কবিতা লেখার চেয়ে কবিতা উপলব্ধি করা মনে হয় বেশি কঠিন। কবির মনোভাব রসের পাখায় ভর করে সাহিত্যাকাশে উড়ে বেড়ায়। সেই রস পাঠককে আস্বাদন করতে হয়। পাঠকের বোধগম্য কবিতা কি সব কবি লিখতে পারছেন? কালোত্তীর্ণ কবিতা বা বহমান কাব্যসুর কি সবার কবিতায় ধরা পড়ে? কেননা কাব্যসৃষ্টির জন্যও প্রয়োজন বিশেষ এক প্রতিভার। কবিরা সেই বিশেষ প্রতিভা নিয়েই জন্মান। সেজন্যই কবিতা গেঁথে যায় পাঠকের মনে।
কবি জীবনানন্দ দাশ তাঁর ‘কবিতার কথা’য় বলেছেন, ‘প্রত্যেক মনীষীরই একটি বিশেষ প্রতিভা থাকে—নিজের রাজ্যেই সে সিদ্ধ। কবির সিদ্ধিও তাঁর নিজের জগতে; কাব্যসৃষ্টির ভিতরে।’ সে কথার সূত্র ধরেই বলি, কবি আবু হাসান শাহরিয়ারের একটি বিশেষ প্রতিভা রয়েছে। সেই প্রতিভার গুণেই তিনি সিদ্ধ। তৈরি করেছেন নিজস্ব কাব্যজগৎ। প্রতিভা তাকে কবি বানিয়েছে। প্রকৃতি তাকে পূর্ণতা দান করেছে। কবিতার প্রতি একাগ্র-বাসনা তাকে বানিয়েছে কবি-ঋষি। কবিতার সাধনায় তার সিদ্ধি লাভ খণ্ডকালীন নয়; বরং দূরস্থায়ী। পাঠকের অন্তরে সর্ববিরাজমানতা তাকে সম্মানিত করেছে।
জীবনানন্দের আলোচনায় ‘সৎ কবিতা’ এবং ‘খাঁটি কবি’ শব্দ দুটি পাওয়া যায়। কবিতারও সততা থাকতে হয়; কবিকেও হতে হয় খাঁটি। কবিতার সৎ-অসৎ বা খাঁটি-ভেজাল বলতে তিনি কবিতার চিরন্তন গ্রহণযোগ্যতাকেই হয়তো বুঝিয়েছেন। তাই এ সময়ে এসেও শব্দ দুটি চিরন্তন বাস্তবতার আলোকে প্রোজ্জ্বল হয়ে দেখা দিয়েছে। সেই অর্থে- আবু হাসান শাহরিয়ার একজন খাঁটি কবি। তার কবিতা নিঃসন্দেহে সৎ।
আধুনিক কবিতার লক্ষণীয় বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী, আবু হাসান শাহরিয়ারের কবিতা ‘অতি অভ্যস্ত বিহ্বলতাকে এড়িয়ে একটা সজ্ঞান পৌরুষে মণ্ডিত হয়ে উঠতে চায়’। (আধুনিক কবি ও কবিতা : হাসান হাফিজুর রহমান)। স্বল্প কথা, স্বল্প ভূমিকায় তাঁকে আলোকপাত করা যায় না। তার পরেও বলতে হয়, তাঁর কবিতা নিয়ে আলোচনা করতে গেলে ভূমিকারও প্রয়োজন হয় না। কবিতায়-ই চিনে নেওয়া যায় কবিকে।
‘অসময়ে নদী ডাকে’ কী চমৎকার বহমান একটি নাম! নদী ডাকে—সময়ে কিংবা অসময়ে। অসময়ে নদী ডাকলে বান আসে। ভেসে যায় চরাচর। কবি নদীর ডাক শুনতে পান। তাঁর নদী অসময়ে ডাকে। মানব শরীরে বহমান একটি নদী সময়-অসময়ে ডেকে যায়। প্রবহমান নদী কখনো কখনো নাব্যতা হারায়। নদীর বুকে জেগে ওঠে চর। অসময়ে ডাকা সেই নদীর নাম-বেত্রাবতী।
