একজনের চেহারা-আচরণের সঙ্গে আরেক জনের যেমন মিল নেই, তেমনি কারও কবিতার সঙ্গে কারও কাব্যের মিল না থাকাই স্বাভাবিক। আবার অন্য মতও আছে। যার-ই কবিতা হোক, তার পরিচয় মুখ্য নয়। কবিতা হলেই বর্তে যায়। কার কবিতা? সেটা বিবেচ্য নয়। বরং নাম নিষ্প্রয়োজন। কবিতাই আসল। এমন ভাবনা ভাবতে ভাবতে হোসনে আরা জাহানের কবিতায় ঠোঁট নেড়ে ওঠে। ‘নিশিন্দা পাতার ঘ্রাণ’-এ প্রাণটা ব্যকুল হয়ে ওঠে।
প্রথমে ঘুরে আসব ‘ব্রক্ষ্মপুত্র পুরাণ’ থেকে। এরপর ‘ইছামতি পুরাণ’-এর স্মৃতিতে সাঁতার কাটাব। এই দুই নদীর মাঝখানেই কবির জন্ম, বেড়ে ওঠা, শৈশব, কৈশোর ও যৌবন। কবিতায় তিনি নিজের ছায়াকে সুচারুরূপে রূপদান করতে চান। নিজের ব্যক্তিত্বকে গাঢ় করে উপস্থাপন করতে চান। কবি তার কল্পনা ও বাস্তবের গল্পকে একটা পুরাণের সুরে আওড়াতে ভালোবাসেন।
‘ব্রক্ষ্মপুত্র পুরাণ’ কবিতায় তিনি নিজের পাখিমনের একটা অনিন্দ্য দৃশ্যকল্প পাঠকের দিকে ছুড়ে দেন। তিনি তার জন্মভূমিতে পাতাটুনি বা আলতা মুনিয়ার বেশে উড়ে বেড়ান। নদের শান্ত জলের কাছে বার বার ফিরে যান। দিগন্তপ্রসারী সন্ধ্যা, আলো-ছায়ার দিনরাত, রোদসী দুপুর, দুপুরের তপ্ত হাওয়া, শিশির ভেজা রাতের সলমা পসরে নিজেকে বিলিয়ে দেন। তিনি তার পাখায় অনুভব করেন কুলকুল জলের ছন্দ। তিনিও যেন পাখি হয়ে জলের সঙ্গে সীমানা ছাড়িয়ে চলেছেন অচিনপথে। তিনি শুয়ে শুয়ে দিহাঙের জল পেরিয়ে, সিয়ংয়ের পাড় বেয়ে, জাঙপোর রূপালি জল পেরিয়ে যান অবলীলায়। তিনি কৈলাসের চূড়ায় গিয়ে একলা হন। এরপর হিমালয়ের পাঁজর ছুঁয়ে ছুঁয়ে বাঁচেন একা।
কবি কল্পনা আর স্মৃতির যে পসরা সাজান, তা সত্যি মোহিত করে। ব্রহ্মপুত্রের সঙ্গে নিজের জীবনের মিল ও অমিল, নিরবধি বয়ে চলা, জলের সঙ্গে নিজের ছবি আঁকানো এবং তার জন্মতালাশ ও নিজেকে অনুসন্ধান করা সার্থকতার ইঙ্গিক করে। ‘ইছামতি পুরাণ’-এও অন্যরূপে সুর তোলে। আগের যে কৈশোরসুলভ আবেগ ও আরতি ছিল, তার চেয়ে অনেক পরিণত ইছামতি পুরাণ। এখানে কবি নিজের ছবি ইছামতির শান্ত জলে দুলে উঠতে দেখেন। গহিনের আলো-আঁধারি কারুকাজের মতো সাজিয়ে দেয় জীবন। জলরঙে খচিত হয় তার আত্মগাথা। বাল্যকালে ব্রহ্মপুত্রের সেই ডুবসাঁতার এখানে মেলে না। মেলে না। মেলে না। বলে একটা দ্যোতনা তৈরি করার যে সুকঠিন সাধনা করেন, তাতে তিনি সফল।
বৃহ্মপুত্র ও ইছামতি এই দুটো কবিতায় তিনি জীবনকে অন্যরকম একটা দার্শনিক মাত্রা যোগ করতে পেরেছেন বলে মনে হয়। কারণ কবিতা দর্শনাশ্রিত একটা মায়াময় কল্পনার আড়ত। সেখানে আমাদের ছায়ামূর্তি দৃশ্য-অদৃশ্যে ধরা দেয়। এ ছাড়াও তিনি ‘প্রিয় ব্রহ্মপুত্র’ নামে আরেকটি শিশুকাব্যের আরাধনাও করতে ছাড়েননি। আসলে স্মৃতি এমন এক করাত যে, সে সবাইকে ফালি ফালি না করে ছাড়ে না। সেখানে জমানো থাকে আনন্দ-বেদনা ও টক-মিষ্টি-ঝালের স্বাদ।
