কবি ও কথাসাহিত্যিক দীলতাজ রহমানের সাম্প্রতিক গল্পগ্রন্থ ‘নিঃসঙ্গ সৈকতে সোনার ময়ূরপঙ্খি নাও’। বেরিয়েছে এবারে বইমেলায়। গ্রন্থটিকে নিছক একটি গল্পগ্রন্থ বলে আখ্যায়িত করলে তার যথার্থ মূল্যায়ন করা হবে না। ভূমিকায় তিনি নিজেই বলেছেন, ‘এই বইয়ে যা লেখা, তার কিছু গল্প, কিছু গল্পের মতো, যাকে অগল্পও বলা চলে’। তবে গল্পগুলোর চরিত্র যা-ই হোক না কেন, সেগুলোকে জীবনের রোজনামচা বলা চলে অবলীলায়। সেই রোজনামচাকে আশ্রয় করে গল্পকার চিত্রায়ণ করেছেন তার জীবনদর্শন।
আমরা জানি, সত্য অনেক সময়ই আমাদের দাঁড় করিয়ে দেয় বৈরী বাস্তবতার মুখোমুখি। দীলতাজ রহমান তার গল্পগুলোতে খুব সহজেই তেমন অনেক সত্য কাহিনী খুঁড়ে আমাদের চেতনার তন্ত্রীতে আঘাত করেছেন এমনভাবে, যাতে জীবন দর্শনের কিছু উপেক্ষিত কিংবা অস্বীকৃত সুর পাঠকের মানসকর্ণে বেজে উঠেছে অবলীলায়। আমাদের পারিপার্শ্বিকতার সে সব উপেক্ষিত ও অস্বীকৃত অনুষঙ্গ পাঠকের কাছে হয়ে উঠে নতুন জিজ্ঞাসার উপাদান। মনে হয়, তাই তো! এভাবে তো ভেবে দেখিনি!
নিজের চারপাশকে নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ, পরিপ্রেক্ষিত ও ঘটনাপ্রবাহ বিশ্লেষণ এবং সুখপাঠ্য গল্প হিসেবে তা পাঠকের কাছে উপস্থাপন—এই তিনটি সামর্থ্যের সমন্বয় ঘটাতে পারলেই একজন লেখক সার্থক গল্পকার হয়ে উঠতে পারেন। সে বিবেচনায় দীলতাজ রহমান একজন সময়োত্তীর্ণ গল্পকার হিসেবে আবির্ভূত হয়েছেন এই গ্রন্থে। কারণ, গল্পগুলো তিনি কেবল ঘটনার ধারাবিবরণীর মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখেননি, দর্শনভিত্তিক বিশ্লেষণ করেছেন। একইসঙ্গে তা পাঠকের কাছে উপস্থাপন করেছেন প্রাঞ্জল ভাষায়। এই তিনের সমন্বয় ঘটাতে গিয়ে আবশ্যিকভাবেই ঘটনার সঙ্গে খাঁদ মিশিয়েছেন। তিনি নিজেই বলেছেন ‘সাহিত্যে খাঁদটা সোনার চেয়ে দামি’। ঘটনাপ্রবাহের সঙ্গে এই খাঁদটুকু অত্যন্ত সফলতার সঙ্গে মেশাতে পেরেছেন বলেই এই গ্রন্থটি একটি পরিপূর্ণ গল্পগ্রন্থ হয়ে উঠেছে।
‘নিঃসঙ্গ সৈকতে সোনার ময়ূরপঙ্খি নাও’ গ্রন্থের ২৫৫ পৃষ্ঠায় মোট ৮টি গল্প স্থান পেয়েছে। কিন্তু গ্রন্থের পাঠ এই ৮টি গল্পেই সীমাবদ্ধ থাকে না। পাঠ শুরু হয় ফ্ল্যাপ কভার থেকে। অন্য অনেক বইয়ের মতো এই বইয়ের ফ্ল্যাপ কোনো প্রথিতযশা কথাসাহিত্যিক লিখেননি। লিখেছেন এমন একজন, যিনি নিজেকে একজন ‘ছড়া শিল্পী ও সাহিত্যের নগণ্য পাঠক’ হিসেবে পরিচয় দিয়েছেন। কোনো রকম ভনিতা না করে কিংবা জ্ঞানগর্ভ আলোচনায় না গিয়ে তিনি এই লেখকের অন্য একটি বই পাঠের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করেছেন এভাবে—‘…কুরিয়ারে আসা বইটি সংগ্রহ করে সেখান থেকেই রক্ত ডোনেট করতে গেলাম। নির্ধারিত চেয়ারে বসে সেখানেই প্যাকেট খুলে বইটি পড়তে শুরু করলাম। একসময় রক্তগ্রহীতা বললেন, ওঠেন, আপনার রক্ত নেওয়া শেষ…! আমি আশ্চর্য হয়ে বুঝলাম, দীলতাজ রহমানের গল্পের বই যদি হাতে থাকে, আর এমন দশ ব্যাগ রক্তও যদি কেউ শরীর থেকে চুরি করে নিয়ে যায়, নির্ঘাত আমি টের পাবো না…’। এই কয়েকটি লাইনেই বোঝা যাবে দীলতাজ রহমান তাঁর পাঠককে গল্পের প্রবাহের সঙ্গে কিভাবে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে রাখেন। আলোচ্য গ্রন্থটিও তার ব্যতিক্রম নয়। গল্পে প্রবেশের আগে ভূমিকায় চোখ বোলালেই পাঠক বুঝতে পারবেন গ্রন্থের