কবি যিনি—নিজেকে ক্রমাগত ক্ষতবিক্ষত করে খোঁজেন শিল্পের রসদ, গড়ে তোলেন সংসার, তাঁর আত্মপ্রকাশ-আত্মউন্মোচনের প্রধান বৈশিষ্ট্য হওয়া উচিত—মৌনব্রত পালন। অর্থাৎ দৃশ্যত তিনি নীরব থাকবেন, তাঁর সব কাজ চলবে প্রায় লোকচোক্ষুর অন্তরালে। কবিতা রচনা মাত্রই তিনি পাঠকের সামনে উপস্থাপন করবেন না। একে কিছুদিন নিজের গুপ্তগৃহে রাখবেন, এরপর কিছুদিন নিজেই পড়বেন, পরিবর্তন-পরিমার্জন করবেন। এরপরই তিনি পাঠকের জন্য ওই কবিতার দ্বার-উন্মোচন করবেন। বলছি বটে, কিন্তু এমন কবির দেখা কি এখনো মেলে? হয়তো মেলে, হয়তো না। তেমনই একজন কবির নাম কাজী মোহিনী ইসলাম। সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে তাঁর তৃতীয় কাব্যগ্রন্থ ‘কিছু মৌনতা কিংবদন্তি হয়ে ওঠে’। এই বইয়ের কবিতাগুলোর প্রধান অনুষঙ্গ ব্যক্তির একাকীত্ব, সংসারযাপন, শিল্প, প্রেম, রাষ্ট্র ও সমাজ।
প্রবেশক কবিতাটির নাম ‘অলৌকিক রোদ’। শিরোনামেই লুকিয়ে আছে কবিতার আটআনা ব্যঞ্জনা, বাকিটা কবিতাজুড়ে। কবি তাঁর সমাজ-রাষ্ট্র ও উপস্থিতকালের মধ্যে প্রায় নৈরাশ্যের ছায়া দেখতে পান। তাতেই তিনি ব্যথিত হয়ে পড়েন। সান্ত্বনা খোঁজেন প্রকৃতির কাছে। দেখেন, ‘অসময়ে নামে রাত নগরীর নীরব শরীরে’। আর তখন তিনি খুঁজে পেতে চান—‘কফিনের নির্জনতায় মাটির কুসুম উষ্ণতা’। কিন্তু সেই উষ্ণতা তিনি পান না। কারণ সমাজ থেকে শুভবোধ হারিয়ে গেছে।সেখানে প্রাণের উচ্ছ্বলতা, ‘সূর্যের ঠিকানা’র সন্ধান মানুষ পেতে চাইলেও সহজে পায় না। তবু শুভবাদী মানুষ স্বপ্ন দেখে—‘কালের শিশির মাখা অলৌকিক রোদ’ ছুঁয়ে দেখার। এভাবেই চিত্রকল্প-উপমার আশ্রয়ে রচিত এ কবিতায়র ভেতর দিয়ে কবি পাঠককে পরিচয় করিয়ে একটি দুঃসময়ে সঙ্গে। যে সময়টা রাজনীতি, সমাজনীতি ও নৈতিকতার দিক থেকে প্রায় অন্ধকারমুখী, পতোন্মুখ।
জীবন সম্পর্কে রয়েছে এ কবির নিজস্ব-স্বচ্ছ ধারণা—সে জীবন কঠিন সংগ্রামের, সামাজিক বৈষম্যের। ফলে সামাজিক বৈষম্যকে অস্বীকার না করেই, এর সঙ্গে যথাসাধ্য সমন্বয় সাধন করে এর ভেতরই জীবন সাজানোর স্বপ্ন দেখেন কবি। ভোগের বিপরীতে তাই ত্যাগের মহিমা গান তিনি। ‘আমি কোনো দুঃখবিলাসী নই’ কবিতায় স্পষ্ট উচ্চারণ তাঁর—‘নিরন্তর দীর্ঘশ্বাসে উড়াব শূন্যতার শাদা পৃষ্ঠা’। তাঁর এই উচ্চারণ দুঃখবিলাসিতার বিপরীতে আত্মবিদ্রূপ-আত্মশাসন-আত্মশ্লেষে রূপান্তরিত।
