কিছু ছবি দেখার পরপরই খুব শান্ত-বিষণ্ন হতে হতে আবার ভালো বোধ হতে থাকে, প্রচণ্ড দায় বোধ হতে থাকে। মনে হয়, সে ছবি সম্পর্কে জানানো উচিত। সবাইকে। ছবিগুলো নিয়ে কথা হওয়া দরকার। আর্টিকেল-১৫ এমন একটি ছবি।
অবশেষে আর্টিকেল ১৫ দেখলাম। এমন well written, well directed ছবি বলিউডে খুব কম হয়। সত্য ঘটনার ওপর ছবিটি নির্মিত হওয়ায় গল্পকারের ও পরিচালকের সততার নান্দনিক প্রতিফলন দেখলাম। একটি তথাকথিত গান বাদ দিলে ছবিটাকে হলিউডের বাস্তবধর্মী থ্রিলার বলে চালিয়ে দেওয়া যায়।
এই ছবি অনেকটাই ব্যতিক্রমী অন্যান্য অনেক ভালো ছবির চেয়েও।
এক.
আবহ সঙ্গীত এই ছবির শক্তিশালী চরিত্র। আমার কাছে স্রেফ অসাধারণ মনে হয়েছে। কানকে বিরক্ত না করে বরং আগ্রহী করে তোলে পরের দৃশ্য দেখার জন্য, এমনটা বলিউডের ছবিতে প্রায় ঘটেনা বললেই চলে। দৃশ্যের ডিটেইলিং ধীর লয়ে হলেও এক মুহূর্তের জন্যেও মনোযোগ হারাতে দেয় না। শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত কাহিনীর উন্মোচনের জন্য অপেক্ষা করতে ভালো লেগেছে।
দুই.
আয়ুষ্মানের চরিত্র আয়ান এর ঠাণ্ডা মেজাজ লক্ষণীয়। পুলিশী অ্যাকশন ধারার ছবিগুলোর নায়ক অজয়, সালমান খান, রনবীর সিংয়ে চরিত্রগুলোর ঠিক উল্টো তার প্রকৃতি। বাস্তবধর্মী, ভালনারেবল, কিন্তু স্থির বুদ্ধি, পরিস্থিতি সম্পর্কে সুসচেতন, কী ঘটবে, তার জন্য প্রতিপক্ষ কিছু করার আগেই সে ব্যবস্থা নিতে আগ্রহী এবং নিতেও সক্ষম। তার চরিত্রের একটি বিষয় শুধু অবাস্তব, সে কখনও ভীত নয় এবং সদা সৎ। যাইহোক, সত্য অনেক সময় গল্পকেও হার মানায়, এজন্যই সত্য ঘটনা নিয়ে সিনেমা হয়।
তিন.
পুলিশ ক্রাইম থ্রিলার হওয়া সত্ত্বেও নেই কোনো পুলিশি দেখনদারি ও মারামারি। বাস্তবতার সঙ্গে মিল থাকায় বরং প্রত্যন্ত এলাকায় পুলিশের সীমাবদ্ধতা ও ভালনারেবিলিটি দেখেছে দর্শক। দেখা যায় নিম্ন বর্ণের দুই ভিকটিমকে গ্যাং রেপ করে পুলিশের তিন সদস্য ও এক সন্ত্রাসী মিলে। রেপ করার সময় তারা মদ্যপ অবস্থায় ছিল। তিন পুলিশের একজন রেপ করেনি, কিন্তু রেপের সাক্ষী, বাকি দুইজনের একজন নিজের ভুল বুঝতে পেরে তীব্র অনুশোচনায় ইনফরমাল স্বীকারোক্তির পরপরই গাড়ির নিচে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করে। বাকি জন উচ্চ বর্ণের এবং তার কোনো অনুশোচনা নেই, নিজেকে বাঁচাতে সে অপুলিশ সন্ত্রাসীটাকে খুন করে। কিন্তু তাতেও শেষ রক্ষা হয় না। তাকে আ্যরেস্ট করে আয়ান।
চার.
