মোবাইলের চার্জ এক পার্সেন্ট বাকি। নেট অফ করে পকেটে রেখে দিলাম। থম ধরা বিকেল। গাড়ি ছুটছে। বাড়ি ফিরতে কতক্ষণ লাগবে, জানি না। বাইরে মুখস্থ দৃশ্য, চির নতুন আকাশ। বাতাসের গোল্লাছুট। সিটে মাথা এলিয়ে দিলাম। প্রকৃতি থেকে চলন্ত নীল, সবুজ নিয়ে চোখে মাখি। যাত্রীদের পড়তে চেষ্টা করি। ক্লান্তি লাগে। টেনিস বলের মতো ছটফট করে মন। কোলে রাখা বইটি পৃষ্ঠা উল্টে পড়তে শুরু করলাম। প্রথম পৃষ্ঠা পড়ার পর মনে হলো, আমি জীবিকাক্লান্ত হয়ে বাসের সিটে বসে নেই। তপন দুর্গার সঙ্গে দাঁড়িয়ে আছি বাজারে। আমার চোখের সামনে একে একে ঘটে যাচ্ছে দৃশ্যের পর দৃশ্য।
গল্পকার শারমিন রহমানের ‘কাঁটাতারের দূরত্ব’ পাঠের অনুভূতি এটি। চৌদ্দটি গল্প নিয়ে প্রকাশিত হয়েছে এই লেখকের ‘কয়েদি নম্বর ৩৩২’। অনেকদিন ধরেই বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা, ছোটকাগজ, ওয়েবপোর্টালে নিয়মিত গল্প লিখে যাচ্ছেন তিনি। তার গল্পগুলো গ্রামবাংলার বৃহত্তর ক্যানভাসে রচিত। মানুষের জীবনের বিচিত্র অনুষঙ্গ, মনস্তত্ত্ব, স্বপ্ন, স্বপ্নভঙ্গের বেদনা, ধর্মীয় গোঁড়ামি, বিশেষ করে নারী জীবনের লাঞ্ছনা-বঞ্চনার আখ্যান এঁকেছেন তিনি।
‘কয়েদি নম্বর ৩৩২’ বইয়ের গল্পগুলোর ভাষা অত্যন্ত সাবলীল ও সুললিত। ছোট ছোট বাক্যে এগিয়ে যায় তার গল্প। পড়তে পড়তে চোখে ভেসে ওঠে দৃশ্যাবলি। চলুন, বইয়ের যেকোনো এক জায়গা থেকে একটু পড়ি, ‘ধোঁয়া ওঠা গরম ভাত, প্লেটে প্লেটে সাজানো ভাজা ইলিশ, বেগুনভাজি, বোঁটাসহ শুকনো মরিচ। ইলিশ- বেগুন ভাজা থেকে যেন চুইয়ে চুইয়ে পড়ছে। কাচের আলমারির ভেতরে অ্যালুমিনিয়ামের বড় ডিশগুলোর একটিতে রয়েছে ইলিশের ডিমভাজা, অন্যটিতে রয়েছে বড় পাঙ্গাশের টুকরো, টমোটো আর ধনেপাতা দিয়ে মাখোমাখো ঝোল। আছে গলদা চিংড়ি, পাবদা। আস্ত ইলিশ ভাজা। আর আছে নানা পদের ভর্তা। মাওয়া ঘটা, পাড়ঘেঁষে থাকা হোটেলগুলো থেকে ইলিশ আর শুকনো মরিচের ঘ্রাণ ছড়িয়ে পড়েছে চারপাশে।’ [মাতবরচর] উদ্ধৃতাংশটুকু পড়ার পর দর্শনেন্দ্রিয়, শ্রবণেন্দ্রিয়র পাশাপাশি ঘ্রাণ-ইন্দ্রিয়ও সজাগ হয়ে ওঠে।
তাই গল্পের শেষে ফুলবানুর উপলব্ধি হয়, এইসব বিবেক-বুদ্ধি সম্পন্ন পুরুষ-পশুর চেয়ে তার আলাভোলা স্বামী, যে স্ত্রীর সেঙ্গ নিবিড় মুহূর্তের কথাও অন্যের কাছে খুব সহজেই বলে দেয়, যার জন্য ফুলবানু বা ফুলবানুর কন্যা পদে পদে মানুষের তিরস্কার শোনে, সে অনেক ভালো।
‘কাঁটাতারের দূরত্ব’ গল্পের প্রসঙ্গে আবার ফিরে আসি। গল্পটি দেশ ছেড়ে আসার ক্ষত নিয়ে নিয়ে লেখা। দেশের পাশাপাশি সম্ভ্রম রেখে আসা তুলসী নতুন করে জীবন শুরু করে কলকাতার হাসনাবাদ রেলস্টেশনের ঘুপচি ঘরে, বস্তিতে। নতুন ঠিকানায় তুলসী বুকে বয়ে বেড়ায় দেশের জন্য ভালোবাসা, সম্ভ্রম ছিনিয়ে নেওয়া মানুষরূপী পশুদের জন্য ঘৃণা, ক্রোধ। নতুন ঠিকানায় তুলসী বয়ে বেড়ায় দুঃসহ জীবনের ভার।
