কবি সাইফুল্লাহ মাহমুদ দুলাল মাঝে-মধ্যে গদ্য লিখেন বলে জানতাম কিন্তু তিনি যে এমন ঢাউস সাইজের একটি গদ্যগ্রন্থ রচনা করেছেন তা জানাই হতো না, যদি না পাঁচ’শ মাইল ড্রাইভ করে নিউইয়র্ক থেকে টরন্টো এসে হাজির হতাম। ২০১৩ সালের আগস্ট মাসে সপরিবারে এক লম্বা ড্রাইভে বেরিয়ে পড়ি। টরন্টো পৌঁছে ফেইসবুকে ম্যাসেজ দেই, ‘দুলাল ভাই, আমি এখন টরন্টো, আপনার ফোন নম্বর দেন।’ মুহূর্তের মধ্যে ফোন নম্বর পেয়ে যাই। তিনি বিস্মিত, আনন্দিত এবং উচ্ছ্বসিত। প্রথমে হোটেলে, পরে বন্ধু রাকিবের বাসায় উঠলেও দুলাল ভাই নাছোড়বান্দা, তার ওখানে যেতেই হবে। সংক্ষিপ্ত সফরে আত্মীয়-বন্ধু সবার সঙ্গে দেখা করা প্রায়ই হয়ে ওঠে না। আমি স্ত্রীকে বললাম, আর কোথাও না গেলেও আমি কবি সাইফুল্লাহ মাহমুদ দুলালের সঙ্গে দেখা না করে টরন্টো থেকে ফিরছি না। আমার অনড় অবস্থানের কারণ তিনি বুঝতে পেরেছেন। তিনি জানেন, আমি প্রায়ই বলি, পৃথিবীর সকল কবি একটি গ্রামের মানুষ, সেই গ্রামের নাম কবিতাগ্রাম। একজন বাঙালি কবির কাছে এই দূরদেশে আরেকজন বাঙালি কবির চেয়ে আপনজন আর কে আছে?
ভাবী খুবই অতিথিপরায়ণ মানুষ। তিনি মাঝে-মাঝে ঢাকার বইমেলায়ও খাবার রান্না করে নিয়ে যেতেন আমাদের জন্য। মাঘের পড়ন্ত বিকেলের সোনাঝরা রোদে মেলার মাঠে বসে খেয়েছি ভাবীর রান্না করা নুডুলস। আমাদের দুর্ভাগ্য, ভাবী নেই। এখন রাত নয়টা বাজে। তিনি এখনো কাজে। দুলাল ভাই কথা বলতে বলতে মাঝে মাঝে খুব আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েন। হঠাৎ তিনি আমার স্ত্রীকে বলেন, মুক্তি, তুমি কি জানো, জহির যে বাংলাদেশের যেকোনো মন্ত্রীর চেয়ে অনেক বেশি জনপ্রিয়? আমি বলি, দুলাল ভাই, বাদ দেন। দুলাল ভাই বাদ দেন না, বলতেই থাকেন। তিনি এক পর্যায়ে আমার হাতে এই বইটি তুলে দেন, ‘কানাডা যাবেন কেন যাবেন।’ সত্যি কথা বলতে কি গ্রন্থের নামটি আমার মোটেও পছন্দ হয়নি। কেমন জানি, ‘কত অজানা রে’ টাইপের নাম। মনে হচ্ছিল কানাডা সংক্রান্ত একটি সাধারণ জ্ঞানের বই। সাধারণ জ্ঞানে আমার আগ্রহ নেই, আমার আগ্রহ অসাধারণ জ্ঞানে, যা আমি কবিতায় খুঁজে পাই।
গ্রন্থটি গত দুই বছর পড়ে ছিল। পড়া হয়নি। কাল রাতে হঠাৎ শেলফ গোছাতে গিয়ে বইটি চোখে পড়ে। পড়তে পড়তে ক্রমশ এই ঢাউস গ্রন্থটির গভীরে ডুবে যাই। ২৯৫ পৃষ্ঠার গ্রন্থটি ৪০টি অধ্যায়ে বিভক্ত। এই অধ্যায়গুলোয় সমন্বয় ঘটেছে ভ্রমণ, প্রবন্ধ, সাহিত্যালোচনা, কানাডার ইতিহাস, রাজনীতি এবং সমাজনীতি। লেখক যেন অনুবীক্ষণ যন্ত্র হাতে নিয়ে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখেছেন এই সুবৃহৎ দেশটির রাজনৈতিক ইতিহাস, এর প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, অতিসভ্য এবং নৈতিক সামাজিক অবকাঠামোর আড়ালে ঘটে যাওয়া সুক্ষ্ণ বৈষম্যসমূহ যার শিকার অ-শাদা অভিবাসীরা। ক্ষণে-ক্ষণে তুলনা করেছেন তার মাতৃভূমি বাংলাদেশের সঙ্গে। কবি ডিএল রায়ের সেই চিরচেনা গান, ‘এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি’র উদ্ধৃতি টেনে আমাদের অজ্ঞতার উদাহরণ দিয়েছেন। ভূস্বর্গ বলে স্বীকৃত কানাডার ভ্যাঙ্কুবারের কথা বলতে গিয়ে তিনি অতি সুকৌশলে আমাদের জানিয়ে দেন, পৃথিবীর ১৪০টি দেশের মধ্যে বসবাসের উপযোগী শহর হিসেবে ঢাকার অবস্থান ১৩৯ নম্বরে। ১৮৬৭ সালের ১ জুলাই স্বাধীনতা লাভ করে কানাডা, আমাদেরই মতো ব্রিটিশ তাড়িয়ে। তবে ওরা এখনো ব্রিটিশ রাজতন্ত্রের ভক্ত, ব্রিটেনের রাণীই সাংবিধানিকভাবে দেশটির প্রধান, অনেক মানুষ চান রাজপুত্র ইউলিয়াম হ্যারি রাজা হয়ে কানাডায় এসে থাকুন। যদিও ফরাসিভাষী অধ্যুষিত কুইবেকের মানুষ ২০১১ সালের জুন মাসে রাজবধু কেট মিডলটন এবং হ্যারি’র আগমনকালে, ‘উইলিয়াম বেরিয়ে যাও’ আওয়াজ তুলেছিল। শহর থেকে দূরে বসবাসকারী কানাডার আদিবাসীদের প্রসঙ্গও টেনেছেন, নিজেরই রচিত একটি কবিতার উদ্ধৃত করে, যার কিছু অংশ আমি এখানে তুলে ধরছি—
নামো, নেমে
ইতিহাসের পথ ধরে খালি পায়ে হেঁটে যাও জ্যাক কার্তিয়ে
খুঁজতে থাকো জন ক্যাবটের পদচিহ্ন যেন ম্যাপলের ঝরা শুকনো পাতা;
খুঁজতে খুঁজতে, হাঁটতে হাঁটতে, যেতে যেতে…ক্ষয় করো পা
বিলুপ্ত-বিলিন নির্জন রাস্তার উপনিবেশের শেষ প্রান্তে
ক্যুবেকের পর কানাটা পেরিয়ে স্টেইডাকোনা গ্রাম
পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম দেশটির দিগন্তহীন অবারিত প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের বর্ণনা করতে গিয়ে লেখক লিখেছেন, ‘নারীর সৌন্দর্যের চেয়ে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য অনেক বেশি বহুমাত্রিক এবং মুগ্ধকর। নারীর শারীরিক সীমারেখা আছে, কিন্তু প্রকৃতির সেই সীমাবদ্ধতা নেই, অসীম।’ তিনি অটোয়ার বর্ণনা করতে গিয়ে লিখেছেন, ‘রাজধানী অটোয়া কূটনৈতিক শহর হলেও শহরটিকে মনে হয়, যেন কোন বিখ্যাত চিত্রকরের আঁকা একটা অপূর্ব নগ্ন নারী শুয়ে আছে। যার চুল–চিবুক-চোখ-নাক-মুখ-স্তন দেহের ভাঁজ, পায়ের পাতা ছড়িয়ে আছে বেসুর থেকে অর্লিন্স পর্যন্ত।’ দানবের মতো হামাগুড়ি দিয়ে নেমে আসা ভয়ঙ্কর শীতেরও যে রয়েছে মনোমুগ্ধকর সৌন্দর্য তা-ও উঠে এসেছে লেখকের বর্ণনায়, ‘শিমুল তুলোর শুভ্র-শাদা স্নো, দুধের সরের মতো ধবধবে বরফ, চারদিকে কাশবনের মতো অপূর্ব দৃশ্য।’ এ গ্রন্থে বাদ যায়নি আমাদের কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কানাডা ভ্রমণের বিষয়টিও। ১৯২৯ সালে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কানাডার ভ্যাঙ্কুবার ভ্রমণ করেন। নোবেল জয়ের ১৮ বছর পর, ততোদিনে রবীন্দ্র সাহিত্যের সৌরভ ছড়িয়ে পড়েছে সারা বিশ্বে। পশ্চিমাদের অদম্য আগ্রহ রবীন্দ্রকর্মে। বর্ণবৈষম্য নিয়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কথা বলেন সরাসরি, ভ্যাঙ্কুবারে বসেই। তিনি বলেন, Canada must believe in great ideals. She will have to solve….the most difficult of all problems, the race problem. ভ্যাঙ্কুবারে প্রদত্ত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শিক্ষা বিষয়ক বক্তৃতার ওপর টরন্টো বিশ্ববিদ্যালয়ের রবীন্দ্রনাথ এবং সত্যজিৎ বিষয়ক শিক্ষক ক্যাথলিন এম ও’কনেলের মূল্যানটি বেশ গুরুত্বপূর্ণ। In 1929 Rabindranath Tagore came to Vancouver to address a conference of the National Council of Education of Canada. This article analyzes his reception as reported in the news media, but primarily examines the educational priorities he chose to elaborate. One major theme that he emphasized was ‘freedom’ in