গল্প তো জীবনের কথা বলে, মানুষের কথাই বলে। বলে সমাজের সঙ্গতি-অসঙ্গতির কথাও। ফলে লেখকের দৃষ্টিগ্রাহ্য ঘটনাবলিই গল্পে চিত্রিত হয়। যে গল্পে জীবনবোধ, আশা-হতাশা, মানবতাবাদ, ভালোবাসা, ব্যর্থতা-সফলতা প্রস্ফুটিত হয়ে উঠে, সে গল্প মানুষের হৃদয় ছুঁয়ে যায়। বর্তমান জটিল বাস্তবতার ভেতর দিয়ে যাপন করা জীবনে অলীক বা কাল্পনিক গল্প হয়তো এখন আর মানুষকে প্রভাবিত করবে না। কেবল বাস্তবসম্মত বোঝাপড়া, দিকনির্দেশনা, অন্ধকারে আলোর বিচ্ছুরণ আমাদের বিকশিত করবে। তাই আমরা ঝুঁকে পড়ি জীবনমুখী গল্পের সম্ভারে।
পাঠকের গল্প শোনার চিরকালীন আকাঙ্ক্ষা পূরণ করানোর মহান দায়িত্ব গল্পকারকে নিতে হয়। সেক্ষেত্রে তার কিছু দায়ও রয়েছে। শিল্পী তার দায় থেকেই গল্প নির্মাণে অবতীর্ণ হন। এ প্রসঙ্গে কবি ও প্রাবন্ধিক মোহাম্মদ নূরুল হক তার ‘সমকালীন সাহিত্যচিন্তা’ প্রবন্ধগ্রন্থে বলেছেন, ‘শিল্পীর মৌল দায় জীবনের স্বরূপ চিত্রায়ণ। সে চিত্রায়ণে যে কথাশিল্পী যত দক্ষ, তার সাহিত্যকর্ম পাঠকমনে তত দাগ কাটতে সক্ষম।’ তেমনই এক সক্ষম গল্পভাণ্ডার নিয়ে হাজির হয়েছেন কথাকার সাবরিনা আনাম। সাতটি দীর্ঘ গল্পে সাজানো বইয়ের নাম ‘নন্দিতা’। এই গ্রন্থের গল্পগুলো হলো—‘ফালগুনে ধূসর সকাল’, ‘জোনাকীর আলো’, ‘ক্ষতিপূরণ’, ‘খুন’, ‘নন্দিতা’, ‘পা’ ও ‘রুলিবালা’।
‘ফালগুনে ধূসর সকাল’ গল্পে সূর্য ও অনিতার অপ্রকাশিত প্রেম সব শেষে গিয়ে জানা যায়। সূর্য প্রগতিশীল রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত। তাই তাদের প্রেমও রাজনীতি প্রভাবিত। অনিতার প্রতি তার প্রেম যখন প্রকাশিত হয়, তখনই সূর্য পেট্রলবোমার আঘাতে নিহত হয়। সেদিন আট ফাল্গুন। শহীদ মিনারে শেষ শ্রদ্ধা জানানো হয় সূর্যকে। ঠিক তখনই সূর্যের প্রতি প্রগাঢ় প্রেম প্রকাশিত হয় অনিতার। সমকালীন আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক অস্থিরতা আলোকে এটি একটি চমৎকার গল্প।
‘জোনাকীর আলো’ গল্পটি একজন শিক্ষকের সঙ্গে ছাত্রীর প্রেম নিয়ে রচিত। যে সম্পর্ক বিয়ে পর্যন্ত গড়ালেও চরিত্রহীন শিক্ষকের কাছে আর থাকা হয় না মেয়েটির। প্রেমের নামে প্রতারণা ও নারীকে ভোগ করার বিষয়টি তুলে ধরা হয়েছে এই গল্পে। লেখক বলেন, ‘চোখ বন্ধ করেই সোমা ভাবতে চেষ্টা করে কোথায় যেন পড়েছিল জোনাকী নামের পুরুষ পতঙ্গসঙ্গমে আকৃষ্ট করতে শরীরে আলো জ্বালে। অনন্ত আকাশ সে পতঙ্গের নাম। যার মিটমিটে আলোয় পথ ভুলে সে এখানে এসেছিল। আর সেদিনই হারিয়ে ছিল নিজের যা কিছু।’
