ভালোবাসা কী? আমেরিকার একটি স্কুলের ছাত্রদের কাছে এই প্রশ্নটি করা হয়েছিল কয়েক বছর আগে। উত্তর হিসেবে পাওয়া গিয়েছিল চমকপ্রদ কিছু বক্তব্য। সেগুলোর মধ্যকার একটি উত্তর ছিল এ রকম- ‘আমার গ্রান্ড মাদার অনেক ঝাল দিয়ে রান্না করে গ্রান্ডফাদারকে খেতে দেন। গ্রান্ড ফাদার সেই রান্না খেয়ে তৃপ্তির সঙ্গে বলেন, খুব সুন্দর, মজাদার, সুস্বাদু। ভালোবাসা হচ্ছে সেই মুহূর্তটি।’ অনুভবের গন্ধ বোধ হয় একমই হয়। হয় বিলুপ্তপ্রায় প্রাচীন পুথির মতো শিল্পিত-বিহ্বল। স্থান-কাল অতিক্রম করে তারা হয়ে ওঠে যুগপৎ আনন্দ ও ঐতিহাসিক। তারপরও তত্ত্বকথা না এসে পারে না। কারণ অনুভব ও ব্যবহারিক অভিজ্ঞতার সঙ্গে প্রায়ই দেখা হয় তাদের। তুলনা করা হয় তাদের সমপাতনতা। সেটা করতে গেলে প্রেমের গভীরতলের যৌনতা না এসে পারে না। এক্ষেত্রে প্রেমের উৎস, ব্যপ্তি, বিকাশ ও পরিণতি সংক্রান্ত কয়েকটি প্রশ্ন আসে। ক্রম তালিকাটি এ রকম হতে পারে:
শারীরিকতা থেকে হৃদয়তার উন্মেষ!
হৃদয়তা থেকে শারীরিকতার মোহ!
শারীরিকতা ও হৃদয়তার সমুত্তীর্ণতা!
প্রথম ক্ষেত্রে ফ্রয়েড, দ্বিতীয় ক্ষেত্রে প্লেটো উত্তীর্ণ হলেও মূলত শারীরিকতা ও হৃদয়তার সমুত্তীর্ণতাই প্রকৃত প্রেমের বিকাশ ও পরিণতি।
কবি আসাদ মান্নান-এর তোমার কীর্তন কাব্যগ্রন্থটিতে যুবকের প্রেমের অনুভব, ব্যপ্তি, বিকাশ ও পরিণতি কী ও কেমন তা বিশ্লেষণ করতে গিয়ে কয়েকটি স্বর চিহ্নিত করা যায়:
প্রেমের অস্ফূট বোধ ও পিপাসা
কল্পনা-অকল্পনার ঘোর
যৌনতা
তোমার কীর্তন-এর কথক যুবকটি-ই কথা বলে যায় প্রেমের মাঠে বসে, বিজন আয়নায় তার স্বপ্নীল উচ্ছ্বাস। কত প্রশ্ন তার মনে ভিড় করে! সারিবদ্ধ হয়ে আসে তারা। প্রেক্ষাপটগুলোকে সম্মিলিত করে। তার মনে বাস করে চিরন্তন যৌবন কামনার লীলা। কিন্তু একজন প্রমিকের যথাযথ মর্ম কি এখানেই গাঁথা? মাঝে মাঝে সে প্রকাশিত হতে থাকে সরল আর সাদামাটায়। কখনো কখনো সম্ভোগ্য। কিন্তু জীবন তো কোনো এক পবিত্র মাতালের স্বীকারোক্তি নয়। মাতাল যুবকটি প্রথমে পুরুষ হতে চায়নি। প্রেমিক হতে চেয়েছে। হয়েছেও। না হলে ক্রমাগত ছাপ্পান্নটি সনেটকে সে কিভাবে গ্রন্থভুক্ত করল! দিতে চাইলো মাহাকাব্যিক ব্যঞ্জনা! অথবা সে একটি কবিতাই বলতে চেয়েছে, নিতে যেতে চেয়েছে শত শত সিঁড়ি বেয়ে সুরম্য প্রাসাদে। যুবকের নির্দেশিত পথে যেতে যেতে পথিক বুঝতে পারে, ছাপ্পান্নটি সিঁড়ি বেয়ে সুরম্য প্রাসাদে নিয়ে যেতে চাইলেও এক একটি সিঁড়িই দিতে পারে ব্যাপক ব্যাঞ্জনা। ওই ব্যঞ্জনা যুবককে করে তোলে পিপাসা-কাতর:
তোমাকে দেখার পর অবিরাম তোমাকে দেখার
এ কেমন ইচ্ছে পাখি আয়ু জুড়ে সকাল উড়ায়;
তোমার চোখের মতো এতো তীব্র আলোময় ভোর
কী করে নিমগ্ন চিত্তে ধরে রাখে উড়ন্ত প্রেমিক!