কাজী মোহিনী ইসলাম কবিতায় প্রায় প্রবাদধর্মী পঙ্ক্তি রচনার চেষ্টা করেছেন। এসব পঙ্ক্তি মূল কবিতার ভাব-বিষয়কে আশ্রয় করে সৃষ্টি হলেও সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র বক্তব্যও প্রকাশ করে। সে রকম কয়েকটি পঙ্ক্তি তুলো ধরা হলো—
ক. দীর্ঘ জীবন শুধু মানুষের প্রয়োজনে স্থির, নির্বাক! (আমাকে ডেকো না)
খ. কিছু কাতরতা চিরকাল বয়ে আনে অভিশাপ (মিস করি সময়ের ট্রেন)
গ. ভ্রাম্যমাণ কষ্টগুলো রোজ আসে/ প্রাচীন পঙ্ক্তি হয়ে পবিত্র সীমানায় (বসে আছি তাৎপর্যহীন বিনয়ে)
ঘ. নাগরিক ড্রয়িংরুমে পেয়ে যায় টবের টুকরো জীবন! (বৃক্ষরাও গতির সাধনায় মগ্ন)
ঙ. প্রাচীন মুদ্রার মতো পতনের শেষ বিন্দুতে নির্জীব মানুষের স্রোত (যে আমাকে উর্ধ্বমুখী করে)
চ.তৃষ্ণার স্বরলিপি পাঠ করে গৌরবের স্থবির আকাশ…(কিছু মৌনতা কিংবদন্তি হয়ে ওঠে)
উদ্ধৃত পঙ্ক্তিগুলোয় যে বক্তব্য প্রকাশ করা হয়েছে, তাতে একদিকে ধরা পড়েছে উপস্থিতকালের দৃশ্য, অন্যদিকে চিরায়ত রূপ। কবির কাজ, উপস্থিতকালকে ভবিষ্যতের দিকে নিয়ে যাওয়া, অন্তত ভবিষ্যতের মানুষের জন্য একটি মাঙ্গলিক বার্তা বয়ে নিয়ে চলা। এজন্য তাঁকে উপমা-চিত্রকল্পের আশ্রয় নিতে হয়েছে। যাপিত জীবনের অভিজ্ঞতার সঙ্গে, প্রত্যাশিত সমাজব্যবস্থার যোগসূত্র স্থাপনও তাঁর সাধনার অংশ। এই পঙ্ক্তিগুলো একইসঙ্গে পাঠ করলে দেখা যাবে, কবি একটি বিশেষ সমযে বসে তাঁর সমাজ-রাষ্ট্র ও এর পারিপার্শ্বিকতাকে পর্যবেক্ষণ করেছেন। দেখেছেন, সমাজস্থ মানুষেরা কখনো কখনো কর্মের ভারে, ক্লান্তির অবসাদে মুহূর্তের জন্য থেমে যায়। কখনো কখনো মনে হয় জীবন বড় দীর্ঘ। তাই তারা স্থির-নির্বাক হতে চায়।
কবি কেবল কল্পনাপ্রবণ নন, আবেগের উদ্গাতা নন, মনীষারও আশ্রয়। ফলে আবেগ ও কাতরতাকে কবি যুক্তিহীনভাবে গ্রহণ করেন না। বিচার করে দেখেন জীবনের প্রয়োজনে এর গুরুত্ব কতটুকু? অনর্থক কাতরতার পক্ষে তিনি নন। কারণ তিনি জানেন ‘কিছু কাতরতা মানবজীবনে অভিশাপ’ বয়ে আনে। এজন্য তিনি সমাজ-রাষ্ট্রকে সতর্ক করে দেন। বলেন কাতরতাকে বিশেষভাবে পরিহার করতে।
এই বইয়ের বিপুল অংশজুড়ে রয়েছে একাকিত্বের যাতনা। কবিহৃদয়ে যে যন্ত্রণা বেজে ওঠে, তারই শিল্পিত রূপ দিয়েছেন কবি অক্ষরে-শব্দে-পঙ্ক্তিতে। একাকিত্বে সুর বেজে উঠেছে ‘বিন্দশালার দেয়ালে’ তাই বলে ওঠেন—‘জেগে আছে অমোঘ তর্জনী-ভাষার বিরল বিভাস’। তবে কবি হতাশাবাদী নন, তিনি আশাবাদী। থাকেন ‘অনিবার্য আগন্তুকের