বলা যায়—সহজ ভাষায় হৃদয়ছোঁয়া লেখা কবিতা এখন দুর্লভ। অযথা জটিলতা সৃষ্টি করা এখন কবিদের স্বভাবে পরিণত হয়েছে। তাই কবিতার স্বাদ আস্বাদন অনেকটাই কম হয় বর্তমানে। যদিও পৃথিবীর অধিকাংশ মহৎ ও জনপ্রিয় কবিই সহজ ভাষায় অসাধারণ কবিতা লিখেছেন। রচনা করেছেন মহৎ সাহিত্য। আর এই মহৎ সাহিত্য নিয়ে অনেকেই অনেক কথা বলেছেন। যেমন সৈয়দ শামসুর হক ‘মার্জিনে মন্তব্য’ গ্রন্থে বলেছেন, যা হৃদয় ছোঁয়া, তাই সাহিত্য। তবে এর মধ্যে ইএম ফস্টারের সংজ্ঞাটি বেশি গ্রহণযোগ্য। তিনি বলেছেন, What is wonderful about great literature is that it transforms the man who reads it towards the condition of the man who wrote. অর্থাৎ যে সাহিত্য পাঠ করার পর পাঠক কবির মতো ভাবতে পারেন ও কবির অবস্থানে ভূমিকা পালন করেন, তাই মহৎ সাহিত্য। এর পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায়—মহৎ কবিতাও তাই, যা পাঠক করে পাঠকও কবির মতো ভাবতে পারেন। কবির মতো প্রেমিক হতে পারেন বা হতে পারেন দ্রোহী কোনো সত্তা। শব্দের ব্যবহার, উপমার প্রয়োগ, চিত্রকল্প ও শব্দশৈলী ও দেশীয় প্রাকৃতিক সৌন্দর্য চিত্ররূপময় শব্দের কাঠামোতে উপস্থাপন একজন কবিকে সচারচর অন্যদের থেকে পৃথক করে। সেই সঙ্গে কবিতায় রস বিশেষত প্রেম, বিরহ, বেদনা ও বীর রসের যথাযথ সংযোজন কবিতাকে করে অনন্য। ময়ুখ চৌধুরী ঠিক তেমন একজন আপাদমস্তক প্রেমিক কবি। সহজ ভাষায় হৃদয়ছোঁয়া কবিতা লেখায় তিনি সিদ্ধহস্ত। তার ডিসকোর্সভিত্তিক প্রেমের কবিতা বা পঙ্ক্তি আমাদের আবেগে শিহরণ জাগায়। এখানে প্রেমিকারা তার কবিতা শুনে কানা মাছি ভোঁ ভোঁর মতো শ্রুতির আঁধারে প্রবেশ করে। তাই তেরটি বছর পর সেই নীল মৌমাছি প্রেমিকাকে দেখে কবি অস্থির। রচনা করেন:
চোখের আড়ালে ছিল ব্যথাহীন বিরহের চর,
রুমাল খুলতে খুলতে লেগে গেলো তেরোটি বছর।
তেরোটি বছর পর সেই মাছি ডানাঅলা মাছের মতোন
ঘাই দিলো আমার ভেতর।
(একটি নাম, দুই চোখের আড়াল )
মাছের ঘাই খাওয়ার পর কবির স্মৃতি তাকে জাগিয়ে তোলে। তিনি পাঠকদের জানান বাইরে নতুন মেঘ। আর এর মধ্যে বৃষ্টির কারণে জেগে উঠেছে ঘাসফুল। আর সেই ঘাসফুলে আবার কবির স্মৃতির কবর জাগ্রত হয়। তাই তিনি বলেন—’বাইরে নতুন মেঘ ঘাসফুলে জেগে ওঠে স্মতির কবর’। এভাবে সহজ-সাবলীল ভাষায় কবিতা লিখে পাঠককে ভাবনায় ফেলে দেওয়ার মতো রসের খোরাক জোগাতে সিদ্ধহস্ত ময়ুখ চৌধুরী।
