২৯ জুলাই ছিল তার প্রয়াণ দিবস। ১৩০ বছর আগে ১৮৯১ সালে তিনি লোকান্তরিত হন। ২০২০ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর তার দ্বিশত জনমবার্ষিকী অতিক্রান্ত হয়েছে। বেঁচে থাকলে তার বয়স এই ২০২১ সালে হতো ২০১ বছর।
হাজার বছরের বাংলা ও বাঙালির ঐতিহ্যে টানা দুইটি শতকের ধরে সামাজিক-সাংস্কৃতিক চিন্তায় ও মননচর্চায় তার মতো সগৌরবে বিরাজমান ব্যক্তিত্ব বিরল। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর সেই অত্যল্প কীর্তিমান বাঙালির একজন, যিনি রাজনৈতিকভাবে বিভাজিত বঙ্গসমাজে দ্বিশত জন্মবর্ষেও সমুজ্জ্বল এবং ‘বিবিসি’পরিচালিত সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালির তালিকায় অষ্টম স্থানের অধিকারী।
বিদ্যাসাগরকে কেবল বিদ্যা ও দয়ার আধার বলে স্বীকৃতি দেওয়াকে রবীন্দ্রনাথ যথেষ্ট মনে করেননি। তার মতে বিদ্যাসাগরের ‘প্রধান গৌরব তাঁর অজেয় পৌরুষ ও মনুষ্যত্ব’। আর এখানেই দ্বিশতবর্ষেও বিদ্যাসাগর চর্চার প্রাসঙ্গিকতা বিদ্যমান। কারণ, ২০২০ সালে করোনার প্রকোপে-সৃষ্ট বৈশ্বিক মহামারির কারণে এই মনীষীর দ্বিশত জন্মবর্ষের আনুষ্ঠানিক উদযাপন বিঘ্নিত হলেও তিনি ছিলেন স্মরণের আলোকধারায় স্রোত।
বিদ্যাসাগরের জীবন ও কর্মের নির্যাস উপস্থাপনের মাধ্যমে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগের প্রফেসর ড. মাহফুজ পারভেজ চেষ্টা করেছেন, কেন তিনি অদ্যাবধি আলোচিত ও প্রাসঙ্গিক, তা চিত্রিত করতে। সংক্ষিপ্ত পরিসরে বিদ্যাসাগরের কর্ম ও জীবনালেখ্য এবং প্রাসঙ্গিক-সংশ্লিষ্ট বিশ্লেষণ-পর্যালোচনার মাধ্যমে তিনি ‘দ্বিশত জন্মবর্ষে বিদ্যাসাগর’গ্রন্থে দ্বিশত জন্মবর্ষের পটভূমিতে তাকে শ্রদ্ধায় স্মরণ করেছেন এবং দ্বিশত জন্মবর্ষেও কেন তিনি বৃহত্তর বাঙালি জনগোষ্ঠীর চিন্তা, কর্ম, দৃষ্টি ও মননচর্চাকে এগিয়ে নিতে সহায়ক ও প্রাসঙ্গিক, সে সত্যটিই গবেষণার মাধ্যমে অনুসন্ধান করেছেন।
বিদ্যাসাগরের প্রয়াণ দিবসে ‘দ্বিশত জন্মবর্ষে বিদ্যাসাগর’গ্রন্থের আলোকে ড. মাহফুজ পারভেজ জানিয়েছেন, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের অনন্য, দৃশ্যমান, কর্ম, কৃতিত্ব, বৈশিষ্ট্য ও ব্যক্তিত্ব সত্যিকার অর্থেই বহুমাত্রিক এবং সুদূরপ্রসারী। জন্মের ২০০ বছর পরেও সর্বস্তরে স্মরণীয় হওয়ার গৌরব লক্ষ-কোটি মানুষের মধ্যে মাত্র এক-দুজনের ক্ষেত্রেই সম্ভব। বহুজনের