প্রতীক্ষায়’। বলেন—‘দুঃখের প্লাবন শেষে কার্তিকের ধানের মতো অনন্ত ঐশ্বর্য/ আমিও আজ সুনীল উদার’। ‘সুনীল উদার’ শব্দবন্ধে উপমা আশ্রয়ী চিত্রকল্পের মাধ্যমে কবি আকাশের বিশালত্বকে প্রকাশ করেছেন, কিন্তু আমাকাশকে আকাশ শব্দে পরিচিত করে তোলেননি। কারণ, আকাশ শব্দ বিশালতার প্রতীক হলেও, উদারতার প্রতীক সরাসরি নয়। অর্থাৎ ‘আকাশ’ বস্তুগত ও ভাবগত অর্থে উদারতার প্রতীক হলেও শব্দের ভেতর তার পরিচয় মেলে না, যেটুকু মেলে, সেটুকু মূলত বিশালতার। একারণেই কবি বিশালতা ও উদারতা একত্রে বোঝানোর জন্য ‘সুনীল উদার’ শব্দযুগল ব্যবহার করেছেন। এর ফলে সৃষ্টি হয়েছে নতুন ব্যঞ্জনা। একইসঙ্গে একাকিত্বের যাতনাও। একাকিত্ব ও নিঃসঙ্গতার চমৎকার শিল্পরূপ এঁকেছেন ‘নতুন আলোয়’কবিতায়। এটি একাব্যের একমাত্র নিরূপিত ছন্দে রচিত কবিতা। সমিল স্বরবৃত্তে রচিত হলেও অক্ষরবৃত্তের মতোই ধীর লয়ে পাঠ করা যায়। ধীরলয়ে পাঠ করলেই কবিতাটির মর্মমূলে প্রবেশ করা যায়। এ কবিতায় কবি বলছেন, একটি নতুন দিনের অপেক্ষায় রয়েছেন তিনি। প্রত্যাশিত বস্তু-ব্যক্তিকেই তিনি পেতে চান, প্রত্যাশিত ব্যক্তির অনুকম্পা কিংবা করুণা নয়।
একবিতায় তিনি আত্মজিজ্ঞাসাপীড়িত। নিজেকে প্রশ্নের বাণে জর্জরিতও করেছেন। বলেছেন,
যে অভিমান বুকের তলে লুকিয়ে আছে—চুপ
জানি না সে নতুন আলোয় বদলাবে কী রূপ
দিন আসে যায় বছর গড়ায় শতাব্দী হয় পার
জন্ম থেকে অপেক্ষমাণ মানুষ থাকে কার?
এই যে,‘জন্ম থেকে অপেক্ষমাণ মানুষ থাকে কার?’ বলে যে প্রশ্ন তুলেছেন কবি,এটি আসলে উত্তরশূন্য জবাব। কবি নিজেও জানেন, মানেন এ ধরনের প্রশ্ন কাউকেই করা যায় না, দীর্ঘপ্রতীক্ষারত মানুষ কেবল নিজেকেই করে এমন প্রশ্ন। উত্তর কেউ সাজিয়ে রাখে না, নিজের মনে নিজের মতো করেই এর উত্তর সাজাতে হয়। এতে স্বস্তি মেলে না, কিন্তু সান্ত্বনা-আত্মপ্রবোধ মেলে।
একাকিত্বের যাতনাকাতর আরও একটি কবিতার শিরোনাম ‘করতালিতে রুচি নেই’। এটি কেবল একাকিত্বের রূপায়ন নয়, একইসঙ্গে শিল্পের শুদ্ধরূপপ্রত্যাশীর ছবকও। উপস্থিতকালের অবক্ষয়, রাজনৈতিক দুবৃত্তায়ন, সামাজিক-নৈতিক বিচ্যুতির কালে কেবল ঠুনকো নীতিকথা শুনে মনকে প্রবোধ দেওয়ার ঘোর বিরোধী কবি। কেবল কোনো তুচ্ছকাজের জন্য লোকের বাহ্বাপ্রত্যাশীও নন তিনি।তিনি সদর্পে ঘোষণা করেন—
করতালিতে রুচি নেই আমার
নির্লজ্জ পঙ্ক্তির মতো করতালির শব্দকে মনে হয়
বর্বরের অন্যায় উচ্চারণ!