স্বপ্ন। এই স্বপ্নকে কতটা অসাধারণভাবে উপস্থাপন করা যায়, তা একজন তরুণ কবি ও পাঠক না পাঠ করলে কবিতার স্বাদ আস্বাদন মনে হয় অপরিপূর্ণ থেকে যাবে। বিশেষত কবি যখন কবিতা লেখেন স্বপ্না, আসলে স্বপ্নের শিরোনাম। আবার এই একই কবিতায় তিনি যখন বলেন, ‘স্বপ্না তোমার নামের মধ্যে গেঁথে আছে একটা ‘না’ কাঁটার মতো’। এ যে একটা শব্দের ‘না’ কে এতটা মহিমান্বিত করে তোলার ক্ষমতা কবিরই থাকতে পারে। অন্য কারও না। একটা ‘না’ কখন গোলাপের কাঁটার মতো না হতে পারে? যখন সেই ‘না’ বলা প্রেমিকাকে কবির কাছ থেকে ছিনিয়ে নেয়। যদিও তখন কবি প্রেমিকাকে ঘুমের মধ্যে কল্পনা করেন। এখানে তিনি প্রেমিককে গেলাপের সঙ্গে তুলনা করেছেন আর না শব্দটিকে তুলনা করেছেন কাঁটার সঙ্গে। অবশেষে তিনি বলেন ‘সারারাত আমার ঘুমের মধ্যে সঙ্গীহীন ভাসমান চাঁদ…,/ ঠিক চাঁদও নয়; যুবতিরাতের তারকাখচিত শাড়ি খসে স্তন’ (স্বপ্না, আসলে স্বপ্নের শিরোনাম)। আর তখনই কবির মনে হয় এমন গোলাপের স্পর্শ না পাওয়ার একমাত্র বাধা বা কাঁটা হলো তার অসম্মতি সূচক শব্দ না। এই না শব্দটি কতো ক্ষমতাবান। কতটা কাতর ও বেদনার্ত স্বরে একজন কবি বলতে পারেন:
সামান্য জ্বরে কপালটা পুড়তে-পুড়তে উঠোনের মতো প্রশস্ত হয়ে উঠেছিলো
নোংরা উঠোনে শিউলি গাছের মতো
একটা হাতও ছিলো না তপ্ত ললাটে
(স্বপ্না, আসলে স্বপ্নের শিরোনাম)
তার এই জন্মদিনে কেউ তাকে শুভেচ্ছা জানাতে আসে না। তিনি এতে আহত হন। কিন্তু তারপরও ক্ষোভকে অবদমনের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণে তিনি অক্ষম। তাই বলেন:
আমি নিজেই মোমবাতির শিখার মতো জ্বলতে থাকবো।
দেখি, শেষ পর্যন্ত কোনো প্যাঁচা এসে বলে কি না—
‘বাতিটা নেভাও, আমি কষ্ট পাচ্ছি’।
(জন্মরাতে)
শুধু প্রেম বিরহ নয়, দ্রোহ প্রকাশেও তিনি অনন্য। তার যে কবিতাটি আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ব্যাপকভাবে সমাদ্ধৃত হতে পারে বলে একজন পাঠক হিসেবে মনে করি তা হলো ‘বিশ্বশান্তি সম্মেলন, বিতর্কিতক প্রেমিক-প্রেমিকা, এবং কার্সসবাদী ও পুঁজিবাদী তাত্ত্বিকের গল্প’। বিশ্বশান্তি নিয়ে অনেকে অনেক কবিতা লিখেছেন। কেউ জাতিসংঘকে বিদ্রূপ করে কবিতা লেখেছেন, কেউ বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠায় মানবতা প্রতিষ্ঠাকরণে জোর দিয়েছেন। কিন্তু বিশ্বশান্তি সম্মেলনে প্রকৃত অর্থে কী ঘটে। এর শৈল্পিক বর্ণনা দিয়ে কবিতা লেখা যেতে পারে তা ময়ুখ চৌধুরীর বেলায় অনেকটা সত্য বলা যায়। একারণে বিনয় মজুমদার তার ঈশ্বরির স্বরচিত প্রবন্ধে বলেছেন—‘একজন প্রকৃত কবি যে কোন বিষয় নিয়ে কবিতা লেখতে পারেন। কবিতা লেখার শুরুর দিকে আমি ভাবতাম কী নিয়ে কবিতা লিখবো। কিন্তু পরে দেখলাম যে কোন বিষয় নিয়ে সাবলীল কবিতা লেখা যায়, যদি প্রস্তুতি থাকে’। ঠিক এ রকম একটি সাবলীল কবিতা লিখেছেন কবি ময়ুখ চৌধুরী। জাতিসংঘ সম্মেলনে আমরা দেখি রাজনৈতিক প্রতিযোগিতার সর্বোচ্চ মঞ্চায়ন। দেখি গোয়েন্দাবৃত্তির নির্লজ্জ আচরণ। এ ধরনের একটি আয়োজনে আর কতটুকুই বিশ্বশান্তি স্থাপন করা সম্ভব তৃতীয় বিশ্বের জন্য? এ কারণে কবি লেখেন:
