মনীষী ছড়াকার অন্নদাশঙ্কুর রায় বলেছেন, ‘নির্দিষ্ট কিছু নিয়ম নেই ছড়া বানাবার, ছড়া আকস্মিক ইরেগুলার। ছড়া আর্টলেস আর্ট। শিশুরা সহজে পারে, বয়স্করা সহজে পারে না…অশিক্ষিতেরা সহজে পারে, শিক্ষিতরা সহজে পারে না, মূর্খেরা বুঝিতে পারে, পণ্ডিতের লাগে ধন্দ।’ আমি পণ্ডিত কি না, জানি না। তবে আমি পড়েছি খুব ধন্দে দশটি ছড়াগ্রন্থের অধিকারী বাংলাদেশের বিশিষ্ট কবি হাবীবুল্লাহ সিরাজীর ২০১৫ সালে একুশে বইমেলায় ঢাকার কাকলী প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত ‘একে শূন্য’ গ্রন্থটি পাঠ করে। যদিও গ্রন্থটির কোথাও উল্লেখ নেই, এটি ছড়ার বই, তবু আমার হাতে এসেছে ছড়াগ্রন্থ পরিচয় নিয়েই এবং এই নিয়েই আমার ধন্দ।
প্রথমে আসি বইটির নামকরণ প্রসঙ্গে। বইটির নাম ‘একে শূন্য’। বলা বাহুল্য, খুব সহজ-সরল গোছের নামকরণ নয় এটা বরং একটু গভীর ও ভারবাহী। নামকরণটির যৌক্তিকতা বুঝে নেওয়ার জন্য বরং শেষপাতার একই নামের (একে শূন্য) পদ্যে (ছড়া-কবিতার মিশ্রণ) আসি। পদ্যটি এই রকম, ‘কদ্দুর? যদ্দুর বোলপুর!/কয় ঘড়ি? নয় কড়ি ঝুরঝুর/ চোখ মেলা তো দেখছে না/কান খোলা তো শুনছে না/গলা ঠিকঠাক বলছে না/ নাকের ফুটো পাচ্ছে না/কদ্দুর? রোদ্দুর ভরপুর/আমপাতা ঝুলমাখা হুড়মুড়!/লংকা পোড়া লবণ আদা/খাচ্ছে দাদা/এক শূন্য মিলছে না।’
এখন যা বলার, তা হলো এই যে পদ্যটি নির্মাণে পুরোপুরি ইরেগুলার। নির্মাণে নির্দিষ্ট কোনো নিয়ম মানেননি। বাক্যবিন্যাস এলোমেলো। নির্দিষ্ট কোনো ছন্দে নেই পদ্যটিতে। অর্থেও আপাততভাবে অসংলগ্ন ও অর্থহীন মনে হয়। কিন্তু আমার বোধে সুকুমারীয় ভঙ্গির একটি ভেতরে ভেতরে চলা বড়দের জন্য গভীর অর্থ ধাক্কা মারছে। তা এই রকম: দ্বিতীয় স্তবকের ‘নাকের ফুটো পাচ্ছে না’ এই বাক্য দুটি ইঙ্গিত দিচ্ছে, এখনকার শৈশব বাতাস পাচ্ছে না। শিশুর চোখ-কান-মুখ খোলা থাকলেও ওরা যেন ঠিকমতো দেখছে না, শুনছে না বা বলছে না। তাদের জীবনের অঙ্ক যেন মিলছে না।
নামকরণের সমর্থনে ‘একে শূন্য’ গ্রন্থটির ‘স্বপ্ন দশ’ শীর্ষক পদ্যটিও পড়ে নেওয়া যাক:
দশ বালিকা নামতা ভাগে/দশেই ভাঙে খোয়া
দশে আবার বাসন মাজে/দশেই খাচ্ছে মোয়া
দশ বালিকা সেলাই কলে/দশেই মনিটরে
দশের ব্যাগে মাখন রুটি/দশে মিলেই ভরে।
দশে দশে মানসাংক/দশ ফুরালে আর কি
আমার বোনের স্বপ্ন দশেই/বাংলাদেশ তো আঁকি।
পাঠকগণ ‘দশ ফুরালে আরকি!’ বাক্যবন্ধটিতে নজর করুন। অর্থাৎ কবি বলতে চান, অঙ্ক মানেই ১০-এর (১-১০) হিসাব। এর বাইরে তো কোনো সংখ্যা নেই। আর দশ মানেই পূর্ণতা। যে যা সংখ্যা চায়, তা ওই দশটা ডিজিট দিয়েই বানিয়ে নিতে হয়। তাহলে পদ্যটির মূল বক্তব্য দাঁড়ালো এই যে, সমাজের যে স্তরের ছেলেমেয়েই হোক না কেন, শ্রেণীবৈষম্যের বাস্তবতা এই ‘একে শূন্য’-এর হিসাব মেনেই চলে। অর্থাৎ শ্রেণীচাহিদার ভিত্তি মেনেই পূর্ণতার অভিমুখে চলতে চায়। দশ মানেই পূর্ণতা। পূর্ণতা মানেই খিদের সমাধানের অন্বেষণ, ‘একদলা ভাত খোঁজা’ (কথা ছিল)।
