কাব্য-ভুবন নির্মাণের বড় আধার প্রেম। এই নিয়ামক ভর করে বলেই পঙ্ক্তির উদয় হতে থাকে মানবের মনে। মানস-বিভা উজ্জ্বলভাবে যারা শব্দে সওয়ার করতে পারে, তাদের কবি পদবাচ্যে অভিহিত করা অন্যায় হয় না মোটেও। কবিরা অন্তত পৃথিবীর তাবত প্রেমিক-প্রেমিকার প্রতিবেশী হয়ে বুকের রক্ত কবিতায় প্রতিস্থাপন করে পৃথিবীকে সুন্দর করেছে, মায়াময় করার প্রাণপণ শব্দসংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছে। যুগ পরম্পরায় এই সিলসিলায় ছেদ পড়েনি কখনো, কখনো বাসি হয়নি হৃদয়ের বিলোড়ন। মানুষকে মহান করার, মানুষকে কাছে টানার, মানুষকে দেবতার অধিক পূজনীয় করার এবং মানুষকে মানবিক করার এই আপাতকঠিন যুদ্ধে কবি জয়ী হয়েছেন শেষতক।
প্রযুক্তিবাহিত আধুনিককালে বসে গুহাবাসের সময়ে ফিরে গেলেও সুন্দরের জয়গান দেখতে পায় কবিকণ্ঠে, এখানে কবি সার্বভৌম সত্তা হয়ে নিজেকে জারি রাখে কালের পর কাল। যুগের ডাকে সাড়া দিয়ে যুগভেরী পুরনো হয়, বিজ্ঞানের আবিষ্কারের প্রয়োজনীয়তা ফুরিয়ে যায় আরেকটি আবিষ্কারের পরিপ্রেক্ষিতে অথচ প্রেমবিষয়ক কবিতা এবং প্রেমের সৌন্দর্য ম্লান হয় না এতটুক। এছাড়া এদেশের ভৌগলিক গঠন আর মানস-প্রকৃতি আমাদের ক্রমাগত প্রেমিক হিসেবেই চিহ্নিত করে, ফলে কবির সাধনার সর্বাঙ্গে জুড়ে থাকে প্রেমের জৌলুস। কবি তাপস চক্রবর্তী আগাগোড়াই প্রেমের কবি। অন্তত ‘কৃষ্ণবালিকা’র ছায়া-সমান্তরালে। প্রিয় পাঠক, শ্রী চক্রবর্তীর নাট্যকার, মঞ্চশিল্পী পরিচয় আপনার জানা থাকলেও অসুবিধে নেই, এক্ষণে কবি তাপস চক্রবর্তীর কবি অভিধার অনুকূলে আর্জি পেশ করা যেতে পারে।
পুতুপুতু প্রেমের কবিতা প্রায়ই দেখা যায় ফেসবুকের কল্যাণে, হয়তো কবিও জানেন দুর্বলতা, সেটা ঢাকতে গিয়ে পোজ দেওয়া একটা ছবিও জুড়ে দেন তিনি! ফেসবুকবাসী সমানে অভিনন্দন বার্তায় ভরিয়ে দেন কমেন্টবক্স। ব্যস, আর যায় কই, তিনি রীতিমতো সেলিব্রেটি! মূর্খ, গোয়ার, ঝানু; প্রত্যেকের অভিন্ন কমেন্টে আমরা বুঝে যাই, ওসব হাদিয়া কবিতাটি পায়নি, পেয়েছে ছবিখানা। মঞ্চের কঠিন রুচিতে গড়া তাপস চক্রবর্তী প্রেমের কবিতায় নিজেকে নতজানু রাখলেও তার প্রেম রুচিতে ভাস্বর, মহাভারত হয়ে সমকালের জাতকে স্থিত তার কবিতার রসদ। ফলে, আদিমতার সঙ্গে আধুনিকতার মিশ্রণে তুমুল একটা নির্যাস দিয়ে রাখেন কবি, যেখানে দৃশ্যমান হতে থাকে তার রাজনৈতিক ও বৌদ্ধিক খতিয়ানের বিষুবরেখা। ‘ব্রহ্মাণ্ডের উজ্জ্বল নক্ষত্রের কাব্যিক মুখরতার/ অবক্ষয়ের রাত পেরুতেই দেখি/ মার্কসীয় সূর্যোদয়।’ মুক্তির পিয়ানো হাতে কবির দৃঢ় উচ্চারণ পাঠককে চকিত ভাবিয়ে তোলে, এমন আকাঙ্ক্ষিত স্বপ্নের ছায়ায় হয়তো নিজেকে সঁপেও দেয়। আরেক কবিতায় কবি ইঙ্গিতে স্বপ্নের সামিয়ানা টাঙিয়ে দেয় পাঠকের দরবারে, ‘উঠেছে লাল পিপঁড়ের সারি/ বেদনায় ন্যুব্জ স্বদেশ-রক্তাক্ত মৃত্তিকা।’ এখানে হামেশাই মৃত্তিকা রক্তিম হয়, বাড়তে থাকে শোষণের শ্বাস।