শহরটা গমগম করছে, বিশ্বশান্তি সম্মেলন চলছে সেখানে
এ রাজনৈতিক অলিম্পিকে অনেকেই যোগ দিয়েছেন
অনেক দেশের আর বিভিন্ন জাতির
বিচিত্র পতাকা সব সকলের নাকের ডগায়
অনৈক্যের দুর্গন্ধ ছড়ায়
(বিশ্বশান্তি সম্মেলন, বিতর্কিত প্রেমিক প্রেমিকা, এবং মার্ক্সবাদী ও পুঁজিবাদী তাত্ত্বিকের গল্প)
আর এ অনৈক্যের দুর্গন্ধ কীভাবে ছড়ায়, তা বোঝাতে বিশদ বর্ণনা দিয়ে তিনি বলেন, নানা রকমের কীট প্রতঙ্গের ভূমিকার কারণে এই শান্তি সম্মেলন তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর কোন উপকারে আসবে না। কারণ:
শহর ভরেছে নানা রকমের পতঙ্গে ও কীটে
যথা: কূটনীতিবিদ, রাষ্ট্রপতি, উপপতি, কম্যুনিস্ট, বুদ্ধিজীবী আর
অধ্যাপক গোয়েন্দা, আমলা
দায়ে-পড়া গবেষক, সাংবাদিক ভাড়াটে লেখক…
তারা একই টেবিলে বসে দাবার পণের মতো তৃতীয় বিশ্বের
রক্তের মতন লাল মদ্য পান করে।
(বিশ্বশান্তি সম্মেলন, বিতর্কিত প্রেমিক প্রেমিকা, এবং মার্ক্সবাদী ও পুঁজিবাদী তাত্ত্বিকের গল্প)
এই কবিতাটি কবিতাটি বিশ্বের বিভিন্ন ভাষায় অনুবাদ করে ছড়িয়ে দেওয়ার মতো কবিতা। কারণ এখানে একজন তৃতীয় বিশ্বের কবি তার মা মাটির অস্তিত্ব রক্ষার্থে সদর্পে সত্য উচ্চারণ করেছেন। তুলে ধরেছেন: কিভাবে শোষিত হচ্ছে তৃতীয় বিশ্ব। যে বাস্তবতা আমরা বর্তমানের অনেক প্রতিষ্ঠিত ও তরুণ কবিদের মাঝে দেখি না। আর এ বিষয়ে হতাশা প্রকাশ করে পাবলো নেরুদাও বলেছিলেন তার আত্মজীবনিতে—‘আমি লাতিন আমেরিকার তরুণ কবিদের বলবো, তারা যেন টিএসএলিয়টের মতো কবিতা না লেখে। কারণ আমেরিকা ও লাতিন আমেরিকার সমাজ বাস্তবতা এক নয়’। এ বিষয়টিকে আরও একটু সুন্দর ব্যাখ্যা দিয়ে বলেছিলেন গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মাকের্জ এক সাক্ষাৎকারে। তাকে যখন এক আমেরিকার সাংবাদিক প্রশ্ন করলেন, আপনি লেখক হয়েও কেন এতটা রাজনীতিতে সক্রিয়? উত্তরে তিনি বলেছিলেন, ‘আমেরিকার সমাজব্যবস্থা অনেক আধুনিক ও মানবিক। সেখানে একজন লেখককে রাজনৈতিক অস্থিরতা নিয়ে ভাবতে হয় না। আর তৃতীয় বিশ্বে রাজনৈতিক সমস্য প্রকট বলেই এখানকার লেখকদের রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি প্রখর ও রাজনীতিতে সক্রিয় অংশগ্রহণ করতে হয়’। আর এ বাস্তবতা কবি ময়ুখ চৌধুরী গুরত্বসহকারে অনুধাবন করতে পেরেছেন বলে এমন একটি অমর কবিতা রচনা করতে পেরেছেন।
কারা যেন শকুনের মতো খুঁটে খুঁটে খাচ্ছে
দশ কোটি হৃদপিণ্ড আর অধিকার।
এইসব শকুনের সাথে ভাগাভাগি করে
বেচেঁ থাকা হবে না আমার।
(জন্মান্তর)
