‘তোমার বুকের ওড়না আমার প্রেমের জায়নামাজ’ (ওড়না)। এমন চমৎকার উপমার ঢঙে কবি হয়ে যান নিতান্তই প্রেমিক। কবি মাত্রই প্রেমিক। হয় প্রকৃতি, হয় মানবের, হয় মা-মাটি ও দেশপ্রেম। প্রেমহীনে হয় না জগৎজয়, হয় না অন্তর্লীন বিজয়ও। একজনমের প্রেমেই টিকে থাকে বিশ্বাসের বিজয়। কবিদের প্রেমের বাক্যে একঢিলে লুকিয়ে থাকে ত্রিমোহনার জোসনা। ভাবের দরিয়ায় থাকে ভেতরের পরিস্ফুটন। উল্লিখিত কবিতাটি কবি হেলাল হাফিজের ‘এক জনমের জন্মজখম’কবিতাসমগ্রের অন্তর্গত।
ভেতরের স্খলনই যেকোনো বাঁশিওয়ালা সুরের মূর্ছনায় ছড়িয়ে দেন বাতাসের কাছে, মানুষের কাছে, ভালোবাসার কাছে। হেলাল হাফিজ ‘নিষিদ্ধ সম্পাদকীয়’ কবিতাটির মতো দেশের সবুজের কোলে নিজের পদার্পণ নিশ্চিতের দ্যুতি ছড়িয়ে দৃঢ়তার সঙ্গে জানান দিতে পেরেছেন কবির শক্তিময়তায়। সাধনার সবটুকু টেনে নিতে উজাড় করেছেন একজনমের ভালোবাসা। কবি মানবতাবোধের সবটুকু ধারণ করেন তার বিশ্বাসের পরিধিতে স্পর্শ রেখে।
‘নিউট্টন বোমা বোঝো/মানুষ বোঝো না’ এ রকম পঙ্ক্তির ভেতরের কামিজ ধরে সমগ্র মানবের মগজে দিয়েছেন গুঁতো। কবিতা মানে বিবেকের উদগাতা বিষফোঁড়া হতে হবে। কবিতায় থাকতে হবে বেঁচে থাকা লড়াইয়ের ইঙ্গিতনামা। হোক তা প্রেয়সীকে বার্তা পাঠিয়ে, হোক সেটা জাতিকে জানিয়ে। কবির ভাষায়-
আমার কষ্টেরা বেশ ভালোই আছেন, মোটামুটি সুখেই আছেন।
প্রিয় দেশবাসী;
আপনারা কেমন আছেন?’
(ইদানীং জীবন যাপন: যে জলে আগুন জ্বলে)
কবিতার চাম্পানে পাল টাঙাতে হবে। দাঁড় বেয়ে স্রোতের প্রতিকূল অবলোকন করতে করতে জলের ঢেউকে করতে হবে পরিমাপ।আঁতুড় ঘরের হিসাবের কান্না থাকতে হবে কবিতার ব্যঞ্জনাশক্তির সিনায় বসে। হেলাল হাফিজ যতটা না বিরহ-বিষাদের গীত গেয়েছেন, তার চেয়ে বেশি গীত গেয়েছেন মানবতার। কবির ভেতরের সবটুকু প্রেয়সীর আদলে এই সবুজের সোঁদামাটির গন্ধটাই ভর করে আছে। ‘তোমার বুকের ওড়না আমার প্রেমের জায়নামাজ’ দেশ প্রেমের অনন্য বাণীও বলা যায়। লাইনটিতে অন্তর্পাঠের চক্ষু ও অবলোকন শক্তি থাকতে হবে। কবি ‘যার যেখানে জায়গা’কবিতাটিতে লিখেছেন ঠিক এভাবে:
টিকেট ঘরের ছাদে বিকালে দাঁড়ায়া যখন যা খুশি যারা কন
কোনো দিন খোঁজ লইছেন গ্রামের লোকের সোজা মন
কী কী চায়, কতখানি চায়
কয়দিন খায় আর কয়বেলা না খায়া কাটায়?
(এক জনমের জন্মজখম)
আহা! কবিরা সবসময় মফস্বল থেকে বেড়ে ওঠা মানবের জাত বলেই মানবিক হতে গিয়েই এমনভাবে বলতে বাধ্য হন। কবিতার শক্তি তো এমনই!