গল্পগুলোর চরিত্র আত্মজৈবনিক। লেখিকা নিজেই জানান দিয়েছেন এই গল্পগুলো মূলত তার নিজের এবং পারিপার্শ্বিকতার রোজনামচা। তিনি অকপটে স্বীকার করেছেন যে নিজের ব্যক্তিজীবনের অনুভূতিগুলো সংবরণ করেননি। পাঠক তাই গল্পের পরতে পরতে সহজেই আবিষ্কার করবেন ব্যক্তি দীলতাজ রহমানকে। ভূমিকাতেই তিনি পাঠককে দাঁড় করিয়েছেন এক জীবন দর্শনের মুখোমুখি—‘ভালোবাসার মতো আপেক্ষিক বিষয় পৃথিবীতে আর কিছু নেই’। ভালোবাসার আপেক্ষিকতা নিয়ে পাঠক শুরুতেই একটা ভাবনায় পড়ে যাবেন। এই ভাবনা তাকে তাড়িয়ে নিয়ে যাবে গল্পগুলোর অভ্যন্তরে।
বইটির পড়া শেষ করতে হলে পৌঁছাতে হয় শেষ কভার অবধি। সেখানে লেখক মাত্র ৪টি লাইনে পুরো গ্রন্থের সবটুকু ঘনীভূত নির্যাস তুলে ধরেছেন এভাবে:
তুমি একটানা অনর্থক কষ্ট দিয়ে যাবে
আর সেই দুঃখ টবে ফুটলে ফুল
হুলুস্থুল তাকেও বলবে, পরকীয়া?
ঘর আর চিতার সংজ্ঞা তবে আগে ঠিক করো!
তাই বলে এটা মনে করা ঠিক হবে না—সংসারের সংঘাত এবং তার পরিণতিতে পরকীয়াই ‘নিঃসঙ্গ সৈকতে সোনার ময়ূরপঙ্খি নাও’-এর প্রধান উপজীব্য। হ্যাঁ, পরকীয়া, পরকীয়ার হাতছানি কিংবা আকাঙ্ক্ষা এসেছে বটে কিন্তু ‘অনর্থক কষ্ট’, সেই দুঃখে ‘টবে ফুল ফোটা’ এসেছে বেশি, আর তারও চেয়ে বেশি বিধৃত হয়েছে ‘ঘর ও চিতার’ ব্যবধান। তাই বলে নিটোল প্রেম, আটপৌরে জীবন যাপন, সংসারের প্রাত্যাহিক অনুষঙ্গ, স্বামী-স্ত্রীর চিরায়ত রসায়ন, একগামিতা আর বহুগামিতার মনস্তাত্ত্বিক ব্যবচ্ছেদ, মাতৃত্ব, প্রাপ্তি অপ্রাপ্তির টানাপড়েন—কোনো কিছুই বাদ পড়েনি। দীলতাজ রহমান নিজের চারপাশে যা কিছুই দেখেছেন বা উপলব্ধি করেছেন তার সবটুকু নির্যাসই পাঠকের সামনে তুলে ধরেছেন বিস্তৃত ক্যানভাসে।
একাকিত্ব, বিষণ্নতা, প্রেম, পরকীয়া, আটপৌরে জীবন যাপন, মনের দ্বৈত সত্তার টানাপড়েন এসব তো আছেই, সেই সঙ্গে আছে বিভিন্ন চরিত্রে জটিল মনস্তত্ত্বের আঙিনায় ঘোরাফেরা।
গ্রন্থের প্রধান গল্পের নাম নিয়ে পাঠকের একটা বিভ্রান্তি থেকে যাবে। গল্পসূচিতে লেখা আছে ‘নিঃসঙ্গ সৈকতে সোনার ময়ূরপঙ্খি নাও’। বইটির নামও তাই। কিন্তু পাতা উলটে গল্পটি পড়তে গেলে শিরোনামে দেখা যাবে ‘বিষণ্ন সৈকতে সোনার ময়ূরপঙ্খি নাও’। একটু বিভ্রন্তি তো বটেই! ‘নিঃসঙ্গ’ শব্দটি ‘বিষণ্ন’তে রূপান্তর কি ইচ্ছাকৃত নাকি লেখক বা মুদ্রাকরের অসাবধানতায়, তা স্পষ্ট নয়। যদিও কাহিনীর প্রবাহে কোথাও কোথাও বিষণ্নতা উঁকি দিয়েছে অনিবার্যভাবে, কিন্তু নিঃসঙ্গতাই অধিকতর প্রযোজ্য মনে হয়েছে। কাহিনীর মূল চরিত্র সব সময় পরিচিতজন পরিবেষ্টিত হয়েও নিঃসঙ্গ। ‘মানুষ মূলত একা’ তার নিজস্ব ভূবনে—এই চিরন্তন সত্যই যেন গল্পের পরতে পরতে ছড়িয়ে আছে প্রচ্ছন্নে। সেই হিসেবে এই গল্পের নাম বইয়ের নামের মতোই ‘নিঃসঙ্গ সৈকতে সোনার ময়ূরপঙ্খি নাও’ হওয়াই যুক্তিযুক্ত। তবে এই আপাত অসঙ্গতি নিয়ে হয়তো লেখক নিজেই ভালো বলতে পারবেন। হয়তো তার কাছে অন্য কোনো ব্যাখ্যা আছে।