আবু হাসান শাহরিয়ারের ‘অসময়ে নদী ডাকে’ কাব্যগ্রন্থে মোট ৫৬টি কবিতা স্থান পেয়েছে। এ গ্রন্থে অনেকবারই নদীপ্রসঙ্গ এসেছে। কেননা নৌকায় নদীতীরবর্তী জনপদে ঘুরে বেড়ানো কবির নেশা। কবি বলেন, ‘গাছ আর নদী ছাড়া আমি কোনও মুনিকে চিনি না।’
এই নদী তাঁর শৈশবের, যৌবনের, তারুণ্যেরও। নদীর মতোই সরলভাবে বহমান তাঁর জীবন। নদীর মতো স্বচ্ছ তাঁর পথচলা। কবির নদীরা অনেক কথা বলে। তিনি নদীর রচনাবলি পড়েন। আসমুদ্র ঢেউভাষা শেখেন। কবি বলেন,
‘শব্দ না ধারালো হলে কবিতাও বোবা
ঢেউ নেই, ভাষাও অচল।’
(ঢেউভাষা)
এ কাব্যগ্রন্থে নদী নিয়ে তাঁর বহু আক্ষেপ ফুটে ওঠে। ‘যেখানে নদী ছিল, সেখানেও নগরসন্ত্রাস’ বলে তিনি প্রতিবাদী হয়ে ওঠেন। আমাদের নদীগুলো হারিয়ে যাচ্ছে। নদীর এমন বিলীন দৃশ্য কবিকে আহত করে। কবি প্রশ্ন তোলেন,‘হাতে কি বোতলজাত মিনারেল নদী?’ (বিবর্তন)।
তাঁর কবিতায় পরিবেশ সচেতনতা লক্ষ করা যায়। তিনি চা এবং কফির তুলনামূলক পার্থক্য খোঁজেন। চায়ের দোকানে ধোঁয়া ধোঁয়া স্মৃতি খুঁজে ফেরেন। খোঁজেন হারানো মুখগুলো।
তিনি কবিতায় একফোঁটা ভোরের শিশির উপহার দেন। বলেন,‘তা যদি জানতামই আমি খাবি খাই এতদূর এসে?’ (জাদুবাস্তবতা)। তিনি পাঠকের জন্য গোলাপ উপহার আনেন। গোলাপ পাঠকের জন্য থাকুক; কাঁটা কেবল কবির জন্য। কবি বলতে চান—
কাঁটায় না বিদ্ধ হলে কবিকে উদ্বাস্তু হতে হয়
ছত্রিশব্যঞ্জনও চায় কাঁটাবিদ্ধ শব্দের প্রণয়
(গোলাপ ও পাঠক)
জনজীবনের আমূল পরিবর্তন কবির দৃষ্টি এড়িয়ে যায়নি। নাগরিক যন্ত্রণা তাঁকে স্মৃতিকাতর করে তুলেছে। তিনি আক্ষেপ করেন। লেকের ব্যথিত জল দেখেন। দেখেন সুশীল মেঘ। শহরের অ্যালবামে অনেক দিঘির ছবি ছিল একসময়। আজ নেই। শহরের ভবনের ছাদে কিংবা খোলা মাঠে লাটাই ছিল—সেসব আজ কোথায়? কবি শোনেন—‘অসময়ে সেলফোন; রিংটোনে নকল কোকিল।’ সব নকলের মাঝে আমরা যেন আসলকেই হারিয়ে ফেলেছি। ভুলে যেতে বসেছি যা সত্য, যা কিছু চিরন্তন।
গ্রন্থের ‘মহাকাব্য’ তাঁর ক্ষুদ্র একটি কবিতা। এই একটি ক্ষুদ্র কবিতায় কত যে ব্যঞ্জনা ধরা পড়ে, তা হয়তো বিদগ্ধ পাঠকই জানে। কবিতাটি মহাকাব্য না হয়েও তা মহাকাব্যের রূপ পরিগ্রহ করে। অন্যত্র রাতকে তিনি অন্ধের শাদাছড়ি মনে করেছেন। তাঁর কবিতায় অসাম্প্রদায়িক চেতনাও লক্ষ করা যায়। তিনি সব ধর্মের সব ধ্বনিকেই বিনয়ের সঙ্গে শ্রদ্ধা করেন। মুসলমানদের আজানের জাদু, হিন্দুদের উলুধ্বনি, গির্জার ঘণ্টাধ্বনি কবির পরানে ঢেউ তোলে। তিনি নির্বাণ পাঠে মুগ্ধ হয়ে যান। তাই আহ্বান করেন—
‘চাপাতি নামাও, রাখো এ সংজ্ঞাবেদিতনিরোধ।
সুরের পূজারী আমি, কার সাথে কীসের বিরোধ?’