অথচ কবির হৃদয় লাল পিঁপড়ের আগমনের প্রহর গুণে। লাল কিসের প্রতিক হে? কবি কঠিন বাস্তবতাকে মেনে নিয়ে কবিতার শেষে উচ্চারণ করেন, ‘অতএব স্বদেশ মানে/ বিত্তশালীর বিত্তের পাঠশালা।’ এরচে’ বড় সত্যের নাম আর কী হতে পারে! নির্বিকার এই সময়ে একজন কবিইবা এরচে বেশি আর কী বলতে পারে! মানুষ হওয়ার দীর্ঘ এবং ব্যর্থ মিছিলে প্রেমহীন সমাজের ছবি আঁকেন কবি এভাবেই, ‘হয়তো মানুষ নই বলে মিছিল চাইনি, স্লোগান চাইনি ব্যথিত বুকে।/ হয়তো অমানুষ বলেই মার খাচ্ছি মানুষের কাছ থেকে।’ মানবিক মানুষ গড়ার যে আর্তি শুরুতে উল্লেখ করি প্রাগুক্ত বাক্যদ্বয়ে তারই পুণরাবৃত্তি যেন কবি করে যান। তবে কোন দায়ে এমন উক্তি? কোন পেরেশানিতে কবি হাহাকার করে ওঠেন? মূলত প্রেমের সৌধ নির্মাণের যে স্বপ্নাঙ্ক্ষা তা বাস্তবতার মাটিতে দাঁড়িতে কবি বিকেচনা করেন এবং হতাশ হন। তবু তিনি নির্মাণ করতে থাকেন তার পথ, তার পরিক্রমা।
বৈশ্বিক ও দৈশিক নানা প্রভাবে মানুষের ভেতর ক্রমাগত বেড়ে চলছে ব্যবধানের চিহ্ন, ক্রমশ বিভিন্ন জাতি হয়ে পড়ছে অভিবাসী। বর্তমান সময়ে সবচে বড় ইস্যু হিসেবে অভিবাসী বর্গ বিশেষভাবে আলোচিত হলেও বাড়ছে এবং বেড়েই চলছে এর সংখ্যা, ফলত কবির মানবিক হৃদয় কেঁদে ওঠে, শব্দের অশ্রুপাতে কবিরা প্রার্থনা করেন মুক্তির নিশানা। কবি তাপস চক্রবর্তী নাফকে সিম্বল ধরে পুরো অভিবাসীবিশ্বকেই যেন চমকে দেন এই বলে, ‘অচেনা স্বদেশ উল্লাস করে মৃত নাফের সঙ্গমে/ হুতোমের গান স্তব্ধ তানপুরার সরগমে।’ যেখানে মানুষের বিজয় নিশ্চিত থাকে না, সেখানে কবিরা অসহায়, কবিতার শরীর বেয়ে নেমে আসে মানবিক প্রেম। তবু মানুষ যেনবা বেলাজ প্রাণী, কিছুই করার থাকে না তার, যেমনি কতিপয় কবি স্তাবকের ভূমিকায় লিখে নেয় নিজেদের কবিসত্তার মৃত্যু পরোয়ানা। সচেতন প্রয়াসে কবি খুঁজে নেন সেসব ইতিবৃত্ত, ‘মৃত্যুপুরীতে আজকাল গোলাপ খুঁজি না/ তোমাকেই খুঁজি নিরন্তর/ চলে যাওয়া পথ লাল ইটের পরতে পরতে/ আঁধারের নিয়ন আলো।… একলব্যের শব্দঋণে, হস্তিনার পরাক্রমে / আমি তুমি আমরা/ গোলাপের মতোই কুশীলব।’ অসাধারণ শব্দ-ভূমিকায় কবি তাপস চক্রবর্তী
সর্বসাম্প্রতিক স্বরগুলোকে চিহ্নিত করার প্রয়াস পান ইতিহাস ও পুরাণের সূত্র ধরে।