স্বাধীনতা, ভাষা-আন্দোলন, ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান, গণতন্ত্র হরণকারী হায়েনার মুখোমুখি হওয়ার মধ্য দিয়ে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে কবির প্রেমের বিবর্তনও ঘটেছে। তিনি কখনো ছিলেন প্রেমিকাকে না পাওয়ার বেদনায় কাতর, কখনো প্রেমিকার রূপকীর্তন করে বেদনাহত। অধিকাংশ সময় তিনি অভিজাত শ্রেণীর প্রেম (Courtly Love) নিবেদন করেছেন, যেখানে সর্ম্পক কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রিত। অভিজাত প্রেমিক হিসেবে নিজের প্রেমিকাকে দেবী মনে করে প্রেমিকার যাবতীয় খেয়ালিপনা সত্ত্বেও প্রেমে অটুট থেকেছেন। তাই তিনি বলেন:
কতটা চোখের জলে তুমি হলে সুখী মাছ একুরিয়ামে
নদীর দক্ষিণ হাতে ভাঙন আর বাম হাতে পলির জাগন।
তারপরও তিনি পাথরের বুকে আমি শ্যাওলার মতোন গাঢ় ঘুমে
লবণাক্ত প্রেমে ভেসে যাই।
(অষ্টম এডওয়ার্ড)
অন্যদিকে ঠিক তেমনি বুদ্ধিদীপ্ত-ব্যঙ্গাত্মক-জ্ঞানগর্ভ উক্তি দিয়ে প্রেমিকাকে করেন ক্ষতবিক্ষত। তার এই নিষ্ঠুর আক্রমণের তীর যেন উচ্চারণ করে:
কাঁকনের চেয়ে ভারী অহংকার বাজে। জমকালো
অবজ্ঞার প্রসাধন সর্বঅঙ্গে মেখেছো তো ভালো।
বা সুন্দরের অত্যাচারে আর্তনাদ করে দু’টি চোখ
বা শরীরটা টেনে হিঁচড়ে দূরে নেওয়া যায়
সেটা কি দূরত্ব হলো!
সর্ম্পকটা যখন দুঃখের
তখন নিকটবর্তিতায় কী আসে যায়।
(অষ্টম এডওয়ার্ড)
পাশাপাশি রূপক-উপমা-চিত্রকল্পের সফল ব্যবহারে তিনি একের পর এক কবিতার শরীর বুননে বাবুই পাখির মতো শৈল্পিক দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন। যেমন:
মহিলার খোঁপার নিপুণ ষড়যন্ত্রে আটকে পড়ে
একটি ফুলের সে কী কষ্ট!
চিলের মতোন তাকে ছোঁ মেরে মুক্তি দিতে পারে
একমাত্র একটি পাগল
বা জাতিসংঘ মাতা তোলে ডাকিনীর খোপর মতন
বা বিপন্ন মাটির মতো শুয়ে-পড়া বিষ্ফোরণ আমি
অন্ধকার আর আতঙ্কের বৈধতায় দু’জোড়া মানুষ মাখন আর রুটির মতো সেঁটে গেলো।
(অষ্টম এডওয়ার্ড)
ময়ুখ চৌধুরী তার ‘ডান হাতের পাঁচটি আঙুল’ কবিতার বইয়ে সহজ ভাষায় অনেক দার্শনিক সত্য বলেছেন, প্রকাশ করেছেন প্রেম ও দ্রোহ। এ প্রকাশভঙ্গি সহজেই একজন সাধারণ পাঠকও বুঝতে পারেন। ফলে তার কবিতায় যেমন একদিকে দেখা গেলো সহজ-সরল সাধারণ গ্রামীণ জীবন, অন্যদিকে অপার্থিব জগৎ। যেখানে প্রাধান্য পেয়েছে আবেগঘন উপলব্ধি, যা পাঠককে করে উৎসাহিত। এই বইটিতে তার ইতোপূর্বে প্রকাশিত ‘কালো বরফের প্রতিবেশী, ‘অর্ধেক রয়েছি জলে অর্ধেক জালে, ‘তোমার জানলায় আমি জেগে আছি চন্দ্রমল্লিকা’, ‘প্যারিসের নীলরুটি’ ও ‘আমার আসতে একটু দেরি হবে’কে একমলাটে বন্দি করা হয়েছে। কবি জানাচ্ছেন—কবিতাগুলো রচিত হয়েছে ১৯৭০ থেকে ২০০০ সালের মধ্যে।
ডান হাতের পাঁচটি আঙুল
লেখক: ময়ুখ চৌধুরী
প্রকাশক: বাতিঘর
প্রচ্ছদ: সব্যসাচী হাজরা
মূল্য: ৪০০ টাকা