আধুনিক সাহিত্য-প্রকরণের প্রায় সবই ইউরোপ থেকে ধার করে আনা। সম্প্রতি একটি নতুন প্রকরণ জনপ্রিয় হয়ে উঠছে; অণুগল্প। বিশেষ করে কানাডিয়ান লেখক এলিস মুনরো নোবেল পুরস্কার পাওয়ার পরে বিষয়টি আরও জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। আগে যারা এ ধারাটিতে চর্চা করতে দ্বিধাগ্রস্ত ছিলেন, তারাও নির্দ্বিধায় লিখতে থাকেন। সবারটা যে ভালো হয়, তা কিন্তু না। এলিস মুনরো শর্টস্টোরি রাইটার হিসেবে পরিচিত। তাঁর ছোটগল্প নানা ধরনের এবং আকারের। তিনি শুধু ছোটগল্প লিখেই নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন। উপন্যাসকে তিনি অপ্রয়োজনীয় মনে করেন। কারণ তিনি মনে করেন, ছোটগল্পেই তিনি সব অনুভূতি প্রকাশ করতে সক্ষম। একজন বড় মাপের লেখক হিসেবে তাঁর নিজের শিল্প প্রকরণের পক্ষে নিজস্ব দর্শন ও যুক্তি থাকবে—এটাই স্বাভাবিক।
তবে আমাদের দেশে কয়েক বছর আগে থেকেই এই প্রকরণটি চর্চিত হয়ে আসছে। মজার বিষয় বাংলা সাহিত্যের অন্য অনেক প্রকরণের মতো এই ধারাটিও রবীন্দ্রনাথের হাতে পরিপুষ্টি লাভ করে। রবীন্দ্রনাথের ছোটগল্প শুধু ‘গল্পগুচ্ছে’ই না। ‘সে’, ‘গল্পস্বল্প’ এবং ‘লিপিকা’য়ও রয়েছে। তিনি এই ধারাটির সফল অনুশীলন করেছেন। তাঁর কয়েকটি বিখ্যাত অণুগল্পের মধ্যে রয়েছে, ‘সওগাত’, ‘একটি দিন’, ‘কৃতঘ্ন শোক’ ইত্যাদি। এর পরে এ ধারায় সফল লেখক বলাইচাঁদ মুখোপাধ্যায় ওরফে বনফুল। বনফুলের হাতে অণুগল্প, ছোটগল্প বিচিত্র ও বিশুদ্ধ হয়ে ওঠে। রবীন্দ্রনাথের অণুগল্পগুলো এক পৃষ্ঠারও কম আয়তনের। বনফুলেরও তাই। বনফুল একপৃষ্ঠার কম আছে, বেশি আছে, মাত্র এক অনুচ্ছেদ, এমনকি তারচেয়েও ছোট আকারের লিখেছেন। এর অনেকগুলোই কালজয়ী হয়ে আছে।
সমকালীন তরুণ লেখকদের মধ্যে যারা কবিতা এবং ছোটগল্প রচনায় সমান পারদর্শী তাদের মধ্যে চন্দন চৌধুরীর অবস্থান শক্তিশালী। তিনি সমকালীন বহুমাত্রিক প্রতিভা। কবিতা এবং গদ্যে সিদ্ধহস্ত তিনি। তবে কবি হিসেবে একনামেই পরিচিত। কবিতা ছাড়াও ছোটগল্প, প্রবন্ধ-নিবন্ধ, শিশুসাহিত্য, জীবনীধর্মী রচনা এবং অনুবাদেও সফল। এ বছর (২০১৭) প্রকাশিত হল তাঁর অণুগল্পের গ্রন্থ ‘না-মানুষ’। এখানে ছিয়াশিটি অণুগল্প রয়েছে। ‘অণুগল্প’ নামটি বইয়ের শিরোনামের ওপর নিজেই বসিয়ে রেখেছেন। এ কারণে এই নামেই বইটিকে উল্লেখ করা হচ্ছে।
