বাংলা সাহিত্যে উপন্যাসের বহু বাঁক পরিবর্তন হয়েছে। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় থেকে শুরু করে বর্তমান সময় পর্যন্ত অনেক বাঁক সুস্পষ্টভাবে চিহ্নিত করা যাবে। একথাও ঠিক, সাহিত্যের সবচেয়ে জনপ্রিয় শাখা উপন্যাস। উপন্যাসের ভেতর ‘জনপ্রিয় উপন্যাস’ বলেও একটা বিশেষ ব্যাপার রয়েছে। সেটা সব দেশের সাহিত্যেই লক্ষণীয়। বাংলা সাহিত্যেও এর ব্যতিক্রম ঘটেনি। ফলে অনেক লেখকেরই মনোবাসনা থাকে নিজেকে জনপ্রিয় লেখক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে। কেউ সফল হন, কেউ হন না।
আবার অনেকেই জনপ্রিয় সাহিত্যকে তুচ্ছতাচ্ছিল্যসহ দূরে সরিয়ে রাখতে সাধ্যমতো প্রয়াস চালান। এসব আমাদের জানার ভেতরই আছে। কিন্তু সব জনপ্রিয় উপন্যাসই তুচ্ছতাচ্ছিল্যের শিকার হয় না, বরং অনেক বেশি আদরণীয় হয়েই কালোত্তীর্ণ হয়ে বেঁচে থাকে। এক্ষেত্রে একবাক্যে গ্যুস্তাব ফ্লবেয়ারের ‘মাদাম বোভারি’র কথা বলা যেতেই পারে। বাংলা সাহিত্যে মীর মশাররফ হোসেনের ‘বিষাদ-সিন্ধু’ এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ উদাহরণ হতে পারে। বাংলা উপন্যাসের বিষয়বস্তু সময় পরিক্রমায় বহুমাত্রিকতা লাভ করেছে। পারিবারিক উপন্যাস, সামাজিক, রাজনৈতিক, ইতিহাসধর্মী, ধর্মভিত্তিক—এরকম নানাবিধ বিষয়কেন্দ্র বাংলা উপন্যাসের সমৃদ্ধি ঘটেছে। বাংলা সাহিত্যে মীর মশাররফ হোসেনের ‘বিষাদ-সিন্ধু’ উপন্যাসটি ধর্ম-আশ্রিত উপন্যাস। প্রায় দেড় শত বছর আগে রচিত এই উপন্যাসটি এখনো পাঠকনন্দিত উপন্যাস হিসেবে গৃহীত।
কিন্তু জয়নব চরিত্র কি সত্যি বাস্তবে কেউ ছিল? যদি থেকেই থাকেন তাকে বিয়ে করার জন্য হাসান কেন প্রস্তাব পাঠালেন? তার তো আরও দুই জন স্ত্রী ছিলেন।
সম্প্রতি কথাসাহিত্যিক মোস্তফা কামালের উপন্যাস ‘কারাবালা উপাখ্যান’ পাঠ করেছি। এটিও ধর্মকে আশ্রয় করে রচিত। দুটি উপন্যাসের বিষয়বস্তু একই। ধর্মকে কেন্দ্র করে বাংলা সাহিত্যে অনেকেই উপন্যাস লিখেছেন। এম এ হাশেমের ‘আলোর পরশ’ একসময় ব্যাপক পাঠকনন্দিত হয়েছিল। এমনকি মোহাম্মদ নজিবর রহমানের ‘আনোয়ারা’ উপন্যাসের মূল উপজীব্য হিসেবে ধর্মকেই ব্যবহার করা হয়েছে। জাকির তালুকদারের ‘মুসলমানমঙ্গল’ও ধর্মআশ্রিত উপন্যাস। এগুলোর সবই ইসলাম ধর্মকে উপজীব্য করে রচিত। ধর্মকে আশ্রয় করে রচিত যে-কোনো সৃষ্টিই সহজেই পাঠকের আগ্রহে পরিণত হয়। জনপ্রিয়তা লাভের ক্ষেত্রে এটি একটি নেশাদ্রব্যের মতো কাজ করে। গুণগতমান শিল্পমূল্য বিচারে পাঠকের কোনো হুঁশ থাকে না। বোধহয় প্রয়োজনও মনে করে না। ফলে অনেক লেখকই জনপ্রিয় হওয়ার পন্থা হিসেবে এটিকে সানন্দচিত্তেই গ্রহণ করেন। আবার, এতে অনেক প্রতিভাবান লেখকের জীবনে হীতে বিপরীতও ঘটে। সহজ খ্যাতিলাভের পন্থা অবলম্বন করায় বিরাট সম্ভাবনা নষ্ট হয়।