দীলতাজ রহমানেরই স্বীকারোক্তি, এই বইয়ের অন্য গল্পগুলোর মতো এই গল্পটিও আত্মজৈবনিক। এর চরিত্রকে একটি আদর্শ ছোটগল্পের সংজ্ঞার মধ্যে ধারণ করা নিয়ে যথেষ্ট দ্বিধার অবকাশ থেকে যাবে। ১৮৩ পৃষ্ঠা দৈর্ঘ্যের এই গল্পটিকে পাঠক বড়গল্প বলতে পারেন আবার উপন্যাসও ভাবতে পারেন। আবার কেউ কেউ একগুচ্ছ গল্পের সংকলন ভাবলেও তা অকারণ মনে হবে না। তবে গ্রন্থে অন্য কোনো গল্প না থাকলে অনায়াসেই তাকে উপন্যাস বলে অভিহিত করা যেতো। গল্পকার মুখ্য চরিত্রের আড়ালে নিজের পরিবার ও পরিচিত মহল ও পারিপার্শ্বিকতার কথাচিত্র এঁকেছেন কোনো জড়তা ছাড়াই। এ তার অনন্য সাহসিকতা। যিনি নিজেকে খোলামেলা উপস্থাপন করতে পারেন, তিনি তার পারিপার্শ্বিকতাকে উপস্থাপন করতে পারবেন ব্যক্তিগত ভাবাবেগ বিযুক্ত করে, সেটাই স্বাভাবিক। তিনি করেছেনও তাই। আর সে জন্যই এই গল্পটি এমন জীবন্ত হয়ে উঠেছে, আমাদের সমাজের স্ফটিক-স্বচ্ছ দর্পণ হয়ে উঠেছে। এই দর্পণে নিজের অভিজ্ঞতালব্ধ জীবন দর্শনের মিশ্রণ ঘটাতে গিয়ে তিনি মানব জীবনের অজস্র অনুষঙ্গ তুলে এনেছেন বিভিন্ন গল্পাংশে। একাকিত্ব, বিষণ্নতা, প্রেম, পরকীয়া, আটপৌরে জীবন যাপন, মনের দ্বৈত সত্তার টানাপড়েন এসব তো আছেই, সেই সঙ্গে আছে বিভিন্ন চরিত্রে জটিল মনস্তত্ত্বের আঙিনায় ঘোরাফেরা। পাঠকের মনে হবে লেখক হয়তো কখনো মনোবিজ্ঞানের প্রাতিষ্ঠানিক পাঠ নিয়েছেন। স্থানে স্থানে এ সব মনোবিশ্লেষণ এবং মনস্তাত্ত্বিক মোচড়গুলো এই গল্পটিকে বিশেষত্ব দিয়েছে। তেমন একটি গল্পাংশে দেখা যাবে পিতৃত্বের বিভ্রান্তি নিয়ে একটি চরিত্রের মনোদৈহিক দংশন। আবার সে গল্পেই অপ্রাতিষ্ঠানিক কাউন্সেলিংয়ের কৌশল উঠে এসেছে অন্য চরিত্রের নিছক কর্মপরিধি হিসেবে। যেমনটি লেখক বর্ণনা করেছেন—‘আমি বুঝতে পারি, ওই যে একটু সেধে খেতে দেয়ার চেয়ে, নির্দ্বিধায় মন খুলে কথা বলতে দেওয়ার প্রশ্রয়টুকুই তাকে হয়তো কখনোসখনো আমার কাছে টেনে আনে!’। এই যে নিজেকে ব্যক্ত করার আকুলতাকে আর আনন্দ বেদনার কথা কারও কাছে উগরে দেওয়ার বাসনাকে প্রশ্রয় দেওয়ার প্রক্রিয়া তা-ই তো কাউন্সেলিংয়ের মূল কৌশল। দীলতাজ রহমান গল্পের মুখ্য চরিত্রের আড়ালে তা করে গেছেন অহরহ। শুধু গল্পকার হিসেবেই নন, একজন মা হিসেবে তিনি শিশু মনোবিজ্ঞানের একটি জটিল সূত্র তুল ধরেছেন সহজ পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে। ‘অনেক বাড়িতে মাস্টারি করে দিনগুজরান করা সে তরুণ লেখাপড়া নিয়ে খেলা করতে শেখেনি বলে এই ক্ষুদে ছাত্রের সাথেও মাস্টারি ফলাতে গিয়েছিল।’ এই বাক্যটি শিশু মনস্তত্ত্ব নিয়ে লেখিকার এক জোরালো পর্যবেক্ষণের স্বাক্ষর। ‘লেখাপড়া নিয়ে খেলা’ করতে না পারা এবং ‘মাস্টারি ফলানো’ এই শব্দগুচ্ছের মাধ্যমে তিনি আমাদের সমাজে শিশুদের পাঠদান পদ্ধতির সীমাবদ্ধতা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়েছেন।
এক জায়গায় দেখা গেলো একজন তার স্বামীকে পরিত্যাগ করে পুরনো প্রেমিককে বিয়ে করেছেন। কিন্তু প্রথম স্বামীর মৃত্যুর পর তিনি উপলব্ধি করলেন, সেই স্বামীর প্রতিও তার অনেকটুকু ভালোবাসাই বেঁচে গেছে। আবার অন্য এক জায়গায় দেখা গেলো একজন পরিবার-নির্যাতিতা নারী যে কিনা পিতামহের দ্বিতীয় স্ত্রী, তার প্রতি সেই পরিবারের একজনের খানিক মমত্ববোধের কারণে নায়িকার সেই ছেলেটির প্রতি এক ধরনের ভালো লাগা তৈরি হয়েছে। আপাত দৃষ্টিতে বিষয়গুলো ঠুনকো মনে হলেও এর গভীরে রয়েছে মানবিকতার বীজ। লেখকের কথায়, ‘প্রায় তিন যুগের সংসার ফেলে পুরোনো প্রেমিকের সাথে আবার ঘর বেঁধেও যে ছেড়ে আসা মানুষটির জন্য সে কান্না থামাতে পারছিলো না…’; কিংবা ‘…যাকে হায়দার ছাড়া আর সবাই বলতো পাগলি। হায়দার একাই বলতো দাদি! এজন্যই কি হায়দারকে আমার ভালো লাগতো কিনা, জানি না!’