দুর্গাপুজোর বিসর্জনের দিন ইছামতী নদীর এপার- ওপারের দূরত্ব ঘুচে যায়। তারপরও তুলসী কখনোই ভাসান দেখতে যায়নি। যায়নি প্রিয় স্বদেশের মাটির বুকে। এবার যখন সে দেখতে পায় এমপি ওসমান ভুঁইয়া পুজো উপলক্ষে দুদিনব্যাপী মেলার সব খরচ বহন করবেন, সবাইকে নিজ হাতে মিষ্টি বিতরণ করবেন, তখন তুলসীর সাধ জাগে ভাসান দেখতে যাওয়অর। কারণ ‘সেই ইছামতীর জল, সেই দুর্গাপুজো, জোছনা রাত যদি তুলসীকে তারকাঁটার দূরত্ব ঘুচিয়ে শোধ নেওয়ার সুযোগ করে দেয়, তাহলে সে কেন সে সুযোগ ছেড়ে দেবে? সবাই ঘুমিয়ে পড়লে, রাত গভীর হলে তুলসী শান দেওয়া দাটাকে প্রতিদিন বুকের মধ্যে জাগিয়ে রাখা ক্ষত থেকে চুইয়ে পড়া জ্বালা দিয়ে আরও শান দিতে থাকে। ’
‘সিরাজের সংসারে’ গল্প শুরু হয়েছে আসন্ন বর্ষায় কুমার নদীর অবস্থা বর্ণনা করে। নদীকেন্দ্রিক এই গ্রামের কয়েক লাইন বর্ণনা পড়ে গ্রাম নিয়ে আমাদের সুখস্মৃতি মনের কোণে তা উঁকি মারে। কিন্তু আমাদের ভুলে গেলে চলবে না লেখক বর্তমান সময়ে বসে এই গল্প লিখছেন। তাই এক স্তবক শেষ হওয়ার আগেই তিনি পরিচয় করিয়ে দেন শেফালী নামের এক জীবন সংগ্রামী নারীর সঙ্গে, যার স্বামী জীবিত ও কর্মক্ষম কিন্তু অলস-মাদকাসক্ত। তাই শেফালীকে চেয়ারম্যান বাড়িতে কাজ করতে হয়। মাতাল স্বামীর লাথি খেয়েও সন্তানের মুখে মাছ তুলে দেওয়ার জন্য গ্রামের সবার সঙ্গে নদীতে মাছ ধরতে যেতে হয়। শেফালীর এই কর্মমুখর পাথর জীবনেও একদিন বসন্তের বাতাস বয়। পাট কাটার মৌসুমে চেয়ারম্যান বাড়িতে কাজ করতে আসা শ্রমিক সুজিত প্রেমে পড়ে শেফালীর। শেফালীও এক সময় সুজিতের নির্মল কোমল প্রেমে ধরা দিতে বাধ্য হয়। স্বপ্ন দেখে সুজিতের সঙ্গে নতুন করে সুখের ঘর বাঁধার। সুজিতরা কাজ সেরে চলে যাওয়ার দিন শেফালীকেও নিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা করা হয়, যাতে শতভাগ সম্মতি থাকে শেফালীরও। কিন্তু সুজিতের সঙ্গে পাড়ি দেওয়ার আগেই সিরাজকে বেঁধে মাদকনিরাময় কেন্দ্রে নিয়ে যায় শেফালীর বাবাতুল্য চেয়ারম্যান। তবে সুজিতের সঙ্গে নতুন দিনের উদ্দেশ্যে পাড়ি দেওয়ার জন্য ঘর থেকে বেরোতে গিয়েও বেরোতে পারে না শেফালী। যে সিরাজ ঘরে থাকলেও হয়তো মাদকের নেশায় চুর হয়ে শেফালীকে বাধা দিতো না। কিন্তু অনুপস্থিত সিরাজের মায়াই শেফালীকে আটকে দেয়। মায়ার কাছে পরাস্ত শেফালীর সুজিতকে নিয়ে আর ঘর বাঁধা হয় না।
শারমিন রহমান অত্যন্ত নিপুণ হাতে নির্মাণ করেছেন গল্পের কাঠামো। পরিবেশ বর্ণনা ও সংলাপ রচনায় গল্পকার অত্যন্ত দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন। আঞ্চলিক সংলাপ গল্পকে করে তুলেছে আরও আকর্ষণীয়। একটু নমুনা দেখা যাক।
‘শেফালী, ও শেফালী!