নাম লোকশ্রুতি এবং ইতিহাসের পাতায় লিপিবদ্ধ থাকলেও মানুষ প্রকৃত অর্থে মনে রেখেছে কয়জনকে? খোদ রবীন্দ্রনাথের মতে, ‘একজনই’। তার নাম ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। জন্ম ১৮২০ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর। প্রয়াণ ২৯ জুলাই ১৮৯১ সাল। রবীন্দ্রনাথ খুব বেশি মানুষের জীবন ও কর্ম নিয়ে আলোচনা করেননি। তবে তিনি অত্যন্ত নিষ্ঠা ও আবেগের সঙ্গে বিদ্যাসাগর চরিত ও কর্মসমূহের মূল্যায়নে লিপ্ত হয়েছিলেন জীবনস্মৃতি গ্রন্থের ‘শিক্ষারম্ভ’ও ‘ঘরের পড়া’ অধ্যায় দুটিতে। শৈশব-বাল্যের স্মৃতিতে বিদ্যাসাগরকে বর্ণনা করেছেন শিশু-মন আবিষ্ট করা, শিশু-পাঠ রচয়িতা অনন্যসাধারণ ব্যক্তিত্ব রূপে। পরবর্তী সময়ে ‘বিদ্যাসাগর চরিত’ রচনায় তিনি উল্লেখ করেছেন: ‘বিদ্যাসাগরের জীবনবৃত্তান্ত আলোচনা করিয়া দেখিলে এই কথাটি বারবার মনে উদয় হয়ে যে, তিনি যে বাঙালি বড়লোক ছিলেন তাহা নহে, তিনি যে রীতিমতো হিন্দু ছিলেন তাহাও নহে, তিনি তাহা অপেক্ষাও অনেক বেশি বড় ছিলেন, তিনি যথার্থ মানুষ ছিলেন।’
এ জন্যেই সৎ প্রজ্ঞাবান মানুষ আজো মনে করেন, এ সমাজ একদিন ঘুরে দাঁড়াবে, চর্চা হবে সততা, নৈতিকতা, ভদ্রতা ও পরোপকারের।
ড. মাহফুজ পারভেজ জানান যে, বিদ্যাসাগর প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথের আরও অনেক বিশ্লেষণাত্মক উক্তি ঐতিহাসিক স্বীকৃতি পেয়েছে। বিদ্যাসাগরের জীবন ও কর্মের আলোকিত দিকগুলোর পাশাপাশি তার ব্যক্তিত্বের মূল প্রবণতা শনাক্ত করেছেন তিনি, ‘বিদ্যাসাগর স্বভাবতই সম্পূর্ণ স্বাধীনতন্ত্রের লোক ছিলেন।’ রবীন্দ্রনাথ দ্বিধাহীন চিত্তে বলেছেন, ‘বিদ্যাসাগর এই বঙ্গদেশে একক ছিলেন।’ দুঃখ ভারাক্রান্তভাবে রবীন্দ্রনাথ মন্তব্য করেছেন, তাঁর (বিদ্যাসাগর) সমযোগ্য সহযোগীর অভাবে আমৃত্যুকাল নির্বাসন ভোগ করিয়া গিয়াছেন। তিনি সুখী ছিলেন না।…প্রতিদিন দেখিয়াছেন, আমরা আরম্ভ করি, শেষ করি না; আড়ম্বর করি, কাজ করি না। যাহা অনুষ্ঠান করি তাহা বিশ্বাস করি না ও যাহা বিশ্বাস করি তাহা পালন করি না।…এই দুর্বল, ক্ষুদ্র, হৃদয়হীন, কর্মহীন, দাম্ভিক ও তার্কিক জাতির প্রতি বিদ্যাসাগরের এক সুগভীর ধিক্কার ছিল।’