এরপর আমাদের ‘ফুলপুর’ স্টেশনে নামতে বাধ্য করা হয়। প্রত্যেক শিল্পী কি পাঠককে জোর করে গলাধাক্কা দিয়ে আমাদের বইয়ের পাতায় নামিয়ে দেন? না কি তিনি ভালোবেসে নিবিড় ছোঁয়ায় আমাদের মায়ার পরশ বোলান? যেভাবেই হোক, কবি প্রিয় ফুলপুরের রোদ্দুরমাখা মাঠ-পথে ঝলমলে আলোর পাড়ে নিয়ে হাজির করেন। খড়িয়া খালের জলে ঝিকিমিকি রোদের কণা তাকে নাচিয়ে বেড়ায়। জলবতী মেঘ নাকি ওপুড় হয়ে তাকে ছড়িয়ে দেয়। টিনের চালের ওপর আমন্ত্রণ জানায়। তখন কবি জানালা গলে আসা বৃষ্টির মতো নিজের মধ্যেও গলতে শুরু করেন। এর নাম কি বেদনা? না কি স্মৃতির রোদন? তিনি দুঃখবতী হন মেঘের জলবতী হওয়ার দৃশ্য মেখে। বেগুনপোড়ানো স্মৃতি ওমকুয়াশার ভোরবেলাগুলো তাকে হাতছানি দেয়। ফুলপুর এখনো তাকে পিছু থেকে হুড়মুড় করে টানে। কবি স্কুলড্রেস পরা সরল বালিকা হয়ে ফুলপুরের ধুলোমাখা রাস্তায় খালিপায়ে আমাদের হাঁটিয়ে দেন অজানার উদ্দেশে। পাঠক হয়ে তখন আর আমাদের বিশ্বাস হারালে চলে না। আমরাও ব্রহ্মপুত্রের কাশফুল তুলে মায়ার বসতবাড়ি ছেড়ে ছলাৎ ছলাৎ জলে ভেসে চলি। শাশ্বত এসব কানাকানি আমাদের ভালোবাসায় রূপান্তর করে।
শুধু কি ব্রহ্মপুত্র বা ইছামতি অথবা খড়িয়া? তিনি নাফ নদীতেও যান। রোহিঙ্গা ইস্যুতে সবুজ জানালার একটা ইঙ্গিত দেন। তাদের মুক্তির পক্ষে, তাদের সীমানার পক্ষে তিনি কথা বলেন। তার ‘কল্পনাপ্রসূত’ কবিতা খানি পাঠ করা যাক:
অবেলায় চলো দুইজনে আজ ভূগোলপাঠে বসি
যেখানে গোলাবারুদ আছে মানুষের যুক্তি ও চিন্তায়,
নিশিন্দা পাতার ঘ্রাণে বিভোর প্রার্থনা হয় ফসলি মাঠে—
পেতে চাও এমন জীবন?
এই সে জিজ্ঞাসা? কবি আমাদের জীবনের একটা হাইওয়েতে তুলে দেন। প্রশ্ন করেন। এমন জীবন চাই কি না? তখন পাঠক ভূগোলপাঠে না বসে পারে না।
হোসনে আরা জাহানের কবিতায় প্রেম-প্রকৃতি, আশা-হতাশা, আনন্দ-বেদনাকে ছায়া ও রোদের সঙ্গে একীভূত করে পাঠককে আঁচ দিয়ে রাখেন। কবিতার ওম পাঠককে উত্তেজিত করে রাখে। তিনি সচেতনভাবে কিছু আঞ্চলিক শব্দ ব্যবহার করেন। সলমাপসর, সলমাচাঁদের, সলমাজরি। এছাড়া শালতিসবুজ, ফুসমন্তর, ঘুমলিবধু শব্দগুলো নতুন নতুন আমেজ তৈরি করে। কবিতায় প্রেম আর কামকে তিনি শিল্পমাত্রায় উন্নীত করতে পেরেছেন বলে মনে হয়।
‘হাইকু’ কবিতাগুলো নিয়ে আমার কোনো মত নেই। আমি এটা বুঝি না। এটাকে বরং ‘বাইকু’ বললে ভালো হয়। অন্য ভাষার সাহিত্য সরাসরি ব্যবহার না করে নিজেদের মতো কিছু একটা করা যায় কি না—ভাবা উচিত। তবে সুন্দরবন নিয়ে একটা অসাধারণ কবিতা আছে ‘কবিতার শিরোনাম’ নামে। বলেছেন, ‘সুন্দরবন তো এক আশ্রমের নাম’।
তার কবিতায় আছে গ্রামীণ মানুষের মেহেদিপাতার গল্প, ধুতুরা ফুলের ইশারা, তুলশি পাতার রেগে ওঠা। আছে বেদনার মতো মিহিসুখ, দীর্ঘ বুননের আগে, ভুসুকুপাকে নিয়েও কবিতা। ‘ফুলের জীবন’ নামে কবিতায় তিনি বলেন,
গাছ, মানুষ কিংবা পাখির মতো; যতদূর জানি—
ফুলের জীবনেও তার নিজের কোনো হাত নেই
ফুল হয়ে জন্মাবার কিছুক্ষণ আগেও সে জানে না
কী রূপ কী শোভা কী গন্ধ সে বয়ে আনবে এ গ্রহে
জীবন জুড়ে কতোটুকু সময় সে পাবে?
এ যেন পাঠককে থমকে দাঁড়িয়ে রাখা। প্রশ্ন করে উত্তর জানতে চাওয়া শিক্ষকের মতো? এই যে দার্শনিকতা আমাদের সবাইকে ভাবায়, সেখানেই হোসনে আরা জাহান খানিকটা জয়ী।
নিশিন্দা পাতার ঘ্রাণ
হোসনে আরা জাহান
প্রচ্ছদ: ধ্রুব এষ
প্রকাশক: অনন্যা
মূল্য: ১০০ টাকা।