এখানে পাঠকের বিস্মিত হবার যথেষ্ট সুযোগ রাখেন কবি, ভাবনার বদ্ধ দরোজায় ক্রমাগত কড়া নাড়ার এক রকম অনুভূতি সঞ্চার করেন। বলা চলে, কবি-পাঠকের এই বিনিময় একান্তই বৌদ্ধিক, তথাকথিত ছেলেমানুষী নয় মোটেও।
‘যিশুর ক্রুশবিদ্ধ ছবি আমাকে বিহ্বল করে/ অথচ আন্দোলিত করে না কৃষ্ণের বংশীবাদন/ বারংবার কেঁদে ওঠে ভেসে ওঠে কুরুক্ষেত্রের মহারণ।…অথচ আমার নোমেন্সল্যান্ড/ করিডোর/ বাইবেল/ জংধরা কাঁটাতার/ ইদানিং ভীষণ তোলপাড় করে/ চিরচেনা রুদ্র বৈশাখে।’ পাঠক হয়তো হকচকিয়ে উঠবে, বলার সুযোগ পাবে, তাপস চক্রবর্তীর সুরের সঙ্গে মাখামাখি করতে থাকে প্রেম, এখানে? দৃষ্টিকে গভীরে নিলেই আমরা খেয়াল করবো, প্রাগুক্ত লাইনগুলোতে সময়ের বেদনাকে কবি ধরার চেষ্টা করেন ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বাক্যবন্ধে। কবি তো স্পস্টত বলে দেন, এখন সময় নয় ‘বংশীবাদন’র! তাহলে? বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর কান্নার রোলের সাথে বরং কুরুক্ষেত্রকে আবিষ্কার করেন কবি। অথচ আরেক কবিতায় কবি স্বজ্ঞানে ঘোষণা করেন, ‘বাহুর তলে কেশর ওঠা নতুন দিনের গান/ সেই গানটা আজও খুঁজি, যে এনেছে বান।/ স্বপ্নবাণের স্বপ্নতনু, স্বপ্নে শুধু খেলা/ রাধার মন বংশীমোহন আমি তাহার চেলা।’ বংশীমোহনের চেলা হবার গৌরব আছে, গর্ব করার উপলক্ষ থাকে নতুন দিনের আহ্বান। যে কবি আনতে পারে না স্বপ্নের রঙিন তাবির তিনি মৃত, যে কবি শব্দঘোরে পাঠককে পরিভ্রমণ করান বোধের জগতে তিনি সর্বসম্প্রসারিত।
কবিতায় দারুণ একটা গল্প না থাকলে পাঠকের ভাবনার জগৎটা প্রসারিত হতে পারে না, পায় না হাওয়া বদলের সুযোগ। সেই টোন কবি তাপস চক্রবর্তী জিঁইয়ে রাখেন ‘ফুল ও গল্প’ কবিতায়। নানা কথকতায় ভরপুর এই কবিতায় বাংলা কবিতার ষাটের দশকের একটা সুর পাওয়া যায় অথচ একেবারে শেষ স্তবকে এসে কবি চমকিত করেন এভাবে, ‘গল্পটা তোকে দিলাম/ ভোরের ফুল ভেবে আঁচলে জড়িয়ে নিস।/ ভালোবেসে/ দেখিস মান্দারফুল একদিন পারিজাত হবেই হবে/ অতঃপর স্বর্গচ্যুত হবেন ঈশ্বর।’ মান্দারফুলকে পারিজাত করার এই সাহস কেবল কবিরই থাকেন এবং সাহসের সমাচার করেন কবি; প্রেমের বিজয়ে ঈশ্বরকে স্বর্গচ্যুত করার মাধ্যমে ঈশ্বরের ঈশ্বরত্বকেই বড় করে তোলেস কবি। মহৎ কবির লক্ষণ নিয়ে শ্রী চক্রবর্তী স্বতঃস্ফূর্ত একটা স্বর তৈরি করেন ‘কৃষ্ণবালিকা’র শরীরজুড়েই।
নারীর পরিপ্রেক্ষিত নিয়ে কবির আশ্চর্যসুন্দর ভাবনার সমৃদ্ধ ভাণ্ডারে উপমার চমৎকার ঢং দৃশ্যায়িত করেন এভাবে, ‘তাই পৃথিবীর সমস্ত দোষগুলো/ পাপগুলো/ অভিমানগুলো/ একে একে ফল হোক, ফলতো নারীর ছবি।’ আহ্, এমন কথা তো কবিকেই মানায়, শব্দের এমন অধিকার আছে কেবল কবিরই!