education: physical, mental, spiritual and moral freedom, and freedom from racial and national prejudice. In particular he stressed the role of leisure in education and human life at large, in contrast to relentless competition for material advantage. He urged that imagination and creativity, especially artistic creativity, be matured, reflecting his own experience of growing up in a remarkably creative Bengali Indian family কবিগুরু তার ভ্যাঙ্কুবার ভ্রমণ শেষে দেশে ফিরে গিয়ে ’কানাডার প্রতি’ শিরোনামের একটি কবিতা রচনা করেন।
বিশ্ব জুড়ে ক্ষুব্ধ ইতিহাসে
অন্ধবেগে ঝঞ্ঝাবায়ু হুংকারিয়া আসে
ধ্বংস করে সভ্যতার চূড়া।
ধর্ম আজি সংশয়েতে নত,
যুগযুগের তাপসদের সাধনধন যত
দানব পদদলনে হল গুড়া।
তোমরা এসো তরুণ জাতি সবে
মুক্তিরণ-ঘোষণাবাণী জাগাও বীররবে।
তোলো অজেয় বিশ্বাসের কেতু।
রক্তে-রাঙা ভাঙন-ধরা পথে
দুর্গমেরে পেরুতে হবে বিশ্বজয়ী রথে,
পরাণ দিয়ে বাঁধিতে হবে সেতু।
ত্রাসের পদাঘাতের তাড়নায়,
অসম্মান নিয়ো না শিরে, ভুলো না আপনায়।
মিথ্যা দিয়ে, চাতুরী দিয়ে, রচিয়া গুহাবাস
পৌরুষের কোরো না পরিহাস।
বাঁচাতে নিজ প্রাণ
বলীর পদে দুর্বলেরে কোরো না বলিদান
কানাডা-যুক্তরাষ্ট্র সীমান্তে রয়েছে পৃথিবীর অন্যতম দর্শনীয় প্রাকৃতিক সৌন্দর্য নায়াগ্রা জলপ্রপাত। একটি অধ্যায়ে লেখক নায়াগ্রা জলপ্রপাতের সৌন্দর্য বর্ণনার পাশাপাশি বিশ্ব সভ্যতার চাকা ঘোরাতে নায়াগ্রার অবদানের কিছুটা আভাস দেন। প্রতি বছর পঞ্চাশ লক্ষ পর্যটক জলপতনের যে গর্জনে মুগ্ধ হয় তাদের অনেকেই হয়ত জানে না ৭শ ফুট ওপর থেকে প্রতি সেকেন্ডে গড়িয়ে পড়ছে ৬০ হাজার গ্যালনেরও অধিক জল। দ্রুতবেগে ধাবমান এই জলশক্তিকে কাজে লাগিয়ে প্রতি সেকেন্ডে উৎপাদন করা হচ্ছে ৪০ লাখ কিলোওয়াট পরিবেশবান্ধব জলবিদ্যুৎ।
আজ ২১ ফেব্রুয়ারি, আমাদের মহান ভাষা দিবস, পেয়েছে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষার মর্যাদা। এই স্বীকৃতি অর্জনের জন্য যারা উদ্যোগ গ্রহণ করেন, নিরলস প্রচেষ্টা চালিয়ে যান স্বীকৃতি না মেলা পর্যন্ত তারা হলেন কানাডা প্রবাসী দুই বাংলাদেশি সালাম ও রফিক, এ যেন বায়ান্নর সেই সালাম রফিকেরই প্রত্যাবর্তন। এই বিষয়টিও একটি অধ্যায়ে তুলে এনেছেন লেখক সাইফুল্লাহ মাহমুদ দুলাল।
শেষের দিকের দুটি অধ্যায়, ‘এই কানাডা সেই কানাডা’ এবং ‘কানাডা যাবেন কেন যাবেন’-এ তিনি তুলে ধরেছেন অভিবাসী বা সম্ভাব্য অভিবাসীদের জন্য প্রয়োজনীয় তথ্য। সেই সঙ্গে এই সুবিশাল দেশটির অতীত ও বর্তমানের তুলনামূলক চিত্রটি তিনি তুলে ধরেছেন নানান ঘটনা ও তথ্য উপস্থাপনের মধ্য দিয়ে। ‘কানাডা যাবেন কেন যাবেন’ কানাডা প্রবাসী এবং সম্ভাব্য কানাডা অভিবাসীদের জন্য একটি প্রয়োজনীয় গ্রন্থ তো বটেই, তবে যারা শুধু ভ্রমণের স্বাদ পেতে চান, তাদের কাছেও গ্রন্থটি সুখপাঠ্য বলে বিবেচিত হবে। লেখক সাইফুল্লাহ মাহমুদ দুলাল এ গ্রন্থে সন্নিবেশিত তথ্যের সপক্ষে প্রতিটি অধ্যায়ের শেষে সংযোজন করেছেন তথ্যসূত্র, কেউ চাইলে উপস্থাপিত তথ্যগুলো যাচাই করে নিতে পারেন। প্রচুর বই ও জার্নালের পাশাপাশি তিনি সমসাময়িক পত্রপত্রিকা এবং গুগলের সাহায্য নিয়েছেন তথ্য সংগ্রহের জন্য।