হাবীবুল্লাহ সিরাজীর পদ্যের বৈশিষ্ট্যই হচ্ছে ছড়া-কবিতার সংমিশ্রণ। প্রচলিত ছড়ার আদলে নির্মিত আর একটি পদ্য,‘খুকির স্বপ্ন’। একটু পড়ে নেওয়া যাক:
খুকি স্বপ্ন দেখেছে
অংক খাতায় একটা ইঁদুর হুলো ধরেছে
এ কি স্বপ্ন দেখেছে
ছেঁড়া জামায় মস্ত একটা গোলাপ ফুটেছে
খুকি স্বপ্ন দেখেছে
কাঁকর-ভাতে ডিমওলা কই নাইতে লেগেছে
খুকি স্বপ্ন দেখেছে…
খুকির নিদ্রা টুটেছে
গরম ডালের ভরা পাতিল উল্টে পড়েছে
খুকির স্বপ্ন ভেঙেছে
উদোম পিঠে তাতা খুনতি ছ্যাঁকা বসেছে।
এই যে স্বপ্ন ও বাস্তবকে পাশাপাশি রেখে গরিবিকে নিয়ে শব্দ খেলা, এ খেলায় আলোচ্য পদ্যকার অনন্য। বলা চলে এটা সিরাজী সাহেবের নিজস্ব ঘরানা। ছোটদের লেখার মধ্যে। আলো-ছায়ার ঢেউ খেলানো এবং অসম্ভব বাক্যমায়ায় ছোটদের মনকে আলোকিত করার প্রচেষ্টা।
এই সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া অবাস্তব নয় যে, ছড়া-কবিতার মেশামেশি একটা চিরকালীন প্রক্রিয়া এবং এটা সর্বজনস্বীকৃত। তাই কুড়িটি পদ্যের বইটিকে ছড়ার বই বলা হলে মহাভারত অশুদ্ধ হবে না।
তার চিন্তনের পোশাকে অভাবের কাঁটার বিস্তার। একে শূন্য-এর পরতে পরতে আমরা তার কষ্টের প্রকাশ দেখতে পাই। আমাদের এই বাংলার রবীন্দ্রনাথে ‘অমলের’ মতো ও বাংলাতেও এক মিথ চরিত্র আছে তার নাম ‘নবী’। এই চরিত্রের স্রষ্টা হলেন সুনামগঞ্জের ভাষাসৈনিক অধ্যাপক শাহেদ আলী। তার প্রথম গল্পগ্রন্থ ‘জিব্রাইলের ডানা’ (১৯৫৩) একটি গল্প হলো ‘জিব্রাইলের ডানা।’ দারিদ্র্য বেশে উত্তরণের প্রবেচষ্টার গল্প। গল্পের মূল চরিত্র কল্পনাপ্রবণ শিশু নবী সে হ্যালুসিনেশনে ফেরেস্তা জিব্রাইলের ডানা দেখতে পায়। এবং তাকে পাবার জন্য ঘুড়ি ওড়ায়। তার বিশ্বাস সেই ঘুড়ি তাদের দুঃখকষ্টের কথা ফেরেস্তার কাছে পৌঁছে দেবে। তাই সে ঘুড়িকে আরও আরও দূরে পাঠানোর জন্য ক্রমাগত সুতো কিনে যায়। অবশেষে আবার সে কল্পনায় দেখে তার ঘুড়ি জিব্রাইলের ডানায় জড়িয়েছে।
এই ‘জিব্রাইলের ডানা’ই তার কলমকে টেনে নিয়ে যায়। তাই তিনি ‘তাপ’ পদ্যে লেখেন:
আঁধার আলোর মাল্টিকালার
গরম তাওয়া কীমশার
আকাশ খোঁজে জিব্রাইলের ডানা।
হাবীবুল্লাহ সিরাজীর পদ্যের আর একটি বৈশিষ্ট্য হলো সময়কে ধরা। ‘তাই হাওয়ার ওপর’ ভাসা আগামী পৃথিবীর মাঝে দেখে ফেসবুক, গুগল, টুইটার প্রস্তুতি প্রযুক্তিকিরণগুলোকে (শীতাতপ)। তার আধুনিকমনস্ক মন ঘড়ির সংজ্ঞা দেখে এভাবে:
ঘণ্টার কাঁটায় লম্বা ঝুঁকি
মিনিট থাকে মকর মুখী
সেকেন্ড খানিক দিচ্ছে টুকি
এক ব্যাটারির কী বুজরুকি (ঘড়ি)।
তার কিছু সমাজ ভাবনামূলক পঙ্ক্তি:
০১.