কিডা? আলো বুজিনি? কী অইছে বুজি?
কী অইছে কসনি? তোরে বুলাইতে বুলাইতে আমার গলা ভাইঙ্গা গেল, আর তুই এহন কস বুজি কী অইছে? কানের মাতা খাইছসনি?
চেইতো না বুজি, চেইতো না… আমি হুনলে কি এহেনে বইস্যা থাহি কও? আমি হুনি নাই বুজি। তুমি বসো। এ রত্না তোর কাকিরে ফিড়াহান দে।
না রে না, বসবার আসি নাই। গাঙে যাব। গাঙে মাছ গাবাইছে। পাইলা ভইরা ভইরা মানুষ মাছ মারবার লাগছে। আমি হুনলাম কেবল। তাই তোরে খবরডা দিবার লাইগ্যা ডাকপালাগছি। নইলেতো আবার কইতি বুজি আমারে খবরডা কইলা না?
মাছ গাবাইছে? তুমি যাও আমি রত্নার বাপরে নিয়া আইতাছি।
হ, আমি গেলাম তাইলে তাগাদা আয়।
হ, আইতাছি যাও।’
ফলে শুরু থেকে শেষপর্যন্ত পাঠকের মনে এক ভালো লাগার রেশ থেকে যায়। শেফালী সংসারের শৃঙ্খল ভাঙতে না পারলেও কোনো অভিযোগ করতে ইচ্ছে করে না লেখকের বিরুদ্ধে। মনে হয় এই তো স্বাভাবিক। এই তো আমাদের সংসারের চিরয়াত রূপ।
‘ফুলবানু’ গল্পে গ্রামের এক অসহায়, অবলা ফুলবানু এই গল্পের মূল চরিত্র। সে মূলত প্রতিটি নারীরই প্রতীক। ঘরে-বাইরে নারীর সবচেয়ে বড় শত্রু পুরুষ। ফুলবানু বিভিন্ন সময়ে ঘরে-বাইরের পুরুষের হাতে যৌননির্যাতনের শিকার। তাই গল্পের শেষে ফুলবানুর উপলব্ধি হয়, এইসব বিবেক-বুদ্ধি সম্পন্ন পুরুষ-পশুর চেয়ে তার আলাভোলা স্বামী, যে স্ত্রীর সেঙ্গ নিবিড় মুহূর্তের কথাও অন্যের কাছে খুব সহজেই বলে দেয়, যার জন্য ফুলবানু বা ফুলবানুর কন্যা পদে পদে মানুষের তিরস্কার শোনে, সে অনেক ভালো। কারণ অন্য নারীর প্রতি তার কোনো লোভ নেই। ক্ষুধার্ত নেকড়ের মতো নারীর ওপর সে ঝাঁপিয়ে পড়ে না।
তার মনে হতে থাকে সে জেল থেকে মুক্তি পেলে আশ্রয়হীন হয়ে পড়বে। তার কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই। কারণ আতিক ও বকুলের মা বকুলকে পারুলের হত্যাকারী হিসেবে শনাক্ত করেছিল। তাই শেষপর্যন্ত বকুল জেলখানার ছোট্ট মুক্তি পাওয়া থেকে জীবন থেকে মুক্তির পথই বেছে নেয়।
‘কয়েদি নম্বর৩৩২’ গল্পটি গ্রামের একজন ভাগ্যবিড়ম্বিত নারীর আত্মকথন। বকুল অনেকদিন পর তার বাপের বাড়িতে নায়র আসে। বিয়ের পর তার স্বামী তাকে বাবার বাড়িতে আসতে নিষেধ করে দিয়েছিল। অনেক বছর চলে যাওয়ার পর যখন বকুলের স্বামী বকুলকে বাবার বাড়ি যাওয়ার কথা বলে, বকুল তখন খুশিতে আত্মহারা হয়ে যায়। কিন্তু বাড়ি এসেই বকুল হোঁচট খায়, যখন সে তার বাবার মুখে জানতে পারে, তার