সন্ধান; শহরে বেড়াতে এসে কবিতায় নগর সভ্যতার ভেতরের কদর্য দৃশ্য সন্ধান; ট্রাক যন্ত্রসভ্যতা অলীক বা পরাবাস্তব সাধ; ক্রিয়ার ব্যবহারে জীবনের নিজস্ব অর্থের প্রকাশ; ভূমি দখলে পরোক্ষভাবে কবিদের অমরত্বের বাসনা; সুবর্ণচর কবির জন্মের আগে মরে যাওয়া বোনের স্মৃতিবিজড়িত অনুভব; বিশেষ ধরনের ছাই নশ্বরতা থেকে সজীবতার নির্মাণ; কাঠের ঘোড়ায় জীবনবিমুখতা ও অলীক অপেক্ষা; যথাযথ পরাবাস্তব অনুভবে দীপ্ত; জাদুঘরে পাঠানোর মতো একটি শব্দ কিংবা তেলাপোকাকালের বদল ও মানবিক অবক্ষয়; সত্যপ্রসাদের ছেলে সত্য-মিথ্যার দ্বন্দ্বে মিথ্যার পরাজয় ও ভঙ্গুরতা কবিতা হয়ে উঠেছে নানান প্রতীক ও চিত্রকল্পের সমবায়ে। এককথায় জীবনাভিজ্ঞতা ও অনুভবের বৈচিত্র্য তাঁর কবিতায় প্রসঙ্গেরও বৈচিত্র্য এনেছে।
চার.
জীবনানন্দ দাশ কথিত ‘কল্পনাপ্রতিভা’র সফল ব্যবহার এবং কাব্যভাষার নিজস্ব নির্মাণশৈলী এক কবি থেকে অন্য কবিকে আলাদা করে দেয়। কবি ময়ুখ চৌধুরী আত্মায় ও আদলে অন্য কবি থেকে নিজের ফারাক ও স্বাতন্ত্র্য তৈরি করতে পেরেছেন কাব্যভাষার অন্তর্বুননে। এই শিল্পবুননে উপাদান হিসেবে কাজ করেছে নিজস্ব জীবনাভিজ্ঞতার সারৎসার, ঐতিহ্যের বিনির্মাণ, ছন্দের গতিময় সৌন্দর্য এবং প্রতীক-রূপক-উপমা ও চিত্রকল্পের নতুন রূপায়ণে। বিশেষভাবে কয়েকটি প্রতীক বিশেষত্বপূর্ণ, যেগুলো কবির কবিতায় বারবার উচ্চারিত:
সরীসৃপ:ধীরগতিসম্পন্ন, ফাঁক-ফাঁকিহীন পথের লক্ষ্যে অটুট,বুকের ঘষাতে কষ্টের বিস্তার;
উইপোকা: নশ্বরতার স্মরণ, কালের করাত, সমস্ত অর্জন ও কৃতির ক্ষয়ের কারণ;
মাকড়সার জাল: নিজের বুকের সূতোর জালে জীবন, আপন আবাসে কষ্টজীবনের বিস্তার;
জোনাকী: অনিদ্র, নিজস্ব আগুনের আলোয়পুড়ে উড়ে ডানা ঝাপটানো;
দাঁড়কাক: সংগ্রামী, সারাক্ষণ খোরাকী সন্ধান ও টিকে থাকার লড়াইয়ে সাহসী;
গুটিপোকা: নিজ শরীরের প্রাকৃতিক লালা দিয়ে তৈরি শৌখিন রেশমি কাপড়ের জনক;
ঘড়ির কাঁটা: সময়ের ধারক, অস্থির পেণ্ডুলামের ঘণ্টাধ্বনির নির্ণায়ক;
পেণ্ডুলাম: দ্বন্দ্বময়, দোদুল্যমান, অবিরাম কাঁটার সঙ্গী, প্রহরান্তর ও ঐতিহ্যের স্মারক।
এইভাবে কবি প্রকৃতিরাজ্যের এমন সব প্রাণি-বস্তুকে নির্বাচন করেছেন, যারা আপন দেহ ও মনের ক্ষরণে সৃষ্টিশীল অথবা বিনাশী। কবি নিজেকে অনেক সময় ভিন্ন ভিন্ন পরিপ্রেক্ষিতে জোনাকি, সরীসৃপ, দাঁড়কাক, শামুক, মাকড়সা, গুটিপোকা রূপেও হাজির করেছেন। তবে জন্মের আগে হারিয়ে যাওয়া বোনের ফ্রকের কথা এসেছে বার বার নানা প্রসঙ্গ-প্রকরণে। ঘড়ি কবির কাছে কেন্দ্রীয় প্রতীক: জীবন মানেই ঘড়ি, মিথ্যে আর সবই। এই ঘড়ির সঙ্গেই পেণ্ডুলামের সম্পর্ক। অন্যদিকে অক্ষরবৃত্ত ছন্দের ব্যাপক কাজ কবির পঙ্ক্তিমালাকে স্মরণীয় করে তুলেছে।
পাঁচ.
সময়ের হিসাবে সত্তর দশকে উত্থান হলেও কবি ময়ুখ চৌধুরীকে নির্দিষ্ট কোনো কালের বিচারে মাপা যাবে না। অন্যসব কাব্যসহ পলাতক পেণ্ডুলামে সীমাহীন কল্পনার করুকাজ, বিষয়ের প্রতীকী ব্যঞ্জনা, বোধের গভীরে মননের বিপুল বিস্তার, সূক্ষ্ম পর্যবেক্ষণ, কাছিমের আবরণে কাব্যশক্তির স্বচ্ছলতা, বাংলার প্রকৃতি ও জীবন থেকে মৌলিক চিত্রকল্পের নির্মাণ-বিনির্মাণ, উপমা-রূপকের নতুন ভঙ্গিমায় উপস্থাপন, ছন্দের দারুণ দক্ষতার ফলে ময়ুখ চৌধুরী বর্তমানে বাংলা কাব্যধারায় অপরিহার্য কবিরূপে গণ্য।