‘ঘর’কে ‘চিতা’ বানানোর ফল হিসেবে কোথাও পরকীয়ার গল্প এসেছে, আবার কোথাও পরকীয়া না এলেও এসেছে সাংসারিক অশান্তির চিত্র। এ ধরনের সমস্যা একেকজন মোকাবেলা করে একেকভাবে। কিন্তু যেকোনোভাবে সংসার টিকিয়ে রাখার প্রচেষ্টা আমাদের সমাজে সবচেয়ে বেশি কাম্য। হয়তো তার নানা পথ রয়েছে। কোনোটা আমাদের সমাজ অনুমোদন করে, কোনোটা করে না। লেখক এখানে চমৎকার একটি রূপক ব্যবহার করেছেন—‘গরুকে দিয়ে গেরস্ত কিভাবে হাল চাষ করিয়ে নেয়, দেখেছো? স্বামী সম্পর্কের আসামী মানুষটির কাঁধেও ওরকম সংসারের জোয়াল তুলে দিয়ে নিজের কৌশল ও আনুগত্য ভাব দেখিয়ে সংসার টিকিয়ে রাখতে হবে!’ হয়তো এ রকম চিন্তা অনেকেই করেন, কিন্তু ক’জন নারী এমনভাবে কথাটি বলতে পারবেন? এখানেই দীলতাজ রহমানের বিশেষত্ব, তার সাহসিকতা।
বলতে দ্বিধা নেই, গল্পের এক জায়গায় এসে একটু হোঁচট খেতে হয়। এই হোঁচট খাওয়া গল্পের প্রবাহ কিংবা কাহিনী বিন্যাসের সীমাবদ্ধতার জন্য নয়, বরং এই একটি স্থানে লেখিকাকে কিছুটা রায়প্রবণ মনে হওয়ার কারণে। তিনি লিখেছেন, ‘যে স্বামীকে যথার্থ ভালোবাসবে, সে শাশুড়িকে ভালো না বেসে পারে না। আবার একজন মা যদি ছেলেকে যথার্থই ভালোবাসেন, তো বউকে ভালো না বেসে, সম্মান না করে পারে কি করে, এ আমি আজো ভাবতে পারি না’। মনে হয়েছে তিনি স্বামী-স্ত্রী-শাশুড়ির ত্রিভূজ সম্পর্কের রসায়ন নিয়ে একটি স্থির উপসংহারে পৌঁছে গেছেন। তার ব্যত্যয় কিন্তু আমাদের সমাজে অগণন। স্বামী স্ত্রীর যথেষ্ট ভালোবাসা থাকা সত্ত্বেও শাশুড়ির সঙ্গে বৈরি সম্পর্ক কিংবা পুত্রের প্রতি অগাধ ভালোবাসা থাকা সত্ত্বেও পুত্রবধুর সঙ্গে বৈরিতা থাকার উদাহরণ আমাদের চারপাশে প্রচুর। অবশ্য উপন্যাসসম এত বড় একটি গল্পে মাত্র একবার হোঁচট খেলে তা সেই গল্পের কালোত্তীর্ণ মানে তেমন কোন আঁচড় ফেলতে পারে না। বরং তা কলঙ্ক থেকে চাঁদের সৌন্দর্যকে আলাদা করে দেখতে সহায়তা করে মাত্র।
তখন সম্পর্কের দৃঢ়তা নির্ভর করে বুদ্ধিমত্তা, সম্পর্ককে লালন করার কৌশল ও দু’জনের মানসিক পরিপক্বতার ওপর।
আরেকটি শক্তিশালী ও বক্তব্যধর্মী গল্প ‘মানবতা ও পাখবতার রজ্জু’। মানব চরিত্রের মনোদৈহিক বৈশিষ্ট্যের সাথে পাখি চরিত্রের তুলনামূলক চিত্র আঁকতে লেখিকা ‘পাখবতা’ শব্দটি ব্যবহার করেছেন। সেই বিশ্লেষণে তিনি একটি পোষা পাখি নিয়ে লেখা গল্পকে আশ্রয় করেছেন। দীলতাজ রহমান প্রাণীমনস্তত্ত্ববিদ নন, এমনকি প্রাণীবিদ্যায় তার কোনো প্রশিক্ষণও নেই। অথচ মানুষ ও পাখির আবেগ ও যৌনতার যে তুলনামূলক চালচিত্র তিনি উপস্থাপন করেছেন তাতে চমৎকৃত না হয়ে উপায় নেই। তা তার গভীর পর্যবেক্ষণ শক্তি, বিশ্লেষণের সামর্থ্য আর সহজবোধ্যভাবে পাঠকের কাছে উপস্থাপনের সাফল্যেরই পরিচায়ক। জোড়ার একটি পাখি মারা যাওয়ার পর যখন আরেকটি অনবরত চেঁচিয়ে যাচ্ছিল, তখন তিনি পাঠককে