ছোটগল্পের বিষয়বস্তু কী হবে—এই নিয়ে ব্যাপক আলোচনা হয়েছে। তবে এরমধ্যে আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের ছোটগল্প নিয়ে ভাষ্য সর্বাধিক গ্রহণযোগ্য বলে মনে হয়। তিনি এখানে বলতে চেয়েছেন, জীবনের ছোট ছোট সমস্যা ও তার সমাধানের বিষয় নিয়ে যে গল্প লেখা হয়, তাই ছোট গল্প। আধুনিক জীবনের সমাজ বাস্তবতায় কোন সমস্যাকে প্রাধান্য দিয়ে গল্প লিখতে হবে, তা অনেকক্ষেত্রে গল্পকাররা নির্ণয় করতে পারছেন না। অন্যদিকে একটি সমস্যার বর্ণনা করতে গিয়ে অন্য সমস্যা তার মাঝে যোগ হয়ে দ্বিতীয় সমস্যাটি গল্পের প্রধান বিষয়বস্তু হয়ে যাচ্ছে। নাগরিক জীবনে সমস্যার অন্ত নেই। জীবনের জটিলতা যখন নির্দিষ্ট কোনো জীবনের অংশ নিয়ে বা সমস্য নিয়ে গল্প লিখতে লেখককে প্রেরণা দেয়, তখনই তা স্বার্থক ছোটগল্প হয়ে দাঁড়ায়। এ বাস্তবতা আমরা চন্দন আনোয়ারের গল্পের বই ‘ইচ্ছামৃত্যুর ইশতেহার’-এ পর্যবেক্ষণ করি। এই বইয়ে লেখক যেমন সমাজজীবনের বাস্তবমুখী সমস্যা তুলে ধরেছেন, তেমনি তার সমাধান নিয়ে পাঠকদের ভাবনার খোরাকও জুগিয়েছেন।
এই বইয়ে মোট ১৫টি ছোটগল্প রয়েছে। প্রথমটি ‘স্কাইপ ও দুটি মৃত্যুমুখ’। এ গল্পে লেখক আমাদের বোঝাতে চেয়েছেন, প্রযুক্তির বিকাশ ঘটেছে। প্রযুক্তির কল্যাণে আমরা একদেশ থেকে অন্যদেশে সহজে আপনজনের সঙ্গে কথা বলতে পারি। কিন্তু এতে কি আমরা নিজেদের মাঝে দূরত্ব গোচাতে পারি? এখানে বয়োবৃদ্ধ বাবা দেশে থেকে দূরদেশের ছেলে ও মেয়ের সঙ্গে স্কাইপে কথা বলেন। কিন্তু ঠিকই নিংসঙ্গ জীবনযাপন করেন। একসময় এ নিঃসঙ্গ জীবন নিয়ে তিনি মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন। এখানে লেখক পাঠককে জানালেন, নাগরিক জীবন আমাদের ব্যক্তিকেন্দ্রিক সফলতার পিছু ছুটতে শিখিয়েছে। এখানে সম্পর্কের মূল্য শুধু স্কাইপে কথা বলা পর্যন্ত সীমাবদ্ধ।
বইয়ের দ্বিতীয় গল্পটি ‘ইচ্ছামৃত্যু’। এখানে লেখক আত্মহত্যা শব্দটি ব্যবহার না করে ইচ্ছামৃত্যু শব্দটি ব্যবহার করেছে। মূল গল্পের প্লটে একজন সংখ্যালঘু সনাতনী বাংলাদেশে বৈরী পরিবেশের সঙ্গে টিকতে না পেরে আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়। সে জানতে পারে, তার সুন্দরী পিসিকে তার বাবা সম্মান রক্ষার দায়ে বদ্ধ ঘরে আটকে রেখে নিজেই হত্যা করে। বেদনাবিধুর সেই পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়ে সে তার পরিবার নিয়ে শঙ্কিত। মৃত্যুই তাকে খবর কাগজের পাতায় স্থান করে দেয়। ঠিক এভাবে গল্পের সমাপ্তি টেনে তিনি প্রায় হাসান আজিজুল হকের মতো মনস্তাত্বিক গল্প রচনা করে পাঠককে ঝাঁকুনি দিতে চেয়েছেন। পুরো গল্পে তিনি এক ধরনের ঘোর সৃষ্টি করে পাঠককে ধরে রেখেছেন শেষপর্যন্ত। গল্পের শেষ বাক্যে শ্যামল বৈশ্য মৃত্যুবরণ করেছেন তা জানান না। বরং তিনি বলেন, ‘শ্যামল বৈশ্যের ইচ্ছেটাই পূরণ হয়। তার আত্মহত্যার খবরটি প্রগতিশীল দৈনিকগুলো গুরত্ব দিয়ে ছেপেছে’। এ যেন প্রগতিশীলদের অহেতুক আস্ফালন ও নিরুপায় শ্যামল বৈশ্যের আত্মহত্যার ইঙ্গিত। আর তা বুঝতে পাঠকের কোনো কষ্ট হয় না।
