মননশীল চিন্তা-চেতনার প্রকাশ শিল্পের নানা অঙ্গনে ঘটতে পারে। তা যখন একজন সৃষ্টিশীল মানুষের স্বকীয় মর্যাদায় প্রতিভাত হয়, তখন সেই সৃষ্টিকে শিল্পের সুষমায় মূল্যায়ন করা হয়। সেইসঙ্গে শিল্পীকেও দেখা হয় সাধারণের বাইরে অন্য দৃষ্টিকোণ থেকে, বুঝতে চেষ্টা করা হয় তার মনস্তাত্ত্বিক ব্যাপারগুলোও।
লেখালেখির বিষয়টাও ঠিক সেই রকম। ‘লেখক’ শব্দটি মূলত সৃষ্টিশীল-মননশীল ব্যক্তির প্রতিশব্দ হিসেবে ব্যবহৃত হয়। লেখা পড়ে ভালো লাগলেই লেখককে আবিষ্কারের নেশা জাগে। বিশেষ করে লেখকের মনস্তাত্ত্বিক বিষয়গুলো বোঝার জন্য। কিংবা কোনো চিন্তা-চেতনার আলোকে তার লেখার প্রতিপাদ্য, এমনকী তার জীবনচারণের মধ্য দিয়ে কিভাবে সময়, মানুষ, প্রকৃতিকে দেখছেন এবং অভিজ্ঞতালব্ধ হচ্ছেন; এসব দিকও লেখকের সৃষ্টির উন্মেষের পথ। তাই জানতেও খুব ইচ্ছে করে। লেখার অন্তর্নিহিত ভাব বোঝার জন্য অনেকসময় লেখকের বিষয়-আশয় আদ্যোপান্ত বোঝার চেষ্টা করি।
ভাগ্যক্রমে লেখক সম্পর্কে জানার এমনই একটি বই আমার হাতে চলে আসে। বাংলা ভাষাভাষী বিশিষ্ট কিছু নারী লেখকের জীবন সম্পর্কিত সাক্ষাৎকারমূলক বই এটি। বইটির নাম ‘আলাপের অ্যাম্ফিথিয়েটারে’। যা সীমান্তহীন বাংলাভাষার নারীস্বর বলে উল্লেখ করেছেন লেখক ইশরাত তানিয়া।
তাই সমসাময়িক বাংলা ভাষার নারী লেখকদের জানার আগ্রহে বিশেষ করে খ্যাতিমান নারী লেখকদের সাক্ষাৎকারমূলক বিশেষ বইটি পেয়ে ধন্য হই। দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে একথা বলতেই হয় যে, নারী জাগরণের অগ্রপথিক হয়ে নারী লেখকেরা অনেক অনেক অবদান রেখে গেছেন।
কারণ, বাংলাদেশ ছাড়াও ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, আসাম ও ত্রিপুরা রাজ্যের কথাসাহিত্যিকদের সাক্ষাৎকারও এই বইয়ে মলাটবন্দি হয়েছে। ২০২০ সালের একুশের বইমেলায় চৈতন্য প্রকাশন থেকে প্রকাশিত বইটি লেখক নিজেই আমার হাতে তোলে দেন উপহার হিসেবে। এসময় বলেন, ‘বইটি পড়লে আপনার ভালো লাগবে।’ অন্তর্জালে আমাদের পরিচয়। সে কারণেই ইশরাত হয়তো আমার মনস্তাত্ত্বিক জায়গাটা বুঝেছিলেন। তাই বইয়ের পাতায় শুভেচ্ছাবাণীতে লিখেছেন, ‘প্রিয় রোজী আপা, যেতে হবে বহুদূর একসাথে’। পাশাপাশি থেকে পায়ে পা মিলিয়ে এগিয়ে যাওয়ার দৃপ্ত অঙ্গীকার। শব্দ ক’টির শুভাশিস ভীষণভাবে আপ্লুত করে। আমি একজন নারী। নারীসত্তা আমার ভেতর সদা জাগ্রত। নারীর বিষয় আমাকে সবসময় নাড়া দেয়। তাই সমসাময়িক বাংলা ভাষার নারী লেখকদের জানার আগ্রহে বিশেষ করে খ্যাতিমান নারী লেখকদের সাক্ষাৎকারমূলক বিশেষ বইটি পেয়ে ধন্য হই। দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে একথা বলতেই হয় যে, নারী জাগরণের অগ্রপথিক হয়ে নারী লেখকেরা অনেক অনেক অবদান রেখে গেছেন।
