দূরের মাঠ, খাঁজকাটা অবারিত প্রান্তর, ধুলিধূসরিত গ্রাম, ঘাসফুল মাড়ানো শিশির, সবুজ ঘাস, পাকা ধানক্ষেত, পদ্মাপারের কাশফুল, কলমির বেড়া ঘেরা মাটির বাড়ি, হেমন্তের মাঠ, পরজীবী সোনালি লতা, মাতাল হাওয়া, হলুদ সোনালু ফুল, ফাটা ফাটা শুষ্ক মাটি, কাঁকর পথ, অরণ্য প্রজাপতি, সূর্য ডোবা বিকেল, রাতজাগা পাখিদের শিস, প্রাচীন বটের ঝুড়ি, বরেন্দ্র ভূমি, ধুতুরার ফুল, রঙিন ঘুড়ির উড্ডীন দিন, পিঠালু, কলাপাতা, ঘাসফড়িং, নদী, চড়ুই, সাপ, প্রজাপতি, রাখাইন মেয়ে, পদ্মপাতা, তুঁত গাছ, জোনাকি, ঝরণা প্রপাত—শব্দচয়নগুলো আমার নয়, কবি শামীম হোসেনের। তাঁরই অনবদ্য সৃষ্টি ‘শীতল সন্ধ্যা গীতল রাত্রি’র মূল উপজীব্য।
কংক্রিটে মোড়ানো পৃথিবীতে কবিতায় লেগেছে প্রযুক্তির হাওয়া। তাই কবিতাও যেন মনে হয় ইট-পাথর আর রড, সিমেন্ট গাঁথা। কবিরা ইন্টারনেট আর ফেসবুকের পাখায় ভর করে ছুটে চলেছেন কৃত্রিম রঙ আর প্রিজারভেটিভের সন্ধানে। ঠিক সেই সময় শামীম হোসেনকে পাওয়া যায় ধুলিধূসরিত গ্রাম, রাত জাগা পাখিদের মাঝে, প্রাচীন বটগাছের নিচে, মেঘের কার্নিশ ছুঁয়ে, পাতার উড়োজাহাজে, লাহাড়ির অবসরে, কালো মহিষের পিঠে, জংলার ওপাশে, শীতল সন্ধ্যায় আর গীতল রাত্রিতে।
প্রকৃতি ও জীবন এক হয়ে মিশে গেছে শামীমের কবিতায়। তাঁর প্রকৃতি কোনো দুর্লভ বা অচেনা কিছু নয়। প্রতিদিন আমাদের সঙ্গে যেসব প্রকৃতি কথা বলে, সে সব প্রকৃতিই স্থান পেয়েছে নির্মল, নির্ভেজাল ও স্বতঃস্ফূর্তভাবে। সামান্য কচুপাতা, কলাপাতা, ধুতুরার ফুল থেকে শুরু করে সমুদ্র নক্ষত্র কোনো কিছুই বাদ যায়নি। প্রকৃতিকে কবি নিজে দেখেছেন, কাছে গিয়েছেন, প্রাণভরে উপভোগ করেছেন সৌন্দর্য আবার অন্যকেও আহ্বান করেছেন তাঁর প্রকৃতিকে দেখার। এমনই একটি কবিতা ‘দেখো’ :
আহা সবুজ ঢেউ! খাঁজকাটা অবারিত প্রান্তর
মেঘের কার্নিশ ছুঁয়ে তুলা ওড়া স্মৃতির শহর
[… … … … …]ফড়িঙের পাখা মেলে দোল খাওয়া শিশুর হাসি
মাদারের গানে মজে যাওয়া রাত্রি যাপন
প্রাচীন বটের তলে জোছনার চাদর মেলে
ফাঁদ পেতে থাকা পঙ্ক্তির ছিপ
খুঁজে দেখো পাবে ঠিক মনের মতোন।
