এবারের বইমেলায় প্রকাশিত মিলু শামসের কাব্যগ্রন্থ ‘দীর্ঘায়িত দুঃখগুলো’ ইতোমধ্যেই পাঠকের কাছে পৌঁছে গেছে। বইটি পড়ে মনে হয়েছে কবি যাপিত জীবন, এর থেকে উত্তরণ এবং স্বপ্নের কাছে পৌঁছাতে চেয়েছেন বারবার। এর সঙ্গে প্রেম, প্রতিবাদ, সংগ্রাম হয়ে উঠেছে কবিতার উপজীব্য বিষয়।
আলোচ্য গ্রন্থের একটি বিশেষ কবিতা ‘কাজের টেবিলে দশটি আঙুল’। নগরযাপন বিপন্ন হতে হতে আজকাল হয়ে উঠেছে ‘নরকযাপন’। অফিস-কাজ-যান্ত্রিকক্ষণ-বাড়িফেরা-আবার অফিস—এটিই হয়ে উঠেছে প্রযুক্তিময় পৃথিবীর নির্মম বাস্তবতা। ফলে ব্যস্ততায়-কোলাহলে প্রিয় কাজগুলি করা আর হয়ে ওঠে না। অথচ এই করতে না-পারার গ্লানি যুক্ত হয় প্রতিদিন। কিন্তু গ্লানি বাস্তবতা থেকে মুক্তি দেয় না। তাই মিলু শামস লিখেছেন, ‘সেই এক গ্লানির হুলে বেঁধা/সুইসাইডনোট/লেখা হয় প্রতিদিন/জনহীন কাজের ঘরে/তারপর আবার—/আরও একটি দিন/কর্মঘণ্টায় বাঁধা দশটি আঙুল/আরও আরও দিন…।’
মিলু শামসের মনে আজন্ম এক বাউল বাস করে। সে বাউল ছুটে যেতে চায় নৈঃশব্দ্যের গহীনে। কবিতায় তার বাউল চরিত্রটি প্রকাশ্যে থাকে না সত্য, কিন্তু অন্তর্নিহিত যে পথচলা, তা থেকে বাউলকে সহজেই খুঁজে নেওয়া সম্ভব। এ বাউলটিই ‘নির্জন সুগন্ধি’ কবিতায় বলে, ‘আজ আমি জ্যোৎস্নায়/স্নান করবো সারারাত—/চাঁদের সিঁড়ি বেয়ে পৌঁছবো/একটি উন্মীলিত/দরজার ওপাশে;/কেউ একজন জ্বেলেছে ধূপ/তার নিজস্ব নির্জন কক্ষে,/…আর একরাশ কিংশুক/বুকে নিয়ে বলবো/দোর খোলো হে নির্জনবাসী,/দেখো আজ দেবালয় এ পৃথিবী।’
‘দীর্ঘায়িত দুঃখ’-এর কবিতাগুলো পড়ার সঙ্গে সঙ্গে দৃশ্যটা খুব সহজে চোখে পড়ে। এ কাব্যগ্রন্থের অন্যতম অনুষঙ্গ প্রকৃতি। ‘নদী’, ‘রাঙা ফুল’, ‘সন্ধ্যা’, ‘কচি ধান’, ‘দুপুর’, ‘মেঘ’সহ প্রকৃতি অসংখ্য অনুষঙ্গ কবিতাগুলোকে প্রাণ দিয়েছে। একই সঙ্গে কবিতাগুলোকে করেছে দৃশ্যময়। তাই গল্পের মতন মনে হয় কবিতার চরিত্রটি যেন পাঠক নিজেই। এই বোধ কবিতাকে পাঠক-ঘনিষ্ট যে করে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। কাব্যের প্রথম কবিতা ‘হলুদ জোনাকি’র কথাই উল্লেখ করা যাক। কবি লিখেছেন, ‘যখন কবিতা আসে/নির্জন ভোর কিংবা নিঃসীম/শূন্যতার দুপুরে—/ইচ্ছে হয় তোমায় নিয়ে হেঁটে যাই/কৈশোরের শিমুলতলা দিয়ে,/ঝাঁ-ঝাঁ রোদে/হাতে রেখে হাত/পেরিয়ে যাই আমাদের/ক্ষীণস্রোতা নদী’। কবিতাটি পাঠের সাথে সাথে পাঠকের চোখের সামনে ‘নির্জন ভোর’, ‘শিমুলতলা’ কিংবা ক্ষীণস্রোতা নদীটি ভেসে উঠবে এবং মনে হবে পাঠকটিই যেন কবিতাপ্রহরে হেঁটে যাচ্ছে কারো হাত ধরে।