‘ক্ষতিপূরণ’ গল্পে স্ত্রীর ভুল বোঝাবুঝির কারণে সমাজের সামনে খেসারত দিতে হয় স্বামীকে। পারিপার্শ্বিক চাপে পড়ে রাতের অন্ধকারে স্ত্রীকে নিয়ে বাড়িও ছাড়তে হয় তাকে। তাই যাওয়ার সময় নিজের গহনা খুলে ক্ষতিপূরণের টাকা দিয়ে দায়মুক্ত হন স্ত্রী। গল্পের চরিত্র জাকির ও স্বপ্না বর্তমান সমাজেরই প্রতিনিধি।
আমাদের সমাজের আবর্জনা যারা পরিষ্কার করে, আমরা তাদের হরিজন বা মেথর বলে থাকি। সেই হরিজন সম্প্রদায়ের অধিকার, শিক্ষা, বিচার ব্যবস্থা, সামাজিক মর্যাদা, দুঃখ-দুর্দশা নিয়ে আবর্তিত হয়েছে ‘খুন’ শিরোনামের গল্পটি। লেখক বোঝাতে চেয়েছেন, ‘জাতের গন্ধ এত সহজে দূর করতে পারবে না সে মেয়ের শরীর থেকে। এই প্রথম বাবা হিসেবে রাজেশ বাস্তবতার মাটিতে পা রাখে।’ সামাজিক চাপে ময়নাকে নিয়ে বাবা রাজেশের সব স্বপ্ন মাটির সঙ্গে মিশে যায়। গল্পের একপর্যায়ে প্রসব বেদনা নিয়ে হাসপাতালে গর্ভখালাস করতে গিয়ে ধর্ষণের শিকার হয় ময়না। বাধ্য হয়ে ময়না খুন করে ধর্ষককে। তবে আইনি প্রক্রিয়ায় জেল থেকে মুক্তিও পায় ময়না। এ গল্পে জীবনের চরম বাস্তবতা তুলে ধরেছেন লেখক।
‘নন্দিতা’ গল্পের প্রধান চরিত্র নন্দিতার পরিষ্কার জবাব— ‘আমার জীবনে কাউকে প্রয়োজন নেই’। তাই সব প্রয়োজনকে অগ্রাহ্য করে সে একাকী জীবনকে বেছে নেয়। একাকী যন্ত্রণাকাতর জীবনকে উপভোগ করে নিজের মতো করে। নিজের সর্বস্ব মানুষকে দান করে দুরারোগ্য ব্যধিতে জীবন থেকে বিদায় নেয়। তাই নন্দিতার ব্যক্তিচরিত্র পাঠককে অবাক করবে। প্রত্যেক নারীকে আত্মপ্রত্যয়ী হতে আহ্বান জানাবে। পরনির্ভরশীলতা ছাড়াই বেঁচে থাকার মানে উপলব্ধি করবেন সবাই।
পোশাকশিল্প আমাদের প্রধানতম শিল্প। রফতানি খাতের সবচেয়ে বেশি আয় এ শিল্পের মাধ্যমে। তবে এর শ্রমিকরা বরাবরই অবেহেলিত। এমনকী অগণিত মানুষের প্রাণহানির কারণও বটে। তারই ধারাবাহিকতায় ঘটে রানা প্লাজা ট্র্যাজেডি। সেই ঘটনাকে অবলম্বন করেই ‘পা’ শিরোনামে গল্পটি রচনা করেছেন লেখক। সে সময় একটি বহুল আলোচিত ছবি প্রকাশিত হয় বিভিন্ন গণমাধ্যমে। কংক্রিটের ভেতর থেকে একটি পা বের হয়ে আছে। সেই পায়ে নূপুর। আর সেই পায়ের মানুষটির গল্পই শুনিয়েছেন লেখক। লেখক বলেন, ‘একটা পা। একগাদা কংক্রিটের জঙ্গলের ভেতর থেকে একটুখানি বেরিয়ে এসেছে সাদা ধবধবে সে পা। মানিক মিয়ার দোকানের চাঁদির নূপুরে তখন সকালের আলো ঠিকরে পড়ছে। আর নূপুর পরা পাখানি লাথি মারছে এ রক্তচোষা সভ্যসমাজকে।’
