সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে সালাহ উদ্দিন মাহমুদের ছোটগল্পগ্রন্থ ‘এখানে কয়েকটি জীবন’। গল্পগ্রন্থটিতে মোট এগারোটি গল্প রয়েছে। গল্পগুলো আমাদের চারপাশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা জীবনের গল্প। হাসি-কান্নার গল্প। আশা-নিরাশা, ভালোবাসা ও সম্ভাবনার কথা নিয়ে রচিত হয়েছে এসব গল্প। যেখানে প্রতিটি গল্পজুড়ে জীবনের নিখুঁত বিস্তার। বইয়ের ভেতরে কোন ধরনের আয়োজন পাঠকের জন্য অপেক্ষা করছে, সে সম্পর্কে লেখকের কলম থেকে স্পষ্ট ধারণা পাওয়া যায়। লেখক বলেন, ‘আমি গাঁয়ের মানুষ। ছাপোষা গ্রামীণ মানুষের গল্প বলতে ভালোবাসি। যদিও সুরম্য অট্টালিকায় মদের পেয়ালা হাতে সুদর্শন রমণীর বিবরণ আমার অভিজ্ঞতায় নেই। আমার গল্পের নারীরা কাঁখে কলসি নিয়ে নদীর ধারে জল আনতে যায়। সাধারণ জীবন তাদের। সাধারণ গল্পও।’ লেখক তার গল্পগুলোকে সাধারণ বললেও আমি দ্বিমত পোষণ করবো। আশা করি অন্য পাঠকও আমার পক্ষে থাকবেন।
বইটির প্রথম গল্প ‘জীবন’। এক নিঃসন্তান দম্পতি ও গর্ভের সন্তান বিক্রি করতে চাওয়া আরেক দম্পতির গল্প। আনিস-রিজিয়ার চরিত্র দুটি পাঠককে মনে করিয়ে দেবে—জীবন শব্দটির সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ শব্দ অপূর্ণতা। গল্পের বেশকিছু মোড় পাঠককে চমকিত করবে। সমাপ্তি ছিল মানবিক ও একান্ত কাম্য। আনিস মূলত আমাদের কাঙ্ক্ষিত পুরুষ মূর্তি। গল্প বলার ক্ষেত্রে লেখকের বিশেষ দক্ষতা গল্পটিকে জোড়ালো করে তুলেছে, যা পাঠকের মনে এক গম্ভীর শীতল বিমর্ষতার আবহ সৃষ্টি করতে সক্ষম হবে।
পরবর্তী গল্পটির নাম ‘সোনাবউ’। গল্পটি সাতচল্লিশ বছর বয়সী অনন্তর মতো নিঃসঙ্গ লোকের একাকী দিনযাপন ও স্মৃতিচারণে জেগে ওঠা প্রেমের অতীত পাঠ। শুক্রবারের খানদানি একাকিত্বের ভিড়ে অনন্তর চোখে পড়ে একটি পুরনো চিঠি। গল্পের আসল বক্তব্য চিঠির ভাষাতেই গাঁথা। এক পৃষ্ঠার ওই চিঠিই আস্ত একটা গল্প। সোনাবউয়ের চিঠি থেকে জাগ্রত দুঃখবোধ পাঠকের মন ভারী করে তুলবে। সোনাবউ মূলত অনন্তর যুবক বয়সের প্রেমিকা। যাকে ভালোবেসে সে ডাকতো সোনাবউ। কিন্তু ভাগ্য করেছে পরিহাস। সোনাবউ হয়েছে অন্যকারও বউ। আর অনন্ত পেয়েছে নিঃসঙ্গতা। মনে রাখার মতো লাইন—‘নিঃসঙ্গতার এই একটা খারাপ দিক, মাঝে মাঝে কিছুই ভালো লাগে না।’
গল্পগুলোর বিষয়বস্তু, পরিবেশ, চরিত্র ও সংলাপ আমার কাছে মনে হয়েছে আমার আত্মার খুব কাছাকাছি। লেখকের গল্প বলার ঢং, ভাষা বিন্যাস, চরিত্র গঠন আমাকে দারুণভাবে মুগ্ধ করেছে।
এমনই আরেক নিঃসঙ্গ জীবনের গল্প ‘দায়ী’। যেখানে গ্রামীণ এক নিঃসঙ্গ কবির রহস্যজনক মৃত্যু গল্পের কেন্দ্রবিন্দু। গল্পের ফাঁকে ফাঁকে লেখক তুলে ধরেছেন আমাদের সমাজে কবি-সাহিত্যিকদের নিয়ে কথিত কিছু মিথ্যা ধারণা। গল্পটি পাঠেই পাঠক এর গভীরতা উপলব্ধি করতে পারবেন।