সেই মানসিকতা নিয়ে ‘আলাপের অ্যাম্ফিথিয়েটারে’ বইটি পড়তে শুরু করি। বইটিতে যে দশ নারী লেখকের সাক্ষাৎকার আছে, তারা হলেন, আনোয়ারা সৈয়দ হক, ঝুমুর পাণ্ডে, তৃপ্তি সান্ত্রা, নাসরিন জাহান, পাপড়ি রহমান, মঞ্জু দাস, রাশিদা সুলতানা, সঙ্গীতা বন্দোপাধ্যায়, সুতপা দাস ও স্বপ্না ভট্টাচার্য। সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেছে লেখক ইশরাত তানিয়া নিজেই। লেখালেখির জগতে এ সব নারী লেখকদের চিন্তা-চেতনার স্ফুরণের গতিবিধি এবং মনস্তাত্ত্বিক বিষয় আশয় বোঝার জন্য বইটি বহুলাংশেই গুরুত্ব রাখে। লেখক সেই লক্ষ্যে প্রসিদ্ধ দশ কথাসাহিত্যিককে তুলে এনেছেন, যারা প্রত্যেকেই স্বস্ব জায়গায়, স্বমহিমায় উদ্ভাসিত। এছাড়া ‘আলাপের অ্যাম্ফিথিয়েটারে’ বইটির বিশেষত্বই হলো, নারী লেখকের লেখকসত্তার পাশাপাশি ‘নারী’ বিষয়ক বিষয়গুলো কিভাবে তারা দেখছেন বা প্রকাশ করছেন তারই বহিঃপ্রকাশ।
সাক্ষাৎকারের প্রশ্নোত্তর পর্বের প্রথমেই রয়েছে, ‘আপন আলোয়, আপন আলয়ে’, এই পর্বে লেখক তার লেখালেখি নিয়ে বলেছেন। দ্বিতীয় পর্বে, ‘সাহিত্যের আলো আঁধারে’, এই পর্বে লেখকের সাহিত্য রচনায় সাহিত্যমান, শিল্পমান এবং বিশ্বসাহিত্য বিষয়ক আলোচনা রয়েছে। তৃতীয় পর্বে, ‘ব্যক্তিগত এক্কাদোক্কা’, যা লেখকের একান্তই ব্যক্তিগত কথার আলাপন। সবশেষ পর্বে, ‘রাজনীতির পথরেখা, বিশ্বায়নের গতি-অগতি এই’ শিরোনামে লেখক তার চিন্তা-চেতনার সঙ্গে বিশ্ব রাজনীতির প্রেক্ষাপট কিভাবে মিশেল ঘটান এবং তার প্রভাব লেখার মধ্যে পড়ে কিনা! চারটি পর্বে সাজানো সাক্ষাৎকারে লেখকদের লেখালেখির বিষয়ে বিশ্লেষণাত্মক মনস্তাত্ত্বিক দিক ফুটে উঠেছে। সেইসাথে নিজেদের লেখালেখির ধরণ, গল্প-উপন্যাস লেখার ইতিহাস বা প্রেক্ষাপট, কি কৌশল অবলম্বন করেছেন, তাদের শৈশব কৈশোরকাল, লেখায় রাজনীতির প্রভাব, নারীবাদ, প্রেম, প্রতিবন্ধকতা, বিপ্লব ও লেখক হয়ে ওঠার অভিজ্ঞতাসহ আরও বিভিন্ন বিষয়ে কথা বলেছেন।
সাক্ষাৎকারের মধ্য দিয়ে যে বিষয়টি সবচেয়ে বেশি প্রতিভাত হয়েছে, তা হলো, এই দশ নারী লেখকের সবাই অবস্থাসম্পন্ন পরিবার থেকে উঠে এসেছেন। সাহিত্য সাধনায় তারা কখনোই প্রতিকূল অবস্থার মুখোমুখি হননি। পারিবারিক পরিবেশ অনুকুলে ছিল বলেই লেখক হয়ে উঠতে পেরেছেন। নারী জীবন এত সুখের নয়, তা অনেকেই উপলব্ধি করতে পারেন না। এমন মানসিকতা নিয়ে বেড়ে ওঠা প্রত্যেকেই লেখক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন। অবস্থাদৃষ্টে সাক্ষাৎকারগুলো তে এমনটাই মনে হয়েছে।
‘আলাপের অ্যাম্ফিথিয়েটারে’ বইটিতে লেখক ইশরাত তানিয়া দশ নারী কথাসাহিত্যিকের আলাপচারিতায় এমনই এক দৃষ্টিভঙ্গির অবতারণা করেছেন। প্রতিকূল অবস্থার মধ্য দিয়েই তারা স্বমহিমায় প্রতিভাত হয়েছেন নিজ প্রজ্ঞার অনুশীলনে।
সাক্ষাৎকারে হুবুহু একটি প্রশ্ন সব লেখককেই করা হয়। সেটা হলো নারীবাদ নিয়ে। আনোয়ারা সৈয়দ হক নারীবাদ বিষয়টিকে ক্লিশে বলে উড়িয়ে দেন। তিনি স্বামী সেবা করে, সংসারধর্ম পালন করে লেখার কাজটি করার পক্ষে। অন্যরা নারীবাদ বিষয়টিকে আলাদা করে না দেখে, তাদের লেখায় বিষয়বস্তুর সঙ্গে ব্লেন্ড করেছেন। লেখায় সরাসরি নারীবাদ বিষয়টি না এনে রূপকের আশ্রয় নিয়েছেন। নারী-পুরুষের সমতার ভিত্তিতে নারীবাদ বিষয়টিকে আলাদা করে দেখতেও অনেকেই চাননি। দুজন লেখক নারীবাদ বিষয়টিকে পক্ষান্তরে গুরুত্ব দিয়েছেন। তবে বাস্তব চিত্র ফুটে উঠেছে নাসরীন জাহানের উত্তরে, ‘অনেক পুরুষ কোনো মেয়ে নিজেকে নারীবাদী বললে, তার সাথে নিজেকে জড়াতে ভয় পায়।’ আমাদের যুদ্ধটা আসলে এখানে।
