সম্প্রতি পড়া হলো মাহবুবর রহমানের ছোটগল্পগ্রন্থ ‘কেওড়া জলে একজীবন’। পড়ার পর ভেতরে তৈরি হওয়া দারুণ এক অনুরণন বা তাড়না থেকেই এই লেখা। গ্রন্থটিতে মোট তেরোটি শিরোনামবিশিষ্ট লেখা আছে, যার সবকটিকে প্রচলিত অর্থে ঠিক ছোটগল্প বলা যায় না। তবে লেখাগুলোতে ছড়িয়ে আছে মানবজীবনের দুঃখ-বেদনা, আনন্দ-উচ্ছ্বাস, আশা-হতাশা, প্রেম-বিরহ, বিশ্বাস-অবিশ্বাসের টুকরো ও জীবন্ত চিত্রাবলী, যা পাঠককে নাড়া দেয়, আপ্লুত করে কখনো কখনো দারুণ এক জীবনবোধে উদ্দিপিতও করে।
মাহবুবর রহমান তথাকথিত পেশাদার বা জনপ্রিয় কোনো লেখক নন। পেশায় তিনি একজন চিকিৎসক, একজন মেডিসিন ও হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ। আর্তমানবতার সেবায় নিবেদিত এই মানুষটি দিনরাত শ্রম দেন মানুষের হৃৎপিণ্ডের রোগ প্রশমনে, অসুস্থতা লাঘবের আপ্রাণ চেষ্টায়। সেই তিনি কেন ছুরি-কাঁচি ফেলে, ডাক্তারের জরুরি ‘প্রেসক্রিপশন’ লেখার মতো পয়সা উসুলকারী কাজ ফেলে হাতে তুলে নেন কাগজ-কলম? বাংলাদেশের মতো দরিদ্র একটি দেশে, যেখানে লেখকেরা সামাজিকভাবে সবচেয়ে অবহেলিত, ক্ষেত্রবিশেষে হাসির পাত্র, সেই দেশে কাকসদৃশ লেখকজীবনের প্রতি কেন জন্মে তার মতো প্রতিষ্ঠিত একজন চিকিৎসকের প্রেম কিংবা মোহ? তবে কি তারও হৃৎপিণ্ডের গভীরে নিতান্ত চুপিসারে লুকিয়ে থাকে কোনো অনন্ত হাহাকার? ব্যাখ্যাতীত কোনো বেদনার ভার, যা তাকে অবিরাম তাড়া করে ফেরে লেখার আশ্রয় নিতে? এসব প্রশ্নের উত্তর মিলতে পারে তার ‘কেওড়া জলে একজীবন’ গ্রন্থটিতে।
গ্রন্থের প্রথম এবং দ্বিতীয় গল্পে করোনাকালের মর্মান্তিক দুটি চিত্র এঁকেছেন লেখক অত্যন্ত আন্তরিকতায়। ‘ব্রুকলেন ব্রিজ’ গল্পটির প্রথমাংশে সাহানা এবং আফজাল নামক এক প্রবাসী দম্পতির প্রেম, বিয়ে এবং তাদের সুখি পরিবারের চিত্র উঠে এসেছে। দ্বিতীয়াংশে করোনার থাবায় আফজালের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে তাদের যৌথজীবনের লালিত স্বপ্নগুলোর করুণ মৃত্যু এবং শাহানার মধ্যে তৈরি হওয়া বিভ্রম পাঠকের মধ্যেও সঞ্চারিত হয়, সাহানার দুঃখে পাঠকের বুক চিরে অজান্তেই দীর্ঘশ্বাস ঝরে। দ্বিতীয় গল্প ‘একপ্যাকেটে বিরানি’তে করোনার কারণে চাকরিচ্যুত আলফাজ মিয়া নামের এক গার্মেন্টস শ্রমিকের করুণ জীবন চিত্রায়িত হয়েছে।
করোনার কারণে বন্ধ অফিসে মাস শেষে বকেয়া দু’মাসের বেতন নিতে এসে যে দেখতে পায়, অনির্দিষ্টকালের জন্য গার্মেন্টস বন্ধ ঘোষণা করে তালা ঝুলিয়ে দিয়েছে মালিকপক্ষ। পাঁচভাই-বোন আর পক্ষাঘাতগ্রস্ত বাবার সংসারে মাসে ছয় হাজার টাকা উপার্জনকারী একমাত্র ব্যক্তি আলফাজ চাকরি হারিয়ে চোখে অন্ধকার দেখে ফেরার পথে কোনো এক কোম্পানির মিলাদের অনুষ্ঠান থেকে পাওয়া বিরানির প্যাকেটটি সযত্নে অসুস্থ বাবার জন্য না খেয়ে আগলে রাখে। ট্রেনের