শামীমের প্রকৃতি নিছকই বর্ণনা নয়। প্রকৃতির সঙ্গে রয়েছে জীবনের অদ্ভূত মিতালী। অভিভাবক শূন্য বিরহের মাঝে প্রকৃতিকে খুঁজেছেন অভিভাবক হিসেবে, প্রকৃতি দিয়ে সাজিয়েছেন প্রিয়ার শরীর, জেগে উঠতে চেয়েছেন প্রকৃতির ডাকে, জাগাতে চেয়েছেন প্রকৃতির ছোঁয়ায়, হিসেবের খাতায় জমা রাখেন প্রকৃতি অরণ্যের প্রজাপতি, খড়কুটো ইত্যাদি। পিতা হারানোর বেদনায় লীন কবি প্রকৃতিকে দেখেছেন বিরহের সঙ্গী হিসেবে। প্রকৃতিও কবির বেদনায় ব্যথিত—
ভূমিকম্পে ভূমির ওপর দাঁড়িয়ে রয়েছি
পিতা আর আমি…
আমাদের দাঁড়ানোর পেছনে দীর্ঘ সাতাশ বছরের দীর্ঘপথ।
এত দীর্ঘপথে
এমন বিরহ মেশানো বৃষ্টি
পৃথিবীতে আর কখনো নামেনি।
পিতা যখন বর্ষণসিক্ত মাটিতে দেহ রাখছিলেন
পূর্ণিমা রাতের মতো উজ্জ্বল ছিল তার মুখ
ভাষাহীন বর্ণমালার মতো আমার ভেতর ভেঙে ছিল কাচের কফিন
(পৃথিবীর সকল পিতারা)
আবার অন্য একটি কবিতায় প্রকৃতির রূপ, রস, গন্ধে বিভোর কবি প্রিয়াকেও আলিঙ্গন করে প্রকৃতির সরোবরে গা ভাসাতে চেয়েছেন :
যখন গহীন অরণ্যে তুমি
চুল বাঁধো পরজীবী গাছের লতায়
তখন বাসনা জাগে ঠোঁটের কার্নিশ বেয়ে
ঝরে পড়ুক প্রেমের শিশির …
হয়তো দূরে কোনো একা একা ছাদে
উড়োমেঘ জমা হচ্ছে সুউচ্চ টাওয়ারে
আর তুমি শরীরে জোছনা মেখে
চাঁদ বন্দনায় পার করছো শিকারি সময়
(প্রেমের পঙ্ক্তি)
বাস্তবতার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে হয়তো কখনো কবি নিজেকে হতাশার সাগরে নিমজ্জিত করেছেন। আশাহত বেদনায় বিলিন হয়ে আবার জেগে উঠেছেন সবুজের ডাকে—’ঘাসের লণ্ঠন জ্বেলে কে ডাকো সবুজ সবুজ!/ পাতার উড়োজাহাজে ভেসে দেখে যাও/ বিরান প্রান্তরে জমিয়েছি শীতের শিশির / বুকের গোপনে সাজিয়ে রেখেছি আগামীর বীজ। / এখন তো অনেক কাজ মাঠে মাঠে / পাকা ধান কেটে কেটে অবশ দুহাত/ লাহাড়ির অবসরে থরে থরে স্বপ্ন আর/ কানে গুঁজে রাখি কলমির ফুল’ (এই কালো শরীর)।
অন্য একটি কবিতায় : ‘মাতাল হাওয়া’ হলুদ পোশাক—শীতল সন্ধ্যায় ঝুলন্ত ব্রিজঝরনার জল জোছনা রাতে সেই শীতল সন্ধ্যা থেকে গীতল রাত্রি পেরিয়ে / ভোর হবার অপেক্ষায় আছি…। আলস্য চেতনার বাঙালি দীর্ঘ সংগ্রামের পর নিজের অজান্তেই কখন যেন ঘুমিয়ে পড়ে। ঠিক সেই মুহূর্তে জাতির পতাকায় আঁচড় কাটতে চায় কিন্তু স্বার্থন্বেষী হায়েনার দল। লুটেপুটে খায় দীর্ঘ সংগ্রামের ফসল তখন প্রয়োজন হয় কিছু মন্ত্রের ভোঁতা অনুভূতিকে শাণিত করার জন্য। এমনই একটি কবিতা ‘সাপ’ যেন মৃতপ্রায় স্পন্দনহীন প্রাণে আনে জাগরণের বার্তা :