বিক্রি হচ্ছে স্বপ্ন-সরণ পোকায় কাটা বই
বিক্রি হচ্ছে সবুজ গন্ধ বুকপকেটের লাল। (বিক্রি)
০২.
বাঘের পিঠে বসলে বাঁদর/ হাওয়া বদলায় মত (ইঁদুর কল)
০৩.
ক্ষুধার গল্পে লাগলে মাটি/ইঁদুরের কল পাতা (ইঁদুর কল)
প্রচুর চরণ লিখেছেন কবি হাবীবুল্লাহ সিরাজী। এবার দুটি ছন্দমধুর পদ্যের কথা বলি:
০১.
এক ছড়াপুর দুধের গ্লাসে/ ভোর সকালে নাস্তা
তেজগাঁ খুলে ছবির বিবি/খাচ্ছে গরম পান্তা।
এক ছড়াপুর রোদে পুড়ে/খুঁজচ্ছে মধু কিল্লায়
মৌমাছিরা উড়াল দিলে/চামচার সব চিল্লায়। (ছড়াপুর)
০২.
ছেঁড়া টাইফুন/বুঝে মনসুন/ খোলে কার্টুন/টিভি পর্দায়
মিয়া তানসেন/ টোড়ি গাইবেন/ফেলে হাইফেন/টুইট ফাটায় (কার্টুন)
০৩.
এই নদীটি নাইতে গেলে/এই পুকুরে বাতাস ঘামে
পুব সাগরের নোনা জলে/ কেমনে আকাশ উদলা নামে?
কাঁচা বৃষ্টি ঝাঁপায় নদী/পাকা বৃষ্টি পুকুর ভাসায়
বৃষ্টি ফলে উজান সাগর/ কেমনে আকাশ একলা থামায়?
০৪.
কথা ছিল সূর্য খুলে/প্রভাত হওয়া দেখা
বৃহস্পতির ধূসর বুকে/ পাঁচের নামতা লেখা। (কথা ছিল)
এতে বোঝা যায় হাবীবুল্লাহ সাহেবের পদ্য কাব্যগুণ-সম্পন্ন। তাই তার ছড়ার মধ্যে রূপক, উপমা অনুপ্রাস (চার দোলা নীলে চঞ্চুতে চিল) খুব সহজেই উঁকি মারে। সোজা কথায় তার পদ্যে (যদি ছড়াও বলি) খুব সহজেই কবিতা ঢুকে যায়। কেউ কেউ বলতে পারেন এই যে ছড়ার মধ্যে কবিতার মিশ্রণ, এটা কি শুধু হাবীবুল্লাহ সিরাজীর মতো এখনকার পদ্যকাররাই করেন? এটা তো প্রচলিত ছড়ার মধ্যেও অনেক দেখা গেছে। একটা উদাহরণ:
এলাটিং, খেলাটিং, সই লো
কী সের খবর আইলে
রাজা একটি বালিকা চাইলো।
এই যে রাজার বালিকা চাওয়া, এটা কি ছড়ার লাইন না কবিতার? অতএব এই সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া অবাস্তব নয় যে, ছড়া-কবিতার মেশামেশি একটা চিরকালীন প্রক্রিয়া এবং এটা সর্বজনস্বীকৃত। তাই কুড়িটি পদ্যের বইটিকে ছড়ার বই বলা হলে মহাভারত অশুদ্ধ হবে না।
পরিশেষে একটা কথা বলা যেতেই পারে যে, ‘একে শূন্য’ এই ছড়ার বইটি প্রচ্ছদে অলংকরণে সোহাগ পারভেজ অসাধারণ কৃতিত্ব দেখিয়েছেন। গ্রন্থের নির্মাণে এক অভিনব সৃষ্টি। বাংলাদেশর কবি তপন বাগচীকে ধন্যবাদ, তিনি কবিতারসে সমৃদ্ধ এমন একটি ছড়ার বই আমাকে পড়ার জন্য পাঠালেন। তাকে কুর্ণিশ।