‘তুমি অনেক কষ্ট করছো মা। ছেঁড়া শাড়ি পইরা বছরের পর বছর পার করছো।’ সংলাপটি ‘শাড়ি’ গল্পের এক আবেগঘন আনন্দময় মুহূর্তের ধারক। বাবা-মার প্রতি সন্তানের দায়িত্ব ও ভালোবাসার গল্প ‘শাড়ি’। শহরে চাকরি করে ছুটিতে বাড়ি যাওয়ার সময় বাবা-মার জন্য ফতুয়া ও শাড়ি কিনে নেয় আজম। সন্তানের এই ভালোবাসা ও বাবা-মার আবেগের বহিঃপ্রকাশই গল্পের মূল দিক।
‘মানুষ মইরা যায় ক্যান? মইরা কই যায়?’ ‘বিবস্ত্র’ গল্পের রুবির এই প্রশ্নের উত্তর কেউই দিতে পারবে না কোনোদিন। বিবস্ত্র গল্পটি এক ছিন্নমূল কিশোরীর গল্প। আমাদের সমাজ বাস্তবতার করুণ কাহিনির বয়ান। যেখানে নিরাপদ নয় কোনো মেয়েই! চারপাশে কেবল জোরজুলুমে মত্ত লুটেরার দল। ফল বিপন্ন, বিবস্ত্র জীবন। গল্পের আখ্যান ও পরিণতি পাঠকের হৃদয়ে রুবি শ্রেণীর প্রতি করুণা আর লুটেরার দলের প্রতি ক্ষোভের সৃষ্টি করতে পারবে।
বিবস্ত্র গল্পের রেশ না কাটতেই পাঠকের সামনে চলে আসবে ‘জয়শ্রী’ গল্পটি। প্রভাবশালী মুসলিম যুবকের প্রেমের প্রস্তাবে হিন্দুর মেয়ে জয়শ্রীর রাজি না হওয়া, অতঃপর ধর্ষণ ও এর বিচারের আকুতি নিয়ে গল্পটি আবর্তিত হয়। শেষমেশ গ্রামীণ এক প্রহসনমূলক শালিসের অবতারণার মাধ্যমে গল্পের সমাপ্তি হয়। সমাজ জীবনে এমর শালিসি অহরহ পাওয়া যায়। প্রহসনের বিচার ও সর্বশেষ পরিণতি পাঠকের হৃদয়ে গভীর দুঃখ ও ক্ষোভের দাগ কেটে যাবে।
বিবস্ত্র, জয়শ্রীর মতোই সামাজিক অবক্ষয়ের আরেকটি গল্প ‘কুমারী’। এটি প্রেমের তালে পথ ভোলা এক মেয়ের গল্প। অবৈধ সম্পর্ক অতঃপর গর্ভধারণ। তারপর প্রেমিকের হাওয়ায় মিলিয়ে যাওয়া। গল্পে তৈরি হয় রহিতন ও তার গর্ভে বেড়ে ওঠা সত্তার অস্তিত্বের সংকট। গল্পের সম্ভাবনা ও আলোকিত বিষয় হলো রহিতনের বড় বোন। রহিতনের সংকটকালের ভরসার আশ্রয়। গল্পের সংলাপগুলো ছিল চমৎকার এবং পরিস্থিতি সাপেক্ষে উপযুক্ত।
সম্ভাবনার সিঁড়িতেই ঝরে পড়া প্রেমের গল্প ‘নাকফুল’। যা বইটির অন্য গল্পের অনুভূতি ছাপিয়ে নতুন আবহের উপস্থিতি। ‘কুকুর’ গল্পের ছায়ায় ঠাঁই পেয়েছে দুটি মানবিক বিপর্যস্ততার গল্প। এক—স্বামীহীন সংগ্রামী আবেদার জীবন। আরেক—বাবাহীন স্বাধীনের পশু প্রেমের বিপরীতে হানা দেওয়া মনুষ্যত্বহীন মানুষের আগ্রাসনের গল্প। ‘গোলেয়া’ ও ‘মিঠু’ গল্প দুটি বিষয়গত দিক থেকে বইয়ের অন্যসব গল্পের চেয়ে ভিন্ন।
গল্পগুলোর বিষয়বস্তু, পরিবেশ, চরিত্র ও সংলাপ আমার কাছে মনে হয়েছে আমার আত্মার খুব কাছাকাছি। লেখকের গল্প বলার ঢং, ভাষা বিন্যাস, চরিত্র গঠন আমাকে দারুণভাবে মুগ্ধ করেছে। বইটির প্রকাশনার মান ছিল খুবই ভালো, নান্দনিক ও হৃদয়গ্রাহী। আমি বইটির বহুল পাঠ, প্রচার ও প্রসার কামনা করছি।
এখানে কয়েকটি জীবন
সালাহ উদ্দিন মাহমুদ
প্রকাশনী: কিংবদন্তী পাবলিকেশন
প্রচ্ছদ: আইয়ুব আল আমিন
মুদ্রিত মূল্য: ৩০০ টাকা।