জেগেছে সাপ— খোলস ছাড়ো/ নাভি থেকে মাথা অব্দি/ ছড়িয়ে যাক ফুলের সুবাস/ পিচ্ছিল পথ—অরণ্য অশেষ / গুহার মুখ থেকে ঢাকনা সরাও / অন্ধকার গভীর হলে গর্তের ভেতর / আনন্দিত হয় সর্পনগর …/ জেগেছে সাপ—খোলস ছাড়ো/ নাভি থেকে পা অব্দি/ ছড়িয়ে যাক ঢেউয়ের বাতাস। [সাপ]
জাতির ক্রান্তিলগ্নে কখনও এমন সময় আসে যখন নেতৃত্বের বড়ই সংকট। চারিদিকে দুর্যোগের ঘনঘটা। মনে হয় যেন একজন পাকা মাঝির শূন্যতায় দেশতরীটি এই বুঝি গেল ডুবে। কিন্তু ইতিহাস বলে সংকট চরমে পৌছালে কেউ না কেউ একজন কান্ডারী হয়ে হাল ধরবেই। আশাবাদী কবি তাই লিখেছেন :
ইন্দ্রিয় সজাগ রেখো কেউ আসছে/ মাটির গন্ধ তার সারাগায়ে / রক্তের গন্ধ তার আকাশে বাতাসে / নখ, মুখ, কান অরণ্যে ঢাকা/ হিমালয়ের মতো বিশাল হৃদয় নিয়ে— কেউ আসছে [বার্তা]
বরেন্দ্রভূমির ইতিহাস, গৌরবের ইতিহাস, দীর্ঘ সংগ্রামের ইতিহাস। সাঁওতাল বিদ্রোহ, তেভাগা আন্দোলন প্রভৃতি শোষণের বিরুদ্ধে সংগ্রামের গৌরবময় ইতিহাস। এই বরেন্দ্রভূমির সংগ্রামে অনুপ্রাণিত কবি এর মাটি ও মানুষকে মনে প্রাণে ভালোবেসে ফেলেছেন। তাই বরেন্দ্রভূমি, বরেন্দ্রভূমির ফাটা শুষ্ক মাটি, কালো মানুষ আদিবাসী রাখাইন, সাঁওতাল রমণী প্রভৃতি শামীমের কবিতার অন্যতম উপজীব্য। ‘ডাকছে বরেন্দ্রভূমি’ এক অনবদ্য সৃষ্টি :
ও রাখাইন মেয়ে দেখে যাও বরেন্দ্রভূমি…
ফাটা ফাটা শুষ্কমাটিতে ঘুমিয়ে রয়েছে নদী
ঢেউ ঢেউ অবারিত সবুজ মাঠ—কাঁকর পথ
আর কান পাতলে শুনবে পাখির কোরাস—
[… … … …]
সাঁওতাল নারীরা খোপায় জবা গুঁজে
পাহারা দেয় ইলা মিত্রের পায়ের ছাপ
জোছনায় জোছনায় আসে উৎসব
সাধের পরব…
ও রাখাইন মেয়ে, দেখে যাও বরেন্দ্রভূমি… [ডাকছে বরেন্দ্রভূমি]
এই বরেন্দ্রভূমির আদিবাসী সন্তান জেঠা টুডু কবির সংগ্রামের অনুপ্রেরণা। কবির চোখে পৃথিবীর একজন নক্ষত্র মানব :
একটি হারানো নক্ষত্রের নাম জেঠা টুডু
বরিনভূমের পাঠশালা হয়ে
পাঠ দিচ্ছে লালমাটির কালো শিশুদের।
[… … … …]
এইসব হাড্ডিসার দেহ লাঙলের ফলা হাতে
ফলিয়েছে সোনালি ফসল
গভীর জোছনারাতে নৃত্য ও মাদলের তালে
জাগিয়েছে সমস্ত পাড়া…
পৃথিবীর নক্ষত্রমানব জেঠা টুডু
যার শরীরে মহুয়ার গন্ধ লেগেছিল।