চন্দন চৌধুরীরর অণুগল্পগুলোতে সাহিত্যের ভাষা, আমাদের চারপাশের বাস্তবতা এবং একটু দর্শনের মিশ্রণ আছে। কিছু গল্প রূপকথার মতো, অন্য প্রাণীর কথাবলা প্রবণতা, রাজা-উজিরের কাহিনি ইত্যাদি আছে। তবে সর্বোপরি মানুষের গল্পই এখানে মুখ্য। আগন্তুক, প্রজাপতি, মানুষ, অমানুষ, কামার, পাগল, তরুণী ও সন্ন্যাসী, অন্ধের জ্যোৎস্না দর্শন, অভিশাপ, পাগল ২, ভয়, ছবি, ভাবনা, জীবন, জীবিত ও মৃত, ছায়াপুরাণ, সেরা অভিনেতা, অতীত, খেয়াপার, ভালো ডাকাত, ছেঁড়াজুতো, ছায়াসুন্দরী, অনুশোচনা, ধ্যান, অন্ধ ছবি, ভেতরের মানুষটা, হাত পাতা, বোকা লোকটা, মৃতদের দুঃখগুলো ইত্যাদি সুখপাঠ্য গল্প। এসব গল্পে কোনো শিল্পতত্ত্ব নয় মানুষই মুখ্য বিষয়। যদিও বইটির নাম ‘না-মানুষ’। আর আশ্চর্যের বিষয় এই যে ‘না মানুষে’র বিষয়ও কিন্তু মানুষ। কারণ এখানে ‘না মানুষ’ মানে মনুষ্যেত্বের অভাব। কাজেই মনুষ্যত্বের পূর্ণতার বিষয়টাই গল্পগুলোর প্রধান আলোচ্যবিষয়।
ধরা যাক, ‘আগন্তুক’ গল্পের যে লোকটির পায়ে সব সাইজের জুতা লেগে যায় সে কি ‘না মানুষ’? তার কাছে অলৌকিক ক্ষমতাসম্পন্ন মুচিও মাথা নত করতে বাধ্য হন। ‘প্রজাপতি’ গল্পে প্রজাপতির সৌন্দর্য আগুনের আঁচে যাওয়ার পরে থেকেই লোকটা অনুভব করে তার সারাশরীরে যেন আগুনে পুড়ে যাচ্ছে। এই অনুভবের পেছনে আছে ছোট্ট একটি প্রজাপতির প্রতি মানবিক দৃষ্টি। ‘মানুষ, অমানুষ’ গল্পে একত্রে রাত্রিযাপনের পরে সকালে যে লোকটা পালিয়ে যায়, তাকে দেখে পাগর গালি দেয়, ‘শালা অমানুষের বাচ্চা।’
কাঠ কাটার জন্য দা-কুড়াল-করাত ইত্যাদি ধারালো অস্ত্র বানায় যে কামার, সে একবার বনের ভেতরে প্রবেশ করলে সব গাছ তার বিরুদ্দে অভিযোগ তোলে সেই তো বৃক্ষদের খুনি। অনেক গাছ চায় তাকে পিষে মেরে ফেলবে। কিন্তু জ্ঞানী এক বনস্পতি তাকে ক্ষমা করে দেয়। বৃক্ষদের কাছে ক্ষমা পেয়ে কামার আর ফিরে আসে না। অবশেষে লোকটা বনচারী হয়ে ওঠে। ‘কামার’ গল্পটা এভাবেই পাঠকের হৃদয়চারী হয়ে ওঠে। ‘পাগল’ গল্পে পাগলের অভ্যাসটা যারা পাগর বলে খেপাতো তারাই রপ্ত করে বসে। শেষ পর্যন্ত সেও পাগলের কাজই করে। এখানে সূক্ষ্ম একটু আধ্যাত্মিকতার রেশ আছে। চন্দন