নগর থেকে পরিত্রাণ চাইলেও নগর এড়ানো অসম্ভব প্রায়। মিলু শামসের কবিতায় নাগরিক জীবনও এসেছে ভালোভাবে। যদিও এ যাপনে তার অনাস্থা দৃশ্যমান, কিন্তু টানও রয়েছে। ‘তুমি আছো বলে’ কবিতায় কবির নাগরিক যাপন—‘সব কিছু চলছে ঠিকঠাক, যেমন চলে—/নিয়ম করে লেখার টেবিলে বসা/কফি মগে চুমুক দিয়ে/দূরের আকাশ দেখা/অফিস যাওয়ার পথে/দীর্ঘ যানজটে বসে/উত্তর-উপনিবেশ দেশের/মিসম্যানেজম্যান্টকে/মনে মনে গালি দেয়া/…এসবের মধ্যে হঠাৎ তুমি এসে দাঁড়াও/সদ্য-নির্মিত অট্টালিকার মতো/যার কক্ষ ও লবির সিলিং থেকে/ঝুলে পড়ে বিমূর্ত অয়েল পেইন্টিং।’ নাগরিক ভাবনার সঙ্গে প্রেম কবিতাকে গতি দিয়েছে। অবশ্য এ কাব্যে একাধিক প্রেমের কবিতা রয়েছে।
কবিতা অসঙ্গতির বিরুদ্ধে তীব্র-আঙুল তুলছে সূচনালগ্ন থেকে। সমাজ ও যাপনের বিচ্যুতি কবিকে স্পর্শ করে যায়। কবি তখন বিচ্যুতির বিরুদ্ধ কথা বলেন কবিতা-ভাষায়। ‘নিজস্ব মুখ’, ‘হ্যাঙ্গারে ঝুলছে’, ‘মঞ্চের কুশীলব’ এ ধরনের কবিতা। অন্যদিকে এ গ্রন্থে মুক্তিযুদ্ধ ও ভাষা আন্দোলন প্রেক্ষাপটে একাধিক কবিতা রয়েছে। ‘আলো নিভে আসে’ কবিতায় কবি ভাষা সৈনিকদের পরিচয় করিয়েছেন এভাবে—‘যারা এসেছিল/ফসলের উত্তাপ বুকে নিয়ে/আলো জ্বালা শেষে/ফিরে গেছে তারা’। কিন্তু সে আলো পূর্ণভাবে জ্বালিয়ে রাখতে পারিনি আমরা। কারণও আমাদের অজানা নয়। কবি সে কথাও স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন—‘বর্ণমালার নিচে/আবেগী আগাছার ঝাড়/ওখানে পড়েনি আলো/সেই তারপর থেকে বহুকাল।’
মিলু শামস যেন এ গ্রন্থে নানাভাবে নিজস্ব যাপন, অনুভব, ভালো ও মন্দের জগৎ, স্বপ্নগুলি উপস্থাপন করেছেন। কিন্তু তার এ ব্যক্তিগত বোধ শেষপর্যন্ত নিজস্ব থাকেনি, অনেকের মধ্যে সঞ্চারিত হয়েছে। ব্যক্তি থেকে সর্বজনে পৌঁছাতে পারা কবিরই সফলতা।
দীর্ঘায়িত দুঃখগুলো
মিলু শামস
প্রকাশক: উৎস প্রকাশন।
প্রচ্ছদ: মোস্তাফিজ কারিগর।
মূল্য: ১৫০ টাকা।
অমর একুশে গ্রন্থমেলার ৩২নং প্যাভিলিয়ন।