এই নিবন্ধে যেহেতু মোস্তফা কামালের ‘কারবালা উপাখ্যান’ নিয়ে আলোকপাত করতে চাই, সেহেতু প্রসঙ্গক্রমে মীর মশাররফ হোসেনের ‘বিষাদ-সিন্ধু’ প্রসঙ্গটি চলে আসে। একই বিষয় নিয়ে বাংলা সাহিত্যে বহু উপন্যাস আছে। যেমন নদীকে কেন্দ্র করে অসংখ্য উপন্যাস আছে। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘পদ্মা নদীর মাঝি’ ও অদ্বৈত মল্লবর্মণের ‘তিতাস একটি নদীর নাম’—এর মতো বিখ্যাত উপন্যাস থাকতেও নদীকে কেন্দ্র করে অনেক লেখক উপন্যাস লিখেছেন। লিখতেই পারেন। কিন্তু কথা হচ্ছে নির্দিষ্ট একটি বিষয়ের ওপর লেখা বিভিন্ন উপন্যাস পাঠের সময় যখন একটি বা দুটি উপন্যাস বারবার মস্তিেেষ্কর কোষে কোষে প্রবহমান হতে থাকে, তখন বিষয়টি নিয়ে ভাবার প্রয়োজন আছে। ‘কারাবালা উপাখ্যান’ পাঠের সময় ‘বিষাদ-সিন্ধু’ আমার মস্তিষ্কের কোষে কোষে প্রবহমান স্রোতের মতো কথা বলেছে। এর কারণও স্পষ্ট, মীর মশাররফ হোসেনের জনপ্রিয়তা শতবর্ষের পরেও, এখনো আকাশচুম্বী। ‘বিষাদ-সিন্ধু’ রচনায় তিনি অপরিসীম দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন। এর কারণ, মুসলমানদের উগ্রতার পাশাপাশি সংস্কারচেতনা বিপুলভাবে তৎকালীন আর্থ-সামজিক পরিপ্রেক্ষিতে বজায় ছিল। তাঁদের নানারকম দ্বন্দ্ব বিরাট জটিলতা সৃষ্টি করে। তিনি ভাষার জোরে পাঠককে মন্ত্রমুগ্ধের মতো ধরে রাখতে পেরেছেন—পাঠকের ভাবনার সুযোগটি এখানে তিনি রাখেননি। একমাত্র মীর মশাররফ হোসেন নিজে মুসলমান হয়েও বাঙালিয়ানার বা জাতিতাত্ত্বিক বীক্ষায় নিজের আত্মপরিচয়ের সম্মানটি অর্জন করতে পেরেছিলেন। অসম্ভব উদার ও অসাম্প্রদায়িক চেতনায় সাহিত্যের পুরাতাত্ত্বিক দস্তুরটি তিনি চিনে নিতে পেরেছিলেন। সেজন্য ‘বিষাদ-সিন্ধু’র মতো মহাকাব্যিক উপন্যাস তিনি রচনা করতে পেরেছিলেন। আর তা জনপ্রিয়তারও তুঙ্গস্পর্শ লাভ করেছিল।
মোস্তফা কামালের ‘কারবালা উপাখ্যান’ এই সময়ে রচনা। ফলে ‘বিষাদ-সিন্ধু’ সহ এ ধরনের উপন্যাসগুলো তার পাঠের আয়ত্তে আছে, এটা অনুমান করা যেতেই পারে। নাও থাকতে পারে। তবে তিনি যে উপন্যাসটি লেখার ক্ষেত্রে বিশেষভাবে সচেতন ও সাবধান ছিলেন এবং ইতিহাসের সঙ্গেই থাকতে চেয়েছেন, তা অনুধাবনযোগ্য। বিষয়বস্তুতে তিনি নিরেট ইতিহাসকে আশ্রয় করেছেন, নিজের থেকে কোনো চরিত্র নির্মাণ করেননি। বিষয়বস্ততে পুরোটাই ইতিহাসে বিশ^স্ত থাকতে চেষ্টা করেছেন। এই ক্ষেত্রে তিনি কতটা মুন্সিয়ানা দেখাতে পেরেছেন, বা উপন্যাসটি কতটা সার্থকতা অর্জনে সক্ষম হয়েছে, সে বিবেচনা গুরুত্বপূর্ণ। কারণ কারবালার নির্মম-মর্মন্তুদ ইতিহাস মুসলমানদের কাছে অতি