মনে করিয়ে দিলেন—’এমন অবস্থায় মানুষ চেঁচালে যারা দোষ দেয়, তাদের সব বাড়ি একবার করে এই পাখিকে পাঠানো উচিত। কারণ প্রকৃতির শিক্ষাই হলো আসল শিক্ষা। এর বাইরের শিক্ষা আরোপিত এবং অসম্পূর্ণ শিক্ষা’। সঙ্গী বা সঙ্গিনীর মৃত্যুর শোকে শুধু যে তার জন্য অনুভূতির তীব্রতা থাকে তা ই নয়, নিজের সম্ভাব্য অপূর্ণতা ও কষ্টের জন্য ও হৃদয়ের ক্ষরণ থাকে। আমরা অনেক সময় বিষয়টি সেভাবে ভেবে দেখি না। অনেক সময় অস্বীকারের ভান করি। লেখিকা আমাদের সে সত্যটি মনে করিয়ে দিয়েছেন অবলীলায়। মোরগ-মুরগি এবং মানব-মানবীর আবেগ ও যৌন অধিকারবোধকে তুলনামূলক ক্যানভাসে চিত্রিত করে তিনি পাঠকে দাঁড় করিয়ে দিয়েছেন এক কঠিন প্রশ্নের সামনে। নারীর তার স্বামী বা প্রেমিকের মন, শরীর আর সম্পদের ওপর একচ্ছত্র আধিপত্যের আকাঙ্ক্ষা, ঈর্ষা এবং সেই সঙ্গে পুরুষের বহুগামী স্বভাবের নানা মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ করেছেন। কিন্তু কোনো উপসংহারে পৌঁছাননি। সেটি গল্পকারের দায়িত্বও নয়। তিনি শুধু পাঠকের চিন্তাকে উসকে দিতে প্রশ্ন রেখে গেছেন—’এই মোরগের প্রবণতা দিয়েই তো বিধাতা পুরুষমানুষ গড়েছেন। তাহলে আইনকানুন সেই ধাতে ফেলে, শর্তগুলো সে রকমারো খোলাসা হতে পারতো। আর নারীগুলোকে বিধাতা কেন শুধু মুরগির মেজাজেই বানাতে পারলেন না! যাদের শেয়াল-বেজি, কাক-চিলের মতো ভয়ঙ্কর প্রতিপক্ষের সঙ্গে লড়াইয়ের তাগদ থাকলেও ঘরের পুরুষকে আটকানোর কোন প্রবণতা, কোনো আগ্রহ ভালবাসা থাকবে না!’ এই প্রশ্নের মীমাংসা্র জন্য লেখিকা একটি সম্ভাব্যতার আলোচনা উন্মুক্ত করেছেন এভাবে—’তাই শুরু থেকে নারীকে মানবতাবোধের চেয়ে পাখবতাবোধটা বেশি শেখাতে পারলে, পুরুষের সাথে গড়পরতা নারীর সম্পর্কের আঁটোসাটো ভাবটা কমে আসবে। তাতে রক্ষা পাবে অনেক সংসার। কোনো শিশুকে আর চোখের সামনে পোহাতে হবে না, মা-বাবার সম্পর্ক ভাঙার মর্মান্তিক যাতনা! আর তখন যাতনা শব্দের গায়ে অতো ভারও থাকবে না!’ বিষয়টি কিন্তু তুমুল বিতর্কের অপেক্ষা রাখে। আমাদের সমাজে অধিকাংশ মানুষই এই ধারনা সমর্থন করবে না। তবে লেখকের কাজ সমর্থন সংগ্রহ নয়, ভাবনার পরিমণ্ডলকে অবমুক্ত করা। দীলতাজ রহমান তাই করেছেন।
উল্লেখ্য, পাশ্চাত্যে পরিচালিত বিভিন্ন সমীক্ষায় দেখা গেছে স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কের কোনো অপূর্ণতা বা সীমাবদ্ধতায় সেই সংসারকে টিকিয়ে রাখার জন্য স্বামী বা স্ত্রীর কিংবা দু’জনের পরকীয়া কখনো কখনো ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে পারে। তাতে দু’জনই সম্পর্কের সীমাবদ্ধতা মেনে নিয়ে সংসারজীবন অব্যাহত রাখে। এই বিবেচনাটি মানুষ পাখিদের কাছ থেকে রপ্ত করেছে কি না, তা অবশ্য বিস্তারিত গবেষণার বিষয় আর এভাবে সংসার টিকিয়ে রাখা মাহাত্ম্য বা প্রয়োজনীয়তাই বা কী, তাও ভিন্ন বিতর্কের বিষয়। ‘পাখি-পশুর মতো অত উঁচু মার্গের স্বাধীনতা ভোগের কৌশল তোরা কখনোই আয়ত্ত করতে পারবি না!’