(চাপাতি নামাও)
সুরের পূজারি কবির কাছে মানুষের ভুলগুলো মধুর লাগে। যে মধুরতা ছড়িয়ে পড়ে তাঁর কবিতায়। কবির জীবনেও হয়তো তাই? ভালোবাসায় মোড়ানো তাঁর হৃদয় ভুলের হাতুড়ি দিয়ে ভেঙে দেওয়া যায় না। তাই কবি ভুলগুলো ভুলে যেতে চান—‘স্লেটে লেখা নামের মতন’।
তাঁর কবিতায় আসে ভাষা, বিউটি বোর্ডিং, সময়, সুসং দুর্গাপুরের স্মৃতি। রবীন্দ্রনাথের জন্য কেবল দু’টি পঙ্ক্তি। কবির জন্মদিনে স্বগতোক্তি তুলে ধরেন কবিতায়। আসে বিরহ, হলি আর্টিজানের দুঃসহ দৃশ্য। পরিবেশ সচেতন কবি সুন্দরবনকে বাঁচাবার আহ্বান জানান। তাই তো সমস্ত পৃথিবীর রঙ উঠে আসে তার কবিতার তুলিতে।
স্মৃতিকাতর কবি প্রিয় পুষ্কর দাশগুপ্তকে উৎসর্গ করেন তাঁর ‘অনূদিত ভোর’ কবিতাটি। আষাঢ় কিংবা শীতের আখ্যান দেখি তাঁর কবিতায়। পরলোকগত হয়েও কবিতার শিরোনাম হন ‘শামসুর রাহমান’, ‘আনা ফ্রাঙ্ক’, ‘শহীদ কাদরী’। তিনি ‘বেত্রাবতী নদী’র ডাক শুনতে পান। সেই প্রিয় নদীর ডাকের কথা বলেন। তাই পাঠকের প্রতি আহ্বান জানান জলে নামার। কবি বলেন,
নদী যদি ডাকে, আজও পাঁজরে ঝংকার শুনি তার
আমার সাঁতারু-মন নদীর শৃঙ্গাররসে ভাসে
আছাড়িপাছাড়ি ঢেউ পারের জমিনে বাঁধে ঘর
এ জীবন ভুলে ভরা; ভ্রমে তো যেতেই পারে মতি
(অসময়ে নদী ডাকে)
উপমার আড়ালে জীবনের চরম সত্য এবং বাস্তবতা উচ্চারিত হয় এই কবিতায়। হতাশা-ব্যর্থতার নাগপাশ কাটিয়েও অমরত্ব লাভের প্রত্যাশা কার না জাগে? কবি মূলত অনেক কথা বলে যান অল্প কথায়। নিজের ক্ষুদ্রতাকে প্রমাণ করতে চান, অথচ এটাই যে তাঁর মহত্বের উৎকৃষ্ট প্রমাণ। কেননা কবি তো সব মানুষের পুঞ্জীভূত ছায়া। কবির আত্মোপলব্ধি ধরা পড়ে তাঁর ‘আত্মা’ নামক এক ছত্রের কবিতায়। ‘তোমার ঘরে বাস করে কারা ও মন জানো না’—বাউল গানের সুরেই কবি বলে ওঠেন: ‘আমি নই; অন্য কেউ বেঁচেছিল আমার শরীরে।’
‘অসময়ে নদী ডাকে’ বইটি পড়তে পড়তে চোখ আটকে যায় এই কবিতায়। মাত্র একটি কথায় কী চমৎকারভাবে এই আত্মোপলব্ধি বা আত্মানুসন্ধানের শৈল্পিক প্রকাশ। তাঁর কবিতার ব্যঞ্জনা মহাকাব্যের চেয়ে কোনো অংশে কম নয়। পুরো গ্রন্থজুড়েই তিনি নিজেকে সন্ধান করেছেন। পৃথিবীর প্রতিটি পাহাড়কে নিরক্ষর মহাকাব্য বলে ঘোষণা দিয়েছেন। রাতকেই তিনি অন্ধের শাদাছড়ি জ্ঞান করেন। কবি আহ্বান জানান—
