ড. আব্দুল আউয়াল খান রচিত পড়ন্ত বয়সে সুখের সন্ধানে গ্রন্থটি ফেব্রুয়ারি ২০১৯ সালে আবীর পাবলিকেশন্স থেকে প্রকাশিত। গ্রন্থটির আপাদমস্তক লেখকের অভিজ্ঞতা প্রকাশ পেয়েছে৷ এর পরতে পরতে ছড়িয়ে রয়েছে লেখকের দেশপ্রেম, মাতৃভূমির প্রতি অপরিসীম দরদ। মা ও মাতৃভূমি যে একই সুঁতোয় বাঁধা, তা বারবার গ্রন্থটি পড়তে গিয়ে অনুভূত হয়েছে। পড়তে গিয়ে কোথাও হোঁচট খেতে হয়নি। কারণ জীবনের নিদারুণ ক্ষয় ঘটলেও বারবার মনকে জানান দিচ্ছিলো মা-মাতৃভূমি-দেশের প্রতি এক গভীর টানের উপলব্ধি! এক অপার অভিজ্ঞতার বুননে লেখক দেশের প্রতি আমাদের দায়িত্ব ও কর্তব্যকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছেন।
পড়ন্ত বয়সে সুখের সন্ধানে গ্রন্থটিতে যে চরিত্রগুলো তুলে ধরেছেন, তার প্রত্যেকটি চরিত্র লেখকের চারপারশ সংগৃহীত। লেখক গ্রন্থের ভূমিকাপর্বেই উল্লেখ করেছেন চরিত্রের নামগুলো তিনি কাল্পনিক ব্যবহার করেছেন। তবে কাহিনিগুলো একদম জীবন্ত।
দীর্ঘ দিনের পর্যবেক্ষণের ফলে তিনি এসব প্রবীণ ব্যক্তিদের জীবনকে পাঠকের উদ্দেশে তুলে ধরেছেন অনেকটা দায়বোধ থেকেই। প্রবাস-জীবন যে কতটা অসহায় হতে পারে, এই গ্রন্থে অধিভুক্ত লেখাগুলো পাঠ করলে তা সহজেই অনুমেয় হয়। লেখক মূলত সমাজের দর্পণস্বরূপ। তিনি সমাজকে যেভাবে দেখেন সেভাবেই পাঠকের সামনে তুলে ধরেন৷ আর সাহিত্য মানুষের জীবনেরই রূপ। এই রূপের আড়ালে ধরা দিয়েছে সমাজের কঠিন-রূঢ়-বাস্তব ও জরাজীর্ণতা! লেখক এখানে চৌদ্দটি কাহিনির স্থান দিয়েছেন। লক্ষ করলে দেখা যায়, এই চরিত্রগুলো প্রত্যেকটাই এলিট শ্রেণির। প্রত্যেকেই জীবনকে খুঁজে চলেছেন। আর আমরা স্বভাবতই জানি, মানুষ তার জীবনের সফলতা খোঁজে সুখের পরিমাপ করে। কোথায়, কতটা সুখপ্রাপ্তি হলো তার ওপরই মানুষের জীবন- সাফল্যের নিক্তি দাঁড়িয়ে থাকে। তেমনই এই গ্রন্থের চৌদ্দটি পরিবার ভিন্ন-ভিন্নভাবে সুখের সন্ধানে ব্যস্ত থেকেছেন। তবে এই গ্রন্থে অধিভুক্ত অধিকাংশ পরিবার সুখ খুঁজেছেন দেশের বাইরে অর্থাৎ প্রবাস জীবনে। যেখানে অঢেল সম্পদ-সম্পত্তির সঙ্গে মনোরম পরিবেশে থাকার ক্লাপনিক বাসনায় সিক্ত হয়েছে এই পরিবারগুলো। কিন্তু লেখক শেষপর্যন্ত একটিতেই তার যুক্তিগুলো তুলে ধরেছেন তা হলো, দেশেই প্রকৃত সুখ৷ বিদেশে নয়। মাতৃভূমি ব্যক্তিকে যতটা স্বাধীনতা ও সুখের সন্ধান দিতে পারে তা আর কোনোকিছুই পারে না। এমনকি পৃথিবীর সব বিত্ত ও শক্তির সমাহারেও মাতৃভূমির সুখ পাওয়া সম্ভব নয়৷ তবু এখানের অধিকাংশ পরিবার সুখ খুঁজতে চয়েছেন। শেষমেশ ধোঁকায় পড়ে নিজের সর্বস্ব হারিয়েছেন কেউ কেউ৷ তাদের সেই সুখ থেকে গেছে, ‘হেথা নয় হেথা নয় অন্য কোথা অন্য কোনখানে।’ আর এভাবেই তারা নিজেদের পরিচালিত করেছেন এক অজানা গন্তব্যে।