অন্যরকম গল্প ‘মৃত্যুবিষয়ক কবিতাপ্রেমী’র গল্প। এখানে সৈয়দ আব্দুল হাদী নামের একজন সরকারি চাকরিজীবী কাজের মেয়েকে মৃত্যুবিষয়ক প্রশ্ন করে। প্রশ্ন করে মৃত্যুর পর কাজের মেয়েটি কোথায় থাকবে। আশ্চর্যের বিষয়, সেদিনই কাজের মেয়েটি রেল লাইনে কাটা পড়ে মারা যায়। আর তিনদিন পর হাদি তা জানতে পেরে শিউরে ওঠে। এখানে লেখক তার আগের গল্পের মতো শুরুতে রহস্য তৈরি করে পুরো গল্পের শেষ পর্যন্ত পাঠককে নিয়ে যেতে চেষ্টা করেছেন। কিন্তু এখানে এভাবে হঠাৎ করে কাজের মেয়েটির মৃত্যু স্বাভাবিক গতি পায়নি।
বাংলাদেশে জীবনের নানা সমস্যার একটি অন্যতম সমস্যা ‘ক্রসফায়ার’। বিচার বর্হিভূত হত্যাকাণ্ডে কত মায়ের বুক খালি হচ্ছে। কতজন হচ্ছে স্বজনহারা। এ স্বজনহারা শিশুরা একজন ক্রসফায়ারকারীর স্বপ্নে তাকে তাড়িয়ে বেড়ায়। লেখক এখানে বলেন, ‘কিন্তু তুমি জানো না, কতটা ওপর থেকে গুলির নির্দেশ আসে। রাষ্ট্রের সিদ্ধান্ত পালনা না করে তুমি আমি কোথায় পালাবো, বলো?’ অথবা এ যে শৈল্পিক চয়ন, ‘সৈকতের ভেতরে সিসার মতো ভার হয়ে থাকা কথাগুলো এই প্রথম ভাষা পেলো’। অথবা শিশুরা স্বপ্নে এসে একজন সম্ভাব্য সন্তানের বাবা সৈকতকে বলে, ‘…আমাদের বাবাকে চাই। তুমি আমাদের বাবাকে খুন করেছ।’ এ যেন সমসাময়িক অনাচারের বিরুদ্ধে লেখকের সচেতন প্রতিবাদ। এই প্রতিবাদই পাঠক হিসেবে আমরা করতে চাই।
ঠিক একই সমস্যা গুম নিয়ে তিনি লিখেছেন ‘রাত পোহালে অন্ধকার’ গল্প। যেন গল্পের শিরোনামই একটি কবিতা। এখানেও একজন শিক্ষক গুম হয়ে যায়। আর গুম হওয়া শিক্ষককে খুঁজতে গিয়ে তার সহকর্মীটিও পড়ে মৃত্যুর মুখে। আর এদিকে তার স্ত্রী স্বামীর লাশও খুঁজে পায় না। এ যে চিরন্তন সত্য তিনি গল্পে তুলে ধরলেন, এ বাস্তবতা আজ বাংলাদেশের হৃদয়ে বাজে।
আবার ‘গ্যাংগ্রিন’ গল্পটির নায়কের জন্মের গণ্ডগোল নিয়ে গল্প। এখানে বাবা তার বাচ্চার পিতৃপরিচয় নিয়ে প্রশ্ন তোলে। কারণ বাচ্চাটি দেখতে তার বাবার মতো নয়। তিনি সন্দেহ প্রকাশ করেন বাচ্চাটি অন্য কারও। একারণে প্রথমে একজন বাবা তার বউকে তালাক দেয়। তারপর ছেলে যেন স্কুলে না পড়তে পারে, স্কুলে গিয়ে এ ব্যাপারে অভিযোগ করে। শালিস ডাকে। এতকিছুর পরও ছেলেটির মা জীবনযুদ্ধে জয়ী হয়ে একটু সুখের মুখ দেখে। নিজের অস্তিত্ব রক্ষার্থে বাচ্চার মা যখন নিজস্ব কারখানা গড়ে তোলে, তখনই বাচ্চার বাবা অধিকার নিয়ে হাজির হয়। অথচ বাচ্চাটি এতদিন পর্যন্ত বন্ধুদের কাছে বলতো—তার বাবা মারা গেছে। এমনকি বাবার মৃত্যুদিবসও সে ইতোমধ্যে পালন করেছে। তারপরও সেই ভণ্ড বাবার কালো থাবা তারা ঠেকাতে পারে না। কারণ বাচ্চার আত্মপরিচয় সংকট বা বাবার নামের আবশ্যকতার কারণে মাকে মেনে নিতে হয় সবকিছু। এই সন্তানের আত্মপরিচয় সংকটে অসহায় হয়ে বাংলার মেয়েরা আজও কত স্বামীর অত্যাচার প্রতিনিয়ত মুখ বুজে সহ্য করে যায়, তাই ফুটিয়ে তোলা হয়েছে এই গল্পে।