এই গল্প পুরোটাই হিন্দু সমাজ ব্যবস্থায় গড়ে ওঠা দুই হাজার বছরের পুরনো বর্ণপ্রথাকেন্দ্রিক ভয়াবহ একটি ঘটনা নিয়ে, তবে একটি ঘটনা হলেও এরকম যে প্রতিদিন ভারত বর্ষের হাজারো গ্রামে ঘটে, তার ইঙ্গিত ছবির শুরুতেই আছে। শুধু এই বিষয়টিকে ফোকাস করে ছবি বলিউডে এর আগে তেমন তৈরি হয়নি। মাসান, ধোবী ঘাট হয়েছে, এরকম আরও হাতেগোনা খুঁজলে পাওয়া যাবে। ফলে এই ছবির গুরুত্ব অনেক। ছবিটিকে নিয়ে ভারতে ব্যাপক বিতর্ক তৈরি হয়েছে। বিতার্কিকদের মূল ইস্যু হলো—এতে হিন্দু ধর্মকে নিচু করা হয়েছে, ব্রাহ্মণদের ছোট করা হয়েছে, হাজার বছরের ধর্মীয় প্রথাকে অসম্মান করা হয়েছে।
কিন্তু ফ্যাক্ট হলো—মাত্র ২০০০ বছর আগে হিন্দু ধর্মে বর্ণপ্রথা শুরু হয় এবং তা প্রথা মাত্র, যে সামাজিক পরিস্থিতিতে এই প্রথা তৈরি হয়েছিল, তা এখন আর নেই। অথচ প্রথা থেকে গেছে এবং তা থেকে উদ্ভূত হাজারও উপপ্রথা তৈরি হয়েছে। যার পদতলে কোটি কোটি মানুষকে নিষ্পেষিত হতে হচ্ছে অকারণে হাজার বছর ধরে। সেই প্রথার অপব্যবহারের ফলে সহিংসতা হয়েছে, আজও হচ্ছে।
এই ছবির শক্তি এখানেই। একটি দৃশ্যে কমিশনার আয়ানকে বলতে দেখা গেছে, সহিংসতা কয়েক ধরণের হয়। আমরা শুধু চোখের সামনে ঘটা রক্তারক্তিকেই সহিংসতা বলি দেখি, কিন্তু তার আগের নীরব নিষ্পেষণকে সহিংসতা বলি না, অথচ মূলত সহিংসতা সেটাই। সহিংসতা হলো নিচু বর্ণের বলে তার হাতে খাবার না খাওয়া, না ছোঁয়া, যথাযথ সম্মান না দেওয়া, সম অধিকার না দেওয়া। এসব নীরব সহিংসতা না হলে চাক্ষুষ সহিংসতা ঘটতো না।
পাঁচ.
ভারতের জনসংখ্যার ৭০ শতাংশই নিম্নবর্ণের মানুষ। অথচ কী পরিহাস, তাদেরই সামাজিকভাবে, এমনকি সাংবিধানিকভাবে বলা হয় সংখ্যালঘু ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠী। এই ভয়াবহ তথ্য এর আগে কোনো গল্পে দেখিনি ইন্ডিয়ান সিনেমায়, আশ্চর্য! এই ৭০ শতাংশকে নিষ্পেষণ ও বঞ্চিত রাখা হয় রাষ্ট্রীয়ভাবে। কেননা উচ্চবর্ণের লোকেদের ধারণা, তারা সুযোগ সুবিধা পেলে শ্রমনির্ভর কাজ করার কেউ থাকবে না, উচ্চবর্ণের লোকেদের খাতির করার কেউ থাকবে না, সন্ত্রাসী আংশু চরিত্রের মুখে এসব কথাকে বাস্তব নির্ভর ডায়ালগের চেহারায় বসিয়ে দেওয়া হয়েছে। দেখে নিয়েন। তবে ভারতীয় উপমহাদেশ অর্থাৎ বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান, আফগানিস্তানের মতো দেশগুলোতে কোটি কোটি মানুষের ধর্মান্তর কেন ও কিভাবে হয়েছে এর কারণও লুকিয়ে আছে এই ডায়ালগগুলোর মধ্যে। বর্ণ প্রথার এই করাল চক্র থেকে বেরোতে কে না চায়! বর্ণ প্রথায় শ্রমের মর্যাদা বলে কিছু নেই।
ছয়.
সাধারণ শ্রমজীবী বর্নপ্রথার ভিকটিমদের জীবনকে প্রথাগত রাজনীতি পরিবর্তন করতে পারে না। তবু তারা রাজনীতিবিদদের হাতে ব্যবহৃত হতেই থাকে, এই আশায় যে, একদিন হয়তো শুভ পরিবর্তন আসবে, কিন্তু তা আর আসে না। বরং রাজনীতিবিদদের জন্যই ভিকটিমদের বিচার হয় না বা বিলম্ব ঘটে। সিভিআই অফিসার, ধর্ষক পুলিশ ব্রহ্মদৈত্য— এসব রাজনীতিবিদদের হাতের কলকাঠি।
সাত.