—এটা লেখকের অভিশাপ কিংবা ভবিষ্যদ্বাণী—যা-ই হোক না কেন, এর মধ্যে ক্ষীণদৃষ্টির পাঠক সামাজিক অবক্ষয়ের ইঙ্গিত দেখবেন। কিন্তু গভীর দৃষ্টির ঋদ্ধ পাঠক দেখবেন চিন্তার জগতে মুদ্রার আরেক পিঠ। পাঠককে এমন দোটানায় ফেলে লেখক এগিয়ে যাবেন অন্য কোনো গল্পে, অন্য কোনো জীবন দর্শনের সূত্র সন্ধানে।
আরেকটি বিষয় সচেতন পাঠকের চিন্তার খোরাক জোগাতে পারে। তিনি এক জায়গায় বিধাতাকে উল্লেখ করেছেন ‘বিধাতাপুরুষ’ হিসেবে। সমাজ বিধাতাকে নিরাকার, না পুরুষ না নারী হিসেবে প্রকাশ্যে মেনে নিলেও অধিকাংশই তাকে পুরুষের প্রতিমায় অন্তরে ধারণ করেন। তবে কি লেখকও সচেতনে কিংবা অবচেতনে সে ধারাই বহন করেছেন?
গ্রন্থের প্রথম গল্প ‘ভালোবাসা যারে খায়’। নামের মতোই গল্পের অবয়ব নিটোল প্রেম দিয়ে সাজানো। একেবারে ‘নাহি তত্ত্ব নাহি উপদেশ’। তবে একে নিছক সাদামাটা প্রেম কাহিনী বলা যাবে না। পাঠক প্রথমে একটি অনিশ্চয়তার ভেতর দিয়ে যাবেন, যার সমাধান পাবেন গল্পের শেষ ভাগের মোচড়ে।
‘বন্ধ খামে খোলা চিঠি’ আরেকটি উচ্চমার্গীয় মনস্তাত্ত্বিক টানাপড়েনের গল্প। গল্পটি লেখা হয়েছে মনোলগের আদলে। স্বামী-স্ত্রীর পারস্পরিক ভালোবাসা, সৌহার্দ্য, বোঝাপড়া, আস্থা ও শ্রদ্ধাবোধের কমতি না থাকলেও কখনো কখনো তাদের রসায়নে কোনো একটা যোজনীর তালকাটা দেখা যায়। তখন সম্পর্কের দৃঢ়তা নির্ভর করে বুদ্ধিমত্তা, সম্পর্ককে লালন করার কৌশল ও দু’জনের মানসিক পরিপক্বতার ওপর। এই গল্প থেকে আগ্রহী পাঠক জীবনের কিছু ব্যবহারিক টিপস শিখে নিতে পারবেন।
‘লেপ ছাড়া এক শীতের কাহিনী’ গল্পটি আমাদের সাহিত্য জগতের এক খণ্ডচিত্র। একজন উঠতি নারী লেখক তার লেখা ছাপানোর জন্য একজন সাহিত্য সম্পাদকের আনুকূল্য প্রত্যাশা করলে সে সাহিত্য সম্পাদক কিভাবে তার কাছ থেকে বৈষয়িক সুবিধা নিয়েছেন তার গল্প। যাদের সুকুমারবৃত্তি লালন করার কথা, তাদের কাছে কখনো কখনো এভাবেই সুকুমারবৃত্তি পরাস্ত হয়ে আসছে।
‘মা যে শুধুই মা’ একটি সনাতন মাতৃত্বের গল্প। পারিবারিক কৌলিন্য আর বৈষয়িক স্বার্থে একজন নববধূর ইচ্ছা-অনিচ্ছার বিসর্জনের পরও তার মধ্যে যে মাতৃত্ব জেগে আছে তা হয়তো ভিন্ন কোনো বিশেষত্ব বয়ে আনে না, কিন্তু গল্পের বিভিন্ন চরিত্র তাদের ‘মায়ের কাছে বা ‘মা’য়ের মধ্যে যা প্রত্যাশা করেছে, সেই ভিন্নতাই গল্পটিকে বিশেষত্ব দিয়েছে। এই গল্পের একটি চরিত্র বাসার, যে ছোটবেলা থেকে মাতৃসান্নিধ্যবঞ্চিত। লেখকের কথায়—‘বাসারের ইচ্ছে করে, মা কাছে এসে জানতে চাক, সে কেমন আছে? শুধু এইটুকু তৃষ্ণা মিটে গেলে বাসার এক সাধারণ মানুষ হয়ে যেতো। তার আর অন্য কষ্ট থাকতো না।’ একটি ছোট্ট প্রত্যাশার মাধ্যমে কী এক বিশাল অভিব্যক্তি!