প্রেমের এই অস্ফুট বোধ প্রেমিককে ‘উড়ন্ত প্রেমিক’ করে রাখে। চলতে থাকে কল্পনা-অকল্পনার ঘোর। প্রেমিক হয়ে ওঠে পিপাসাকাতর। তার ভেতরে শূন্যতার নহর বয়ে যায়। ঘোর ও ভ্রান্তির মধ্যে সে হাবুডুবু খায়। বাড়িতে ফিরে দেখে বাড়ি নেই তার রাতের ডেরায়। উঠোনজুড়ে মৃত নদী। প্রবাহহীন। শূন্যতা থেকে ভ্রান্তি, ভ্রান্তি থেকে কল্পনা, কল্পনা থেকে আবার ঘোর, ঘোর থেকে বাস্তব, বাস্তব থেকে পুরুষে ফিরে আসা। এভাবে উড়ন্ত প্রেমিক একসময় পুরুষ হয়ে ওঠে। হয়ে ওঠে যৌনকাতর।
কতটা নিবিড় হলে কামবতী রমণীয় ছোঁয়া
বুকের ভেতর দিয়ে হয়ে যায় মুগ্ধ করোতোয়া
এ রকম যৌনতার ছোঁয়া আর প্রশ্নবোধকতা নিয়ে যুবকের মনস্তত্ত্ব আবর্তিত হলেও তার প্রেমিকা কামতপ্ত নয়। নয় শরীরিণী। কবিতায় সে মুখ্য চরিত্র হয়েও নিজেকে উপস্থাপিত করে না। সে খানিকটা গৌণই। প্রেমিক পুরুষের প্রেম-ভাবনার একক ও বহুবিম্বিত মানচিত্র সে। তার কোনো মুখ্য ভূমিকা নেই। নায়কের চোখেই তাকে আমাদের দেখতে হয়। কারণ যুবকের অভিব্যক্তিতেই সে জন্ম লাভ করে। বিকশিত হয়। বিচ্ছুরিত হয়। এসব কোলাজকে একত্রিত করেই পাঠক নির্মাণ করেন নায়িকার ভূগোল। তবে তা অবশ্যই নায়কের ব্যক্তিক অনুভবের শিকার। কখনো সমাজ বা রাষ্ট্রের ক্রীড়নক। নায়কের প্রতি তার তেমন কোনো প্রত্যক্ষ অনুভব-অভিব্যক্তির প্রকাশ পাওয়া যায় না। নায়কের সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবেও সে শরীরলগ্না নয়। কিন্তু পাঠকের একসময় পড়তে হয়, ‘তোমার শরীরে হাত রেখে সে পুরুষ নিদ্রায় যায়’। এভাবে পূর্ববর্তী প্রেমের কিংবা পরকীয়ার খোলস এখানে উন্মোচিত হয়ে যায়। আবার ‘বহুগামী মেঘে ভাসে বসন্তের কোকিল রমণী।’ কে এই কোকিল রমণী? এটা কি শুধু পরিচিত পরিবেশের সঙ্গে প্রেমিকের ব্যক্তিক অনুভবের রসায়ন? না কি চেনা-জানা জগতের মধ্যে ভিন্ন চিত্রের ফল? এভাবে পাঠক যখন প্রেম না কি ‘পরকীয়া প্রেম’ এই দ্বিধার দোলাচলে দোলায়িত তখন প্রেমিকা নিজেই, এই প্রথম, নিজেকে উপস্থাপন করে,
চুমু তো দোষের নয়; তবু ভয় ওত পেতে রয়
না জানি কখন তুমি ওষ্ঠ ছেড়ে ছোঁবে হিমালয়
প্রেমিকার জবানিতে তার প্রেম, দেহ ও প্রেমিক সম্পর্কে অভিব্যক্তি ও ধারণার কথা জানা গেল এই প্রথম। এই প্রথম নারী তার গৌণ অবস্থানের জায়গা থেকে উঠে এলো প্রত্যক্ষ ভাব প্রকাশের জগতে।
শেষ তিনটি সনেটে দেখা যায় যুবকের প্রেমদাহের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে স্বদেশ ও সমকালের দাহ। এই দাহ তাকে ভস্মীভূত করে না ঠিকই কিন্তু ব্যাপকভাবে ঝলসে দেয় তার প্রেম-মনোভূমিকে। ব্যক্তিগত বোধ-বিশ্বাস-অনুভব-আকাঙ্ক্ষা-অভিব্যক্তি-কাম-কামনা-অভিঘাত পেরিয়ে যুবকটি স্বদেশি চেতনায়, স্বদেশি বাস্তবাতায় উন্মুখ হয়ে যায়। যুবকের সব ব্যক্তিগত সংকট যেন বোমার স্প্লিন্টারের মতো ছড়িয়ে পড়ে। অধিবাস্তব ও পরাবাস্তর ভাবনার জগতে বাস করেও যুবক মুখোমুখী হয় নগ্ন বাস্তবতার। যে বাস্তবতা তাকে তার লৌকিক-অলৌকিক জগতের ঘূর্ণায়মান ভাবনার অন্দর মহল থকে একটানে তুলে আনে:
সকল সুন্দর ছেড়ে উড়ে যাচ্ছে তোমার সুন্দর;
তোমাকে উদ্ধার করে কে পরাবে আলোর পোশাক?