পুরুষশাসিত সমাজে নারীর অবস্থান কেমন, আমরা প্রত্যেক নারী তা জানি। এই উপলব্ধির জায়গা থেকে নারী লেখকদের লেখা সমাজ সংসারে কতটুকু প্রভাব ফেলছে বা প্রতিভাত হচ্ছে, তা বিশেষভাবে বোঝার বিষয়। বইটির ভূমিকায় লেখকের স্বীকারোক্তি থেকে বুঝতে পারি, তিনি কোন মানসিকতা থেকে এমন কষ্টসাধ্য কাজটি করেছেন। সাহিত্যের জগতে নারী লেখকদের অবস্থান যে খুবই করুণ, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। তাই বিশিষ্ট দশ নারী লেখকের সাক্ষাৎকার নিয়ে তাদের সাহিত্যচর্চার বাস্তব অবস্থান ও মনস্তাত্ত্বিক অবস্থা বোঝার প্রয়াস চালানো হয়েছে।
সাক্ষাৎকারের চারটি পর্বের প্রশ্নোত্তরে প্রত্যেক লেখকই ঋদ্ধ এবং বিশ্লেষণধর্মী জবাব দিয়েছেন। সাহিত্যচর্চার বাঁকে বাঁকে অভিজ্ঞতাকে তুলে ধরেছেন। নির্মোহ স্বতন্ত্রবোধের পরিচয় দিয়েছেন। সাক্ষাৎকারের মধ্য দিয়ে আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটে ভূ-রাজনৈতিক, প্রাকৃতিক বৈচিত্র্য উঠে এসেছে ‘আলাপের অ্যাম্ফিথিয়েটারে’। স্বতঃস্ফূর্ততার দিক থেকে বিচার করলে ঝুমুর পাণ্ডে, পাপড়ি রহমান ও রাশিদা সুলতানা প্রশ্নোত্তর পর্বে বেশ প্রাণবন্ত জবাব দিয়েছেন। তাদের সাক্ষাৎকার পড়ে মনে হয়েছে আমি স্পষ্টতই তাদের ইমেজটা দেখতে পাচ্ছি। বিশেষ করে পাপড়ি রহমানকে সবচেয়ে বেশি সজীব ও স্বতঃস্ফূর্ত মনে হয়েছে। তবে দশ নারী লেখকই আমার নমস্য। সাধনা ও অধ্যাবসায় একজন মানুষকে সিদ্ধিলাভে সহায়তা করে। সেইক্ষেত্রে তারা প্রত্যেকেই তাদের নিজ অবস্থান তৈরি করে বাংলা সাহিত্যের আকাশে নক্ষত্র হয়ে বিরাজ করছেন।
সবশেষে বইয়ের ফ্লাপে লেখা রয়েছে সিমোন দ্য বোভোয়ারের একটি উক্তি, যেখানে বলা হয়েছে, ‘নিজেকে যদি সংজ্ঞায়িত করতে চাই, আমাকে শুরুতেই বলতে হয়, আমি একজন নারী। বাদবাকি কথা এই সত্যকে ঘিরেই। পুরুষের নিজেকে প্রথমেই পুরুষ বলার দায় নেই।’ তাই বলতেই হয়, নারী হয়ে বড় হওয়া যত সহজ, মানুষ হওয়া তারচেয়েও অধিক কঠিন। ‘আলাপের অ্যাম্ফিথিয়েটারে’ বইটিতে লেখক ইশরাত তানিয়া দশ নারী কথাসাহিত্যিকের আলাপচারিতায় এমনই এক দৃষ্টিভঙ্গির অবতারণা করেছেন। প্রতিকূল অবস্থার মধ্য দিয়েই তারা স্বমহিমায় প্রতিভাত হয়েছেন নিজ প্রজ্ঞার অনুশীলনে। একজন সার্থক গল্পকার হিসেবে লেখক ইশরাত তানিয়াকে জেনে এসেছি। তার কষ্টসাধ্য কাজটিতে বেশ অভিভূত হয়েছি। এমন প্রয়াসকে সাধুবাদ জানাতেই হয়। প্রশ্নের মুন্সিয়ানায় লেখকদের গভীর মূলের তথ্যগুলো উঠে এসেছে। শুরুতেই বলেছিলাম লেখককে বোঝার অভিপ্রায়ে এই বইটি পড়ার আগ্রহ জাগে। বিশিষ্ট দশ নারী লেখকের লেখকজীবনের আদ্যোপান্ত জানতে পেরে কৃতার্থ হলাম।