‘কৃষ্ণবালিকা’ কাব্যগ্রন্থটির মূল সুর প্রেম হলেও সমকালীন রাজনীতি ও পুজের নহর বিধৃত করেন কবি। তাতে যোগ হয়েছে ধর্মান্ধতাকেন্দ্রিক নানা কুটিলতা, প্রযুক্তিসংশ্লেষ ও সমাজবাস্তবতা। উল্লেখ করা দরকার, কবি কবিতার শরীরকে নানা রূপের গৌরবদান করেছেন শব্দমায়ায়, ফলত নানা কৌণিক বিশ্লেষণের সুযোগ থেকেই যায় পাঠকের সামনে। মানুষের অমানুষ আর পুঁজির দাস হয়ে যাওয়ার পীড়া নিয়ে কবি লেখেন, ‘হয়তো মানুষ নই বলে মিছিল চাইনি, স্লোগান চাইনি ব্যথিত বুকে।/ হয়তো অমানুষ বলেই মার খাচ্ছি মানুষের কাছ থেকে।’ এই দীর্ঘশ্বাস শিল্পীমাত্রই বিরাজমান, এই ব্যথা গোপন চরকি হয়ে ঘুরে বেড়ায় কবির হৃদয়ে। তবু তাকে আশার বাণী শোনাতে হয়, দায় নিতে হয় মানবিক সমাজ-মানসে উসকে দেওয়ার। ‘বিধিনিষেধের উপনিষদ’ কবিতার এই প্রার্থনা তাই ছুঁয়ে যায় গণমানুষের হৃদয়, ‘কিম্বা তোমার বিজ্ঞান ছুঁয়ে যেতে পারে/ উপনিষদের সহস্র গণ্ডি/ ভাগবতের ষোড়শ অধ্যায়ের পরতে পরতে/ ছুঁয়ে যাওয়া মধ্যমা কনিষ্টা বৃদ্ধার অঞ্জলি।/ ক্রমান্বয়ে মহানন্দার মিলনক্ষেত্রে/ হাজার বিধি-নিষেধের পাটকল হয়ে উঠুক/ উর্বর বনভূমি।
কোনো কোনো কবিতায় শব্দমেদ ভর করছে ‘কৃষ্ণবালিকা’য়, অন্ত্যমিল দিতে গিয়ে কোথাও বা গতি হারিয়েছে শব্দস্রোত। পৌণঃপৌণিকতা আরেকটু আড়াল করা যেতো, হয়তো বা নতুন কোন কবিতাকিতাবে কবিকে আমরা আবিষ্কার করবো নতুন সুরে, নতুন স্বরে। উপনিষদকে সঙ্গে রেখে তার কবিতার ডানা ছড়িয়ে পড়বে সম্ভাব্য সব ক্ষেত্রে। সর্বময় আলোয় কবিতাকে আরো বেশি প্রোজ্জ্বল করতে হলে, মানুষকে নবতর পরিপ্রেক্ষিতে বিবেচনা, অনালোকিত পর্বে আরও বেশি ফোকাসড করতে হলে কবিকে হতে হয় অনুসন্ধানী। মঞ্চের আরাধনা আছে বলে কবি সেদিকটাও কবিতার ব্যঞ্জনায় প্রয়োগ করতে পারেন পরিমাণমতো। আবীর প্রকাশনীর ‘কৃষ্ণবালিকা’র প্রচ্ছদ করেছেন শিল্পী উত্তম সেন। আবেগের ঘোড়াকে চেপে ধরে কবি তাপস চক্রবর্তী তার কবিতাকে আরও বেশি মনের ওষুধ করে তুলবেন, এই বিশ্বাস আমাদের আছে, কারণ তিনি প্রেমিক!
কৃঞ্চবালিকা
তাপস চক্রবর্তী
গ্রন্থমেলা ২০১৯
আবির প্রকাশনি
প্রচ্ছদ, উত্তম সেন