প্রশ্নের মধ্যে উত্তর চিহ্ন নেই। নেই ইঙ্গিত। যুবক দাবি করে সে-ই পুনর্জন্ম দেবে। শরীর থেকে মুছে দেবে ধর্ষণের চিহ্ন। ‘আকাশ থেকে দূর হবে শকুন সন্ত্রাস/ একমাত্র কবি ছাড়া অন্য কেউ তোমাকে পাবে না’- সুস্পষ্ট উচ্চারণ। উপসংহারিক চরণের মাধ্যমে যুবক জানালো একমাত্র কবিই তাকে পায়। তাহলে যুবকটি কে? এতক্ষণ যার কথা বলো হলো, সে? আসলে কোনো কথাই শেষ নয়। না প্রেমিক, না যুবক, না কবি। আসলে প্রেমিক, যুবক কিংবা কবি কিংবা কথক যেই হোক না কেন এই দীর্ঘ ধারাবাহিকতায় নিযুক্ত থেকে থেকে পাঠকও নির্মাণ করে আরেক পরিপূরক ভাবনার দরোজা। এই দরোজা দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করলে দেখা যায়, এক ছায়া-ছায়া দেবীর ছায়া-ছায়া রূপ। এক ছায়া-ছায়া দেব অন্য এক ছায়া-ছায়া দেবীকে পাওয়ার আকুলতায় পেছনে পেছনে ছুটছে। প্রথম মূর্তি যতই দ্বিতীয় মূর্তির দিকে ছুটছে দ্বিতীয় মূর্তি ততই দূরে দূরে সরে সরে যাচ্ছে।
ছায়াগুলো এভাবে কোনো এক অজ্ঞাত সময়ে থেমে যায়। এগিয়ে যায় তারা। মিলিত হয় তারা । বিচ্ছিন্ন হয় তারা। পুরো প্রাসাদে বিরাজ করে এক ছায়া-ছায়া খেলা।
হয়তোবা এটা এক ধরনের বহুগামিতা। কিন্তু এও তো প্রেমের আরেক রূপ। বহু নারীর প্রেমে যৌনতা পূরণ হয়, জীবন পূরণ হয় না। আবার একজন আকাঙ্ক্ষিত নারীর এক আরাধ্য চুমুতেই জীবন পার হয়ে যায়, ধন্য হয়ে যায়। প্রেমও পায় পূর্ণতা।
যা হোক পুরো ‘তোমার কীর্তন’-এ আমরা এক প্রেমিকের পিপাসা পান করি। আমরা এক যুবকের ক্ষণিকতাকে ঘিরে থাকি। আমরা এক কবির চীরকালিনতার বীজে অঙ্কুরোদগমের ছন্দ শুনি। ধারাবাহিকতা দেখি। আবহমানতাও। কিন্তু কে এই প্রেমিক? কে এই যুবক? সে আসলে প্রেমিক ও পুরুষের সমন্বিত রূপকে সংশ্লেষিত এক কবি। সে-কবি হয়তোবা কবি আসাদ মান্নান নিজেই।
তোমার কীর্তন
আসাদ মান্নান
প্রকাশক: মিজার পাবলিশার্স
প্রথম প্রকাশ: বইমেলা, ২০০৬
প্রচ্ছদ: খালিদ আহসান
মূল্য: ৬০ টাকা