একজন মৃত্যুপথযাত্রী বিধবার প্রতি তার পরিবার পরিজনের অবহেলার কাহিনী এবং তার ফলে সে বৃদ্ধার নিজের মতো করে প্রতিশোধ নেওয়ার অভিপ্রায় উঠে এসেছে ‘মরণের মূল্য’ গল্পে। সমাজ যে গল্প ধামাচাপা দিয়ে রাখতে চায়, দীলতাজ রহমান সে গল্প প্রকাশ করে সমাজের কালিমাই অবমুক্ত করে দিয়েছেন।
একজন নারী যখন এই উপমা ব্যবহার করেন, তখন স্বভাবতই প্রশ্ন জাগে—তিনি কি নারীর অনুপস্থিত অণ্ডকোষের কথা বলেছেন
শেষ গল্প ‘সোনার পাথরবাটি’। প্রেম ও দাম্পত্যের রসায়ন কিংবা তার সীমাবদ্ধতা, পরকীয়ার প্রকাশ ও গোপনীয়তার পটভূমি এবং একাকীত্বের নানা রকম মনোদৈহিক অনুষঙ্গ নিয়ে এই গল্পের কাহিনী এগিয়েছে। পড়তে গিয়ে বারবার মনে হয়েছে—জীবন যেমন জটিল, তেমন চমকপ্রদও বটে। কিছু কিছু বাস্তবতা আমাদের জানা থাকলেও কিছু কিছু বাস্তবতা আমাদের নতুন জিজ্ঞাসার সামনে দাঁড় করিয়ে দেবে। এই গল্পের দু’টি চরিত্রের তেমন কিছু কথোপকথন:
কলেমা পড়ে একটি সম্পর্কের পরে তারা যা-ই করুক, পুরুষমানুষ কখনো কোথাও কারো কাছে গিয়ে বলে না, যে আজ বউয়ের সাথে এই এই করলাম। তা ছাড়া, যতই ভালো মানুষ হোন, যতই তিনি পার্সোনালিটিসম্পন্ন, ইনটেলেকচুয়্যাল হোন, তিনি কোথাও না কোথাও তার অবৈধ সম্পর্কের কথা উগরে দেন!
কারণ কী?
পরের বৌকে করার ভেতর পৌরুষ নিহিত আছে কিনা…।
পুরুষের পৌরুষ প্রকাশের এই যে আকুতি তা নিয়ে পাঠকের চিন্তার অনেক খোরাক আছে। বিতর্কের অবকাশ তো অবশ্যই আছে। এ রকম নানা বিতর্কসাপেক্ষ প্রসঙ্গের অবতারণা করেই গল্পটি পরিণতির দিকে এগিয়ে গেছে।
দীলতাজ রহমানের দৃষ্টির তীক্ষ্ণতা ও গভীরতা এবং তা প্রকাশের সাবলীলতা ঈর্ষনীয়। ‘তার স্বামী কিছু দিন হলো, ডিগ্রি আনতে বিদেশে গেছেন’—অভিব্যক্তিটি ব্যবচ্ছেদ করলে পাঠক দেখতে পাবেন, তিনি ‘উচ্চ শিক্ষার্থে’ বিদেশ যাওয়ার কথা বলেননি, বলেছেন ‘ডিগ্রি আনতে’ যাওয়ার কথা। এই দু’টো যে ভিন্ন জিনিস, তা অনেক সময় আমরা ভুলে যাই। ভুলে যাই বলেই আমাদের সমাজে ডিগ্রিপ্রাপ্ত মানুষের আধিক্য থাকলেও প্রকৃত শিক্ষিত মানুষের প্রচণ্ড অভাব। এই অপ্রিয় সত্যটি লেখকের দৃষ্টি এড়াতে পারেনি।
গল্পগুলোকে জীবন্ত করে তোলার জন্য লেখক তার রচনাশৈলীতে যথোপযুক্ত প্রাঞ্জলতা দিয়েছেন। কোথাও থমকে দাঁড়াতে হয় না, খেই হারাতে হয় না। কথোপকথনের ভাষা ব্যবহারেও তিনি বাস্তবানুগ। ‘ঠিকাছে’, ‘আসতেছি’, ‘নাস্তা খাইছো’—এই অভিব্যক্তিগুলো তারই পরিচায়ক। বইটিতে উপমা ও রূপকের ব্যবহারেও চমৎকারিত্ব রয়েছে। ‘এক বৈয়ম মধু আমি এখনো অণ্ডকোষের মতো লুকিয়ে রেখেছি।’ একজন নারী যখন এই উপমা ব্যবহার করেন, তখন স্বভাবতই প্রশ্ন জাগে—তিনি কি নারীর অনুপস্থিত অণ্ডকোষের কথা বলেছেন এই ভেবে যে অনুপস্থিত কোনো জিনিস যেমন খুঁজে পাওয়া যায় না, ঠিক তেমন করেই লুকিয়ে রেখেছেন, যা কোনো চেষ্টায়ই খুঁজে পাওয়া যাবে না, না কি নারীদেহে অণ্ডকোষের অনুরূপ অঙ্গ ডিম্বাশয়ের কথা বলেছেন, যা কিনা দেহের অভ্যন্তরে লুকানো থাকে। ব্যখ্যা যা-ই হোক না কেন, লুকিয়ে রাখার অধিকতর প্রযোজ্য উপমা খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। আবার কোথাও বলেছেন, ‘ওর এইসব মৌলিক চিন্তার প্রতিফলনগুলো দিঘির স্বচ্ছ জল হয়ে আমার ভেতর জলমাকড়সার মতো আন্দোলিত করে।’ জলকে আন্দোলিত করার অনুঘটক জলমাকড়সার চেয়ে বেশি প্রযোজ্য আর কী হতে পারে!