মহাজনী শোষণ গ্রাম বাংলার চিরন্তন চিত্র। কালো শরীরে ঘাম ঝরিয়ে সোনার ফসল ফলায় কৃষক। স্বপ্নে বুক বাঁধে লাহাড়ির অবসরে। কিন্তু সেই ফসলের সিংহভাগ যখন চলে যায় মহাজনের গোলায় তখন পড়ে থাকে শুধুই কৃষকের হাড্ডিসার কালো শরীর। কবির কাছে এক একজন মহাজন যেন এক একটি ইঁদুর :
এখন তো অনেক কাজ মাঠে মাঠে/ পাকা ধান কেটে কেটে অবশ দুহাত / লাহাড়ির অবসরে থরে থরে স্বপ্ন আর/ কানে গুঁজে রাখি কলমির ফুল…./ আহা সেই স্বপ্নের ঘরে মহাজনী ইঁদুর / ফসলের ফসিল কেটে চালাকি ধামায় / ভরে ছিল গর্তের গোলাঘর আর তার/ লাল চোখের নিচে জমেছিল পাপের সিরিজ…
কালো মানুষকে ভালোবাসতে গিয়ে কবি কালোকেই ভালোবেসে ফেলেছেন। হতে পারে বর্ণবাদী পৃথিবী জুড়ে শাদাদের আস্ফালন, কালোদের প্রতি ঘৃণা আর নিপীড়নের বিরুদ্ধে এটি কবির প্রতিবাদী বিদ্বেষ। তাই অকপটে লিখেছেন :
নদীরাও কালো হোক—মাঠের কৃষক/ আর কোনো সাদা নয়, বাদামি নয় / সবকিছু কালো হয়ে যাক/ হাতের নখ, মুখ শহর ও গ্রাম/ শাদারাও কালো হোক কালোরাও কালো/ চিত্রকর্ম, স্থাপত্য, মন ও মুখোশ/ সুউচ্চ বাড়ি—মন্ত্রির ড্রাইভার ক্ষেতের ফসল। / প্রেমিকার মুখ— সাধের আঙ্গুর।
প্রকৃতিসিক্ত কবি জীবনের টানে শহরের অট্টালিকার ভিড়ে বাস করলেও শেকড়ের টানে ভুলতে পারেনি এখানকার মাটি ও মানুষকে। হারানো শৈশব, ধুলিধূসরিত গ্রাম, কুয়াশা মোড়ানো শহর, ছোট্ট ইশকুল, চশমা আঁটা দিদিমণি, ফ্রকপরা বালিকার হাসি, ধুলো মাখা মার্বেল দুপুর, চড়ুইয়ের প্রভাত সংগীত সবকিছু ফিরে পেতে চায় আগের মতোন নির্মল নির্ভেজালভাবে। ঝরাপাতা যার বিষণ্ন সঙ্গী, নদীর কাছে যার দুঃখের মিতালী, প্রাচীন বটের তলে যার কবিতার অনুপ্রেরণা, এমন কবিকে প্রকৃতি প্রেমিক শুধু নয় আমি বলবো ‘প্রকৃতির কবি’।
‘শীতল সন্ধ্যা গীতল রাত্রি’ নামটি ছন্দ ও নান্দনিকতায় যেমন সবাইকে আকৃষ্ট করে তেমনই আকৃষ্ট করে ভেতরের কবিতাগুলোর প্রতিটি চরণের গীতল বিন্যাস। স্বাতন্ত্র, সৃজনশীলতা ও গীতিময় নান্দনিকতার সমন্বয়ে আলোকিত কবির আবহমান বাংলার প্রকৃতি, মাটি ও মানুষের প্রতি ভালোবাসাই শামীম হোসেনের কবিতার প্রতি আমার এ নিখাদ ভালোলাগা।
শীতল সন্ধ্যা গীতল রাত্রি
শামীম হোসেন
প্রথম প্রকাশ : একুশে বইমেলা ২০১৩
প্রকাশক : নদীপ্রকাশ,
প্রচ্ছদ : রাজিব রায়,
মূল্য : ১০০ টাকা