গ্রন্থটির প্রথম কাহিনি গড়ে উঠেছে রহিম সাহেব নাম্নী এক সরকারি চাকরিজীবীকে ঘিরে। যিনি পিএইচডি করতে ইংল্যান্ডের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে যান। পরবর্তীকালে দেশে ফিরে রাষ্ট্রীয় গবেষণা প্রতিষ্ঠানে সর্বোচ্চ পদে উন্নীত হন। কিন্তু ড. রহিম এতেও সুখলাভ করেননি। তাই পুত্রের ভবিষ্যৎ এবং নিজের উন্নতর জীবনের আশায় যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে পাড়ি জমান৷ প্রবাসে ছেলেকে বড় করার মধ্যে দিয়ে সাত থেকে আট বছরের জীবন অতিবাহিত হয়। একসময় ছেলে বড় হয়ে এক অবাঙালি মেয়েকে বিয়ে করে। পুত্র এহসানের ঘরে আসে এক নাতি৷ নাম সোহেল। সুখের আশা ও স্বপ্নের ঘাটতি না থাকলেও রহিম দম্পতি খুব শিগগিরই অনুভব করেন ছেলের পরিবারে তারা বোঝার মতো। একসময় ছেলে তাদের দেশে ফেরত যাওয়ার জন্য আচার-আচরণে বিশেষভাবে বুঝিয়ে দেয়। প্রবাসে সুখের আশায় ঢাকার অ্যাপার্টমেন্ট বিক্রি করে ভবিষ্যৎ গড়তে চাইলেও সেখানে একবুক হতাশা নিয়ে দেশে ফিরতে হয়।
লেখক ড. আব্দুল আউয়াল খান কাহিনিগুলো তুলে ধরার মধ্যে দিয়ে এটাই বোঝাতে চেয়েছেন, প্রয়োজনে একাকী হলেও নিজ দেশেই সুখের সন্ধান করা উত্তম। পড়ন্ত বয়সে কাঙ্ক্ষিত সুখের জন্য বিদেশের মাটিতে সন্তানের ঘরে থাকা বোকামি।
জীবনের শেষ প্রান্তে পৌঁছে ইঞ্জিনিয়ার রহিম বুঝতে পারেন, স্বাধীনতার সুখ নিজ দেশেই। জীবনের এই কাহিনিবৃত্তে লুকিয়ে আছে একটি গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা। লেখক তুলে ধরেছেন এভাবে: ‘দেশের সম্পদ বিক্রি করে বিদেশে শান্তির নীড় তৈরির চেষ্টা নির্বুদ্ধিতা মাত্র।’ অন্যদিকে এই গ্রন্থের দ্বিতীয় জীবন কাহিনিতে দেখা দিয়েছে ভিন্নচিত্র। সদ্য স্বাধীন দেশে ইঞ্জিনিয়ার আজহারের ব্যবসায় কিঞ্চিৎ ব্যাঘাত ঘটলেও পরে শিল্পকারখানা ও ব্যাংক-বীমাসহ বিভিন্ন ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান উন্নয়নে সক্ষম হন। তিনি ও তার বন্ধু ইঞ্জিনিয়ার রফিক দুজনেই উপলব্ধি করেন পরিণত বয়সে পাশ্চাত্যের পরিবেশ মোটেও সুখকর হবে না। তাই বিদেশ না গিয়ে দেশেই কর্মে আত্মনিয়োগ করেন। শেষপর্যন্ত সফলও হয়েছেন৷
ড. আন্দালিবের কাহিনিটি বেশ সংগ্রামের ও সাহসের। শিক্ষাবৃত্তির আওতায় পিএইচডির জন্য স্ত্রী-সন্তানসহ দেশ ছেড়ে গিয়ে সুখ-শান্তি খুইয়ে, স্ত্রী-সন্তানের সঙ্গে মতভেদের ফলে শেষে একাই দেশে ফেরেন এবং শেষপর্যন্ত স্ত্রী ও সন্তানের সঙ্গে বিচ্ছেদ। পরবর্তীকালে দেশে এসে আবার নতুন করে সংসার ও চাকরিজীবনে সুখ খোঁজার জন্য দ্বিতীয় বিয়ে মতো সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। আন্দালিবের কাছে বিদেশের মাটিতে দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক হয়ে থাকার চেয়ে দেশে স্বনামধন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতাই শ্রেয় মনে হয়েছে। লেখক ম্যোরাল অব দ্য স্টোরি হিসেবে দেখিয়েছেন: ‘প্রবাসে উচ্চশিক্ষা শেষে প্রয়োজনে সংসার ছেড়ে নিবেদিত হতে হবে স্বদেশ সেবায়।’