আগে যেমন বলেছি, চাঁদের সৌন্দর্য পুরোপুরি উপভোগ করার জন্য তাকে চন্দ্রকলঙ্ক থেকে আলাদা করে দেখতে হয়। তেমন কিছু চন্দ্রকলঙ্কও হয়তো সচেতন পাঠকের দৃষ্টি এড়াবে না। তার অধিকাংশই হয়তো বা লেখিকার অসাবধানে হয়েছে। ‘মাল্টিপুল (হবে ‘মাল্টিপল’) ভিসা’, ‘ক্যাথেডার’ (হবে ‘ক্যাথেটার’) তেমন কিছু অসাবধানতার স্বাক্ষর। ‘কানাডার অন্য স্টেট’ কথাটিও তথ্যগতভাবে ঠিক নয়। কানাডার প্রদেশগুলো অস্ট্রেলিয়া বা আমেরিকার মতো ‘স্টেট (অঙ্গরাজ্য)’ নয়, বরং সেগুলো ‘প্রভিন্স’ (প্রদেশ)। কোথাও কোথাও বাক্য বিন্যাসে কিছু অসাবধানতা ও যতিচিহ্নের অতিব্যবহার পরিলক্ষিত হয়েছে। ‘সাহস শুধু ভয়ের প্রতিশব্দ নয়, দ্বিধা-জড়তারও’—এখানে ‘প্রতিশব্দ’ ব্যবহারও অসাবধানতাজনিত বলে মনে হয়েছে (হওয়ার কথা ‘বিপরীত শব্দ’)। কিছু গল্পের নামকরণে লেখক আরেকটু চমক দেখাতে পারতেন বলে মনে হয়। বিশেষ করে ‘লেপ ছাড়া এক শীতের কাহিনী’, ‘মা যে শুধুই মা’ ও ‘মরণের মূল্য’—এই নামগুলো কাহিনীর বিবেচনায় যথার্থ মনে হলেও আরও সমসাময়িক করা যেতো বলে মনে হয়েছে। একজন সাধারণ লেখকের লেখায় এসব অসাবধানতা আর অসঙ্গতি হয়তো এড়িয়ে যাওয়া যাবে, কিন্তু দীলতাজ রহমানের মতো একজন শক্তিশালী কথাসাহিত্যিকের লেখা বলেই তা সচেতন পাঠকের চোখ এড়াবে না।
বেশ কিছু মুদ্রণ প্রমাদ চোখে পড়েছে। ‘আনোয়ারা আজাদ আমার আজ জন্য’ (আনোয়ারা আজাদ আজ আমার জন্য), ‘বেহেস্তে যায়’ (ভেস্তে যায়), ‘খুঁতেই থাকি’ (খুঁজতেই থাকি), ‘ফফিক’ (শফিক), ‘থাবে না’ (থাকবে না/ থাকে না), অন্যকষ্ট (অন্য কষ্ট), ‘শফুরা’ (সফুরা) পড়তে গিয়ে বারবার হোঁচট খেতে হয়েছে। অমর একুশের গ্রন্থমেলায় বই প্রকাশের তাড়া থেকে এমন কিছু মুদ্রণ প্রমাদ হয়ে থাকবে। পরবর্তী সংস্করণে এই অসাবধানতা ও প্রমাদগুলো সংশোধন করার অবকাশ থাকবে নিশ্চয়ই।
যেসব পাঠক একটি পূর্ণাঙ্গ গল্পগ্রন্থের তৃষ্ণা নিয়ে এই বইয়ে প্রবেশ করবেন, তারা বিমুখ হবেন না। গল্পগুলোতে কাহিনীর অভাব নেই, আবার ঘটনার ঘনঘটাও নেই, জীবনের কথা আছে কিন্তু আত্মজীবনীর শুষ্কতা নেই, জীবনদর্শন আছে কিন্তু তা দর্শনশাস্ত্রের পাঠ হয়ে ওঠেনি। দীলতাজ রহমানের মুন্সিয়ানা এখানেই। আর সে জন্যই গ্রন্থটি বহুচারিত্রিক হলেও মূলত একটি পরিপূর্ণ গল্পগ্রন্থ হয়ে উঠেছে।
নিঃসঙ্গ সৈকতে সোনার ময়ূরপঙ্খি নাও
লেখক: দীলতাজ রহমান
প্রকাশক: এবং মানুষ
প্রচ্ছদ: চারু পিন্টু
মূল্য: ৫০০ টাকা।