‘সাঁওতাল মেয়ের ঈশ্বর’ গল্পে দেখানো হয়েছে—গ্রামের চেয়ারম্যানের ছেলে এক সাঁওতাল মেয়ের শ্লীলতাহানি করে। চেয়ারম্যানের ছেলে মেয়েটির কাচির আঘাতে আহত হয়। কিন্তু মুখ রক্ষার ভয়ে চেয়ারম্যান এ বাস্তবতা লুকাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। একময় ওই আঘাতই ছেলেটির মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়ায়। এখানে লেখক গল্পের নামের মধ্যেই ইঙ্গিত দিয়ে দিয়েছেন, গল্পটি কেমন হতে পারে। অতিপ্রাকৃত এ গল্প পাঠে পাঠক ভিন্ন স্বাদ পাবেন।
তবে যেসব ক্ষেত্রে ‘মুখোমুখি’ চরিত্র গল্পটি পাঠ করে আমরা লেখকের অবারিত কল্পনা সম্পর্কে ধারণা করতে পারি। এখানে একজন লেখককের গল্প পাঠ করে তার বাড়ির কাজের মহিলা কুদ্দুসের মার সম্পর্কে বস্তি পাড়ায় গুজব রটে। গুজব রটে যেহেতু লেখক কাজের মেয়ের সঙ্গে বাসার মালিকের প্রেমের গল্প লিখেছেন, তাই লেখকের সঙ্গে কুদ্দুসের মায়ের সেই ধরনের সম্পর্ক আছে বলেই অনেকেই মনে করেন। দিনে দিনে কুদ্দুসের মায়ের ওপর অত্যাচার বাড়ে স্বামীর। আর ঠিক এ সুযোগ নিয়ে কাজের মেয়েটিও লেখকের ঘাড়ে চেপে বসে। দিন দিন সে বুদ্ধিদীপ্ত কথা বলে নিজের অধিকার ফলাতে চায়। ইনিয়ে-বিনিয়ে স্বামীর অত্যাচারে আঘাতপ্রাপ্ত অঙ্গপ্রত্যঙ্গও লেখককে দেখায় সে। একদিন লেখক তার অত্যাচারের বর্ণণা শুনে বিরক্ত হয়ে মামলা করার কথা বলে। কিন্তু এর উত্তরে কুদ্দুসের মা বলে, ‘তহন পুলিশ আপনেরেই ধইরা নিবো।…তারপর কুদ্দুসের মার চোখে মুখে হাসি, আমার এহন তিন মাস।’ ঠিক এইভাবে গল্পের ইঙ্গিত টেনে লেখক তার অন্যান্য গল্প শেষ করেছেন বইটিতে।
প্রতিটি গল্পের বাক্যের বুননে তিনি গেঁথে দিতে চেয়েছেন রহস্য। এ রহস্য পাঠককে আকর্ষণ করে এমনভাবে, যেন পাঠক গল্পের শেষ পর্যন্ত পাঠ করেন। তাই ইচ্ছামৃত্যুর ইশতেহার এই গল্পের বইটিকে বলতে হবে আদর্শ ছোট গল্পের বই। পাঠকের ক্ষুধা নিবারণের খোরাক। এখানে শব্দের বুননে যেমন লেখক শৈল্পিক সত্তার পরিচয় দিয়েছেন। বাক্যগুলোকে করেছেন প্রচণ্ড ইঙ্গিতবাহী। তাই গল্পের কোনো একটি অংশ বাদ দিয়ে পড়লে পুরো গল্প বোঝার কোনো সুযোগ থাকে না। গল্পের প্রতিটি বাক্যই অনিবার্য। প্রতিটি গল্পই পাঠ্য। প্রতিটি গল্পই মনস্তাত্বিকভাবে পাঠককে নাড়া দিতে সক্ষম।
ইচ্ছামৃত্যুর ইশতেহার
লেখক: চন্দন আনোয়ার
প্রকাশক: কথা প্রকাশ
মূল্য: ২০০টাকা