স্বামী আতিক কিছুদিন আগেই এ বাড়িতে এসে একসপ্তাহের মতো থেকে গেছে। যা বকুল জানতো না। তবে বকুলের জন্য আরও চমক বাকি ছিল। এক রাত পার হওয়ার আগেই বকুলের পৃথিবী এলোমেলো হয়ে যায়। ঘরের বাইরে ঝগড়ার শব্দ শুনে এসে দেখে ছোট বোন পারুল মায়ের পা ধরে কাঁদছে। আর মা তাকে বকেই যাচ্ছে। আতিকও সেখানে উপস্থিত। সে কখন এসেছে, বকুল তা জানতো না। কিছুক্ষণের মধ্যেই বকুল বুঝতে পারে এসব ঘটনার নেপথ্য কারণ। পারুলের বিয়ে হয়নি। কিন্তু সে সন্তানসম্ভবা। সে সন্তানের বাবা আর কেউ নয়, বকুলের বকুলেরই স্বামী আতিক। পারুল বকুলকে দেখে ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। দৌড়ে এসে বকুলকে এলোপাথাড়ি মারতে থাকে। কারণ পারুলের ধারণা, আতিক আর তার মিলনের মাঝে একমাত্র বাধা বকুল। বকুলের বাবা ও আতিক অনেক কষ্ট করেও পারুলের হাত থেকে বকুলকে উদ্ধার করতে পারে না। একপর্যায়ে বকুলের বাবা পারুলকে জোরে ধাক্কা দিলে পারুল কাঠের আলমারির ওপর গিয়ে আছড়ে পড়ে মারা যায়। এরপরই আমরা দেখতে পাই, পারুলের মৃত্যুর জন্য নির্দোষ বকুলকে পুলিশ ধরে নিয়ে যায়। বকুলের পনেরো বছরের জেল হয়। নির্ধারিত মেয়াদের আগেই ভালো আচরণের কারণে বকুলকে জেল থেকে মুক্তি দেওয়ার ঘোষণাও হয়। কিন্তু এই মুক্তি বকুলের কাছে হয়ে উঠে ভয়ঙ্কর। তার মনে হতে থাকে সে জেল থেকে মুক্তি পেলে আশ্রয়হীন হয়ে পড়বে। তার কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই। কারণ আতিক ও বকুলের মা বকুলকে পারুলের হত্যাকারী হিসেবে শনাক্ত করেছিল। তাই শেষপর্যন্ত বকুল জেলখানার ছোট্ট মুক্তি পাওয়া থেকে জীবন থেকে মুক্তির পথই বেছে নেয়।
সংলাপে আঞ্চলিক শব্দ ব্যবহারে দক্ষতা দেখিয়েছেন শারমিন রহমান। সমাজের নানা অসঙ্গতি প্রতিফলিত হয়েছে তার গল্পে। তবে শারমিন রহমান তা উচ্চকণ্ঠে প্রকাশ করেননি। শারমিন রহমানের গল্পগুলোতে প্রকৃতিও চরিত্রের ভূমিকা পালন করেছে। ফলে তার গল্প পাঠের সময় অন্যরকম একটা দ্যোতনা জাগে মনে।
‘কয়েদি নম্বর ৩৩২’ গ্রন্থের মধ্য দিয়ে শারমিন রহমানের যে যাত্রাশুরু হলো, সমস্ত কারাগার, সীমাবদ্ধতাকে ভেঙে প্রতিনিয়ত নিজেকে নবায়ন করে সেই যাত্রা বিস্তৃত করবেন নতুন নতুন পথে; এই প্রত্যাশা রইলো।
কয়েদি নম্বর ৩৩২
লেখক : শারমিন রহমান
প্রচ্ছদ : নির্ঝর নৈঃশব্দ্য
প্রকাশক : পেন্সিল পাবলিকেশনস
প্রকাশকাল: ফেব্রুয়ারি, ২০২০
মূল্য : ২৬০ টাকা