লেখার বিষয়টি যেমন তেমন হলেও কবিতা পড়া আমার একেবারেই মেজাজ মর্জি আর নিজস্ব ধ্যান ধারণার ওপর নির্ভরশীল। দেখা গেলো মর্জি হলে কেউ যদি খাঁটি গরুর দুধ, না কি গরুর খাঁটি দুধ, এমন অর্থহীন বাক্যব্যয় করেও একে কবিতা বলে দাবি করে, তবু আমি আগ্রহ নিয়ে পড়ছি। আবার কখনো শুধু মর্জির অভাবেই তুমুল প্রিয় ও আরাধ্য বিষ্ণু দে, হেলাল হাফিজ, সৈয়দ শামসুল হক, তসলিমা নাসরিনদের হেলায় দূরে সরিয়ে রাখছি। বোদ্ধারা অবশ্য বলেন, কাব্যরস না বুঝে কবিতা লেখা এমনকি পড়াও উচিত নয়। কিন্তু যে আমি কেবলই নিজের মর্জির মালিক, অনিয়মে সিদ্ধহস্ত, সে আমাকে এসব গুরুবাক্য বোঝায় কার সাধ্য! সুতরাং প্রথমেই বলি, আমি কবিতার কিছুই বুঝি না। আমার কাছে বেশিরভাগ কবিতাই কেবল ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র লাইন, কখনো বা শব্দের, কখনো আবার ভাবের ভালো লাগার ঝলকানি। ঠিক যেমন অন্ধকারে ক্যামেরার ফ্লাশ জ্বলে উঠলে চোখ ধাঁধিয়ে যায়, তেমনি না বুঝেই কবিতার ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সৌন্দর্য আমার চোখ ঝলসে দেয়। যাই হোক, এভাবেই বুঝে না বুঝে চলে আমার কবিতা পড়ার অভিযান।
তো সদ্য শেষ হওয়া মেলায় একদিন ঢুঁ মেরে কয়েকটা বই কিনেই দ্রুত পালালাম, যেন তেমন কারও সঙ্গে দেখা না হয়। ব্যাগে করে নিয়ে এলাম সুবর্ণ আদিত্যের কবিতার বই ‘গন্ধচুরি ও হাওয়া নিরঙ্গম’। ওর প্রথম বইটা পড়া থাকলেও দ্বিতীয় বইটি পড়া হয়নি। শুনেছি বেশ ভালো, কিন্তু সত্যি বলতে কেন যেন ফারদুন নামক সিরিজটির প্রতি আমার আগ্রহ জন্মায়নি। বিশ্বাস করুন এ জন্য আমি দায়ি না, দায়ি আমার বিভ্রান্তিকর মর্জি। তবে নামের মধ্যে কোথায় যেন সুরিয়ালিস্টিক ভাব থাকায় গন্ধচুরি নিয়ে আমার কৌতুহল ছিল। সেই কবে লালন বলেছেন, চিত্ত মন্দ তম অন্ধ নিরঙ্গম রবে না রে। সে কারণেই বইটি কিনে পড়া। ভিষণ গরমের এক দুপুরে বসেছিলাম গন্ধচুরি নিয়ে। মলাট পেরিয়ে কৌতূহলোদ্দীপক সব কবিতার শিরোনাম। চলো তবে শুরু করি শেষের নামে।
কবিকণ্ঠে স্বৈরাচারবিরোধী কবিতার আসরে নাকি সভাপতি করা হয়েছে হিটলারকে। মাইক্রোফোন নিজের হাতে নিয়ে তিনি যখন বললেন, এই আসরের প্রধান কবি কে? সমবেত কবিগণ সমস্বরে বলে উঠলেন, মহামহিম আপনি। বাহ, বেশ মুগ্ধ হলাম কবিতাটি পড়ে। এবার চলো পেছন দিকে আগাই। শান্তিচুক্তি, আগুন, বাবা, স্বর্গ থেকে আসে প্রেম, গন্ধচুরি কখনো ভালো লাগে আবার লাগে না। তবে মাঝে মধ্যেই কিছু কিছু লাইনে সেই তীব্র আলোর ঝলকানি লেগে সাময়িক অন্ধ হয়ে যাই। মনে হয় সেই সব অসাধারণ লাইন জুড়েই তো আরেকটা সুন্দর কবিতা লেখা যায়। ভাবি, দেখা হলে একদিন কবিকে তার কবিতার ভেতরের কবিতা দেখতে দিয়ে জানতে চাইবো আকারে ইঙ্গিতে কোথাও কোনো নতুন সূত্র আছে কি না।
আমার অর্ধশিক্ষিত মগজ হুজুগে উৎসুক, পর্নোগ্রাফিতে পোক্ত। খবরের কাগজে আইন আদালত খুন খারাবি নধর দেহের পাতা পড়া শহুরে বিকৃত মন। আমার কি সাধ্য আমি মানুষ বুঝি? আসলেই আমি মানুষ বুঝি না। কেবল অমলিন অস্বস্তিটুকু বোধগম্য। সুবর্ণ আদিত্য আপনি কি বোঝেন?