চৌধুরীর নিজস্ব দর্শন এভাবেই সাহিত্যের ভেতর দিয়ে টেকসই হয়ে থাকে পাঠকের মনে। ‘তরুণী ও সন্ন্যাসী’ গল্পে তরুণীর প্রেমে পড়ে সন্ন্যাসী চিরদিনের জন্য আশ্রম ত্যাগ করে। ‘অন্ধের জ্যোৎস্নাদর্শন’ গল্পে অন্ধ লোকটি শেষপর্যন্ত বোঝেন জ্যোৎস্না কখনোই মানুষের মনের চেয়ে সুন্দর হতে পারে না। ‘অভিশাপ’ গল্পে যে লোকটি অভিশাপ দেয় সে শেষ পর্যন্ত দরবেশের নির্দেশনা অনুসারে নিজের অভিশাপে নিজেই জ্বলেপুড়ে মরে। চন্দন চৌধুরীর গল্পে দরবেশ, সন্ন্যাসী, পুরোহিত ও মোল্লাদের সম্পর্কে সমকালীন লেখকদের ধারণার চেয়ে ভিন্ন একটা ধারণা পাওয়া যায়। অনেকটাই ইতিবাচকভাবে এঁরা এখানে অবস্থান করেন। এখানেই লেখকের ব্যতিক্রমী দৃষ্টিভঙ্গি। ‘ভয়’ গল্পে অন্যের চরাচলে বাধা হতে চাওয়ার চেয়ে নিজে থেকেই সরে যাওয়া ভালো বিবেচনা করে লোকটা যেখানে পা রাখে সেখানেই ভয় পায়। ‘ছবি’ গল্পটি আধুনিক স্টাইলের একটি চমৎকার গল্প। এখানে রয়েছে আধুনিক চরিত্র এবং প্লট। সবচেয়ে ছোট অণুগল্প ‘জীবন’—মাত্র দুই বাক্যের। পুরোটাই উদ্ধৃতি দেওয়া যায়। ‘একটি ঢেউ উঠতে উঠতে বলল, ‘জানো, আমরা উঠতে উঠতেই পড়ে যাই। আরেকটা ঢেউ এটা শুনতে শুনতেই তলিয়ে গেল।’ এখানে ঢেউয়ের শক্তি নয় স্থায়িত্ব নিয়ে কথা হয়েছে। ঢেউ ক্ষণস্থায়ী হলেও তার শক্তি অনেক। এবং স্থায়ী প্রভাব রাখতে সক্ষম। খুব সম্ভবত এই বইয়ের সবচেয়ে নানন্দনিক গল্প ‘জীবিত ও মৃত’। দু’জন মানুষ অনেক সময় থেকেই পাশাপাশি। কিন্তু নাগরিক ভদ্রলোকীপনার কারণে কেউ কারো সাথে কথা বলেনি। যখন কথা বলা শুরু করেছে তখন অনুভব করেছে, ‘কথা বলার আগে থেকে আমরা আসলে দুজনই দুজনের কাছে মৃত ছিলাম।’ একজন কথাসাহিত্যিক কথা সম্পর্কে এর চেয়ে বড় কথা আর কী লিখতে পারেন? ‘ছায়াপুরাণ’ গল্পে বর্ণবৈষম্যের প্রতি আছে তীব্র প্রতিবাদ। মানুষ সুদর্শন হোক আর কুদর্শন হোক তার ছায়া একই রকম। অর্থাৎ আলোর কাছে সবাই সমান। ‘ছায়াসুন্দরী’ গল্পের বিষয়বস্তু একই। তবে সেখানে ছায়ার চেয়ে ভয়ংকর মৃত্যুর মুখ দেখার ব্যাপার আছে। ‘সেরা অভিনেতা’ গল্পে আধুনিক নাগরিক জীবনে আমাদের অভিনেতার জীবন নিয়ে কথা। ‘ভালো ডাকাত’ গল্পের ভেতরে অস্পষ্টভাবে হয়তো সমকালীন রাজনৈতিক এবং আর্থসামাজিক ইঙ্গিত আছে। ‘অনুশোচনা’ সবচেয়ে মানবিক অনুভূতিসম্পন্ন গল্প। এখানে হাতিটি মারা গেছে বলে মনে করে লোকটি সারাজীবনই অনুশোচনায় ভোগে। যদিও লেখক দেখিয়েছেন হাতিটা বানের পানিতে মুক্তি পেয়ে নিরাপদ আশ্রয়ে সরে গেছে। কিন্তু হৃদয়বান মানুষের মনের বেতর বিপন্ন হাতিটা কখনোই মুক্তি পায়নি। হৃদয়গ্রাহীকে অবিরাম আগুনে পোড়ায়। ‘ধ্যান’ গল্পে একজন কৃষকের ধ্যান যে কৃষিকাজ করা এ কথাটাই স্মরণ করিয়ে দেওয়া হয়েছে। সমাজের সবাইকে একই কাজ করতে হবে এমন কথা নয়। ‘ভেতরের মানুষটা’ গল্পে ঘোরতর সাম্প্রদায়িক একজন মোল্লা আর একজন ব্রাহ্মণ পরস্পর পরস্পরকে নিজেদের অজান্তেই বিপদ থেকে উদ্ধার করে। অবশেষে দুজনেই বিশ্বাস করে ওই লোকটা আসলে খারাপ না। লেখকের মতে, ‘তাদের ভেতরের মানুষটা বের হয়ে এলো।’
‘হাত পাতা’ গল্পটির গঠন আধুনিক ও সমকালীন বাস্তবতা। না বললেও বোঝা যায় বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকার গল্প। ট্রাফিক পুলিশ মাত্র দুই টাকা ঘুষ খাওয়ার জন্য পেছন দিকে হাত পেতে মুখ ঘুরিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। আর একজন ভিখারির দুই টাকা ভিক্ষার জন্য সামনের দিকে হাত পাতে। ‘বোকা লোকটা’ গল্পে সরল মনের মানুষটিকে ঠকানোর পরেও তার সংবিৎ ফিরে আসে না। শেষ পর্যন্ত আসে না। তবে গল্পটি নিষ্করুণ। ‘মৃতদের দুঃখগুলো’ গল্পে দেখা যায় পিতার মরদেহের সামনের বসে শিশু সন্তান বলে বাবার বুকরে ভেতর বাতাস বয়ে যায়। মেঘ উড়ে যায়। তার ধারণা মৃতদের ভেতরে সব কিছুই আছে, নেই শুধু তাদের দুঃখ। মৃতেরা পৃথিবীতেই রেখে যায় দুঃখগুলো। সেগুলো নিয়েই তো জীবিতেরা মৃতদের জন্য কাঁদে। আর লেখক না লিখলেও বুঝি মৃতেরা একারণেই কাঁদে না।
চন্দন চৌধুরীর অণুগল্পগুলোতে উচ্চকিত কোনো বক্তব্য নেই। নেই কোনো তাত্ত্বিক অভিযান। কোমল ও সূক্ষ্মানুভূতির গল্পগুলো তাই হৃদয়গ্রাহী। যারা আগে এ লেখকের শুধু কবিতা বা অন্য রচনা পড়েছেন কিন্তু গল্প পড়েননি, এ বইটি পড়লে তারা নতুন এক লেখকের সঙ্গে পরিচিত হবেন। এমন একটি বই উপহার দেওয়ার জন্য লেখককে ধন্যবাদ।
অণুগল্প না-মানুষ
লেখক: চন্দন চৌধুরী
প্রকাশক: বেহুলা বাংলা, ঢাকা
প্রকাশ কাল: বইমেলা ২০১৭
প্রচ্ছদ: আল নোমান
পৃষ্ঠা: ২১২,
মূল্য: ২০০ টাকা।