‘দ্বিশত জন্মবর্ষে বিদ্যাসাগর’গ্রন্থের লেখক ড. মাহফুজ পারভেজ মনে করেন, বিদ্যাসাগরকে কেবল বিদ্যা ও দয়ার আধার বলে স্বীকৃতি দেওয়াকে রবীন্দ্রনাথ যথেষ্ট মনে করেননি। তাঁর (রবীন্দ্রনাথ) মতে বিদ্যাসাগরের ‘প্রধান গৌরব তাঁর অজেয় পৌরুষ ও মনুষ্যত্ব’। রবীন্দ্রনাথ বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে বলেছেন যে, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের বিধবা বিবাহ আন্দোলন, বাল্যবিবাহ বন্ধ, পণপ্রথা রোধের সংগ্রাম ছড়িয়ে পড়েছিল সাহিত্যে, সামাজিক ও শিক্ষা আন্দোলনে। পাশাপাশি এটি গুরুত্ব পেয়েছিল রামমোহন-পরবর্তী সমাজ অগ্রগতির জন্য সূচিত নারী আন্দোলনেও। রবীন্দ্রনাথ প্রত্যয় ও দৃঢ়তার সঙ্গে ‘বিশিষ্টতম বাঙালি মনীষা’ রূপে বিদ্যাসাগরের যে মূল্যায়ন, বিশ্লেষণ ও বর্ণনা দিয়েছেন, তা কালোত্তীর্ণ, দ্বিশত জন্মবর্ষেও দেদীপ্যমান এবং অখণ্ড বাঙালির চিন্তা, কর্ম, দৃষ্টি ও মননচর্চাকে এগিয়ে নিতে সহায়ক ও প্রাসঙ্গিক।
ড. মাহফুজ পারভেজের বিশ্লেষণে, নিজের অশনবসনেও বিদ্যাসাগরের একটি দৃঢ়তাযুক্ত অটল সরলতা ছিল। সেই সরলতার মধ্যেও ইস্পাতকঠিন মনোবলের অস্তিত্ব ছিল। নিজের তিলমাত্র সম্মান রক্ষার প্রতিও তার লেশমাত্র শৈথিল্য ছিল না। ঔপনিবেশিক কুসংস্কৃতিতে প্রবল সাহেবিয়ানা ও নবাবি দেখিয়ে সম্মান লাভের যে ঠুনকো প্রবণতা ইংরেজ কোম্পানি শাসিত পরাধীন কলকাতার নব্য-বনেদি অভিজাতদের মধ্যে প্রচলিত ছিল, বিদ্যাসাগর আচারে, আচরণে ও পরিচ্ছদে তা ঘৃণা ভরে প্রত্যাখ্যান করেন। বিদ্যাসাগরের ছবির পাশে তৎকালীন কৃতিদের ছবি রেখে তুলনামূলক পর্যালোচনা করা হলেই বিষয়টি স্পষ্টতর হয়। রবীন্দ্রনাথ যে বিষয়টিকে আরও সুন্দরভাবে উপস্থাপন করেছেন যে, ‘ভূষণহীন সারল্যই তাঁহার রাজভূষণ ছিল’।
দৃষ্টান্ত স্বরূপ ড. মাহফুজ পারভেজ উল্লেখ করেন, বিদ্যাসাগর যখন কলিকাতায় (তখন কলিকাতা বলা হতো, কলকাতা নয়) অধ্যয়ন করছিলেন, তখন তার মা চরকায় সুতা কেটে পুত্রের বস্ত্র প্রস্তুত করে পাঠাতেন, যে মোটা কাপড় তিনি মাতৃস্নেহমণ্ডিত গৌরবে চিরকাল সর্বাঙ্গে ধারণ করেছেন। বিদ্যাসাগরকে তৎকালীন লেফটেনেন্ট গভর্নর হ্যালিডে সাহেব রাজসাক্ষাতে উপযুক্ত পোষাক পরিধান করে আসার জন্য বলেছিলেন। শুধু সেই একবার তিনি চোগা-চাপকান পরিধান করে সাহেবের সঙ্গে দেখা করলেও রাজ-কর্তৃপক্ষকে বলেছিলেন, ‘আমাকে যদি এই বেশে আসিতে হয়, তবে এখানে আর আমি আসিতে পারিব না।’ ফলে লেফটেনেন্ট গভর্নর বা ছোটলাট বিদ্যাসাগরকে তাঁর অভ্যস্ত বেশে আসার জন্য বিশেষ অনুমতি দিতে বাধ্য হন। মোটা কাপড়, চটিজুতা, চাদর পরিধান করে তিনি রাজগৃহ থেকে দরিদ্র্যের বাড়িতে অবাধে ও সম্মানের সঙ্গে যাতায়াত করতেন। ঔপনিবেশিক আমলের তথাকথিক অনেক বিখ্যাতই যে সাহস, আত্মমর্যাদা ও আত্মপরিচিতি দেখাতে পারেননি। বিদ্যাসাগরের সঙ্গে অন্যদের পার্থক্য ছিল এই যে, তিনি নিজের মর্যাদা, সম্মান ও পরিচিতি রক্ষা করেই ইংরেজদের সঙ্গে মিশেছিলেন। তিনি মিশেছিলেন দিতে, নিতে নয়। ভাষা ও শিক্ষা বিষয়ক কর্মতৎপরতায় ইংরেজ শাসকগণ তার সাহায্য ও সহযোগিতার মুখাপেক্ষী ছিল। তিনি আত্মসম্মানের সঙ্গে নিজের দায়িত্ব পালন করেছেন। কিন্তু অন্যরা লেজুড় ও অনুকরণের মাধ্যমে আত্মসম্মান বিসর্জন দিয়ে মিশেছিলেন এবং নতজানু হয়ে ইংরেজ শাসকের কাছ থেকে দয়া ভিক্ষা এবং বস্তুগত ও আর্থিক সুবিধা লাভের বাঞ্ছা করেছিলেন। বিদ্যাসাগরের সঙ্গে আর সবার ‘পার্থক্য ছিল মেরুদণ্ডের’। তার সবল ও সুদৃঢ় মেরুদণ্ড ছিল। আত্মসম্মান ছিল। অন্যদের এসব ছিল না।
গবেষক ড. মাহফুজ পারভেজ মনে করেন, দুঃখজনক বিষয় হলো এই যে, বিদ্যাসাগর তৎকালীন ধর্মীয় সাম্প্রদায়িক শক্তির আঘাত ও সমালোচনার কবল থেকে রক্ষা পাননি; এখনো তিনি জন্মের দুইশত বছর পরেও ধর্মীয় মৌলবাদীদের হামলা থেকে রক্ষা পাচ্ছেন না। খোদ কলকাতার বুকে বিদ্যাসাগর কলেজ প্রাঙ্গণে প্রতিষ্ঠিত বিদ্যাসাগরের মূর্তি ভেঙে ফেলার ঘটনায় এই নির্মম সত্যটিই উন্মোচিত হয়। তবে, দ্বিশত বর্ষেও আঘাত-প্রাপ্ত-বিদ্যাসাগর বৃহত্তর বাংলার ধর্মান্ধতা, সাম্প্রদায়িকতা, মৌলবাদ, কূপমণ্ডুকতা ও কুসংস্কারের বিরুদ্ধে সংগ্রামের প্রয়োজনেই প্রাসঙ্গিক ব্যক্তিত্ব ও অপরিহার্য্য চরিত্র।
প্রফেসর ড.মাহফুজ পারভেজ রচিত ‘দ্বিশত জন্মবর্ষে বিদ্যাসাগর’গ্রন্থের প্রকাশক ঐতিহ্যবাহী সংস্থা স্টুডেন্ট ওয়েজ, যা বর্তমান পরিস্থিতিতে একটি উল্লেখযোগ্য প্রকাশনা। কারণ, মনন, মনুষত্ব, বিবেক ও বিচারবোধ সম্পন্ন মানবিক মানুষ আজকের সমাজে বিরল। অনৈতিক উপার্জন, প্রতারণা, ভুল বিচার যেখানে সহনীয়, সেখানে মানুষ পেশিশক্তি-ক্ষমতা প্রয়োগে অবৈধভাবে নিজের স্বার্থ ও উৎকর্ষকে সমৃদ্ধি অর্জনের চকচকে সিঁড়ি হিসেবে বেছে নেবে, এটাই স্বাভাবিক। আর এভাবেই এগুচ্ছে আজকের সমাজ। তবে আশার কথা হলো, আজও বদলায়নি ভালোত্ব আর মন্দত্ব শব্দের আক্ষরিক অর্থ। মানুষ তার আচরণের মন্দ সত্তা আর লোক দেখানো ভালোত্ব এই দুই সত্তা বহন করার ক্লান্তি নিয়ে বেঁচে থাকলেও ভালোত্বেই জয় হয়।