কবি দেখেন উপস্থিতকালে কিছু মানুষ প্রতারণা ও নিষ্ঠুরতার চূড়ান্ত রূপ দেখাচ্ছে। নিষ্ঠুর হিংস্র-ঠগ শ্রেণীর মানুষ অন্যকে ঠকিয়ে উল্লাসে ফেটে পড়লে যেমন সাধারণ মানুষ শিহরে ওঠে, তেমনি কোনো লোক দেখানো কাজের পর কেউ করতালি দিলে তখন কবির মনে হয়, ‘বর্বরের অন্যায় উচ্চারণ’। তাই কবি, এসব লোক দেখানো ভড়ঙ এড়িয়ে চলেন, নিজের জন্য বেছে নেন নিজস্ব নির্জনতা। বলেন, ‘মাটির স্বভাবে আছি বসে বন্ধ দরজার পাশে’।
শিল্প-শিল্প-সমাজ ও প্রেম যুগপথ বেশ কিছু কবিতার অনুষঙ্গ হয়ে উঠেছে। এসব কবিতায় বিষয়ের সঙ্গে চিত্রকল্প-উপমার যেমন সাজুয্য রয়েছে, তেমনি রয়েছে কবির দর্শনভাবনাও। ‘অজস্র কণ্ঠের বিশ্বস্ত উচ্চারণ’ শুনতে শুনতে কবি নিজেকেই প্রশ্ন করেন—‘বিত্তের বৈভবে কে রাখে পুষে চিত্তের শূন্যতা’? আবার প্রত্যয়ী জীবনবৃত্তে’ দেখি জীবন সম্পর্কে মিশ্র অনুভূতি প্রকাশ করছেন কবি। প্রত্যাশার সঙ্গে না পাওয়ার বেদনার সম্পর্ক স্থাপন করেন। বলেন, ‘চোখের আকাশজুড়ে তার উদাসীনতার ঘোর/ জমে থাকে প্রৌঢ় মেঘ অহেতুক…’। এই একটি চিত্রকল্পে কবি জীবনের সারাৎসার ফুটিয়ে তোলেন। প্রত্যাশার যে আকাশসমান বিস্তৃতি, তার সঙ্গে প্রাপ্তির সম্পর্ক খুবই ক্ষীন। তাই সে আকাশে প্রৌঢ়মেঘ অর্থাৎ প্রাণচাঞ্চল্যহীনতা এসে ভিড় করে। ফলে মানুষকে হতাশ হতেই হয়।
আবার প্রেমের কবিতায় মোহিনী ইসলামকে দেখি, গভীর অপেক্ষমাণ হিসেবে। ‘ফেরারি প্রেমিক’ কবিতায় নিজেকে সুর হিসেবে দেখান। একইসঙ্গে বিরহের গান জয়গান। থাকেন প্রেমিক পুরুষের অপেক্ষায়, বলেন, মাল্টিকালার আলোর জড়োয়া পরা পণ্যশালার মতো তুমিও কি ভুলে গেছ? চন্দ্রমুখী রাত আর সূর্যমুখী দিনের ব্যবধান?’ কবি তার প্রেমিক পুরুষকে সময় পরিবর্তন ও মানবমনের পরিবর্তনের মধ্যেকার যোগসূত্র মনে করিয়ে দেন। কিন্তু প্রেমিক পুরুষ অনেকটাই উদাসীন, তাই কবি পুনরায় আক্ষেপ করেন, বলেন, ‘তবে কার আমি কাজল বধূ?’ অর্থাৎ কবির সমস্ত আয়োজন একসময় ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। প্রেমিক পুরুষ তার বাসনার সারথী হয় না। প্রায় সমধর্মী অপেক্ষমাণতার গল্প রয়েছে ‘আঁধার হেঁটে চলে দ্বিধাহীন’, ‘অপরাহ্নের মায়াবী মুগ্ধতায়’, ‘জীবনের সূচিপত্রে তুমি’, ‘থেমে আছি ট্রাফিক সিগন্যালে’, ‘যে আমাকে উর্ধ্বমুখী করে’ ও ‘কিছু মৌনতা কিংবদন্তি হয়ে ওঠে’ কবিতায়। এসব কবিতায় কবি জীবনের নানা ঘটনা-দুর্ঘটনার ইঙ্গিত যেমন রেখেছেন, তেমনি বুনেছেন হৃদয় আবেগের সুক্ষ্মতম বিষয়ও। একইসঙ্গে নিজেকে করেছে প্রশ্নবিদ্ধ, প্রকাশ করেছেন বিস্ময়, ভাবিয়েছেন মানুষকে। কয়েকটি উদাহরণ দেওয়া যাক এবার:
ক.
রাতভর দেয়ালটি কাঁদছিল বুনো বাতাসে কাঁপছিল ক্যালেন্ডারের পাতাগুলো
একটি দেয়ালঘড়ি অবিরাম বুকে তার যন্ত্রণার সরল কাঁটা ঘুরাচ্ছিল
. টিকটিক…টিকটিক….টিকটিক
(আঁধার হেঁটে চলে দ্বিধাহীন)খ.
অমোঘ বিশ্বাসে তুমি আমি এক হলে
অন্তর্লোক বদলাবে কি বিপরীত গন্তব্য তোমার?
(অপরাহ্নের মায়াবী মুগ্ধতায়)গ.
কত কী কৌশলে শুধুই ঠকাতে চাও
যে আমি সংশয়হীন ঠকতে শিখেছি অনায়াসে
মানুষকে বিশ্বাস করে নিজেকে জেতাবো বলে
ঠকেছি বারবার মানুষেরই কাছে।
(থেমে আছি ট্রাফিক সিগন্যালে)ঘ.