করুণ আবেগের বিষয়। এর ঘটনাবলি কম-বেশি সবার জানা। ফলে এ ধরনের চির-পরিচিত বিষয়কে কেন্দ্র করে উপন্যাস রচনা একরকম সাহসের ব্যাপার। মোস্তফা কামাল সেই সাহসটি দেখিয়েছেন। উপন্যাসে বিষয়বস্তুকে সাবলীলভাবে তিনি এগিয়ে নিয়ে গেছেন, কোনোরকম জটিলতা বা মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্ধ¦-সংঘাত ছাড়াই। পাঠককে ধরে রাখতেও তিনি যথেষ্ট সক্ষম হয়েছেন। ‘বিষাদ-সিন্ধু’তে আজর চরিত্রের মাধ্যমে যে অসাম্প্রদায়িক চেতনাকে প্রবলভাবে প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছিল, অবিশ^াস্য রূপাগ্নি জয়নবকে বিবাহিত দেখিয়ে মীর মশাররফ হোসেন তার দ্বিতীয় বিয়ে ঘিরে ব্যক্তিক যে লোভ-লালসা, নবীবংশ ধ্বংস এবং হাসানকে ভেজা পুটলির মাধ্যমে সূক্ষ্ম কৌশলে অতি সাবধানে বিষ খাওয়ানোর যে ব্যাপারটি ছিল, মোস্তফা কামাল তা সযত্নে এড়িয়ে গেছেন। তিনি ইতিহাসের সত্যনিষ্ঠ তথ্যকে পুঁজি করে ‘কারবালা উপাখ্যান’ লিখেছেন। ‘বিষাদ-সিন্ধ’ু উপন্যাসে যে অতিকথন ও অলৌকিতাকে আশ্রয় করা হয়েছে, মোস্তফা কামাল এক্ষত্রে সতর্ক থেকেছেন। তিনি ঔপন্যাসিক হয়েও এখানে নিজেকে নির্মোহ রাখতেই সচেষ্ট। বাস্তবের কাছে থেকেছেন। তিনি ইচ্ছে করলে নিজস্ব শিল্প-শক্তিমত্তায় ইতিহাসের বাইরে থেকেও চরিত্র সৃষ্টি করতে পারতেন। তা করেননি।
তিনি কাহিনিতে ইতিহাসে বিশ^স্ত থেকে চরিত্র নির্মাণ করেছেন। প্রত্যেকটি চরিত্র ইতিহাস থেকে গৃহীত। ইতিহাসে তাদের যে ভূমিকা জানা যায়, এখানেও তাদের সেভাবেই নির্মাণ করেছেন। তাদের চিনতে বা তাদের সম্পর্কে জানতে এতে করে বিশেষ সুবিধা হয়েছে। এই লেখক চরিত্রগুলোর সংলাপ নির্মাণে মুন্সিয়ানা দেখিয়েছেন। মনে রাখতে হবে, এই ইতিহাস আজকের নয়, দুই চার দশ বিশ বা এক দুই শ বছর আগেরও নয়। বহুকাল আগের। সেই সময়ের বিষয়কে ধারণ করে, সেই সময়ের চরিত্রের মুখে এই সময়ের ভাষা তুলে দেওয়া সহজসাধ্য নয়। কঠিন। অনেক কঠিন। এই কঠিন কাজটি তিনি দারুণ শিল্প-দক্ষতায় করতে পেরেছেন। সেটি একেবারেই সেই সময়ের বাস্তবের বুকে নিবিড়ভাবে বসে। হাসান-হোসেনের জীবনযাপন, ধর্মভীরুতা, সত্যনিষ্ঠতা—সবকিছুকে কেন্দ্র করে তাদের যে ছবি এঁকেছেন, তা খুবই সাধারণ একজন মুসলমানের মতোই। ছবিটা চোখে দেখা যায়। কিন্তু হাসান-হোসেন যেভাবে কথা বলেছেন, তা যেন এই সময়কালের। আমাদের এই দেশের বা এই বঙ্গের কোনো মানুষ। মনে হচ্ছে আমাদের সময়কালের কেউ কথা বলছেন। উপমা-প্রবাদগুলোও শুধু এই সময়েরই নয়, একেবারেই বাঙালির জীবনযাপনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে। কিন্তু জয়নব চরিত্র কি সত্যি বাস্তবে কেউ ছিল? যদি থেকেই থাকেন তাকে বিয়ে করার জন্য হাসান কেন প্রস্তাব পাঠালেন? তার তো আরও দুই জন স্ত্রী ছিলেন।