সমাজ আর রাষ্ট্রের ভেতরে বসবাস করা যাপিত জীবনের প্রণালীর কোলঘেঁষে মানুষের অসহায়ত্ব প্রকাশ দেখে কবি হয়ে যান দরদি। কবি হেলাল হাফিজ বারবার মানবিক হতে চেয়েছেন। কবিরা কল্যাণ খোঁজেন। সেটা হয়ে যায় ঐশ্বরিক পুণ্য। আসুন ‘ব্যবধান’ কবিতাটি একটু পাঠ করি:
মানুষ গিয়েছে ভুলে কী কী তার মৌল উপাদান।
তাদের ভেতর আজ বৃক্ষের মতন সেই সহনশীলতা নেই
ধ্রুপদী স্নিগ্ধতা নেই,নদীর নম্রতা নিয়ে মুগ্ধ মানুষ
কল্যাণের দিকে আর প্রবাহিত হয় না এখন।আজকাল অধঃপতনের দিকে সুপারসনিক গতি মানুষের
সঙ্গত সীমানা ছেড়ে অদ্ভুত নগরে যেন হিজরতের প্রতিযোগিতা।
(ব্যবধান- এক জনমের জন্মজখম)
কবির বিশালতার মাঝে আরও বিশালতার শরণাপন্ন হতে ভালোবাসেন। ভালোবাসেন নিজের ইচ্ছের কাছে, নিজের স্বাতন্ত্র্যের কাছে,
পাওয়া না পাওয়ার হিস্যের কাছে সমর্পিত হতে। কবির আকুতি দাঁড়িয়ে যায় আমূল মৌল বিশ্বাসের কাছে।
কবি হেলাল হাফিজ নিতান্তই বিশ্বাসে থেকেছেন। কীসের বিশ্বাস? সব হারানোর বিশ্বাসের চেয়ে মানবতাবোধ হারানোর বিশ্বাসের কাছে কবি বার বার শরণাপন্ন হয়েছেন। কবির ‘এক জনমের জন্মজখম’কে কবিতাসমগ্র একটি প্রেমের উপাখ্যান বলা যায়।
কবিরা সবসময় দায় কাঁধে নিতে পছন্দ করেন। কবিরা শিল্পের সুষমায় সে দায় দাঁড় করান এমনভাবে, যেখানে পাঠক ও বোদ্ধামহল লুপে নেন বাঁচার সম্বল। কবি হেলাল হাফিজ ৬৯-এর গণ অভ্যুথ্যানের সময় এমন একটি কবিতার চমৎকার দুটো চরণ জাতিকে উপহার দিলেন যে, চরণদুটো কবিকে বাঁচিয়ে রাখবে অনেক কাল। কবি সফলতার এইটুকু নিয়ে কাব্য রচনায় আর বেশি ব্রতী হননি।এইটুকুতেই কবির বাজিমাত। লাইনদুটো হলো, ‘এখন যৌবন যার মিছিলে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়/এখন যৌবন যার যুদ্ধে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়।’
কবিতায় এমন আস্থার প্রতিফলন জাতিকে স্বপ্নের দোরগোড়ায় পৌঁছে দেয় নিশ্চিত। সেটা এ জাতির ভাগ্যও বলা যায়। ৬৯-এ মানুষের চেতনা জাগরণের অধিকার ফেরত পাওয়ার মূলমন্ত্র রোপিতের সূত্রও বলা যায়।
কবি হেলাল হাফিজ মেদহীন বাক্যের কবিতার জন্য মানুষের মুখে মুখে বেঁচে থাকবেন আজীবন। বেশ কিছু উপমাময় সুখপাঠ্য কবিতা ও কবিতার লাইন আছে এই ‘এক জনমের জন্মজখম’ কবিতাসমগ্রে।
১। তুমি আমার নিঃসঙ্গতার সতীন হয়েছো।(সতীন)
২। রোদ্দুরে ভেজাবো তোকে শুকাবো বৃষ্টিতে!(লীলা)
৩। কতো বুক বুকে নিয়ে ব্লাউজগুলো ঝুলছে দোকানে। (বুকের দোকান)
৪। রেটিনার লোনাজলে তোমার সাঁতার/ পিতৃদত্ত সে মহান উত্তরাধিকার (পিতার পত্র)
৫। মন ও মগজে গুনগুন করে প্রণয়ের মৌমাছি (আছি)
৬। আমরণ পাখি হয়ে যাবো,-খাবো মৌন মুগ্ধতা তোমার (তুমি ডাক দিলে)।
বইটি ইংরেজিতে অনুবাদ করেছেন এ সময়ের তরুণ অনুবাদক যুবক অনার্য। চেষ্টা করেছেন কবি হেলাল হাফিজের কবিতার ভাবপ্রণয়ের রহস্য উদঘাটন করতে। তাকেও সাধুবাদ।
এক জনমের জন্মজখম
হেলাল হাফিজ
অনুবাদ: যুবক অনার্য।
প্রকাশক: চর্চা গ্রন্থ প্রকাশ
প্রকাশকাল: জুন ২০১৯
দাম :৩৬০/টাকা