যদিও মানুষের মাঝে প্রাণপ্রবাহ আছে, সৌন্দর্য আছে, তেমনিভাবে কদর্যও আছে। লোভ-লালসা, ঔদার্য-পরোপকার, আত্মসংযম, দান, প্রতিদান সবই আছে। বিচার আছে সংশোধন ও আছে। ভালো-মন্দের মাখামাখিও আছে। মানুষের মনোজগতের চলমান আদালত আমরা দেখি না, যেখানে বিবেককে নিয়ত চপেটাঘাত করছে লোভের অর্জন আর অর্জিত পরধন। অন্যায়-জুলুম অর্জিত সম্পদ চিরদিন অধিকারে থাকে না। শেষ পরিণতি তার চিতার অগ্নিরথে যাত্রা যা প্রকৃতিই নির্ধারণ করে দেয়। পেছনে পড়ে থাকে কদর্য ইতিহাস। এ জন্যেই সৎ প্রজ্ঞাবান মানুষ আজো মনে করেন, এ সমাজ একদিন ঘুরে দাঁড়াবে, চর্চা হবে সততা, নৈতিকতা, ভদ্রতা ও পরোপকারের।
ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর তার মনুষত্ববোধ দিয়ে বিচার করেছিলেন শতবর্ষ আগের সমাজকে। তার নিজের মনন থেকে বিদ্রোহ করেছিলেন কুসংস্কার আচ্ছন্ন প্রথাগত সমাজের বিরুদ্ধে। তিনি ইংরেজ সভ্যতার বিদেশি আচারের কাছে বিসর্জন দেননি তার নিজের সংস্কৃতি ও ব্যক্তিগত লেবাস। প্রশ্ন হলো, ড. মাহফুজ পারভেজ ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের জন্মের দুশ বছর পর তাকে নিয়ে পুস্তক রচনা করে তাকে আলোচনায় আনলেন কেন? যেখানে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর তার জন্মের দু’শ বছর পর তার নিজ ধর্মীয় মানুষের দ্বারা আক্রান্ত হয়েছেন। উত্তর, একটাই ভালোত্ব ও মন্দত্ব।
মানুষ জাগবে সত্য, ন্যায়, শালীনতা, ভদ্রতা ও নৈতিকতার মানদণ্ডে, যা আমাদের শিখিয়েছেন বিদ্যাসাগর ও অপরাপর নমস্য পূর্বসূরিরা।
আমাদের সাহিত্য, ইতিহাস চর্চায় নিয়োজিত সুশীল মানুষেরাও আজ দ্বিধাবিভক্ত। কেউ বংশ পরম্পরাগত পারিবারিক আদর্শ সততা, নৈতিকতা ও পরোপকারের ইতিবাচক ধারায় সমাজকে সংশ্লিষ্ট করার জন্য লিখে নিজেকে আলোকিত করছেন। কেউবা গা ভাসিয়েছেন সমাজের চলমান নোংরা ধারায়। তাদের কেউ কেউ বিখ্যাত হচ্ছেন অতি সহজেই। কেননা তাদের লেখার উপজীব্য রম্যরস ও ভাষা আজকের সমাজের অধিকাংশ মানুষের নিম্ন রুচিবোধ উপযোগী।