প্রতিটি কাহিনিই জীবন থেকে সংগৃহীত। জীবনের মারপ্যাঁচে কেউবা সঠিক পথে চলেছেন আর কেউবা অতীব সুখের আশায় হতাশ হয়েছেন। চতুর্থ কাহিনিতে স্থান পেয়েছে মোহাম্মদ হালিমের দুঃখ-কষ্টের কথা। হালিম সরকারি কর্মকর্তা হিসেবে ১৯৭৪ সালে সম্মান ও মর্যাদাসহকারে অবসর গ্রহণ করেন। অতঃপর ছেলে-মেয়েদের উচ্চশিক্ষার জন্য সপরিবারে ইমিগ্রেশন নিয়ে নিউইয়র্কে পাড়ি জমান। শেষপর্যন্ত তাদের করুণ পরিণতি জীবনকে আরেকবার প্রশ্নবিদ্ধ করে! ছেলে-মেয়েরা উচ্চতর ডিগ্রিপ্রাপ্ত হয়। কিন্তু সুখ নামক মরিচীকা হালিম দম্পতির কাছে আর ধরা দেয় না। ছেলে-মেয়েদের বিয়ে-সংসার অন্যদিকে মিসেস হালিমের বাধর্ক্যজনিত কারণে মৃত্যু হালিম সাহেবকে আরেকবার দুর্দশার দিকে ঠেলে দেয়। বাবাকে বোঝা ভাবতে শুরু করে। একসময় নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে জীবনাবসান ঘটে। পড়ন্ত বয়সে সুখের সন্ধানে নিজের দেশত্যাগ করে হালিম দম্পতি সুখ কিনতে চেয়েছিলেন কিন্তু ধরা দিয়েছে গভীর বেদনা ও জীবনের ক্ষয়।
পঞ্চম কাহিনি ইঞ্জিনিয়ার ফাত্তাহ সাহবের। তিনি কানাডার অভিবাসী। তার জীবনের শেষ প্রান্তে এসে তিনিও অনুভব করেন প্রবাস তার জীবনে সুখ আনতে পারে না। তেমনই ষষ্ঠ কাহিনিতেও মি. রেজওয়ানের সুখের সন্ধানে দেশ ত্যাগ। গভীর হতাশায় ডুবে যাওয়া বিবৃত হয়েছে। একে একে চৌদ্দটি কাহিনিতেই কোনো না কোনোভাবে এই পরিবারগুলোর প্রবাসে গমন এবং তাদের নিদারুণ পরিণতি ফুটে উঠেছে। লেখক ড. আব্দুল আউয়াল খান কাহিনিগুলো তুলে ধরার মধ্যে দিয়ে এটাই বোঝাতে চেয়েছেন, প্রয়োজনে একাকী হলেও নিজ দেশেই সুখের সন্ধান করা উত্তম। পড়ন্ত বয়সে কাঙ্ক্ষিত সুখের জন্য বিদেশের মাটিতে সন্তানের ঘরে থাকা বোকামি। বরং নিজের ঘরে নিজের দেশেই প্রকৃত সুখ। তিনি আরও বোঝাতে চেয়েছেন, বিদেশে উচ্চ শিক্ষা বা অর্থ উপার্জন ফলদায়ক হলেও পড়ন্ত বয়সে সুখ নিজ দেশেই। লেখকের এ গ্রন্থ থেকে সবিশেষ এটাই অনুমেয় যে, সুখের সন্ধানে দেশ ত্যাগ চরমতম নির্বুদ্ধিতা। প্রতিটি কাহিনিতে এর ছাপ চূড়ান্ত। এই গ্রন্থে নিবদ্ধ অধিকাংশ উচ্চবিত্ত পরিবারই সুখের সন্ধানে দেশ ছেড়েছে কিন্তু শেষপর্যন্ত তাদের কপালে জুটাছে নিদারুণ বঞ্চনা-লাঞ্ছনা ও অবেহেলা! ড. আব্দুল আউয়াল খান এই শ্রেণিকে গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করেছেন বলেই এত রূঢ় সত্য তুলে ধরতে পেরেছেন। লেখকের সার্থকতা এখানে যে, তিনি মানুষকে বোঝাতে সক্ষম হয়েছেন দেশ-মা-মাতৃভূমি আগে। মাতৃভূমিকে ছেড়ে কখনো সুখের আশা করা যায় না।