‘কারবালা উপাখ্যান’ এই সময়ের একটি গুরুত্বপূর্ণ শিল্প-সৃষ্টি। ইতিহাসে বিশ্বস্ত থেকে নিজের দেশের আবহাওয়া নদী-নালা-প্রবাদ-প্রতিম-অলংকার প্রয়োগ করে উপন্যাস রচনা করা বেশ মুশকিল আছে।
হাসান তো নিজেও জানতেন জয়নবকে বিয়ে করলে সমস্যা অবধারিত। সেটা হয়েছেও। নবীবংশের সঙ্গে ইয়াজিদের যে দ্বন্দ্ব-সংঘাত-হত্যাকাণ্ডের মূলে তো জয়নব একটি বড় ঘটনা, বলা যায় মূল ঘটনা। জয়নব কুমারি হয়েও সম্মানের লোভে বিবাহিত হাসানকে বিয়ে করেছেন। জয়নবও কি ভাবেননি হাসানকে বিয়ে করলে এর পরিণতি কতটা ভয়াবহ হতে পারে! কেউই ভাবেনি। এতে দূরদর্শিতার অভাব ঘটেছে এবং খুবই সাধারণ মানের ব্যক্তিত্বে পরিণত হয়েছেন। এদের মধ্যে আত্মদংশন—আত্মসমালোচনাও তৈরি হয়নি। উপন্যাসে লক্ষ্য করা যায় নি। লেখক নিজেও তা সৃষ্টি করেননি। কারণ লেখক বোধহয় চেয়েছেন, চরিত্রগুলো যে-রকম আছে, সে-রকমই থাকুক। সত্যিকার অর্থেই এসব চরিত্রে বাস্তবানুগ কোনো শক্তিমত্তা নেই। হোসেনের চরিত্র নির্মাণে লেখক যে দক্ষতা দেখিয়েছেন, তা প্রশংসনীয়। তিনি ইতিহাসের বৃত্ত থেকে বের হয়ে এসে নিজের শিল্পকল্প শক্তিকে ব্যবহার করেছেন। এতে হোসেনের চরিত্রে দৃঢ়তা সৃষ্টি হয়েছে। মুয়াবিয়া ও ইয়াজিদ চরিত্র নির্মাণে লেখকের মুন্সিয়ানা আছে। বিশেষ করে মুয়াবিয়া চরিত্রে। ইয়াজিদ চরিত্রে ক্ষমতালোভী ও চরিত্রহীন বিষয়টি উঠে এসেছে ভালোভাবেই। কিন্তু যে-জয়নবের জন্যে তার এত প্রেম এই প্রমত্ততা—এত ধ্বংসযজ্ঞ সৃষ্টি—পরবর্তী সময়ে তা লক্ষ করা যায়নি। বরং শিমার চরিত্রটি একেবারেই বাস্তবসম্মত হয়েছে। এই চরিত্রটিই বেশি সার্থকতা লাভ করেছে। তার ভেতরের যে কুটিলতা ও লোভ—তা চমৎকারভাবে উপস্থাপিত হয়েছে। মায়মুনার কুটিল চরিত্র পাঠকের সামনে জীবন্ত হয়ে উঠেছে। কিন্তু জায়েদা চরিত্র শেষ পরিণতি পায়নি। এক্ষেত্রে প্রশ্ন থাকতেই পারে, শেষপর্যন্ত জায়েদার পরিণতি কী হয়েছিল! এভাবে প্রত্যেকটি চরিত্র ধরে ধরে বিশ্লেষণ করা গেলে, অনেক চরিত্র নির্মাণেই তিনি সার্থকতা দেখাতে পেরেছেন তা নির্ণীত হবে।
মোস্তফা কামাল ‘কারবাল উপাখ্যানে’ চমৎকারভাবে সেই সময়কালের অর্থনৈতিক ও সামাজিক অবস্থা তুলে ধরেছেন। অর্থ যে চিরকালই সমাজ-রাষ্ট্রকে নিয়ন্ত্রণ করে, এখানেও এর ব্যতিক্রম ঘটেনি। বহু ধ্বংসযজ্ঞের মূলেও যে রূপশ্রীর নারী থাকে, সেই সত্য এখানেও প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। রূপশ্রী নারীর জন্য রাজা-বাদশা থেকে শুরু করে বহু মহারথি যেমন কাতর-পানিপ্রার্থী হয়ে জীবন ও রাজ্য ধ্বংস করেছেন, প্রবল ধর্মপ্রাণ মুসলমান হাসানও সেই লোভ থেকে মুক্ত