ড. মাহফুজ পারভেজ প্রচলিত প্রথা ও গতানুগতিক ধারার ব্যাতিক্রম। তিনি এ যুগের ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। কেননা তিনি লড়ছেন প্রচলিত নেতিবাচক ধারার বিরুদ্ধে। তিনি শ্লীলতাকে আহবান করেন তার লেখায় আর এসব লেখা পড়ে কলুষমুক্ত হচ্ছে মানুষ, উপকৃত হচ্ছে সমাজ। এটাই তার সামাজিক আন্দোলন, এটাই সমাজ সংস্করণ, এটাই বুদ্ধিবৃত্তিক প্রচেষ্টা, যার সূচনা করেছিলেন স্বয়ং বিদ্যাসাগর।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পরিবারের নৈতিক শিক্ষা, সামাজিক ন্যায়বিচার ও প্রাতিষ্ঠানিক সুশিক্ষা মানুষকে তার মনুষত্ববোধ সম্পর্কে সচেতন করে। মনুষত্ববোধ সম্পর্কে সচেতন এমন সজ্জন মানুষ তার প্রতিবেশী ও সমাজের জন্য নিরাপদ। উপরন্তু এসব মানুষেরাই সামাজিক বৈষম্য দূরীকরণ ও সমাজকে নিরাপদ করে মানুষের মঙ্গলের জন্য তাদের নিজের অর্থবিত্ত ও জীবনকে উৎসর্গ করেন। এরপরও তারা মানুষ ও সমাজের নিগ্রহের শিকার হন। যেমন হয়েছেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। মৃত্যুর দু’শ বছর পর তার মূর্তি ভেঙে ফেলার মতো পৈশাচিক মানসিকতা এর নিকৃষ্টতম নমুনা। এমন আঘাত প্রাচীন পণ্ডিত সক্রেটিসকে করা হয়েছিল।
কিশোর ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর তার মা ভগবতী দেবীকে দেখার জন্য দামোদর নদী সাঁতরে পার হয়েছিলেন। আর আজকের সমাজের কিশোর মাদক ক্রয়ের টাকার জন্য মাকে হত্যা করছে। এরই ধারাবাহিতায় পারিবারের নৈতিক শিক্ষাহীন ও আদর্শহীন উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত ধনাঢ্য মানুষ তাদের মা বাবাকে রেখে আসছেন বৃদ্ধাশ্রমে।
মা-বাবা তাদের নিজ সন্তানের ভালো-মন্দ ভবিষ্যৎ গড়ার ক্ষেত্রে সর্বোত্তম কারিগর। শৈশবে দুরন্তপনার জন্য ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরকে তার পিতা ঠাকুর দাস বন্দ্যোপাধ্যায় একবারও কটু কথা বলেননি, কিন্তু ইংরেজি স্কুলে ভর্তি করতে যাওয়ার পথে অঙ্ক শেখাতে ভুল করেননি। আজকের সমাজে পিতা তার পুত্রকে অবলীলায় শিখিয়ে দিচ্ছেন হরণকৃত পরধনের হিসাবের অঙ্ক আর বুদ্ধিমত্তা, কিভাবে তা দীর্ঘদিন সুকৌশলে নিজ স্বার্থ হাসিলের আর দেশ ও জনগণের ক্ষতির কাজে নিজের অধিকারে রাখা যায়।
ড. মাহফুজ পারভেজের সমাজ গবেষণা, সাহিত্য, ইতিহাসকর্ম ও বিদ্যাসাগর বিষয়ক গ্রন্থ হলো প্রতীকী প্রতিবাদ। এ প্রতিবাদে শামিল হবে মানুষ, শামিল হবে সমাজ। অসঙ্গতির বিরুদ্ধে আবার ঘুরে দাঁড়াবে মানুষ, সমাজ, সংস্কৃতি, সভ্যতা। মানুষ জাগবে সত্য, ন্যায়, শালীনতা, ভদ্রতা ও নৈতিকতার মানদণ্ডে, যা আমাদের শিখিয়েছেন বিদ্যাসাগর ও অপরাপর নমস্য পূর্বসূরিরা।