তুমি যদি নদী হও, মোহনায় দেখা হবে তারাজ্বলা রাতে
এই ছবি জলরঙে আঁকা
(শাদাছড়ি)
তিনি নবীন কবিদের উৎসাহ-অনুপ্রেরণা জোগান। বিউটি বোর্ডিংয়ে আসার আহ্বান জানান নবীন-প্রবীণদের। নিজের অপারগতা স্বীকার করেন অকুণ্ঠচিত্তে—
কবিতা-পদ্য অনেক লিখেছি; এখন পারি না
যারা পারে আমি তাদের মুগ্ধপাঠক
(বিউটি বোর্ডিং)
পাশাপাশি নবীনদের লেখা ও পাঠের প্রতি গুরুত্বারোপ করেছেন তিনি। কবি তাদের উদ্দেশে বলেন—‘হে নবীন, এসো, কবিতার খাতা খোলো।’ (বিউটি বোর্ডিং)।
কবি বরাবরই মূর্খতাকে ধিক্কার জানিয়ে প্রাজ্ঞজনকে খুব যত্ন করেছেন। আকাট মূর্খজনের প্রতি তার চিরকালীন ক্ষোভ। অজ্ঞতা কোনো অপরাধ না হলেও মূর্খতা বড় মাপের অপরাধ বলেই মনে হয়। কবি তাই বলেন—‘মূর্খ যাকে তুচ্ছ জানে, প্রাজ্ঞ তাকে যত্নে তুলে রাখে’। (জলরঙ)
আসলে ‘অনেক কথা যাও যে বলে কোনো কথা না বলে’ কথাটিই সত্য হয় এখানে। সত্যিই অনেক কথা ফুলঝুরি ছড়িয়ে আছে তার কাব্যের উঠোনে। কিন্তু কথা বলেন খুব কম। এই গ্রন্থের বেশির ভাগ কবিতাই ক্ষুদ্রায়তনের। তবু তার আবেদন শেষ হয় না। রয়ে রয়ে বাজে। কেননা মাত্র দুটি বাক্যে অনেক কথা বলে যান কবি অনায়াসে। তাঁর ‘আমি কেউ নই’ বলার মধ্য দিয়ে নিজের ক্ষুদ্রতাকে বোঝাতে চেয়েছেন। অথচ এ কথাতেই তার বিশাল হৃদয়ের প্রমাণ মেলে।
তাঁর বিশালত্ব কবিতায়। বিশালত্ব চিন্তায়-চেতনায়। তাঁর বিশালতা মেধা ও মননশীলতায়। তাঁর এই বিশালত্বের মাঝে এমন ক্ষুদ্র আলোচনা পাঠকের তৃষ্ণা নিবারণে হয়তো যথেষ্ট নয়। তাই তার কাব্যের অমীয় সুধা পান করে তৃষ্ণা মেটানোর উদাত্ত আহ্বান জানাই। এমন একটি কাব্যগ্রন্থের জন্য অসীম কৃতজ্ঞতা কবির প্রতি। তাঁর মতো ‘কবিবৃক্ষ’র ছায়া পেলে প্রত্যেক পাঠকের জীবন ধন্য হবে। কবি আবু হাসান শাহরিয়ার একটি বৃক্ষের নাম; যার সুশীতল ছায়াতলে পাঠকের হৃদয় জুড়ায়।
অসময়ে নদী ডাকে
আবু হাসান শাহরিয়ার
প্রকাশনী: প্লাটফর্ম
মূল্য: ১৬০ টাকা
প্রচ্ছদ: মোস্তাফিজ কারিগর