হতে পারেননি, একইভাবে ব্যর্থতার বিষজ¦ালায় প্রতিশোধ-গ্রহণে কঠিন নির্মম পন্থা গ্রহণে বিন্দুমাত্র দ্বিধা করেনি ইয়াজিদ। এসব অসাধারণ বাক্সময় রূপ পেয়েছে গ্রন্থটিতে। তবে একথা ঠিক, মাইকেল মধুসূদন দত্তের ‘মেঘনাদবধ কাব্যে’র রাম লক্ষণ যেমন দেবতানির্ভর, এখানে হাসান-হোসেনও সেরূপই। অদৃষ্ট এক মহাবাণীকে ধারণ করেই নিজেরা মৃত্যুর জন্য তৈরি হয়েছিলেন। নিজেরা ভাগ্য অতিক্রমের কোনোরূপ চেষ্টাই করেননি। সর্বক্ষেত্রেই নির্জীব চরিত্রের মানুষ হয়ে থেকেছেন, শেষের যুদ্ধটুকু ব্যতিত। সফোক্লিসের ‘ইডিপাস’ও ভাগ্যনিয়ন্ত্রিত বিশ্বকাঁপানো ট্র্যাজেডি নাটক। সেখানে ইডিপাস যখন বুঝতে পেরেছিল, সে ভাগ্যের কাছে বন্দি, তখনো সে ভাগ্যকে অতিক্রম করার চেষ্টা করেছে। যদিও সফলকাম হয়নি। ওই চেষ্টার কারণেই ইডিপাসের বিখ্যাত হয়ে ওঠা এবং সে যে রক্ত-মাংসের দৃঢ়চেতা দায়িত্বশীল মানুষ—তা প্রমাণিত হয়। ‘কারবালার উপাখ্যানে’র হাসান-হোসেনের ভেতর সেই দৃঢ়চেতা রক্তমাংসের মানুষ অনুপস্থিত। ভাগ্যকে বরণ করে মৃত্যুকেই মেনে নিতে প্রস্তুত থেকেছেন।
‘মেঘনাদবধ কাব্যে’র রাম-লক্ষণের মতোই নিয়তিনির্ভর। লেখক নিজেও হাসান-হোসেন চরিত্র নির্মাণে সেই নির্জীবতাকেই গ্রহণ করেছেন। মোস্তফা কামালের ‘কারবালার উপাখ্যানে’ সবচয়ে বড় কৃতিত্ব ভাষাশৈলিতে। গ্রন্থটি পাঠের সময় মনে হয়েছে এটা আমাদের মাটি-আলো-বাতাসেই গড়ে উঠেছে। ঐতিহাসিক নাম আর স্থানগুলোর নাম বাদ দিলে মনে হবে এটা আমাদেরই বঙ্গভূমির কোনো ঘটনা। যেমন—কাটছাঁট, ঝিমমেরে, ঘোট পাকানো, ঘোলা জলে মাছ শিকার, বিট্রে, গুল মারছ; এরকম অনেক শব্দ ব্যবহার করে তিনি কৃতিত্ব দেখিয়েছেন। তিনি চরিত্র ও স্থান ব্যবহারে ইতিহাসে বিশ্বস্ত থাকলেও কাহিনিতে শিল্পরূপ দিতে পুরোটাই বাঙালির জীবনের প্রতিদিনের শব্দমালা ও পরিবেশকেই গ্রহণ করে দেশপ্রেমেরর দারুণ পরিচয় রেখেছেন। এ গ্রন্থে কথার ছলে অনেক দর্শনের কথা আছে। যেমন ‘কয়েকজন লোক চলছে। তাদের সঙ্গে মৃত্যু চলছে।’ কী অসাধারণ দক্ষতায় তিনি কথাটি বলে ফেললেন। মানুষের জীবনের চিরসত্য অমোঘ বাক্যটি কী অসাধারণ শিল্প-সুষমায় ব্যবহার করেছেন। অথচ তিনি সহজেই ব্যবহার করতে পারতেন, ‘ভাগ্যের লিখন না যায় খণ্ডন।’ কিন্তু তিনি তা না করে তাঁর ক্ষুরধার শিল্পমেধার স্বাক্ষরটি রেখে গেলেন এই বাক্যের ভেতর।
‘কারবালা উপাখ্যান’ এই সময়ের একটি গুরুত্বপূর্ণ শিল্প-সৃষ্টি। ইতিহাসে বিশ্বস্ত থেকে নিজের দেশের আবহাওয়া নদী-নালা-প্রবাদ-প্রতিম-অলংকার প্রয়োগ করে উপন্যাস রচনা করা বেশ মুশকিল আছে। সেই কঠিনকে জয় করার প্রয়াস লক্ষণীয় এই গ্রন্থে। এটি গুরুত্বপূর্ণ একটি উপন্যাস হিসেবে বিবেচিত হওয়ার সব যোগ্যতাই আছে।