লাইনগুলো কি খানিকটা এরকম হতে পারে, আমি ফুল আর তুমি একটা পক্ষাঘাতগ্রস্ত দশমিক। তুমি ফুরালেই বন, অথচ ডানা নেই এমন এক পাখির দুঃখ বয়ে বেড়ায় গাছ। এভাবেই ধানের নামতার ভেতর কান্না করছে একটি পাজামা, অনাগত ফসল, বিস্তীর্ণ ক্ষেত, রোদে পোড়া ঘ্রাণ। তবু জেনে রেখ যুদ্ধের চেয়ে মাতৃদুগ্ধ পান জরুরি, সুখের চেয়ে শান্তি শ্রেয়তর। কারণ ঈশ্বর আমাকে ডেকে বলেছিল, ভালোবাসা ছাড়া পৃথিবীতে আর কোন ভয়ঙ্কর অস্ত্র নেই। তাই চলো ভরপুর বেঁচে থাকি একে অন্যের ভেতর।
আরও পড়ুন: লাল রাত্রির গান: কবিতায় আত্ম-অনুসন্ধান ॥ রাকিবুল রকি
বইটি পড়তে পড়তে কখনো আমার মনে হয়েছে ঠিক এভাবে না হলেও পারতো। অন্তত আমি হলে স্বর্গ থেকে আসে প্রেম বা গন্ধচুরি ও হাওয়া নিরঙ্গম অন্যভাবে পাল্টে দিতাম। আবার দুই নম্বরে যখন পানশালায় মাথা গলিয়ে হাত বলছে বোতল ছোঁবে না, জিহ্বা বলছে স্বাদ নিতে সেখানে আমি গ্লাসটা ভরে নিয়ে তাতে দুদণ্ড বরফ ফেলে নিজের মতো করে আর কাউকে দেখতে চাইতাম। না সেখানে থাকতো আমার সঙ্গে রবীন্দ্রনাথ বা শেখ মুজিব। না আসতে দিতাম ম্যারাডোনা হোমার সক্রেটিস বা চে গুয়েভারাকে। এ হলো কবির চিন্তার সঙ্গে পাঠকের কল্পনার ডুয়েল। আবার একে আমার মতো নির্বোধ পাঠকের তষ্করবৃত্তিও বলা যায়, যেখানে কবির গলায় ছুরি ধরে তাকে তার ভাষাতেই বলা, সব চারারই সমান যত্ন আদর ও পরচর্যার পাশাপাশি উপড়ে ফললাম আগাছা। আমার ঔদ্ধত্যে কবির রাগ হতে পারে, জন্ম নিতে পারে নিছক করুনা। কিন্তু সত্যি করার কিছু নেই। বন্দুককে সন্দেহ করলে গুলি যেমন আসবেই, তেমনি কবিতায় আমার ওপর ভরসা রাখলে বিতিকিচ্ছিরি একটা অবস্থা দাঁড়াবেই।
তবু বলে রাখি, সত্যিই বেহুলাবাংলা ‘গন্ধচুরি ও হাওয়া নিরঙ্গম’-এর মতো ভালো একটি বই প্রকাশ করেছে। অন্তত পড়ে যেমন আরাম পেয়েছি, তেমনি পেয়েছি ভাবনার খোরাকও। কখনো আবার কবিতার নাম অনুযায়ী ভেতরটা পড়ে হতাশ হয়েছি কিন্তু বিরক্ত না। স্বর্ণময়ূর, মধ্যরাতের কবিতা, সেপটিপিন আলো দুর্দান্ত হয়েছে। মানুষ কবিতাটি পড়ে কতক্ষণ ক্ষান্ত হয়ে চিন্তা করেছি কী ভাবা যায়। তারপর বইটা পাশে রেখে তুমুল গরমে ঘামতে ঘামতে ভেবেছি এবার না হয় থাক। কারণ আমাকে দিয়ে হবে না। আমার অর্ধশিক্ষিত মগজ হুজুগে উৎসুক, পর্নোগ্রাফিতে পোক্ত। খবরের কাগজে আইন আদালত খুন খারাবি নধর দেহের পাতা পড়া শহুরে বিকৃত মন। আমার কি সাধ্য আমি মানুষ বুঝি? আসলেই আমি মানুষ বুঝি না। কেবল অমলিন অস্বস্তিটুকু বোধগম্য। সুবর্ণ আদিত্য আপনি কি বোঝেন?
আরও পড়ুন: বাইশ খান্দান: মানুষের পথ-গেরস্থি ॥ সুমন মজুমদার