সহযাত্রীদের খিদে সেই বিরানির প্যাকেটে চাঙা হয়ে ওঠে, আলফাজের নিজের খিদেও নিশ্চয়ই। তবু সে অসুস্থ বাবার জন্য সে খিদেকে খুন করে, যত্নে আগলে রাখে প্যাকেটটি। একসময় ঝিমুনি আসে তার, ট্রেনের দুলুনিতে ঘুমিয়ে পড়েন এই গল্পের বয়ানকারী নিজেও। গল্পের সমাপ্তি ঘটে আচমকা চেঁচামেচিতে, যখন দেখা যায় আলফাজের ঝিমুনির সুযোগে কে একজন তার বিরানির প্যাকেটটি নিয়ে চম্পট দিয়েছে। গল্পটিতে করোনার ঢেউ আলফাজদের মত নিম্নবিত্তদের কীভাবে রাতারাতি পথে নামিয়ে দিয়েছিল, তাদের জীবনজুড়ে এনে দিয়েছিল নিদারুণ সব হাহাকার আর বঞ্চনা, তার চমৎকার চালচিত্র অঙ্কিত হয়েছে বিশ্বাসযোগ্য বুননে।
‘হোসনা’ এবং‘হোসনার পারলৌকিক একটি রাত্রি’ গল্পদুটিতে অকালপ্রয়াত এক বাল্যবন্ধুর জন্য আরেক বন্ধুর ভেতরে তৈরি হওয়া হাহাকার পাঠককেও আলোড়িত করে, স্পর্শ করে।
‘মৃত্যুর আগে কথোপকথন’ গল্পে জীবনের গূঢ় এক দর্শন উঠে এসেছে। ক্যান্সারাক্রান্ত এক রোগির বয়ানে শুরু হওয়া গল্পটিতে গল্পকথক মৃত্যু নিয়ে যখন ভাবেন, ‘কোথায় যায় সে? সবই কি নিশ্চিহ্ন ধুলায় মিলিয়ে যায় তবে? এই যে সবুজের অদম্য অবোধ সমারোহ, প্রভাতের বুক জুড়ানো মৃদুমন্দ সমীরণ আর আকাশজুড়ে রুপালি জোছনা! সে কি কেবলই মরীচিকার কুহক? কেমোর কিষক্রিয়ায় আমার এত সুন্দর সখের চুলগুলো আমাকে নিঃস্ব করে বিদায় নিলো। যেন আমারই ‘খণ্ড খণ্ড আমি’ আমার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে মৃত্যুকে বরণ করে নিলো। মৃত্যু কি তবে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র মৃত্যু দিয়ে তৈরি? জীবনের শাসাল ফলের ভেতর তবে কি লুকিয়ে আছে কালো কালো মৃত্যুবীজ? নাকি জন্মান্তরের পরম্পরা সে?’
মানবমনে জন্ম নেওয়া চিরন্তন এই প্রশ্নগুলো পাঠকের মনেও দৃঢ়ভাবে গেঁথে যায়, জীবনের অমোঘ এক সত্যের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেয়, তাকে বিহ্বল, বিবশ করে তোলে। গ্রন্থে সন্নিবেশিত প্রতিটি লেখাতেই জীবনের এমন টুকরো টুকরো ছবিগুলোকে দারুণ সাবলীলভাবে চিত্রায়িত করা হয়েছে আলোচ্য গ্রন্থে। যা পাঠককে ছুঁয়ে যায়, ভালোবাসা, বিরহ, প্রেম, প্রতারণা আর সন্তানবাৎসল্যের মতো বহুবিচিত্র সব বোধে আন্দোলিত করে, মুগ্ধ করে। এছাড়া গ্রন্থটির প্রতি পরতে ছড়িয়ে থাকতে দেখা যায় লেখকের রবীন্দ্রপ্রেম। রবীন্দ্রঘোরে আচ্ছন্ন লেখক সেটি লুকোনোর বিন্দুমাত্র চেষ্টা বইটিতে করেননি কিংবা চাননি। গ্রন্থপাঠে পাঠককে কোথাও হোঁচট খেতে হয় না, ধৈর্যচ্যুতি বা মনোযোগের ছন্দপতন ঘটে না, যা একজন শক্তিশালী লেখকের গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য।
জীবনের টুকরো ছবি
মাহবুবর রহমান,
প্রকাশক: দাঁড়কাক,
প্রচ্ছদ: সঞ্জীব পুরোহিত,
পরিবেশক: জ্ঞানকোষ;
পৃষ্টা সংখ্যা: ৮৮,
মূল্য: ২৫০ টাকা।