তবু তৈরি হয় বিদ্রোহের স্ফুলিঙ্গ। নিশাদের মতো মেধাবী যুবকরা আন্ডারগ্রাউন্ড রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়ে সমাজ বদলানোর স্বপ্ন নিয়ে, কিন্তু পেরে ওঠে না। কুলাঙ্গার রাজনীতিবিদ, কলুষিত সিস্টেমের ক্রসফায়ারে মারা পড়ে তাদের মতো অনেক স্বপ্নপাগল মানুষ। নিশাদ চরিত্রে আইয়ুবের অভিনয় কয়েক মিনিটের, কিন্তু তা ভোলা অসম্ভব। আন্ডার গ্রাউন্ড রাজনীতি সমাধান নয়, এই রকম চরিত্র দিয়ে এই মেসেজ দেওয়া ভারতীয় গল্পে এখন নিয়মিত হয়ে গেছে। কিন্তু আসলে সমাধান কী? সমাধানের পথ কি শুধু আয়ানদেরই দেবার অধিকার আছে? সিস্টেমের উজ্জ্বল প্রতিষ্ঠান থেকে বের হওয়া আইসিএস অফিসার, অনমনীয় কিন্তু ধীরস্থির পুলিশ কমিশনার আয়ান। এই সিনেমা হয়তো এটাই বলতে চায়।
আট.
এই ছবিতে বলা হয়েছে, ভারতের সংবিধান লিখেছিলেন ড. আম্বেদকর। ১৫ নম্বর ধারায় তিনি বর্ণপ্রথা, জাতি, ধর্ম, লিঙ্গ, স্থান ও কাল নির্বিশেষে সমান অধিকারের কথা বলেছেন। ফলে বর্ণপ্রথার আসলে কোনো আইনগত ভিত্তি ভারতবর্ষে নেই। এটা মানতে কেউ মূলত বাধ্য নয়। কিন্তু তবু শিক্ষা ও অর্থনীতিতে দুর্বল জনগোষ্ঠীকে মানতে বাধ্য করছে আজও উচ্চবর্ণরা।
নিম্নবর্ণের মানুষরা, বিশেষত মেথরের কাজ যারা করে, তাদের প্রতি রাষ্ট্রীয় নির্যাতন অবর্ণনীয়। এখন সর্বত্র কমোড, পাকা ল্যাট্রিন, উন্নত প্রযুক্তি। অথচ সুইপারের কাজ যারা করে, ম্যানহোলের ময়লা, ড্রেন যারা পরিষ্কার করে তাদের কোনো ধরনের উন্নত প্রযুক্তি সরবরাহ করা হয় না। তারা এখনো কোনো নিরাপদ বর্ম বা মুখোশ ছাড়া এক্কেবারে খালি হাত পায়ে নেমে কাজ করে মৃত্যুর ঝুঁকি নিয়ে। বছরে যে পরিমাণ মানুষ অন্যান্য দুর্ঘটনায় মারা যায়, তার চেয়ে অনেক বেশি মানুষ মরছে ভারতে শুধু ম্যানহোল আর ড্রেন পরিষ্কার করতে গিয়ে। নিম্নবর্ণের প্রতি এই ইচ্ছাকৃত অবহেলা কোনো ভুল নয় বা ছোট অপরাধ নয়, রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস। এভাবেই যুগে যুগে রাষ্ট্রীয়ভাবে দুর্বলের ওপর সবলের অত্যাচার জারি রাখা হয়েছে। বাংলাদেশেও এই চিত্র রয়েছে। তবে এখানে বর্ণ প্রথার করাল গ্রাস না থাকলেও, ড্রেন ও ম্যানহোল পরিষ্কার করতে গিয়ে মারা যাওয়া মানুষের সংখ্যা কম নয়। এসব নিয়ে সাংবাদিকরা দেশে-বিদেশে প্রচুর লেখালেখি করলেও এখনো কোনো ফল মিলছে না।
নয়.
এই ছবিটিকে গান বাদ দিয়ে অস্কারে পাঠানোর হিম্মত ইন্ডিয়ার নেই এখন, তাই পাঠায়নি। গেছে ‘গাল্লিবয়’। ধারণা করা যায়, এই ছবিটি কোনো সরকারি পুরস্কারও পাবে না, অন্তত এই মোদি আমলে। ছবি হিট হওয়া, পুরস্কার পাওয়া সবসময় সব ছবির জন্য গুরুত্বপূর্ণ নয়, বিশেষত এ ধরনের ছবির জন্য। এ রকম ছবিগুলো এমনিতেই দর্শক ভালোবেসে সব সসময় দেখে, সব যুগে দেখবে। এই উপমহাদেশীয় চলচিত্রের যে বাঁকবদল হচ্ছে তার সেরা আউটকাম আয়ুষ্মান খুরানা। এ রকম দুয়েকটা দুর্দান্ত গল্প আর পরিচালক বাছাইও একজন অভিনেতার প্রতিভা। তাই আয়ুষ্মানে অনেক ভরসা এখন, কারণ সে এই প্রতিভা দিয়ে দর্শকের টাকা আর সময় দুইয়েরই সার্থক প্রতিদান দেয়।