সাবরিনা আনামের এ গল্পটি মূলত যাবতীয় অব্যবস্থাপনার প্রতি তীব্র প্রতিবাদ। সভ্যসমাজকে তিরস্কার করেছেন লেখক। প্রভাবশালী মহলের চোখে আঙুল দিয়ে দেখাতে চেয়েছেন, রাবেয়ারা কত সংগ্রামী। তারা গ্রাম ছেড়ে, স্বজন ছেড়ে শুধু একটু উপার্জনের জন্য শহরে পাড়ি জমায়। তবুও তারা অবহেলিত। অথচ মহসীন তার স্ত্রী রাবেয়াকে নূপুর গড়ে দেওয়ার আগে বলেছিল, ‘তাইলে চল গেরামে যাইগা। তুই নূপুর পায় বাড়ির বড় দিঘিতে ডুব দিবি আমি তাকায়ে তাকায়ে দেখপো।’
সাবরিনা আনামের ‘রুলিবালা’ গল্পটি এক নারীর যাপিত জীবনের কড়চা। স্বামীঅন্তঃপ্রাণ এক নারী নিজের প্রিয় রুলিবালা বিসর্জন দেন অন্য এক নারীর কাছে। ভাগ্যের নির্মম পরিহাস হলেও ভাগ্যটি তৈরিও করে পুরুষশাসিত সমাজ। ভক্তিকে সারল্য বা দুর্বলতা ভেবেই নারীকে বঞ্চিত করে পুরুষ। বিভিন্ন অজুহাতে হঠকারিতার আশ্রয় নিতেও কুণ্ঠাবোধ করে না তারা। এখানে স্থান পেয়েছে নারী অধিকারে উচ্চকিত এক বিষাদের গল্প। যেখানে ধর্মের আড়ালে মানুষ অধর্মকে পোষে। তাই লেখক বলেন, ‘বিদ্যুৎ স্পর্শ পাওয়ার মতো আমেনা বেগম দেখতে পান পানির গ্লাস এগিয়ে দেওয়া হাতে সেই রুলিবালা, মক্কা থেকে হাজী সাহেব যেটা তার জন্য নিয়ে এসেছিলেন। হাতের ব্যথায় সেটা তার আর পরা হয়ে ওঠেনি।’ গল্পে হজ করে হাজী সাহেব সামাজিক মর্যাদা অর্জন করলেও পারিবারিক মর্যাদা তার ক্ষীণ হয়ে আসে। আমেনা বেগম সব বঞ্চিত নারীর প্রতিনিধি হয়ে এমন বিধ্বস্ত সময় পার করেন।
সবমিলিয়ে গল্পগুলো বিবৃত সময়ের উপযুক্ত প্রতিবাদ হিসেবেই প্রতীয়মান হয়। প্রতিটি গল্পেই নারী চরিত্রগুলো প্রধান হয়ে উঠেছে। পুরুষ কেবল প্রাসঙ্গিক চরিত্র হিসেবে উপস্থাপিত হয়েছে। তবে তার গল্প বলার ধরনে মুন্সিয়ানা রয়েছে। বাক্যগঠন, শব্দচয়ন, ঘটনার বর্ণনায় সাফল্যের স্বাক্ষর রেখেছেন। দুঃখের বিষয় হচ্ছে—যথাযথ সম্পাদনার অভাবে প্রতিটি গল্পেই অসংখ্য বানান ভুল লক্ষ করা যায়। আশা করি পরবর্তী সংস্করণে বিষয়টি প্রকাশনা সংস্থার নজরে আসবে। তাহলেই সাবরিনা আনামের গল্পগ্রন্থটি আরও পাঠকপ্রিয়তা পাবে বলে আমার বিশ্বাস।
নন্দিতা
লেখক: সাবরিনা আনাম
প্রচ্ছদ: হিমেল হক
মূল্য: ১৫০ টাকা