পক্ষহীন বিপক্ষের আনন্দ-উত্থানে
দৃশ্য আর অদৃশ্যের মাঝে চলে অভিষেক আয়োজন
…
প্রাচীন মুদ্রার মতো পতনের শেষ বিন্দুতে নির্জীব মানুষের স্রোত
(যে আমাকে উর্ধ্বমুখী করে)ঙ.
অদৃশ্যে উড়ে যায় শাদা ঘোড়া এক থেকে অগণিত
শুদ্ধ চোখের লাল বিস্ময়ে ছড়ায় উষ্ণতা বিপুল বৈভবে
তবু এ কোন শূন্যতাবাদ দিগন্তময় সমস্ত প্রান্তরে?(কিছু মৌনতা কিংবদন্তি হয়ে ওঠে)
কবি বিশ্বাস করেন, চরাচরের বিপুল বৈভবের মাঝে শূন্যতার ধারণা আপেক্ষিক। মানুষ নিজের মনের ভেতরই সুখ-দুঃখের জগৎ সৃষ্টি করে। সেখানে আপন মনেই সে নিজেকে সুখী-দুঃখী রূপে প্রায় দেখতে ভালোবাসে। নিজে যেমনটি পছন্দ করে, অন্যকেও সেভাবে দেখতে চায় সে। এ কারণেই ক্যালেন্ডারের পাতাগুলো কাঁপার পরও সময়ের পরিবর্তন তাৎক্ষণিকভাবে ঘটে না, দুটি মন এক হলেও কারও গন্তব্য বদলায় না, হয়তো এ কারণে মানুষকে মানুষ বিশ্বাস করেও বারবার ঠকে। কখনো কখনো মানুষের পতন আসে প্রাচীন মুদ্রার মতো। তবু মানুষ বিপুল বৈভবের স্বপ্ন দেখে, চারিদিকে রয়েছেও বিপুল বৈভব। কেবল দেখার দৃষ্টি প্রয়োজন। তাই কবির প্রশ্ন—‘তবু এ কোন শূন্যতাবাদ দিগন্তময় সমস্ত প্রান্তরে’?
কাজী মোহিনী ইসলাম ছন্দসচেতন। শব্দ প্রয়োগ ও গঠনে তাঁর পরিমিতি বোধ রয়েছে। তবে পুরোকাব্যে তিনি একটি মাত্র কবিতা ‘নতুন আলোয়’ লিখেছেন স্বরবৃত্তে, বাকিসবই গদ্যছন্দে। কিন্তু এসব কবিতায় তিনি চারিয়ে দিয়েছেন প্রবহমান অন্ত্যমিলবিযুক্ত অক্ষরবৃত্তের চাল। এছাড়া, চিত্রকল্প-উপমা সৃষ্টিতে তাঁর সযত্ন প্রয়াস লক্ষণীয়। সমাজ-সংসারের প্রতি তিনি উদাসী নন। শিল্পের সঙ্গে যাপিত জীবনের যোগসূত্র স্থাপন করেন তিনি। তবে ব্যক্তিগত-পারিবারিক ইস্যুকে কবিতায় স্থান দেন না। এ ক্ষেত্রে রুচির আভিজাত্য রক্ষায় তাঁর সতর্ক প্রয়াস রয়েছে। ‘কিছু মৌনতা কিংবদন্তি হয়ে ওঠে’ কাব্যের সিংহভাগ কবিতায় এই কবি স্বপ্ন ও সংসারের সমন্বয়ের বিষয় স্পষ্ট। বিশেষত তাঁর স্বপ্ন এমন যে, তিনি সংসারের যাবতীয় কাজ করার সময়ও প্রতিটি কাজের মধ্যে কবিতাকে খুঁজে চলেন। একইসঙ্গে যে মমতা, কল্পনা ও গুরুত্বের সঙ্গে তিনি কবিতা সৃষ্টি করেন, একই প্রক্রিয়ায় তিনি সংসারের অন্যান্য কাজও সম্পন্ন করার স্বপ্ন দেখেন। তাঁর কাব্যচর্চার সততা, নিষ্ঠা নিরন্তর বহমান থাকলে কাব্যসিদ্ধি তাঁর জন্য সময়ের ব্যাপার মাত্র।
কিছু মৌনতা কিংবদন্তি হয়ে ওঠে
কাজী মোহিনী ইসলাম
প্রকাশক: নতুন দিন
পরিবেশক: নদী প্রকাশ
প্রচ্ছদ: রাজিব রায়
মূল্য: ১৪০ টাকা